• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ছোটগল্প : ত্রিকোণমিতি

  রাহাতুল রাফি

১৫ নভেম্বর ২০১৯, ১১:১৮
গল্প
ছবি : প্রতীকী

সংসার!

ময়না তার সংসারের কথা ভাবে। সাত মাসের সাজানো সংসার। শ্বশুড়-শাশুড়ি, ননদ। স্বামী। স্বামী, মানুষটা...। না না!

ময়না আর কিছু ভাবতে পারে না। ভালোই তো ছিল ময়না। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই তার বিয়ের সম্বন্ধ আসল। ভালো বংশের ছেলে। চেহারা ছবিও মাশাল্লাহ। উঁচা-লম্বা। ছেলে বিদেশ ফেরত। দুবাই ছিল সাড়ে পাঁচ বছর। রোজগার পাতি একেবারে কাঁচা পয়সা।

দক্ষিণমুখী আষ্টে-ছাব্বিশে নতুন হাফ বিল্ডিং। নতুন মটর সাইকেল। জমি-জিরাত। আর কি চাই! গুণী ছেলে। এক কথায় সুপাত্র। তার উপর ছেলের কোন দাবী দাওয়াও নাই। শুধু ছেলের খালার একটা ছোট্ট দাবী। শ্বশুরবাড়ির ওজন যেন ঠিক থাকে। এই কথা কি আর এখন বলা লাগে? মেয়ে বিয়ে দিবে, সুবীর ওজন না বুঝতে পারলে হবে?

বিয়ের কথাবার্তা দিন-তারিখ দু’দিনেই ঠিকঠাক। তৃতীয় দিনেই ময়নার বিয়ে। তেমন কিছু বুঝে উঠার আগেই ময়না বাসর ঘরে।

তারপর পাঁচ-পাঁচটা মাস। সেই সময়টা ময়নার ভাবনারও বাইরে ছিল। উথাল-পাথাল সুখের কতগুলো দিন। মধুময় পাঁচটি মাস। মানুষের জীবনে সুখের প্রকারভেদ বুঝতে শিখেছিল ময়না। ময়না কি আর এতকিছু জানতো। সেই মানুষটাই ষোল আনা শিখিয়ে পরিয়ে নিয়েছিল। কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দিয়েছিল সুখের চৌষট্টিকলা। ময়নার সুখের সংসার।

যে মানুষটা তাকে ছাড়া একটি দিন, রাত, একটি মুহূর্তও থাকতে পারেনি। অথচ ময়নাকে ছেড়ে সে এখন কত দূরে। মানুষটা বিদেশে চলে যাওয়ার পর প্রথম কয়েকটা দিন ময়নার কাটতেই চাইতো না। সবকিছু খালি খালি লাগতো। ঠিক হতে অবশ্য একটু সময় লেগেছে। মানুষটার শরীরের গন্ধ এখনো তার নাকে লাগে। মোবাইলের ওই প্রান্ত থেকে মানুষটার ঠোটের ইশারায় গায়ে এক অদ্ভুত শিহরন অনুভব করে ময়না। অথচ আজ-

আজ ময়নার কিছুই ভালো লাগছে না। বিকেলের পর থেকেই সবকিছু কেমন যেন উল্টেপাল্টে যাচ্ছে। এতগুলো দিনে একটিবারের জন্যও যে ব্যাপারটি তাকে এক চিমটিও ভাবায় নি, আজ সেই ভাবনাই পেয়ে বসেছে। অথচ ময়না ভাবতে চায় নি। সবকিছু যেমন খাপে খাপ মিলে গিয়েছিল, আজ যেন তা জোড়ায় জোড়ায় ছেড়ে দিচ্ছে।

মতি স্যারের কাছে গণিত প্রাইভেট পড়ার এক ফাঁকে সহপাঠী আলম ময়নার খাতায় চিঠি গুঁজে দিয়েছিল। ময়না তো ভয়ে শুকিয়ে কাঠ। অবশ্য ব্যাপারটা কারো নজর এড়ায় নি। রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে কুপি বাতির আলোয় ময়না সেই চিঠিটি যে কতবার পড়েছিল..।

আলম চিঠির জবাব চেয়েছিল। ময়না দেয় নি। চিঠির জবাব দেয়ার আর দরকার হয়নি। তার আগেই মন দিয়ে বসেছিল ময়না। তারপর আর ময়নার মাথায় গণিত ঢোকেনি। প্রাইভেটে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো আর আড়চোখে আলমকে দেখতো। ময়নার সকল ভালোলাগা ছিল আলমকে ঘিরে।

স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানের দিন এক ফাঁকে সুযোগ বুঝে আলম তার হাতটা চেপে ধরেছিল। প্রথমবারের মত ময়নার সমস্ত দেহ কেঁপে উঠেছিল। মনে পড়লে ময়নার এখনো হাসি পায়।

এসএসসি পরীক্ষা হয় স্কুল থেকে অনেক দূরে। থানা শহরে। এসএসসিদর শেষ পরীক্ষার দিন আলম ময়নাকে কিরণ স্টুডিওতে যেতে বলেছিল। ময়না গিয়েছিল। একা।

স্টুডিওটা শহরের একটু বাইরের দিকে। ভরদুপুর। নীরব, নি:স্তব্ধ চারদিক। ময়না ছবি তোলার ঘরটায় বসেছিল। আবছা অন্ধকার ঘর। স্টুডিওর মালিকে আলম বলে পানি আনতে, সে গিয়ে আর আসার নাম নেই।

আলম কাছে আসে। ময়না উঠে দাড়ায়। মুখোমুখি দুজন। দৃষ্টি দু’দিকে। কোন কথা নেই। পিনপতন নীবরতা। আচমকা আলম ময়নাকে টেনে ধরে। কাছে টানতে টানতে একেবারে বুকের কাছে। খানিকটা হকচকিয়ে গেলেও ময়না নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় না।

আলমের রোমশ বুকে নাক গুঁজে দেয়। তাকে আরো জোরে চেপে ধরে। ময়নাও যেন আলমের দেহে মিশে যেতে চায়। দুজনেরই নি:শ্বাস ভারী হয়। শরীরে উত্তাপ ছড়ায়। সকল লোমকূপ যেন মুহূর্তেই জেগে উঠে।

স্টুডিও মালিকের গলা খাকড়িতে দু’জন দুদিকে সটকে যায়। স্টুডিও মালিক তাদের খুব সমাদর করে। চানাচুর, বিস্কুট, কোমল পানীয় নিয়ে আসে। স্টুডিও মালিক খুব কৌতুক করে। আলমও সেই কৌতুকে রসদ দেয়। ময়না লজ্জায় আর তাকাতে পারে না। আলমের হাতের পেশী চেপে ধরে লুকোতে চায়। এরই মধ্যে ক্যামেরার ফ্লাশ। পর পর দুবার..।

তারপর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ময়নার বিয়ে হয়ে যায়। আলমের সাথে আর দেখা হয় নি, কথাও হয় নি। কিন্তু, সব স্পষ্ট মনে আছে ময়নার। এতসব কিছু এতগুলো দিন একটি বারের জন্যও মনে আসেনি। ভুলেই ছিল ময়না।

তবে, আর যাই হোক, পাশের বাড়ীর জয়নালকে দেখলে এমনটা মনেই হয় না। ছোটখাটো সাইজের শরীর। কোঁকড়া চুল। কেমন টলমলে চোখ। মায়াবী চেহারা। বাজারে ব্যবসা আছে। বিয়ের পর দিন ময়না তাকে দেখেছিল। মানুষটা জয়নালের সাথে আলাপও করিয়ে দিয়েছিল। মানুষটা দেশে থাকতে জয়নাল এ বাড়ীর উপর একবারের জন্যও আসেনি।

আজ এসেছিল। বিকেলে।

শাশুড়ির কথায় ময়না জয়নালকে পান-সুপারি সাজিয়ে দিয়েছিল। জয়নাল বাড়ীর সবার সাথেই গল্পগুজব করল। শেষমেশ ময়নার দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ল- ভাবী, আর একটু জর্দা দেইন।

ময়না জর্দার কৌটা এগিয়ে দিতে কাছে যেতেই জয়নাল পকেট থেকে একটি ছবি বের করল। ময়নাকে দেখাল। ময়না তো দেখেই চমকে উঠল। সেই স্টুডিওতে তোলা ময়না আর আলমের একটি ছবি। ময়না হাত বাড়িয়ে ছবিটা নিতে চাইল। জয়নাল দ্রুত ছবিটা পকেটে রেখে দিল। কৌটা থেকে এক চিমটি জর্দা মুখে দিয়ে পান চিবাতে চিবাতে কানে কানে বলল, ‘ভাইজান তো মনে হয় বিষয়টা জানে না। যদি জানতে পারে তাইলে কি হবে ভাবছেন একবার?’

ময়নার কলজে কেঁপে যায়। গলা শুকিয়ে যায়। একি শুনছে সে!

মুচকি হাসে বলে জয়নাল, ‘রাত বারটার পরে পুকুর ঘাটে আইসেন। বিষয়টা নিয়া খোলামেলা আলাপ করব নে।’

জয়নাল আবারো হাসে। জয়নাল চলে যাবার পরই ময়নাকে সকল ভাবনা পেয়ে বসে। খাপে খাপ মিলে যাওয়া সব কিছু যেন জোড়ায় জোড়ায় ছেড়ে দিতে থাকে।

জয়নালের কথার মানে আর হাসির ইঙ্গিত ময়না বুঝতে পারে। ময়নার চোখে ভাসে স্বামীর মুখ। মানুষটা বিদেশ বিভূঁইয়ে থেকেও ময়নার পুরোটা জগত জুড়ে আছে। ময়নার চোখে ভাসে আলম। তার জীবনের প্রথম পুরুষ। ময়নার চোখে ভাসে জয়নালের মুচকি হাসি। ময়না আর কিছু ভাবতে পারে না। ময়না আর কিছু ভাবতে চায় না।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড