• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৪ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : জেডো মুই আনিস আজাকার

  সেখ হুমায়ুন কবির সূর্য্য

১১ নভেম্বর ২০১৯, ১২:৫৩
গল্প
ছবি : প্রতীকী

‘জেডো মোক চেনেন নাই, মুই আনিস। হরিকেশের আনিস।’ বক্তার মাওলানা বিরক্ত চোখে তাকালেন। জোহরের নামাজ শেষে একান্তে দোয়া-দরুদ পড়ছিলেন তিনি। এ সময় অনাকাঙ্খিত আগন্তকের উপস্থিতি তাকে শুধু বিরক্ত নয়; তীব্রভাবে ক্ষেপে উঠলেন তিনি। অনেক কষ্টে রাগ দমন করতে হচ্ছে। গ্রাম থেকে এসব উটকো ঝামেলা এসে শুধু হাড়ির ভাত ধ্বংস করে না, যাবার সময় ইনিয়ে-বিনিয়ে দু:খের কথা বলে তার সহধর্মিনীর আঁচলের ভান্ডারেও টান পরে। অনেক কষ্টে রাগ দমন করে তিনি লোকটির দিকে আড়চোখে তাকালেন। বেগুনী কালারের একটা ঢোলা প্যান্ট পড়া। দুমড়ে-মুচড়ে আছে। লাল সোয়েটারের উপরে পাঞ্জাবী গলিয়েছে। গলার দুপাশে ঝুলছে রঙচঙে মাফলার। থুতুনীতে অল্প দাঁড়ি। পানের রস কষে লেগে আছে। লোকটিকে চেনা চেনা লাগছে। তিনি বিরক্ত মাখা গলায় বললেন, ‘কি নাম বললে?’ আনিস দু’কানে হাসি ঠেকে বললো, ‘জেডো মুই কদিমল মওলানার বেটা, আনিস। আনিস আজাকার!’

এবার বক্তার মওলানার চোখে সব অতীতের স্মৃতি ভেসে উঠল। তিনি মূহুর্তের মধ্যে ঢাকা ছেড়ে সুদুর কুড়িগ্রামে চলে গেলেন। এই স্মৃতিগুলো এখন তাকে দারুণ পোড়ায়। তার অতীত কর্মকান্ড নিয়ে তিনি খুব আতঙ্কে রয়েছেন। একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের নামে দেশের সনামধন্য মওলানাদের যেভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছে, তা ছিল তার কল্পনারও বাইরে। এখন নিজের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন! শান্তি কমিটির শীর্ষ নেতার দায়িত্ব পালন করার ফলে তার নামে মামলা হয় কিনা এনিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। মনে কোন শান্তি নেই। একাত্তরে হিন্দুদের লুট করা টাকা-পয়সা নিয়ে ঢাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য করে কেবল শান্তির মুখ দেখছিলেন। এমন সময় অজানা আতঙ্ক তাকে উচ্চচাপে ভোগাবে। আনিস দাঁত কেলিয়ে বলছে, ‘জেডো মনে নাই একাত্তুরত কুড়িগ্রাম থাকি পালায়া দুইজনে ইন্ডিয়া গেইছলং। অসম ভাষা শিকি দুজনে ওয়াজ-মাহফিল করি বেড়াইছিলং।’ বক্তার মওলানা এবার চিনতে পারলেন। এসব কথা, এসব স্মৃতি তিনি ভুলতে চাইছিলেন। কিন্তু নাছোড়বান্দার মতো এই লোকটি এসে সবকিছু মনে করিয়ে দিচ্ছে। আনিস তখনো বলে চলেছে, ‘জেডো মুই সউগ ভুলি গেইলোও কিছু কিছু ওয়াজ ভোলং নাই।’ তারপর একটু থেমে বলল, ওই যে কইছিলং না, ‘দিন যায় আহে রাতি, আয়ু বহিছে টুটি, লাহে লাহে চোমচাপি আহিছে মরণ। ওহে অমর ভাই ইয়াতোআর কাম নাই, মহুময় মায়াময় বহিছে রতন।’ বক্তার মওলানা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোমার জেল হইছিল না।’ আনিস উত্তর দিল, ‘হয় জেডো। ইন্ডিয়া থাকি আটাত্তর সালে আসপের পর, দুই বছর লুকিয়া আছনু। আশি সালোত জালাল মুক্তিযোদ্ধা লোকজন দিয়া মোক বাড়িত থাকি ধরি হাজির হাটোত গাছোত বান্ধি পিটাইছিল। পরে পুলিশ আসি চালান দেয়। তিন বছর জেল খাটি ফেরৎ আইসং।’ বক্তার মওলানা এর কথায় খুবই বিরক্ত হচ্ছিলেন। তিনি রাগ চেপে বললেন, ‘কি মনে করে আসছো।’ আনিস চাপা গলায় বলল, ‘শুনলং তোমারও নাম নাকি পেপাড়োত উঠছে।’ ‘এসব ফালতু কথা কে বলল তোমাকে!’ আনিস উত্তর দিল, ‘সগাই কওয়া কওয়ি করছিল। যাক সে সউব কথা। যে জন্য আসনু সেই কথা কং। মোর বেডার বিয়াও দিবার নাগছং। তোমাকগুলাক জেয়াফত দিবার আচছং জেডো।’ এবার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বক্তার মওলানা আরো বিরক্ত বোধ করতে লাগলেন। নিশ্চয়ই টাকা পয়সার জন্য এসেছে। এসব লোককে তিনি সহ্য করতে পারেন না। কেন যে তার কাছে আসে। তিনি এদেরকে তার চৌহদ্দির মধ্যে দেখতে চান না। আনিস রাজাকার উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘জেডো মোর বেটা আজশাহী ভার্সিটিত পড়ছে। শিবিরের বড় নেতা আছিল। গেল চেয়ারম্যানী ইলেকশনে ভোট নিয়া কাইজা করি জালাল মুক্তিযোদ্ধাক এমন পিটন পিটাইছে। ব্যাটা এল্যা লুলা হয়া হাটে। শালা তারপরও কয়, অসত্রো জমা দিছং; টেনিং জমা দেং নাই। কনতো, তুই হাঁটপেরে পাইস না, তোর টেনিং কাই খাইবে।’

এসময় বক্তার মওলানার স্ত্রী রুমে প্রবেশ করলেন। তিনি স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আনিসতো এখন সুখী মানুষ। বড় মেয়ের স্বামী রাজশাহী ইউনিভার্সিটির টিচার। ছোট মেয়ের স্বামী রংপুর সেনানিবাসে চাকরী করে। বড় ছেলে রাজশাহী ভার্সিটি থেকে পাশ করে রংপুর ইসলামী ব্যাংকে চাকরী করে। ছোট ছেলে গ্রামের মাদ্রাসায় চাকরী করছে। বহুত জমিজমা করেছে। সুখে আছে। এখন বড় ছেলের বিয়ে দিচ্ছে। মেয়ের বাবা তোমার বন্ধু। এজন্য আমাদের সবাইকে দাওয়াত দিতে এসেছে।’ এবার নড়েচড়ে বসলেন বক্তার মাওলানা। তিনি উৎসুখ চোখে তাকাতেই আনিস রাজাকার বলল, ‘জেডো তোমরা চিনবেন। তোমার দোস্ত ছাদেকুল এমপির বেডি।’ ‘কোন ছাদেকুল।’ স্ত্রী উত্তর দিল, ‘তোমাদের পার্টির ছাদেকুল। কুড়িগ্রামে যে বারবার ইলেকশন করে আর হারে। একবারো জিততে পারেনি। এবার বক্তার মাওলানা সবকিছু বুঝতে পারলেন। আনিস ছাদেকুলের কারণে এসেছে। তারমানে আনিস অনেক উপড়ে উঠে গেছে। এটা ভাল কথা। চারদিক থেকে বদমাসরা যেভাবে চেপে বসছে, তাতে টিকে থাকতে হলে শক্তি বাড়াতে হবে। যোগাযোগ বিস্তৃত করতে হবে। একাত্তরে পাক সেনাদের পরাজয়ের পর জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশ ছেড়ে পাঁচ পাঁচটি বছর বিদেশ বিভুইয়ে খেয়ে না খেয়ে তাদেরকে থাকতে হয়েছে। অনেক কষ্ট করে আজ এই অবস্থানে আসতে পেরেছেন তিনি। এই স্থান ছেড়ে দেয়া যাবে না।

পুরাতন সাথী-বন্ধুদের একত্রিত করতে হবে। নতুন আর পুরাতন মিলে পরাজয়ের ঘা শুকাতে হবে। এই দেশ তাদের ছিল, তাদের মুঠোয় রাখতে হবে। এসব কথা ভেবে বক্তার মাওলানা কিছুটা স্বস্থি পেলেন। তিনি আনিস রাজাকারকে বললেন, ‘আনিস অনেক কষ্ট করে আমরা এই জায়গায় এসেছি। এটা ধরে রাখতে হলে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ থাকা দরকার। আমার বন্ধু ছাদেকুল একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি খেয়ে এখনো বেঁচে আছে। ওর মেয়ের বিয়েতে আমি না যেয়ে কি পারি।’

অনেকদিন পর দুই রাজাকার নিজেদের চোখের দিকে তাকিয়ে স্বস্থির হাসি হাসলেন। পরিষ্কার আকাশটি হঠাৎ যেন কালো মেঘে ঢেকে গেল। আনিস রাজাকার বলল, ‘জেডো হামরাগুলা এক সময় ভাত পাই নাই। এলা হামার বাড়িত ৪/৫ জন লোক খাটে। টেকের পয়সা খরচ করি অসিমুদ্দির রিক্সাত যখন উঠোং, তখন খুব তৃপ্তি পাং। উয়াক কইছিনু। মুক্তিযুদ্ধ করি তোর কি হইল। আগোত অস্ত্র চালাইছিস। এ্যালা প্যাডেল ঠেলিস। তোর তো কপাল খুলিল না।’ কথাগুলো বলে মিটমিট করে হেসে ওঠে আনিস রাজাকার। বক্তার মাওলানা প্রশ্রয়ের হাসি দিয়ে বলেন, ‘ওই করে ওদের মরতে হবে। ওরা যেন কোমড় তুলে দাঁড়াতে পারে না।’ এসময় আছরের আজান শুরু হল। দুই রাজাকার দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কোলাকুলি করলেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড