• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ছোট গল্প : পীর বক্স আলীর স্বপ্নভঙ্গ

  সেখ হুমায়ুন কবির সূর্য্য

১৪ নভেম্বর ২০১৯, ১১:৩৪
গল্প
ছবি : প্রতীকী

মাথার উপর গণগণে রোদ। চাঁদি ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা। পীর বক্স আলীর কপাল-বুক দিয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। এক নাগারে হাঁটার ফলে মাথার সাথে পা দুটোও ঝিমঝিম করছে। তবু জোর কদমেই হাঁটছে সে। একটু জিরিয়ে নিলে ভাল হতো কিন্তু তাকে যেতে হবে অনেক দূরের পথ। প্রচণ্ড কষ্ট হলেও হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে চলছে সে। রাস্তায় তার মতো ছিন্নমূল অনেক মানুষ চুপচাপ যন্ত্রের মতো হেঁটে চলেছে। কারো মুখে কোন কথা নেই।

পীর বক্স আলীর মনে হল তার বুঝি শহরেই পৌঁছানো হবে না। ক্ষুধা এবং পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু রফিক চেয়ারম্যানের কথা মনে হতেই তার মধ্যে জেদ চেপে বসল। কষ্ট সহ্য করতে না পারলে বউ-ছেলে-মেয়েরা না খেয়ে থাকবে। তাকে সবার আগে শহরে পৌঁছাতে হবে। আবার নতুন উদ্যমে পা টেনে টেনে এগুতে লাগল সে।

রফিক চেয়ারম্যান তাকে কখনোই কোন সাহায্য করবে না। সেপ্টেম্বরে সর্বনাশা বন্যা দুবার ফসল নষ্ট করেছে। অক্টোবরের ঘূর্ণিঝড় আধপাকা ফসল জমিতে খেয়ে ফেলেছে। নভেম্বরের এই মাঝামাঝি সময়ে ফসল হারিয়ে কাজ না পেয়ে চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিল কার্ডের জন্য। কিন্তু চেয়ারম্যান তাকে দু’কথা শুনিয়ে দিয়েছে।

বলেছে, ‘কি পীর বক্স মিয়া, ভোটের সময় আমার বিরুদ্ধে খুবতো লম্ফ-ঝম্প করলা। বাপ-দাদা তুইলা গালিগালাজ দিলা। এখন আমার কাছে আসতে শরম লাগল না।’ পীর বক্স আলী অসহায় আত্মসমর্পণে বলেছিল, ‘বাবাজি, না খায়া আছি! একটু ব্যবস্থা করি দেওয়া লাগবে।’ চেয়ারম্যান তেরছা গলায় বিদ্রূপ করে বলেছিল, ‘আমার কাছে ক্যান, তোমার হাসেম মৃধার কাছে যাও! সেই গোলা থাইকা তোমারে চাল দিবো, গম দিবো।’ অপমানিত পীর বক্স আলী ক্ষোভ চাপা দিয়ে বলেছিল, ‘এইডা কি কও! সরকার তো হগল গরীব মানুষের জন্য কার্ড দিছে। আমারে দিবা না কেন?’

একটা ইটের টুকরোর সাথে ধাক্কা খেয়ে চেতনা ফিরে পেল পীর বক্স আলী। ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল কেটে গেছে। শরীরে রক্ত না থাকায় অল্প একটু রক্ত বেরুল। কিন্তু ব্যথা করছে খুব বেশি! এবার দাঁত চেপে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। কতদূর এসেছে জানে না। তবে মাইকের হালকা শব্দ শোনা যাচ্ছে। তারমানে কাছাকাছি এসে পড়েছে। এবার একটু গতি বাড়াল সে। শহরে নামকরা একজন মন্ত্রী আসছেন। বিরাট মিটিং হবে। ভাষণ দেওয়ার পর মন্ত্রী সবাইকে এক বস্তা করে চাল দিবে। সে আশায় ক্ষুধার্ত-ভগ্ন শরীর নিয়ে পথ মাড়িয়ে চলছে সে। তাকে যে চালের বস্তা পেতেই হবে।

বেলা একটার দিকে শহরের সেই বিশাল মাঠে এসে পৌঁছিল পীর বক্স আলী। বিশাল মাঠের তখন অর্ধেক ভরে গেছে। লোকজনকে ঠেলে-ঠুলে সামনের দিকে এগুতে লাগলো সে। প্রত্যাশা আর পরিশ্রমে কাহিল হয়ে পড়েছে শরীর। দুইটার দিকে মিটিং শুরু হল। তখনো মন্ত্রী মহোদয় আসেননি। চ্যালা-চামুণ্ডারা তখন বক্তৃতা দিচ্ছিল। মন্ত্রী মহোদয় আসলেন প্রায় দুই ঘণ্টা পর। ততক্ষণে পুরো মাঠ ছেয়ে গেছে মানুষে মানুষে। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। লোকজনের ঠেলাঠেলিতে পীর বক্স আলী হাঁসফাঁস করতে লাগল। তার মনের মধ্যে চাপা দেয়া আশার প্রদীপ ক্রমেই যেন নিভে যাচ্ছিল! এত মানুষ। অথচ বস্তা চোখে পড়ছে না। আসলে কি সবাই বস্তা পাবে। মাইকে কে কি বলছে তার কোনটাই কানে ঢুকছে না। মনে মনে আওড়াচ্ছে কখন শেষ হবে বক্তৃতা। তারপর শুরু হবে বস্তা দেয়া। এই ভীরে বস্তা নিয়ে যেতে পারবে তো! চারদিকে শুধু মানুষের মাথা। কোথায় দাঁড়ালে সুবিধা হবে, এটাই ভাবছিল সে। এমন সময় সবাই হাততালি দিয়ে উঠল।

মনে হয় মন্ত্রী মহোদয় ভাষণ দিবেন। পীর বক্স আলী এবার মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করল। তিনি বলার জন্য মাইকের কাছে গেছেন, ঠিক এমন সময়ে মঞ্চের ভিতরে ও পীর বক্স আলীর সামনে বিকট শব্দে বোমাটা ফাটল। আর্ত চিৎকারে লুটিয়ে পড়ল অনেক মানুষ। মানুষের ঢালের কল্যাণে অল্পের জন্য বেঁচে গেল সে। বুকটা তার এখনো ধড়ফড় করছে। তবে শরীরে কোন শক্তি নেই। ফলে লোকজনের ধাক্কায় দুর্বল শরীরে মাঠেই নেতিয়ে পড়ল সে। এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পেয়ে পীর বক্স আলী তাকিয়ে দেখে চারদিকে পুলিশ ছেয়ে গেছে। যারা পালাবার তারা পালিয়ে গেছে। পীর বক্স আলী পালাতে পারেনি বলে পুলিশের সন্দেহ হওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা হল। ফ্যালফ্যাল চোখে নিজের দুরবস্থা দেখছিল সে। মন্ত্রী মহোদয় বোমার আঘাতে সাথে সাথেই মারা গেছেন। তার মৃত্যুতে পুলিশ বাহিনীর টনক নড়ে গেছে। একজন পুলিশ অফিসার চিৎকার করে অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘সন্দেহজনক কেউ যেন রেহাই না পায়। হত্যাকারীদের ধরতে হলে কাছাকাছি যারা ছিল তাদের সবাইকে আটক করতে হবে।’ পীর বক্স আলী হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। এক পুলিশ বুট দিয়ে তার কোমরে জোড়ে লাথি মারল।

পরদিন থানায় রফিক চেয়ারম্যান এলেন। ডিউটি অফিসার পীর বক্স আলীকে দেখিয়ে বললেন, ‘এরে চেনেন।’ রফিক চেয়ারম্যান আমুদে হাসি দিয়ে বলল, ‘একটু আধটু চিনি। আমার ইউনিয়নের লোক। শুনেছি অচেনা অজনা লোকজনের সাথে উঠ বস করে।’ পীর বক্স আলী আর ছাড়া পেল না।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড