• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধারাবাহিক গল্প : এক পলকের একটু দেখায় (দ্বিতীয় পর্ব)

  সাবিকুন নাহার নিপা

২৯ অক্টোবর ২০১৯, ১৪:৪৬
গল্প
ছবি : প্রতীকী

দু’বছর পরে আবারও এক রাতের ট্রেনে সিলেট থেকে ফিরছে তাওসিফ। এবার ট্রেনের জানালায় মাথা রেখে নিজে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। পার্থক্য শুধু এবার সেই অচেনা মেয়েটার বদলে সামনের সিটে বসে আছে সৈকত। তাওসিফ কান্নাজড়িত কন্ঠেই বলল, ‘বয়স্ক দু’টো মানুষ এভাবে কি করে গায়েব হয়ে গেল বলতো?’

সৈকত অসহায় গলায় বলল, ‘ভাই আমি সত্যিই কিছু জানিনা। আমার তখন পা ভাঙা ছিলো। দুই মাস হসপিটাল থেকে ফিরে যখন খোঁজ নিলাম তখন শুনলাম যে তারা নাকি বাড়ি বিক্রি করে চলে গেছে।’ - এত কম সময়ে কি করে বাড়ি বিক্রি করে ফেলল বলতো? - হয়তো তুই যেভাবে কম সময়ে আমেরিকা যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলি সেভাবে করেছে। হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে তাওসিফ বলল, ‘আমি আগেই স্টুডেন্ট ভিসার জন্য এপ্লাই করেছিলাম কিন্তু সেটা তোদের বলিনি। বললে কোনো না কোনো ভাবে বাবা জেনে যেত আর আমার যাওয়া আটকে যেত।’

সৈকত অসহায় গলায় বলল, আজ ও তুই নিজের সাফাই গাইছিস ভাই? এতকিছুর পরও? তুই বিয়ে না করে চলে গিয়ে খালা-খালুকে বিপদে ফেললি তারপর আবার এই দু’বছরে যোগাযোগ করলি না। যোগাযোগ করার কোনো অপশন ও রাখলি না। আর এখন এইসব কুমিরের কান্না কেন ভাই!

তাওসিফ একটু চুপ থেকে বলল, আমি ইচ্ছে করেই যোগাযোগ করিনি। কারণ, বাবা একবার জানতে পারলে যে করেই হোক আমাকে নিয়ে আসতেন। আর বলতে পারিস কেনই বা আমি বারবার তাদের জন্য স্যাক্রিফাইস করবো? সেই ছোটবেলা থেকে সবকিছু তো তাদের জন্য বিসর্জন দিয়েই আসছি। জীবনে তো শুধু দুটো ব্যাপার নিজের পছন্দমতো চেয়েছিলাম। আমার ক্যারিয়ার আর বিয়ে। সেখানেও তাদের ইচ্ছে মানতে হবে!

সৈকত কিছু বলল না। সৈকতকে চুপ করে থাকতে দেখে তাওসিফ বলল, ‘কিন্তু তোর সাথে কেন যোগাযোগ করল না বলতো?’ সৈকত নিচু গলায় বলল, তুই সেদিন চলে আসার পর খালা আমায় ডেকেছিল মেয়েটাকে বিয়ে করার জন্য। কিন্তু আমি রাজি হইনি। খালু তারপর আমাকে বেদম মার দিয়ে বাম-পা ভেঙে দিয়েছেন। হসপিটাল দু’মাস থাকার পর ফিরে এসে আর পাইনি তাদের।

তাওসিফ আবারও চুপ করে থাকে। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, ‘তুই জানিস আমি প্রায় রাতেই মাকে স্বপ্নে কাঁদতে দেখি। না জানি মা আমার জন্য কতো না কাঁদছে। সবকিছু হচ্ছে বাবার জন্য।’

শেষের কথাটা আক্ষেপ করে বলল তাওসিফ।

সৈকত দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তাওসিফের স্বভাব বরাবরই এরকম অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়া। স্কুল কলেজে পড়াকালীন সময়েও কোনো কিছু ঘটলে সৈকতকে ভুক্তভোগী হতে হতো। এখনও নিজে দোষ করে বাবার উপর চাপাচ্ছে। সেই মানুষটা তো ওর ভালোই চেয়েছিলেন। আর ও কি না নিঃস্ব করে চলে গেল সবাইকে! সেটা নিয়ে কোনো আফসোস নেই ওর! - তুই কেন মেয়েটাকে বিয়ে করলি না? সৈকতের মেজাজ খারাপ হল। তবুও ঠাণ্ডা গলায় বলল, - আমি মেয়েটার যোগ্য ছিলাম না তাই। তাওসিফ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ঠিকই বলেছিস খোরা মেয়ের জন্য খোরা ছেলে দরকার ছিলো। তুই আমি না! সৈকত দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করল। ঘুম পাচ্ছে, আজ রাতেও কি ওই স্বপ্ন টা দেখবে!

২ - লিয়া ওঠো আজ তোমার কাছে গেস্ট আসবে! সিসিলিয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিছানা থেকে উঠলো। স্মিত হেসে বলল, ‘আমার কাছে গেস্ট?’ - হ্যাঁ। তোমার ঘরের সামনে আজ দু’টো শালিক বসেছে। দেখো তোমার কাছে আজ সত্যিই কেউ একজন আসবে। - কে আসবে? অনন্যা একটু ভেবে বলল, ‘ঘোড়ায় চড়ে হয়তো মদনকুমার আসবে মধুমালাকে নিতে।’ সিসিলিয়া শব্দ করে হেসে ফেলল। অনন্যা খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তুমি হাসোনা কেনো লিয়া? তোমাকে হাসলে কি সুন্দর লাগে!’ সিসিলিয়া দুঃখী ভাব করে বলল, ‘তুমি কেনো রোজ সকালে এতো মজার মজার কথা বলোনা অনন্যা? তাহলে তো আমার সকাল টা হাসি দিয়েই শুরু হতো।’ অনন্যা মুখ বাকিয়ে বলল, আচ্ছা তাই বুঝি? এবার থেকে দেখা যাবে! সিসিলিয়া আবারও হাসলো। অনন্যা বলল, ‘ইউনিভার্সিটিতে আজ তোমার প্রথম দিন। শাড়ি পরে যেও কিন্তু কেমন!’ সিসিলিয়া জিজ্ঞেস করল, আঙ্কেল কোথায়? - জানিনা। সকালে সেজেগুজে কোথায় যেন গেল। আমি আর জিজ্ঞেস করিনি। কি দরকার সকাল সকাল বেচারার মুড খারাপ করার! সিসিলিয়া খেয়াল করল অনন্যার মন খারাপ হয়ে গেছে। প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করল, - তোমার হবু ক্যাডারের কি খবর? - দিন রাত পড়ছে তো। - হ্যাঁ, আমিও খেয়াল করেছি। দেখো এবার হয়তো ক্যাডার হয়েই ছাড়বে। অনন্যা চোখ নামিয়ে নিলো। সিসিলিয়ার মনটা খারাপ হয়ে গেল। অল্প বয়সী মেয়েটা বাবা-মা ছেড়ে প্রতিকের হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে এসেছিল আর ছেলেটা কি না ইউনিভার্সিটির টপ স্টুডেন্ট হয়েও একটা চাকরি যোগাড় করতে পারল না!

সিসিলিয়া ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্য বের হওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হতেই প্রতীকের সাথে দেখা হলো। প্রতীক হেসে বলল, -বেস্ট অফ লাক লিয়া। তোমাকে কিন্তু সুন্দর লাগছে। -তোমার পড়ার কি অবস্থা? -পড়ছি আর পড়ছি। দিনরাত তো পড়েই যাচ্ছি। দেখি এবার আল্লাহ মুখ তুলে তাকায় কি না! সিসিলিয়া হেসে বলল, দেখ এবার সত্যিই তুমি ক্যাডার হবে। প্রতিকের চোখ দুটো জ্বলে উঠলো। সিসিলিয়া খেয়াল করেছে যে ইদানীং দুটো ভালো কথা বললেই প্রতীকের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে যায়। - দেখো লিয়া দুই শালিক! যদি কিছু চাওয়ার থাকে তবে চোখ বন্ধ করে মনে মনে চেয়ে নাও। - তুমি এসব বিশ্বাস করো প্রতীক? প্রতীক ইতস্তত করে বলল, লোকে বলে যে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। - তুমি কি চাইলে? - আমি নিজের জন্য চাই নি। অনন্যার জন্য চেয়েছি। সিসিলিয়া কিছু বলল না। প্রতীক নিজেই দ্রুত প্রস্থান করল। সিসিলিয়া রিকশায় উঠে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, - সহে আল্লাহ এই দুটো ভালোবাসার মানুষ কে তুমি সারাজীবন সুখে রেখ। এদের জীবনের গল্পে যেন শুধু ভালোবাসাই থাকে।

৩ এনামুল চৌধুরী শুকনো পাউরুটি মাখন লাগিয়ে পানি দিয়ে গিলছে আর পাশে তার স্ত্রী প্লেট ভর্তি করে ভাত খাচ্ছে। এনামুল সাহেব ব্যাপার টায় খুব বিরক্ত হচ্ছে। সকালে আগে যখন গ্রামে থাকতো তখন এনামুল সাহেব ভাত খেতো। এরপর তার দিন পাল্টেছে আর সাথে সাথে পাল্টেছে অভ্যাস ও। তাই এইসব পুরনো জিনিস দেখলে এনামুল সাহেব খুব বিরক্ত হয়। কারন এসব ব্যাপার তার অতীতের সাথে জড়িত। আর অতীত কে কিছুতেই সে মনে করতে চায় না। কিন্তু এনামুল সাহেব যেসব জিনিস চায় না তার সাথে সেসব ই বেশী ঘটে। এই যেমন মেয়েদের জেদ তার পছন্দ না। কিন্তু তার মেয়েটা ঠিক জেদি আর একরোখা হয়েছে। সবকিছু তার মর্জিমাফিক হতে হবে। সকাল ১০ টায় কথা বলবে বলেছে কিন্তু ১০ টা বেজে ২৫ মিনিট এখনো তার খবর নেই। এনামুল সাহেব আবারও ঘড়ির দিকে তাকালো। - খুব কি বিরক্ত হচ্ছো বাবা? এনামুল সাহেব একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, না মামুনি বিরক্ত হবো কেন? - হ্যাঁ সেটাই বিরক্ত হওয়ার কথাও না। যেখানে অপ্রয়োজনীয় মানুষ দের জন্য তোমার এতো সময়। টেবিলের অপর প্রান্তে বসা সেলিনা বেগম রক্তচক্ষু নিয়ে একবার প্রমাকে দেখে উঠে গেল। সেলিনা উঠে যেতেই এনামুল চৌধুরী বললেন, - তুমি যেন আমায় কি বলবে? - হ্যাঁ। আসলে আমি ভাবছিলাম এবার লাইফে সিরিয়াস হবো। এনামুল সাহেব বেশ খুশি হলেন। উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, -সমবাহ বাহ ভালো সিদ্ধান্ত। তাহলে জয়দেবপুরের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি টা বরং তুমিই দেখো এখন থেকে। প্রমা স্বাভাবিক গলায় বলল, - বাবা লাইফে সিরিয়াস হওয়া বলতে আমি বুঝিয়েছি আমি বিয়ে করতে চাই। এনামুল সাহেব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো মেয়ের দিকে। ২৬ বছর বয়সী মেয়ে বিয়ে করতে চাইলে যে কোনো বাবার খুশি হওয়ার কথা। তবুও সে খুশি হতে পারছে না। মিনমিন করে বলল, একটু কাজে থিতু হয়ে নিলে কি ভালো হতো না মা? - এতো টাকা টাকা করে জীবনে কি হবে বাবা? টাকার পিছনে ছুটেছো দেখে তোমার সংসার টা ঠিকঠাক হয়নি। আমি সেই ভুল করতে চাই না। আমি বিয়ে করতে চাই। - বেশ তো। পছন্দের কেউ আছে? প্রমা কফির কাপে চুমুক দিয়ে উদাস গলায় বলল, - আগেও বলেছি এখনো বলছি বিয়ে করলে আমি তাওসিফ কেই করবো। এনামুল চৌধুরী এবারে রেগে গেলেন। এ কেমন ছেলেমানুষী মেয়ের! দুইবছর আগের কিছু ঘটনার জন্য মেয়ে একি প্রতিশোধের খেলায় মেতে উঠেছে! - তাওসিফ কিংবা তার পরিবারের কোনো খোঁজ আমি জানিনা। -ওর পরিবার কে আমার দরকার নেই। আমার দরকার তাওসিফকে। -তোমরা দুজন দুজন কে দেখোনি। কি করে ওকে বিয়ে করতে চাও তুমি? -তাওসিফ দেশ ছাড়ার আগে তার সাথে আমার দেখা হয়েছে এয়ারপোর্টে। আর আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ও হয় হোয়াটসঅ্যাপে। সে প্রমা চৌধুরী কে চেনে কিন্তু মোনালিসা চৌধুরী কে চেনে না। এনামুল সাহেব হঠাৎ করেই মাথায় তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন। অতিরিক্ত টেনশনে সবসময়ই এমন হয়।

৪ সৈকত মেয়েটাকে ডেকেই যাচ্ছে কিন্তু মেয়েটা শুনছে না। পানির ভিতরে আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে। সৈকত চিৎকার করে মেয়েটাকে ডাকল, ‘আপনি যাবেন না প্লিজ। আপনি ডুবে যাবেন।’

মেয়েটা এক পলক সৈকতের দিকে ফিরে তাকিয়ে হাসে আবারও হেটে সামনের দিকে যায়। সৈকত আবারও চিৎকার করে ডাকে কিন্তু মেয়েটা শোনেনা। চিৎকার করতে করতে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। এ পর্যায়ে এসে ঘুম ভাঙে সৈকতের। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি বের করে বোতল শেষ করে। নিজেকে ধাতস্থ করে বিড়বিড় করে বলে, ‘এত কষ্ট কেন তোমার বিষণ্ণতা!’

(চলবে...)

আরো পড়ুন প্রথম পর্ব- ধারাবাহিক গল্প : এক পলকের একটু দেখায়

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড