এম. ফজলে রাব্বী
গল্পটি নব্বইয়ের দশকের, শিব শঙ্কর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী। থাকেন মহসিন হলে। পড়ুয়া ধাঁচের ছেলে। কারও আগেও নেই, পিছলেও নেই। তার ধ্যান জ্ঞান রসায়ন। পড়ার টেবিলে বইয়ের স্তূপকে ছোটখাটো আইফেল টাওয়ার বলা চলে। টেবিলের বাপায়া ঘুণপোকা খেয়ে নড়বড়ে করে দিয়েছে। যেকোনো সময়ে তা সেই বইয়ের আইফেল টাওয়ার সহ ধূলিসাৎ হওয়ার দিনক্ষণ গুনছে। নতুন একটি টেবিল কেনার সামর্থ্য তার নেই। একটি টিউশনি সে করাতো। সেটাও কিছুদিন আগে ভেস্তে গেছে। ছাত্রী তার প্রণয়ঘটিত অসুখে আক্রান্ত হয়ে গানের শিক্ষকের সাথে নিরুদ্দেশ হয়েছে এবং তাদের গন্তব্য যে বৃন্দাবন নয় তাও অতিদ্রুত আবিষ্কার হয়েছে। এ নিয়ে শিব শঙ্করের মাথা ব্যথা নেই, তবে পেটে তার মাঝে মাঝে ব্যথা হয়। এ ব্যথা ক্ষিদের ব্যথা। শিব শঙ্কর পানি খায় ক্ষিদে মেটাতে। রসায়ন তার মাথায় আর বিক্রিয়া করে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তখন ছাত্র রাজনীতির ব্যাপক প্রভাব। সদ্য স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া রাজনীতি ছাত্রদের হাতে এনে দিয়েছে প্রবল ক্ষমতা। হলে হলে অস্ত্রের মহড়া চলত নিয়মিত। রাস্তাঘাটে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, রাহাজানি মহামারির মত ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বিবদ্যালয় এলাকায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য হলে থাকা হয়ে উঠেছে দুষ্কর। বাছাই করে প্রতিদিন নতুন নতুন কর্মী হলে তোলা হচ্ছে আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া হচ্ছে। যারা এখনো হলে আছে তাদের অন্য কোনো উপায় নেই বলেই হলে আছে।
শিব শঙ্করের রুমে একদিন পা পড়লো তৎকালীন ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের। হল ছাড়তে হবে শিব শঙ্করকে। সময় একদিন। এর মধ্যে হল না ছাড়লে পিটিয়ে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হবে। একরাম ভাইয়ের নির্দেশ। ভাই একটা কথার লোক। বাতাসের দিক পরিবর্তন হয় কিন্তু একরাম ভাইয়ের কথা নড়চড় হয় না।
শিব শঙ্করের মাথায় বাজ পড়লো। সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে ঢাকা শহরে তার পরিচিত আত্মীয় স্বজন কেউ নেই। কোথায় যাবে সে? কি করবে? এমনিতে তো তার দিনে একবেলা না খেয়ে থাকতে হয়। তবুও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলো সে। এখন তো তার পড়াশোনা বাদ দিয়ে অকর্মণ্যের মত গ্রামে ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই! সে একরাম ভাইয়ের কাছে গিয়ে তার পা ধরে কেঁদে ফেলল। ‘ভাই গো, আপনি আমার মায়ের পেটের ভাই। আমারে হল থেকে বাইর কইরেন না। আমার কেউ নাই, কই যাব? আপনার পায়ের কাছে একটু জায়গা দেন।’
একরাম ভাই তার নাম জিজ্ঞেস করলো। নাম শুনে সে বলল, ‘তোকে তো রাখতে পারব না রে। দলের বারণ আছে। ঝামেলা আছে। বুঝসই তো, হিন্দুদের সাহায্য করতে গেলে এখন আমার পদ খোয়া যাবে। তুই কালকেই সিটা ছেড়ে দিস। কেমন?’
একরাম ভাই বেনসন ফুঁকতে ফুঁকতে বিদায় নিল। শিব শঙ্কর হল ছাড়েনি। একদিন পর সকালবেলা একরামের কর্মীরা হকি স্টিক দিয়ে পিটিয়ে শিব শঙ্করকে হল ছাড়া করেছিল। শিব শঙ্করকে সেদিন কুকুরের মত পেটানো হয়েছিল। কেউ সেদিন এগিয়ে আসেনি। শিব শঙ্কর কেঁদেছিল পাগলের মত। একরামের কর্মীরা সেদিন পশুদের মত উল্লাস করেছিল।
এই ঘটনার বছর আটেক পরের ঘটনা। শিব শঙ্কর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের লেকচারার। ক্লাশে ঢুকে তিনি দেখলেন একরাম ভাইয়ের সেই ছোট ভাইদের যারা তাকে হকি স্টিক দিয়ে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছিলো। তিনি এক পলক তাকিয়ে না দেখার ভান করে ক্লাস নিলেন। ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরলেন। তারপরও তিনি ক্লাস নিয়েছেন ওদের। কখনো পুরোনো স্মৃতির মূল্যায়ন করেননি। মনে পড়লে ভুলে যেতে চেয়েছেন। ভুলতে পারেনি শুধু একরাম ভাইয়ের সেই কর্মীরা। এর বছর খানেক পর তারা একবার শিব শঙ্করের সাথে দেখা করতে এসেছিল তার বাড়িতে। অতীতের অপরাধের জন্য হাউমাউ করে কেঁদেছে শিব শঙ্করের পায়ে পড়ে। শিব শঙ্কর আবার কাঁদলেন সেদিন। কেন কাঁদলেন জানেন?
এই দুঃখে কাঁদলেন যে কিছু মানুষ তাদের মস্তিষ্কের সঠিক ব্যবহার সঠিক সময়ে করতে পারে না। এরাই বিপথগামী হয়ে অন্যের দ্বারা পরিচালিত হয়। তারপর বেলা শেষ ফিরে এসে দেখে নিজের যা ছিল হারিয়েছে তার সবই।
একরামের সেই কর্মীদের আর কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন তারা বাতিল মাল। সার্টিফিকেট বিহীন ছাত্রত্বের সেই ইতিহাস এখনো ঘুরেফিরে আসে চক্রাকারে। কারণ ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। একরামদের শিষ্যরা অতি উৎসাহী হয়ে ক্রমাগত ব্যবহৃত হয়। ব্যবহার শেষ কনডমের মত আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। তখন একরামরা কিন্তু কখনোই শিকার যায় না যে ওটা তার ব্যবহৃত কনডম। হাজার হলেও তো কনডম একটি নিষিদ্ধ জিনিস! তাই না?
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড