• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ (১৭তম পর্ব)

  রিফাত হোসেন

০৯ নভেম্বর ২০১৯, ১৪:২৩
গল্প
ছবি : প্রতীকী

রোদ চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়াল। ঠোঁটের কোণে রহস্যময় এক হাসি লেগেই আছে। ও ইতির দিকে যত এগিয়ে আসছে, ইতির হার্টবিট ততই বেড়ে যাচ্ছে। বুকের ভিতরের ডিপডিপ শব্দটা যেন চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। রোদ থামতেই চাইছে না। মুচকি হাসি নিয়ে এগিয়েই আসছে ইতির দিকে। তার ইচ্ছে করছে এখান থেকে পালিয়ে যেতে। ভয় আর কৌতূহল ওকে কাবু করে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। সেই সাথে কিছুটা লজ্জাও পাচ্ছে। কারণ, ও রোদের সাথে অন্যায় করেছিল। রোদ আসলে কোনোরকম নেশা করতো না। বিয়েটা করবে না বলে ইতি অজুহাত হিসেবে ওই অভিযোগগুলো করেছিল। এছাড়া ওর কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। কারণটা শুধুমাত্র হলো আনিস উদ্দিন। তিনি চাইলে আগেই বিয়েটা আটকাতে পারতো। কিন্তু না, তাকে যখনই বলা হয়েছিল এই বিয়ে না হতে দিতে, তিনি তখনই রেগেমেগে গিয়ে বলেছেন, ‘কেন? বিয়েটা করলে সমস্যা কোথায়, ছেলে কী গরীব? না ছেলে গুণ্ডাপাণ্ডা। ছেলের পরিবার হয়তো ক্ষমতাবান লোকদের সাথে চলাফেরা করে। কিন্তু তাতে কী ছেলে খারাপ হয়ে যায়?’

এইসব এর উত্তর ইতির জানা ছিল না। অনেক খোঁজখবর নিয়েও রোদের সম্পর্কে এমন কোনো তথ্য জোগাড় করতে পারেনি, যার দ্বারা বিয়েটা ভেঙে দেওয়া যায়। তাই শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছিল মিথ্যে কথা বলে বিয়েটা ভাঙতে। সফলও হয়েছিল বটে।

হঠাৎ কারোর গরম নিঃশ্বাস মুখের উপর পড়তেই চমকে উঠল ইতি। ভয়ে ভয়ে সামনে তাকাতেই দেখল রোদ দাঁড়িয়ে আছে। একদম ওর কাছাকাছি। যতটা কাছাকাছি থাকলে একজনের নিঃশ্বাস আরেকজন অনুভব করতে পারে। ইতি হঠাৎ পিছিয়ে গেল কয়েক পা। সেদিন রোদ খুব রেগে গিয়েছিল। রোদের ভয়ঙ্কর রূপ সবাই দেখেছিল। অবশ্য সেটার জন্য ইতি নিজেই দ্বায়ী। কারোর উপর অন্যায় অপবাদ দিলে সে তো সহজে তা মেনে নিবে না। রোদও মেনে নেয়নি সেদিন। কিন্তু সায়েম ইতির পাশে ছিল। তাই ইতি নির্ভয়ে প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করেছে। সেই একই ভুল ইতি দ্বিতীয়বার করতে চায় না। রোদের কাছ থেকে সবসময় দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।

ইতিকে আবারও চমকে দিয়ে রোদ কর্কশ গলায় বলল, ‘কেমন আছ ইতি?’

রোদের কণ্ঠস্বর শুনে ইতি ভীত হলো। রোদ যে সাংঘাতিক চটে আছে, সে সম্পর্কে ইতি অবগত আছে। এখন মনে হচ্ছে এই অফিসে চাকরি নেওয়াটাই ওর জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে। রোদ যেকোনো সময় নিজের প্রতি হওয়া অন্যায়, অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারে৷ ইতি নিজের মনে মনে ঠিক করল, ‘এখন থেকে সাবধানে থাকতে হবে।’

ইতিকে চুপ থাকতে দেখে রোদ একবার ঠোঁট বাঁকা করে হাসল। তারপর কপালে হাত বুলাতে বুলাতে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। ইতি ভীত গলায় ফিসফিস করে বলল, ‘লোকটা কী কপালে হাত বুলিয়ে নিজের রাগ কন্ট্রোল করছে? নাকি এমনিতেই হাত বুলাচ্ছে। আবার যদি আমার কাছাকাছি আসে, তাহলে এক দৌড়ে পালিয়ে যাবো এখন থেকে।’

ইতি একবার পিছনে তাকিয়ে দেখে নিলো দরজাটা খোলা আছে কি-না। দরজাটা খোলাই আছে। ইতির স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। মাথাটা নিচু করে রোদের দিকে আড়চোখে তাকালো। রোদ কড়া গলায় বলল, ‘আমি বাঘ না ভাল্লুক, যে এত ভয় পাচ্ছ?’

ইতি আবারও বিড়বিড় করে বলল, ‘বাঘ-ভাল্লুক হলে যতটা ভয় পেতাম, তার থেকেও বেশি ভয় পাচ্ছি আপনাকে দেখে। কারণ বাঘ- ভাল্লুকের নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য থাকে। ওরা হয় আমাকে একেবারেই মেরে ফেলবে, আর নাহয় ডিস্কোভারি চ্যানেলের সেই বাঘ-ভাল্লুকের মতো দূর থেকে দেখেই চলে যাবে। কিন্তু আপনার তো কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। আপনি যে কখন কী করে বসবেন, সে আপনি আর আল্লাহ মাবুদ ছাড়া কেউ জানে না। আর এটা ভেবে আমার আত্মার পানি শুকিয়ে আসছে যে, পুরো অফিস সময়টা আমাকে আপনার সাথে কাজ করতে হবে।’

রোদ এবার রেগেমেগে টেবিলে একটা থাপ্পড় দিলো। ধপাস করে একটা শব্দ হওয়াতে ইতি ভয়ে নিজেকে এক কোণায় গুটিয়ে নিলো। রোদ বলল, ‘এইসব কী হচ্ছে ইতি? এটা অফিস, এখানে আমরা কাজ করতে এসেছি। তুমি নিজের বসকে এতই যখন ভয় পাও, তাহলে চাকরিটা করতে এলে কেন?’

ইতি নিজেকে সামলালো।- কথাটা আসলেই সত্যি। বসকে এত ভয় পেলে চাকরি করতে এসেছি কেন? উনার সাথে পূর্বে যা-ই হোক না কেন? তার প্রভাব নিশ্চয়ই এখানে পড়বে না। আপাতত সে আমার বস। সুতরাং ভয় না পেয়ে সাহসীকতার সাথে কাজ করতে হবে।

ইতি হালকা কাশি দিয়ে নিজের গলার স্বরটা ঠিক করে নিলো। এরপর দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘জি, বলুন মিস্টার রোদ।’

রোদ আবারও নিজের কপালে হাত বুলালো। ইতি নিশ্চিত ‘কপালে হাত বুলানো’ নামের কোনো রোগ আছে রোদের। নাহলে বারবার এইরকম করতো না।

রোদ বলল, ‘বসকে কী বলে ডাকতে হয় সেটা কী জানো না? নাকি আমি জানিয়ে দিবো।’

ইতি বিব্রত হলো। বসকে নাম ধরে ডাকা একেবারেই উচিত হয়নি। যতই সে পূর্বপরিচিত হোক, অফিসের বস মানে বস। ইতি অপরাধীর স্বরে বলল, ‘আই এম সরি স্যার। আর হবে না।’

- ভেরি গুড। শোন, তুমি আমার পূর্বপরিচিত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক আর সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তুমি এখন আমার বউ থাকতে। অকারণবশত বিয়েটা হয়নি। কিন্তু তাই বলে তোমাকে আমি আপনি করে সম্মোধন করতে পারব না। আগেও তুমি করে বলেছি, এখনও বলব৷ তবে তুমি আমাকে আপনি করে এবং স্যার বলেই ডাকবে। বিকজ আমি সিনিয়র। সেদিন বিয়ে বাড়িতে আমার সম্মান নিহত হয়েছিল৷ কিন্তু আমি চাই না এই অফিসে আমার সম্মান নিহত তো দূরে থাক, আহত পর্যন্ত হোক। সো সাবধান।

ইতি স্ট্রেট উত্তর দিলো, ‘ওকে স্যার।’

রোদ টেবিল থেকে কয়েকটা ফাইল ইতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এগুলোতে চোখ বুলিয়ে নাও৷ তাহলে নিজের কাজ সম্পর্কে ধারণা আরো গাঢ় হবে।’

ইতি ফাইলগুলো হাতে নিয়ে রোদকে ‘ধন্যবাদ’ দিয়ে বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে বুকে হাত দিয়ে বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ‘যাক বাবা, আপাতত বেঁচে গেলাম।’

ওদিকে রোদ পৈশাচিক এক হাসি দিয়ে বলল, ‘খেলা তো সবে শুরু হলো মিস ইতি। একে একে সব হিসেব পুষিয়ে দিবো। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।’

সায়েম চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গেল। পাঁচ মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বের হলো। ঘরে কোনো ঘড়ি নেই। ফোনটাও নেই যে সময় দেখবে। বালিশের উপরে একটা মোবাইল দেখে এগিয়ে গেল সায়েম। মোবাইলটা রাফার। রাফা অবশ্য ঘরে নেই। কোথায় আছে সেটার দেখার প্রয়োজনবোধ করল না সায়েম। মোবাইলটা হাতে নিয়ে পাওয়ার বাটনে চাপ দিলো। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই চোখ দু'টো বড়বড় হয়ে গেল ওর। শরীরে আস্তে আস্তে রাগটা বাড়তে লাগল। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘মেয়েটা কী কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে? এত বেলা হয়ে গেছে, অথচ আমাকে ডাকেনি। আজ ওর একদিন কী আমার একদিন।’

অতঃপর সায়েম রাগে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে ড্রয়িংরুমে এলো। ড্রয়িংরুমে এসে দেখে রাফা চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে টিভি দেখছে। বা হাতে রিমোট। আর ডান হাতটা নিজের থুতনিতে দিয়ে রেখেছে। এমম ভাবে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে, যেন চোখ দিয়ে টিভির দৃশ্যটা গিলে খাবে। উঁহু, শুধু দৃশ্য না, যেন টিভিটাই গিলে না।

সায়েম সেদিকে আর নজর না দিয়ে পাশের ঘরের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ইতি বলে ডাক দিলো। কিন্তু না, কেউই সাড়া দিলো না। সায়েম আবারও ডাক দিলো। এবারও কেউ সাড়া দিলো না। সায়েমের রাগটা নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে। রাগে রীতিমতো ফুসতে শুরু করেছে। ঘাড়টা বাঁকা করে রাফার দিকে তাকালো একবার। রাফা বিরক্তিকর মুখ নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে গভীরভাবে। সায়েম নিশ্চিত রাফার বিরক্ত হওয়ার কারণ ও নিজেই। কারণ ও খুব জোরে চেঁচাচ্ছে। কিন্তু অদ্ভুত, এই চেঁচামেচি শুনে বাড়িওয়ালা দু'তলা থেকে চার তলায় চলে আসবে। কিন্তু রাফা এত কাছাকাছি থাকা স্বত্ত্বেও সায়েমকে অগ্রাহ্য করছে। সায়েম রাগে গজগজ করতে করতে রাফার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাফার বিরক্তিকর চেহারার আকৃতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। তবুও কোনো কথা না বলে এদিক ওদিক উঁকি দিচ্ছে টিভি দেখার জন্য। কিন্তু সায়েমও কম যায় না। সে কোনোভাবেই রাফার দৃষ্টি টিভি স্ক্রিনে পড়তে দিবে না। তবুও রাফা থেমে যাচ্ছে না। বারবার করে টিভি দেখার চেষ্টা করছে। সায়েম রেগে গিয়ে রাফার গালে ঠাসস করে থাপ্পড় মেরে রিমোটটা কেড়ে নিলো। রাফা অগ্নি দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে। সায়েম কিছু বলার আগে ও ওঠে দাঁড়াল। এরপর সায়েমের শার্টের কপাল চেপে ধরে রাগী কণ্ঠে বলল, ‘কারণে-অকারণে শুধু আমাকে মারো কেন তুমি? আর একবার কোনো কারণ ছাড়া আমাকে মারলে তোমার হাত কেটে ফেলবো আমি।’

রাফার কথা শুনে সায়েম অবাক আর বিস্ময় নিয়ে তাকালো। রাফা ওর শার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘শোন মিস্টার সায়েম, অন্যসময় যাই করো না কেন, আমি কিছুই বলব না। বাট আমি যখন টিভি দেখব, তখন আমাকে বিরক্ত করবে না। শুধু বিরক্ত করা না, তখন আমার আশেপাশেও যেন তোমাকে না দেখি।’

সায়েমের মাথাটা কেমন ঝিম ধরে গেছে। ও আহত গলায় বলল, ‘তুমি কী ঠিক আছ রাফা? মানে জ্বরের ঘোরে এইসব বলছ না তো।’

রাফা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ‘জ্বর তো অনেক আগেই পালিয়েছে। এখন তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করলে, তোমাকেও পালাতে বাধ্য করব। তাই বলছি বেশি বাড়াবাড়ি করো না। এখন বল এত চেঁচাচ্ছ কেন?’

সায়েম আবারও আহত হলো। এ যেন নতুন রাফাকে দেখছে। তবুও নিজেকে সামলালো। রাফার সামনে ভীত হওয়া যাবে না। কোনোভাবেই না। সায়েম দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘ইতি কোথায়?’

- অফিসে গেছে।

- অফিসে গেছে মানে?

- আজ থেকেই নাকি তার অফিস শুরু। তাই প্রথম দিন হিসেবে একটু আগেই গেছে। আর যাওয়ার সময় বলে গেছে ঠিক আধ ঘন্টা পর যেন তোমাকে ডেকে দেই।

- তাই নাকি? তা আমাকে ডেকেছিলে?

- না। এক্ষুনি যাবো ভাবছিলাম। কিন্তু এর আগেই তুমি ওঠে পড়েছ।

সায়েমের ইচ্ছে করছে রাফাকে আরেকটা থাপ্পড় মারতে। কিন্তু না, সেটা এখন করা যাবে না। শেষে দেখা যাবে রাফা উল্টো পাল্টা কিছু করে বসবে, তখন নিজেরই ইজ্জতভ্রষ্ট হবে। তাই সায়েম শান্ত গলায় বলল, ‘এতটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও তুমি বলছ ডাকবে বলে ভাবছিলে। জাস্ট ওয়াও রাফা।’

রাফা অবাক হয়ে বলল, ‘এতটা সময় পেরিয়ে গেছে মানে কী? কয়টা বাজে এখন?’

সায়েমের ফোনটা রাফার দিকে এগিয়ে দিলো। রাফার ফোনের দিকে তাকিয়ে মুখটা ‘হা’ করে বলল, ‘ও আল্লাহ। ১০টা বেজে গেছে অলরেডি। ইতি আপু তো বলেছিল ৮.৩০ এর মধ্যে ডাক দিতে।’

- এবার বুঝতে পারছ তো কেন থাপ্পড়টা মেরেছিলাম তখন?

রাফা মাথা নিচু করে বলল, ‘আই এম সরি সায়েম।’

সায়েম রাফাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘গতকালকে রাতে বলেছিলে আজ সারাদিন আমাকে ভাইয়া বলে ডাকবে। সেটা কী ভুলে গেছ।’

রাফা মাথা নিচু করেই বলল, ‘ঠিক আছে ভাইয়া।’

রাফার মুখ থেকে ভাইয়া ডাকটা শুনে কেন জানি সায়েমের ভালো লাগল না। অথচ আগে ও সবসময় রাফার মুখ থেকে ভাইয়া ডাক শুনতে চাইতো। যদিও মুখে বলছে রাফা ওকে ভাইয়া বলেই ডাকুক। কিন্তু মানুষের ইচ্ছে তো আর একটা নয়। একটা অভ্যন্তরীণ ইচ্ছে, যেটা মনের ভিতর থেকে আসে। আরেকটা বাহ্যিক ইচ্ছে, যেটা বাইরে থেকে আসে। আই মিন মুখে যেটা বলে। এই বাহ্যিক আর অভ্যন্তরীণ এর কাহিনিটা সায়েম বুঝেও না বুঝার ভান করে আছে। কোনোভাবেই রাফার প্রতি দূর্বল হওয়া যাবে না।

সায়েম নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। জামা-কাপড় চেঞ্জ করে কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসে রাফাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমাকে সারার মায়ের কাছে রেখে যাই চল। একা-একা থাকতে পারবে না।’

রাফা লক্ষ্য করল সায়েম তাড়াহুড়ায় নিজের চুলগুলো ঠিক করতেও ভুলে গেছে। তাই ও নিজেই সায়েমের দিকে এগিয়ে গেল মাথার চুল ঠিক করে দিতে। কিন্তু সায়েম ওর হাতটা ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার চুল ঠিক করে দেওয়ার জন্য অন্য একজন মানুষ আছে। দয়া করে এই দায়িত্বটা নিজের কন্ট্রোলে নেওয়ার চেষ্টা করো না।’

রাফা আহত ভঙ্গিতে তাকালো সায়েমের দিকে। এভাবে চলতে থাকলে ও নিহত হবে। সায়েম যে খুব রেগে আছে তা ভালো করেই বুঝতে পারছে রাফা। সেজন্যই সায়েমকে বলতেও পারছে না যে, খেয়ে যাও। অবশ্য একদিন সকালের খাবার না খেলে তেমন কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না। তবুও ভদ্রতার খাতিরে বলা যেতেই পারে। কিন্তু না। রাফা এত ভদ্র না। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে সায়েমকে খাওয়ার কথা বলবে না। সায়েম নিজে থেকে খেতে চাইলে ও বলবে " খাবার নেই। পাশের ফ্লাটের বিড়াল জানালা দিয়ে এসে সব খেয়ে ফেলেছে।"

- তুমি যাবে না এখানেই বসে থাকবে। আমার হাতে কিন্তু সময় নেই একদমই। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমার জন্য বসের ঝাড়ি আজ ফরজ হয়ে গেছে।

রাফা ভাবনা বাদ দিয়ে বাস্তবে ফিরল। সায়েমের উদ্দেশ্যে বলল, ‘হ্যাঁ, চলো।’

রাফার পরণে অন্য একটা শাড়ি এখন। এই শাড়িটা ইতির। তবে এখন এলোমেলো ভাবে না। বেশ গুছিয়েই শাড়িটা পরেছে। রাফা যে কিছুক্ষণ আগে গোসল করেছে, তা ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। হালকা ভেজা কালো কুচকুচে চুল মাথায় পিছন দিয়ে হাটু পর্যন্ত নেমে গেছে। এইটুকু সাইজের মেয়ে এত বিশাল লম্বা চুল নিয়ে হাঁটে কীভাবে তা কিছুতেই ভেবে পায় না সায়েম। রাফার মুখটা কেমন নিষ্পাপ আর স্নিগ্ধ লাগছে। তবে ডান গালে একটু লাল দাগ বসে গেছে। সাদা দবদবে গালে সায়েমের হাতের তিনটে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট ভেসে ওঠেছে। হঠাৎ সায়েমের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করতে লাগল। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী রইল না। রাফা কেমন করে জানি বুঝে গেল সায়েমের ভাবনাটা। সে সায়েমকে তাগাদা দিয়ে বলল, ‘আরে বাবা আমি খুব বেশি ব্যাথা পাইনি। এত ভাবতে হবে না এই নিয়ে। তুমি বরং অফিসে যাও। আর আমি সারা আপুর মাকে চিনি। গতকালকে বিকেলে ইতি আপুর সাথে গিয়েছিলাম। তাই আমাকে নিয়ে এখন ভাবতে হবে না। একা-একা থাকতে ভালো না লাগলে দরজা লক করে দিয়ে আমি নিজেই উপরের তলায় চলে যাবো।’

সায়েম ব্যাগটা ডান হাত থেকে বা হাতে নিলো। দরজার কাছে গিয়ে বলল, ‘সাবধানে থেকো। আমার ফোনটা ওই বাড়িতে রেখে এসেছি। কোনো সমস্যা হলে ইতিকে ফোন দিও।’

রাফা সম্মতি জানালে সায়েম নিশ্চিন্তে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে।

আনিস উদ্দিন গলা ঝেড়ে নিজের স্ত্রীকে ডাকলেন৷ ইদানীং তার ঘন ঘন ইচ্ছে করে স্ত্রীর সাথে কথা বলতে। কিন্তু স্ত্রী সামনে এলেই ভালো কথা হারিয়ে যায়৷ মেজাজ হয়ে যায় খিটখিটে। চোখেমুখে বিরক্তি চলে আসে। ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে তখন। আর অদ্ভুতভাবে স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করার সময়ই তার গলার জোর অটোমেটিক বেড়ে যায়৷ আজ-ও তাই হলো। তবে শুরুতে কিছুটা নরম সুরেই বললেন, ‘অন্তরা।’

অন্তরা বেগম শুনলেন না। তাই এবার চেঁচিয়ে ডাকলেন। কয়েক মিনিট পর অন্তরা বেগম ঘরে এসে বলল, ‘চেঁচাচ্ছ কেন এত? তোমার না শরীর অসুস্থ? তাহলে গলায় এত জোর এলো কোত্থেকে?’

আনিস উদ্দিন বিরক্তির গলায় বললেন, ‘উঁহু চুপ করো তো। কোথায় ভাবলাম তোমার সাথে একটু গল্প করি। তা না, এসেই এমন সব কথা বলতে শুরু করলে, এতে গল্প করা তো দূরে থাক, তোমার মুখ দেখলেও মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’

- সে তো লাগবেই। আমার তো এখন বয়স হয়েছে, তাই না? এখন তো আর আমাকে খুব বেশি ভালো লাগবে না।

- ব্যাপারটা ঠিক সেরকম না। ব্যাপারটা হলো গিয়ে যৌবন। আমার মধ্যে আর সেই আগের যৌবন নেই। যৌবন অক্ষত থাকতে কত কী করে বেরিয়েছি। এখন আর সেগুলোর দিকে কোনো অগ্রাহই নেই।

অন্তরা বেগম বিছানায় বসতে বসতে বললেন, ‘তাই নাকি? তা কী এমন করেছ যৌবন কালে? যে এভাবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলে বেড়াচ্ছ।’

- বুঝলে অন্তরা, আমার ল্যাংটা কালের এক বান্ধুবী ছিল।

অন্তরা বেগম নিজের নাক কুঁচকে বললেন, ‘ছি:, এগুলো কোনো ভদ্র মানুষের ভাষা হতে পারে না। ল্যাংটা কালের বান্ধুবী না বলে বাল্যকালের বান্ধুবী বললেই তো হয়?’

- গ্রামের খাটি ভাষার কদর তুমি কী বুঝবে? যাই হোক, বাদ দাও। আচ্ছা অন্তরা, তুমি কী কখনো বাল্যকালের বান্ধুকে চুমু খেয়েছিলে?

অন্তরা বেগম একটু নড়েচড়ে বসলেন। স্বামীর দিকে নিখুঁতভাবে তাকিয়ে বললেন, ‘না। কেন?’

- আমি বান্ধুবীর চুমু খেয়েছিলাম। সে এক অদ্ভুত কাহিনী বুঝলে, হাওয়ায় মিঠাই নামে এক ধরনের মজার খাবার আছে। তো ছোটবেলায় আমরা হাওয়ায় মিঠাই খেতাম খুব। একদিন আমার ওই বাল্যকালের বান্ধুবী বলল, বুঝলি আনিস, তোমার ঠোঁট দু’টো এমনিতেই গোলাপি। এই গোলাপি রঙের হাওয়ায় মিঠাই খেয়ে আরো গোলাপি হয়ে গেছে।

অন্তরা বেগম চোখ পাকিয়ে বলল, ‘তারপর?’

- তারপর ও বলল "আয় তোর ঠোঁটে একটা চুমু দেই। আমিও না করলাম না। এগিয়ে গেলাম। আর ব্যাস, হয়ে গেল।

অন্তরা বেগমের চোখ দিয়ে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। রাগে তার শরীর জ্বলে যাছে। তিনি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘তারপর কি হয়েছিল?’

আনিস উদ্দিন বেশ মজা পাচ্ছেন স্ত্রীকে রাগাতে। তবে সেটা মাত্রাতিরিক্ত হতে দেওয়া যাবে না৷ তখন উল্টো নিজেরই বিপদ বাড়বে। তাই বলল, ‘এরপর কী হয়েছিল সেটা বলা যাবে না। সব সিক্রেট বলে দিলে তুমি আবার কথায় কথা খোটা দিবে আমায়।’

অন্তরা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, ‘তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। আমি আজ একটু বাপের বাড়িতে যাবো?’

- বাপের বাড়িতে যাবে কেন?

অন্তরা বেগম রাগ দেখিয়ে বলল, ‘চিন্তা করো না। আমি তোমার মতো অসভ্য না, যে বাল্যকালের বান্ধুকে চুমু খাওয়ার জন্য ওখানে যাচ্ছি।’

আনিস উদ্দিন হেসে দিয়ে বলল, ‘এই তো শুরু হয়ে গেল খোটা দেওয়া। এখন থেকে তো কথায় কথায় তুমি খোটা দিবে এই নিয়ে৷ যাই হোক, আরো গভীর কিছু সিক্রেট ছিল, যা আস্তে আস্তে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই ইচ্ছেটা এখন আর নেই৷ এখন বল বাপের বাড়িতে কেন যাবে? তুমি কী জানো না বাবা-মা মরার পর বাপের বাড়িকে আর বাপের বাড়ি বলা যায় না। ওটা তখন ভাইদের বাড়ি হয়ে যায়। আর ভাইদের বাড়ি ঘন ঘন যাওয়া যায় না। এতে ওরা বিরিক্ত হয়।’

- আরে বাবা, আমি ঘন ঘন কোথায় যাচ্ছি? এই তো কাছেই বাপের বাড়ি। তাও তো নিজ থেকে খোঁজখবর নেই না কখনো। সবসময় ভাইয়েরাই খোঁজখবর নেয়। তাছাড়া আমি ওদের ওখানে ঘুরতে যাচ্ছি না৷ কাশেম তো আমার বাপের বাড়ির এলাকাতেই থাকে। রাতে সায়েম মেইল করেছিল আমাকে। মেইলে লিখা ছিল, আমি নিজে গিয়ে যেন কাশেমের বাড়িতে খোঁজখবর নিয়ে আসি। কাশেম বাড়িতে না থাকলে ওর পরিবারের লোকদের জিজ্ঞেস করব ও কোথায় কোথায় যেতে পারে। কার সাথে ও গত কয়েকদিন একটু বেশিই কথা বলেছে। যোগাযোগ করেছে।

- ঠিক আছে যাও, যাও। ছেলের সঙ্গ দেওয়া শুরু করেছ আবার, তাই না? আমারও কিছু হিসেবনিকেশ করা বাকি আছে। এই যে দু'জনের বিয়েতে এত আয়োজন করলাম। এখানে কী টাকা-পয়সা খরচ হয়নি? তা এত টাকা-পয়সা খরচ করে লাভটা তো কিছুই হলো না। তাই ভাবছি এই টাকা-পয়সা সব আদায় করে নিবো তোমার ছেলে-মেয়ের কাছ থেকে।

অন্তরা বেগম কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন রাগ দেখিয়ে।

(চলবে...)

আরো পড়ুন ১৬তম পর্ব- ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড