• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ (১৩তম পর্ব)

  রিফাত হোসেন

২৯ অক্টোবর ২০১৯, ১৩:৩৮
কবিতা
ছবি : প্রতীকী

ফাহাদ মাথা নিচু করে ভিতরে এলো। ফাহাদকে দেখে সবাই চুপ হয়ে গেলেও বিড়বিড় করছে সায়েম। ফাহাদের দিকে অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ নীরবতা সবার মাঝে। ইতি ফাহাদের কাছে এসে বলল, ‘ফাহাদ ভাইয়া তুমি এখানে? মানে কীভাবে জানলে রাফা এখানে আছে?’

ফাহাদ মাথা তুলে বলল, ‘তোমার মা ফোন করেছিল সকালে। তার কাছ থেকে সবটা শুনেই এলাম এখানে।’

- ওহ।

ফাহাদ সায়েমের কাছে এলো। সায়েম কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও নিজের ভিতর শান্তি অনুভব করছে। কারণ একমাত্র ফাহাদই পারবে রাফাকে বুঝিয়ে বাড়িতে নিয়ে যেতে। রাফার সব দায়িত্ব ফাহাদের হাতে দিয়ে দিতে পারলেই এখন সায়েম বেঁচে যায়। আর সায়েম খুব ভালো করেই জানে, ফাহাদ কখনোই এর সাথে অন্যায় করবে না। ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাবে না। ফাহাদ তো ভালো করেই জানে সায়েম কী চায়? কাকে ভালোবাসে? মন থেকে কাকে নিয়ে সারাজীবন থাকার স্বপ্ন দেখে সায়েম। ফাহাদ নিশ্চয়ই এমন কিছু করবে না, যাতে সায়েমের স্বপ্ন, বিশ্বাস সব ভেঙে যায়। - কিন্তু রাফার ভবিষ্যতের কী হবে?

নিজেকে প্রশ্নটা করল সায়েম। কিছুক্ষণ ভেবে আবাবও নিজে নিজে উত্তর দিলো - ওর কী হবে সেটা দেখার দায়িত্ব আমার নয়। আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে পেলেই হবে। আমি আবার এত দায়িত্ববান ব্যক্তি নই, যে একটা দূর্ঘটনা সারাজীবন বয়ে নিয়ে বেড়াবো। নিজের সুখের জন্য এইরকম হাজারটা দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি আমি।

- তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে সায়েম। একটু ভিতরের ঘরে চল প্লিজ। ফাহাদের কথায় ভাবনা স্থগিত রাখল সায়েম। সম্মতি জানিয়ে বলল- হুম, চল।

সায়েম নিজের ঘরে এলো। পিছনে ফাহাদ। ঘরে এসে দরজাটা আটকে দিয়ে ফাহাদ অপরাধীর স্বরে বলল, ‘তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার মতো সাহস আমার নেই সায়েম। আন্টির কাছ থেকে রাফার সব কূ-কর্মের কথা আমি শুনেছি। কিন্তু সত্যি বলতে আমি একটুও অবাক হইনি।’

- হোটায়? ফাহাদকে থামিয়ে দিয়ে চোখ কটকে তুলে কথাটা বলল সায়েম। চোখ পাকিয়ে পাকিয়ে ফাহাদকে বার কয়েক দেখল। তারপর নিজে নিজেই নিঃশব্দে বলল - সবই তো ঠিকঠাক। মনে তো হচ্ছে না নেশা করে এসেছে। তাহলে এইরকম উদ্ভট কথা বলছে কেন? নিশ্চয়ই বোনের শোকে কাতর হয়ে গেছে৷ কিন্তু রাফা তো আর আত্মহত্যা করেনি যে ফাহাদ শকট্ হবে। জাস্ট একটা পাগলামি করেছে। দু'মিনিটেই এই কেস ডিশমিশ হয়ে যাবে।

- নিশ্চয়ই ভাবছিস আমি এইরকম অদ্ভুত কথা কেন বলছি? এইরকম ভাবাটাই স্বাভাবিক। কারণ আমার বোন এইরকম একটা কাজ করেছে। ভাই হিসেবে আমার অবাক হওয়াটা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু কী জানিস তো, আমি যেমন নিজের মতো চলি। তেমনি নিজের মতোই ভাবি। আমার নিজস্ব মনটা খুব তীক্ষ্ণ।

- হয়েছে থাক। নিজের ঢাক নিজে পেটায় তো বোকারা। আর তুইও একটা বোকা। সেজন্যই তো নিজেই নিজের প্রশংসা করছিস। সায়েম মুখটা বাঁকা করে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে কথাটা বলল। কিন্তু সায়েমের তাচ্ছিল্যতা ফাহাদের ইগো স্পর্শ করল। তাই রাগী কণ্ঠে বলল - তুই কী আমার সাথে ঝগড়া করার ইচ্ছা প্রকাশ করছিস?

- আমার তো মনে হয় তুই ঝগড়া করার জন্যই এসেছিস৷ কিন্তু তোর সাথে ঝগড়া করার মতো মুড এখন আমার নেই। জানিস তো এই সায়েমের সব কাজ-কর্ম মুড এর উপর ডিপেন্ড করে।

- তুই কিন্তু এক্সট্রা কথা বলছিস সায়েম। আমরা যেকারণে এই ঘরে এসেছি, সেটাই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।

সায়েম নিজেকে সামলিয়ে নিলেও তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিলো। ফাহাদ কিছু বলতে গিয়েও থেমে যেন। সায়েম যেন এতে আরো আনন্দ পেলো। বিজয়ী বিজয়ী একটা ভাব নিয়ে বলল - ওকে বল।

- আসলে আমি আগে থেকেই জানতাম রাফা এইরকম কিছু করবে।

ফাহাদকে থামিয়ে দিয়ে সায়েম বলল - মানে কী? তুই এইসব জেনেও বাধা দিসনি। রাফাকে সব করতে দিয়েছিস। মানলাম আমাদের মধ্যে একটা মান-অভিমানের ব্যপার ঘটেছিল। তাই বলে এভাবে বন্ধুর সাথে বেইমানি করলি। ছি: ফাহাদ।

- প্লিজ আমাকে ভুল বুঝিস না৷ আমি জানতাম না যে এতকিছু, আর এত তাড়াতাড়ি সব হবে। তবে আমি অনুমান করেছিলাম। আর সেজন্যই ওকে সবসময় নজরাবন্ধি করে রেখেছিলাম। কিন্তু।

সায়েম রেগে গিয়ে কিছুটা চেঁচিয়ে বলল, ‘কিন্তু কী? এবার নিশ্চয়ই বলবি ও বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। এই কথাটা একেবারেই অবিশ্বাস যোগ্য। কারণ দু'দিন হয়ে গেছে ও বাড়িতে নেই। এর মধ্যে ওর কোনো খোঁজখবর তুই নিসনি। তাছাড়া রাফা নিজেই আমাকে বলেছে ও কোনো এক ফ্রেন্ডের বাড়িতে গেছে তোকে জানিয়েই।’

- পুরোটা না শুনেই চেঁচামেচি শুরু করে দেওয়া তোর একটা বাজে অভ্যাস সায়েম। এটা পরিবর্তন করা দরকার। রাফা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়নি। আর আমাকে বলেই গিয়েছিল।

- তুই যখন অনুমান করতে পেরেছিলি ও এইরকম কিছু করতে পারে, তাহলে ওকে বের হতে দিয়েছিলি কেন?

- তাহলে কী আটকে রাখবো বাড়িতে? আরে ইয়ার, ওকে ছোট থেকে আমি নিজের হাতে খাইয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে নিজের বুকে ঘুম পাড়িয়েছি৷ ওর হাবভাব, গতিবিধি সব আমার জানা আছে। কিন্তু ওর জেদ সম্পর্কে তোর ধারণা নেই৷ তাছাড়া ওর বয়সটা ভেবে দেখ৷ এই বয়সের মেয়েরা সাধারণত আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। ওকে ঘরে আটকে রাখা ঠিক হতো না। আর একটা মানুষকে ২৪ ঘন্টা নজরে রাখা যায় না। এই ২৪ ঘন্টার মধ্যে থেকে কয়েকটা মিনিট ও নিজের ক্ষতি করার জন্য ঠিক বেছে রাখতো। সেটা নিশ্চয়ই ভালো হতো না। তাই ওকে বাড়ি থেকে বের হতে দিয়েছি আমি। তবে আমার নজরের বাইরে রাখিনি ওকে। ওর সব বন্ধুবান্ধবকে আমি অনুরোধ করে বলেছি, ওকে যেন কোনো অন্যায় কাজে সাহায্য না করে। এবং ওর সব আপডেট আমাকে যেন দেয়।

- তোর বোনের তো অদৃশ্য মানব নামে এক বন্ধু আছে। সেই সাহায্য করেছে ওকে। তাছাড়া ওর যে বন্ধুকে তুই বেশি বিশ্বাস করেছিলি, সেই বন্ধুই ওকে অনেকটা সাহায্য এবং সাপোর্ট করেছে।

- আমি জানি সায়েম। কিন্তু এই অদৃশ্য মানবটা কে?

- আমি জানি না। রাফা আমাকে বলেনি। আমার জানার কোনো ইচ্ছে-ও নেই। কারণ এর শেষ হওয়া দরকার। তুই প্লিজ রাফাকে বাড়িতে নিয়ে যা।

- কিন্তু সেটা করা ঠিক হবে না সায়েম। ওর অবস্থাটা একবার ভেবে দেখ। ও যদি কোনো ভুল করে ফেলে। ওর ইচ্ছে বিরুদ্ধে যাওয়া ঠিক হবে না।

সায়েম জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘কী বলতে চাচ্ছিস তুই?’

- প্লিজ একটু বুঝার চেষ্টা কর। ওকে আপাতত এখানেই রাখ।

- এটা মজা করার বিষয় না ফাহাদ। তুই খুব ভালো করেই জানিস আমি সারাকে ভালোবাসি।

- আমি জানি সায়েম। কিন্তু এখন পরিস্থিতিটাই অন্যরকম। হুটহাট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। ভালো করে ভেবে দেখ।

- তুই কী এটা ভাবছিস, আমি রাফাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবো?

- এটা সম্পূর্ণ তোর ব্যক্তিগত ব্যপার সায়েম। কারণ জীবনটা তোর। বাট তোর সাথে এখন রাফা-ও জড়িয়ে গেছে। তাই ভুল সিদ্ধান্ত নিলে বিপদ হতে পারে।

সায়েম অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল- আমি রাফাকে নিয়ে সেভাবে কখনো ভাবিনি ফাহাদ। ওকে স্ত্রী হিসেবে কীভাবে মেনে নিবো আমি?

- আমি তো বলছি না ওকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নে। আমি এটাই বলছি রাফা এখন তোর সাথেই থাক। তুই নিজেই ওকে বুঝা। ও তোর কথা বুঝার চেষ্টা করবে সায়েম। কারণ ও তোকে ভালোবাসে।

- এটা ঠিক হচ্ছে না ফাহাদ। এতে করে রাফা আরো উৎসাহিত হয়ে পড়বে। তাছাড়া সারাকে কষ্ট দিতে পারব না আমি। এমনিতেই অনেক কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।

- অন্তত কিছুদিন ওকে সহ্য কর। আমার বিশ্বাস ও বাস্তবতা বুঝতে পারবে। ও এতটাও খারাপ না যে, কাউকে কষ্ট দিয়ে নিজে সুখে থাকার কথা ভাববে। ও এতটা নিষ্ঠুরও নয়। তাছাড়া দায়িত্ব যখন কাধে পড়বে, এমনিতেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে।

- আমার এইসব ভালো লাগছে না ফাহাদ।

ফাহাদের চোখের কোণে জল ছলছল করছে। একদিক দিয়ে নিজের বোনকেও কষ্ট পেতে দিতে চাইছে না, আরেকদিকে বন্ধুর জীবনটাও অন্ধকারে ফেলে দিতে চাইছে না। কিন্তু ওকে তো কোনো একদিক ঠিক রাখতেই হবে৷ তাই ফাহাদ হাটু গেড়ে বসল সায়েমের সামনে। সায়েম নির্বাক দৃষ্টিতে তাকালো। ফাহাদ বলল - আমি তোর পায়ে ধরতেও রাজি আছি সায়েম। কিন্তু প্লিজ আমার বোনকে কষ্ট দিস না। ওকে তুই ভালোবাসা, স্নেহ দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা কর। কিন্তু প্লিজ ওর সাথে এমন কিছু করিস না, যাতে ও কষ্ট পেয়ে কোনো ভুল করে বসে। ওর জন্যই আমি লাইফে সফলতার এতদূর এসেছি। কারণ ওর পুরো দায়িত্ব আমার উপরে ছিল।

সায়েম কিছু বলতে পারছে না। ও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম ফাহাদকে এভাবে কাঁদতে দেখছে ও। আর ফাহাদ কারোর সামনে মাথা নতো করছে, তাও আবার বোনের জন্য। সায়েমের যেন এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না। সায়েমের বুকটা চিনচিন করছে। ফাহাদের করুন কণ্ঠ ওকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে৷

বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর ফাহাদ ওঠে দাঁড়াল। পিছনে ফিরে চলে যেতে চাইলে সায়েম ওর হাতটা ধরে বলল। - চিন্তা করিস না ফাহাদ। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। আর আমি কথা দিচ্ছি, আমি এমন কিছু করব না, যার প্রভাবে রাফা কোনো ভুল কাজ করতে বাধ্য হয়।

ফাহাদ কিছুটা আশ্বস্ত হলেও মনকে কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছে না। চোখ মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সায়েমের ঘরের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে রাফা। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল এবং শুনছিল। চোখটা মুছে ফাহাদের পিছনে পিছনে ড্রয়িংরুমে এলো। কিন্তু ততক্ষণে ফাহাদ চলে গেছে। রাফা শূন্যতা অনুভব করল৷ কোথাও একটা যন্ত্রণা অনুভব করছে ও। বুকের ভিতরটা কেমন ছটফট করছে। ড্রয়িংরুমের চেয়ারে বসতে বসতে বলল- ভাইয়া আমার সাথে একটা কথাও বলল না। এতই রেগে আছে আমার উপর। অবশ্য এটা হওয়ারই ছিল। কারণ ভাইয়াকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি। ভাইয়া আজ আমার জন্য কাঁদল। কোনো ব্যক্তির সামনে মাথানতো করল যা আগে কখনোই দেখেনি আমি। আর এইসব কিছু হয়েছে আমার জন্য। আচ্ছা আমি কী এতই খারাপ? সবাইকেই কী আমি শুধু কষ্ট দেই? নাকি কেউ আমাকে বুঝতেই পারে না।

কলিংবেলটা বাজিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সারা। বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পর-ও কেউ দরজা খুলছে না৷ অপেক্ষা জিনিসটা বড্ড যন্ত্রণার। আর শরীরে যখন রাগ থাকে, তখন তো অপেক্ষার যন্ত্রণাটা এমনিতেই কয়েক ডিগ্রি বেড়ে যায়। সারার ক্ষেত্রেও এখন ঠিক তাই হচ্ছে। বেস্ট ফ্রেন্ড এর বাসায় এসে এতক্ষণ অপেক্ষা করার কোনো মানেই হয় না। এমনটা তো নয় বাড়ির মানুষজন মন্ত্রী, মিনিস্টার। অথবা খুব নামি-দামি সেলিব্রিটি কেউ। তবুও যে কীসের এত ব্যস্ততা এদের, তা কিছুতেই ভেবে পায় না সারা। - নেহাৎ শরীরে জোর কম, নাহলে এই দরজাটা লাত্থি দিয়েই ভেঙে দেলতাম।

বাড়ির মানুষজনকে রাগ দেখিয়ে কথাটা বলতে চেয়েছিল সারা। কিন্তু এই বাড়ির কেউই সামনাসামনি কোত্থাও নেই এখন। তাই ক্ষোভটা নিজের মধ্যেই জামিয়ে রাখলো। অবশ্য বাড়ির কেউ থাকলে কথাটা বলতে গিয়ে কয়েকবার গলাটা কেঁপে উঠতো সারার।

হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। সারা চমকে ওঠে সামনের দিকে তাকাল। ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে অবাক কণ্ঠে মিথিলা বলল - হবু মিসেস সারা যে, তা এতদিন পর আমাদের স্বরণাপন্ন হলেন। আমাদের তো ভুলেই গেছিলেন।

মিথিলার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে ভিতরে ঢুকল সারা। ড্রয়িংরুমে থাকা টেবিলটার উপরে পানি রাখা ছিল। সারা পরপর চারটা গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে পান করতে লাগল। মিথিলা "হা" করে তাকিয়ে সারাকে দেখছে। আর মনে মনে ভাবছে, কী এমন হলো সারার? যার জন্য হুট করেই এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে৷ মিথিলা আবার বলল - আরে কী হলো তোর?

সারা ঠোঁটের চারিদিকে লেগে থাকা পানি মুছতে মুছতে বলল - হবু মিসেস সারা মানে কী? হু।

- তুই কী জানিস না, মানুষের খুব শীঘ্রই কিছু ঘটতে চলেছে মানে সে হবু, হবু তে আছে৷ এই ধর, দরজা খুলতে দেরি হওয়ার অপরাধে ঘরে গিয়ে তুই আমাকে মারতে শুরু করবি৷ তাই তোর নাম হবে হবু ফাইটার সারা। তারপর ধর তুই বাথরুমে যাবি খুব শীঘ্রই। তখন তোর নাম হবে হবু বাথরুম সারা। তেমনি তুই কিছুদিন পর বিয়ে করবি৷ তখন তোর নাম হবে হবু বিয়ে সারা। উঁহু, তখন হবে হবু মিসেস সারা৷ কারণ তখন তুই মিস থেকে মিসেস হবি। এবার বুঝেছিস তো।

সারা চোখের কোণে জল ছিল। ওর কাঁদতে ইচ্ছে করছিল এতক্ষণ। কিন্তু এই মেয়েটার কথা শুনে ওর উচ্চস্বরে হাসতে ইচ্ছে করছে৷ পরিস্থিতিটা খুব বাজে থাকলেও সারা মুখটা আড়াল করে মিটমিট করে হাসতে লাগল।

মিথিলা সারার দিকে এগিয়ে এলো। সারা নিজেকে সামলে নিয়ে মিথিলার দিকে তাকালো। মিথিলা বলল - এবার বলতো কী হয়েছে? এমনিতে তো বন্ধের দিন ছাড়া তোর দেখা পাওয়া যায় না৷ আজ হঠাৎ এই অফিস টাইমে আমার কাছে৷ ব্যাপার কী? কোনো সমস্যা হয়েছে?

সারা জড়িয়ে ধরল মিথিলাকে। মিথিলা আজ সারাকে দেখে হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে৷ শুরুতেই ও সারার চোখে জল দেখেছিল। আর সেজন্যই মজা করেছিল একটু। যাতে করে সারার মনটা একটু ভালো হয়৷ হয়েছিল-ও বটে৷ তবে সেটা ক্ষণিকের জন্য। আর এতে মিথিলা সন্তুষ্ট হয়। সারার জন্য ওর মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে৷ কিন্তু সেটা সারার সামনে প্রকাশ করা যাবে না। এতে হয়তো ও আরো আশাহত হবে। তাই সারাকে উদ্দেশ্য করে বলল - ঘরে চল সারা।

সারা ওকে ছেড়ে দিয়ে চোখটা মুছে সম্মতি জানালো৷ এরপর দু'জনে ঘরের দিকে যেতে লাগল। মিথিলার ঘরে তখন অধরা আর সানি বসা ছিল। সারাকে দেখে ওরা দু'জন দাঁড়িয়ে গেল। সানি সারার দিকে এগিয়ে এসেই বলল - মাই ডেয়ার সুইটহার্ট। তুই এইসময় এখানে। আমি তো জাস্ট ‘হা’ হয়ে গেলাম।

সারা চোখ পাকিয়ে তাকালো শুধু৷ অন্যসময় হলে এতক্ষণে সানির উপরে বড়সড় না হলেও মধ্যম সাইজের একটা সুনামি শুরু হয়ে যেতো। মুহূর্তটা হালকা-পাতলা করার জন্য মিথিলা সানিকে ধমক দিয়ে বলল - তুই চুপ করবি না মাইর খাবি।

সানি চুপ হয়ে গেল। যেন মিথিলার ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেছে ও। জায়গা খালি করার জন্য কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। তবে এতে সারা স্থগিত রইল না। হাতের সাথে সাথে ও নিজেও হাসফাস করছে সানিকে মারার জন্য৷ ইচ্ছে করছে ওকে খুন করে ফেলতে। কিন্তু জেলে যাওয়ার ভয়ে সেই চিন্তাটা আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলাই উত্তম। সারা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওর তাকিয়ে থাকলেও সানির চোখে কৌতূহল নেই একটুও৷ ও সারার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তা দেখে সারা বলল - এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

প্রতিউত্তরে সানি বলল - দেখছি আর কতরকম ভাবে তোর প্রেমে পড়া যায়।

সানির এই উত্তরটাকে পাত্তা দিলো না সারা। কারণ ও খুব ভালো করেই জানে সানির এই বাজে অভ্যাসটা কোনোদিনও চেঞ্জ হবে না। ও এমন একটা ছেলে, যে কিনা সারাদিনে যতগুলো ভাত মুখে দেয়, তার থেকেও বেশি প্রেমে পড়ে। ভিন্ন ভিন্ন মানুষদের উপর। কিন্তু সারার এইসব পছন্দ হয় না। সেজন্য ওদের মাঝে প্রায়ই ঝগড়া লেগে যায়। এই তো মাত্র কয়েক বছর আগে পরিচয় হয়েছে সানির সাথে।

সারা কয়েক বছর আগে চলে গেল। গভীর এক ভাবনা থেকে ভাবতে লাগল ওর আর সানির পরিচয় পর্বটা৷ সেদিন এক্সাম হলে দেরি করে আসার অপরাধে স্যার সারাকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। তাই দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করছিল। তখন হুট করে কোত্থেকে যেন সানি এসে হাজির হলো। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ওকে গভীর তীক্ষ্ণতা গিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল৷ অচেনা একটা ছেলের এইরকম কাণ্ডে সারা তো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সামনে স্যার থাকায় তেমন রিয়েক্ট না করে সানির হাতটা ধরে আড়ালে এসে বলল - কে আপনি? আর এভাবে কী দেখছেন আমাকে?

সানি সারার তাকিয়ে বলেছিল - তোমার প্রেমে পড়তে খুব ইচ্ছা করছিল। সেজন্যই দেখছিলাম কীভাবে কীভাবে তোমার প্রেমে পড়া যায়।

- কীভাবে কীভাবে প্রেমে পড়া যায় মানে? আর আমাকে তুমি করে বলছ কেন? তুমি কী আমার সিনিয়র, না আমার পূর্বপরিচিত?

- তুমি করে বলার জন্য পূর্বপরিচিত বা সিনিয়র হতে হয় না, মনে একটু ভালোলাগা থাকলেই হয়ে যায়। আর কীভাবে প্রেমে পড়া যায় বলতে বুঝিয়েছি কী দেখে প্রেমে পড়া যায়। এই ধর আমি তোমার ঠোঁটের প্রেমে পড়তে পারি৷ তোমার ঠোঁটের ঠিক উপরে যে ঘাম জমে আছে, সেই ঘামের প্রেমে পড়তে পারি। তোমার হেয়ার স্টাইলের প্রেমে পড়তে পারি। তোমার নরম তুলতুলে গালটার প্রেমে পড়তে পারি। তোমার স্নেহময় নামটার প্রেমেও পড়া যায়। যদিও নামটা এখনো অজানা। আর।

- আর কী?

- তোমার এই রাগী মুখটার প্রেমে পড়তে পারি।

সারা বিরক্তির স্বরে বলল - আপনি চুপ করবেন প্লিজ। আর এখান থেকে যান তো। এমনিতেই ঘড়িতে এক্সামের সময়টা পাগলা কুকুরের মতো দৌড়াচ্ছে। তার উপর আপনার উপস্থিতি আমাকে বিরক্ত করে তুলেছে। এই যান ভাই আপনি।

- আমি তোমার ১ ইয়ারের জুনিয়র। তাই তোমার ডিকশনারী থেকে এই ভাই শব্দটা কেটে বাদ দিয়ে দাও। শুধু নাম ধরে ডাকো।

সারা চোখ মটকে তুলে বলল - তোমার সাহস তো কম না। আমার জুনিয়র হয়েও আমার প্রেমে পড়তে চাইছ।

- প্রেমে পড়ার জন্য সিনিয়র হতে হয় না, আমার মতো সাহসী প্রেমিক হলেই হয়ে যায়। এই যে দেখছ না, তুমি আংশিক প্রেমে পড়ে গেছ আমার। সেজন্যই তো আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছ। এরপর আরো কাছাকাছি চলে আসবে। কাছাকাছি আসতে আসতে একসময় এতটাই কাছাকাছি চলে আসবে, যতটা কাছাকাছি এলে ক্ষণে ক্ষণে আমাদের মাঝে মারামারি লেগে যাবে।

সারাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সানি দৌড়ে চলে যায়। সারা ও ওর যাওয়ার পথের দিকে "হা" করে তাকিয়ে থাকে। আর ভাবতে থাকে সানির বলা শেষ কথাটা।

হঠাৎ কারোর স্পর্শ পেয়ে চমকে যায় সারা। সানি ওর খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। হাত দিয়ে ওর মুখের সামনের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে৷ সারা সানির হাতটা ধরে ওকে থামিয়ে দিয়ে চুপ করে রইল। সানি অবাক হয়ে বলল - আমরা যতবারই এতটা কাছাকাছি এসেছি, ততবারই আমাদের মধ্যে মারামারি লেগে গিয়েছিল। আজ সেরকম কিছু হলো না এর কারণ কী?

সারা অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল - প্লিজ সানি, আমার ভালো লাগছে না। তোর মজা করাটা অন্তত কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত রাখ।

- কয় মিনিটের জন্য স্থগিত রাখবো। দুই মিনিট। না তিন মিনিট। এর থেকে বেশি সময় স্থগিত রাখতে আমি পারব না কিন্তু। আর অনুরোধ করলেও হবে না। কারণ তুই আমার বউ না, যে তোর অনুরোধ আমি রাখবো৷

সারা হাল ছেড়ে দিয়ে মিথিলার দিকে তাকালো। মিথিলা পরিস্থিতি নিজের কন্ট্রোলে আনার চেষ্টা করে বলল - এই সানির বাচ্চা। তুই চুপ করবি, নাকি এই জানালা দিয়ে তোকে ছুড়ে ফেলে দিবো।

- এই তো একটা ছোট্ট জানালা। তার উপর এখান দিয়ে ছুড়ে মারলে কী আর হবে? তাছাড়া এক তলা বাড়ির একটা ঘরে এতগুলো জানালা রেখেছিস কেন? তোর আর তোর বরের বাসর রাতটা আমাকে লাইভ দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

মিথিলা চেঁচিয়ে বলল - হারামজাদা তুই নিজে থেকে চুপ করবি, না আমি তোর মুখে টেপ লাগিয়ে দিবো।

- টেপ কিনতেও টাকা লাগে। সেই টাকা কী আছে তোর কাছে? তাছাড়া তুই যেই লেভেলের কিপ্টে। মনে তো হয় না শুধুমাত্র আমার মুখ বন্ধ করার জন্য তুই নিজের টাকা দিয়ে টেপ কিনবি।

মিথিলাও হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ল। অধরা কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু সারা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল - দোষটা আসলে তোদেরই। এখানে তোরা দু’জন মেয়ে আছিস। ও একা একটা ছেলে এখানে কী করছে?

সারার কথা শেষ হতেই অধরা বলল - ও তো সবসময়ই আমাদের সাথে থাকে। আমার তো বেশ ভালোই লাগে। ইশ, দারুণ হ্যান্ডসাম একটা ছেলে। আর খুব হাসিখুশি। আমি তো প্রতি মুহূর্ত ওর প্রেমে পড়ি।

সানি অধরাকে থামিয়ে দিয়ে বলল - এত তাড়াহুড়ো করিস না। তোর যে বজ্জাত বাপ। এইসব শুনলে আমাকে গরম পানিতে চুবিয়ে মারবে। আর যদি জানতে পারে তোর সেই প্রেমিক জুনিয়র, তাহলে গরম পানি থেকে বেরিয়ে আসা কঙ্কালটাও আস্ত রাখবে না আর।

মিথিলা ফিক করে হেসে দিলো। সারাও মুখ টিপে হাসতে লাগল। এই এক সমস্যা। এদের সামনে কখনোই মন খারাপ করে টেকা যায় না৷ এরা যেভাবেই হোক, মন ভালো করে দিবে৷ - " কাঁটা দিয়েই কাঁটা তোলা হয়ে গেল৷" সারা নিজের মনে মনে কথাটা বলল।

মিথিলা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে সারা দিকে তাকালো এবার। বলল - এবার বল তো কী হয়েছে?

সারা কণ্ঠটা একটু ক্লিয়ার করে বলল - সায়েম ওর বন্ধুর বোনকে বিয়ে করেছে।

সারার কথা শুনে ভ্রু-কুঁচকালো অধরা আর মিথিলা। পাশ থেকে সানি অট্টহাসি দিয়ে বলল - আমি জানতাম এইরকম কিছু হবে৷ সেজন্যই বলেছিলাম ওর পিছে ঘুরা বাদ দে৷ এর থেকে ভালো আমার সাথে প্রেম কর। আমার পিছনে ঘুরাঘুরিও করতে হবে না। বিয়ে করতে বললে এক্ষুনি করে ফেলল।

সারা রাগী কণ্ঠে বলল - তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস সানি৷ তুই খুব ভালো করেই জানিস আমি এইসব নিয়ে ঠাট্টা পছন্দ করি না। তোর কিছু কিছু কথা শুনলে মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার এই ফ্রেন্ড সার্কেলে থাকার যোগ্যই না তুই। তোর মতো অসভ্য ছেলে আমি দু'টো দেখিনি। দেখছিস আমি একটা সিরিয়াস কথা বলছি, এখানেও তোর মজা করতে হবে৷

সানি মৃদু হাসি দিয়ে সারার পাশে বসল। সারার একটা হাত ধরতেই, সারা হাতটা সরিয়ে নেওয়ার জন্য হ্যাঁচকা টান দিলো৷ কিন্তু সানির শক্ত হাতের মুঠো থেকে ও নিজের হাতটা সরাতে পারল না। সানি আরও শক্ত করে ওর হাতটা ধরে বলল - আরে রাগ করছিস কেন? তুই তো জানিস আমি মজা করতে ভালোবাসি। বিশেষ করে তোদের সাথে।

অধরা বলল - বাট এখন একটু চুপ থাক। সারার কথাটা শুনতে দে। সারা তুই প্লিজ সবকিছু খুলে বল আমাদের।

সারা কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই সানি হাত দিয়ে ওর মুখটা আটকে দিয়ে বলল - ছি: ছি: ছি:! একটা ছেলের সামনে তোরা এইসব কথা বলছিস। তোদের কী লজ্জা বলে কিছু নেই? আমি কিন্তু খুব লজ্জা পাচ্ছি।

অধরা মুখটা ‘হা’ করে বলল - কী এমন বললাম যে তুই লজ্জা পেলি?

- এই যে খোলাখুলির ব্যপারটা।

অতঃপর সবাই রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো সানির দিকে। সবার চোখেই যেন আগুন জ্বলছে। এমন ভাবে সানির দিকে তাকিয়ে আছে, যেন চোখ নিজেই বলতে চাইছে, ‘হারামজাদা সানি, এই চোখের আগুনেই তোকে পুড়িয়ে মারব। কারোর চোখই যেন আর অপেক্ষা করতে পারছে না। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে আছে চোখের আগুন নিয়ে সানিকে পুড়িয়ে মারার জন্য। এমন এক পরিস্থিতিতে সানি থতমত খেয়ে গেল।’

মুহূর্তটাকে আউট অফ কন্ট্রোল হওয়ার আগেই ভয়ে ভয়ে বলল - ইয়ে মানে, আই এম সরি। আসলে মুখ ফসকে উল্টো পাল্টা বলে ফেলেছি।

মিথিলা চোখ মটকে তুলে নিজের দাঁতে দাঁত চেপে রেখে বলল - জীবন নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাস, নাকি লাশ হয়ে ফিরতে চাস।

সানি অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল - সরি বললাম তো। তাছাড়া এখনো বিয়ে করতে পারিনি। এই সময়ে মরে গেলে যে অনেক কিছু মিস করে যাবো।

- তাহলে এক মিনিটের মধ্যে পালা এখান থেকে।

- ১০০ টাকা দে। একটা সিগারেট ধরিয়ে রিকশা করে বাড়িতে চলে যাবো।

সারা নিজের ব্যাগ থেকে ১০০ টাকার নোট বের করে সানির হাতে দিয়ে বলল - আগামী ১ মাসেও তোর মুখ যেন না দেখতে হয়, সেজন্য টাকাটা দিলাম।

সানি টাকাটা হাতে নিয়ে বলল - তোর হাতের স্পর্শের টাকা। এই টাকা রিকশাওয়ালাকে দেওয়া যাবে না।

- আর দিতে পারব না। এবার যা এখান থেকে।

- ওকে।

সানি চলে গেল সেখান থেকে। মিথিলা আর অধরা খিলখিল করে হাসতে লাগল। সারা নিঃশব্দে হেসে বিড়বিড় করে বলল - অসভ্য ছেলে একটা।

মিথিলা হাসি থামিয়ে বলল - ওর কথা বাদ দে তো। সারাজীবনেও ঠিক হবে না ও। সেদিন অপরিচিত একটা মেয়েকে তার স্বামীর সামনেই প্রপোজ করে বসেছিল। আমরা ছিলাম বলে বেঁচে গেছে। আচ্ছা এইসব বাদ দে প্লিজ। এবার বল সায়েম কাকে বিয়ে করেছে? তাছাড়া ও তো তোকে খুব ভালোবাসতো। তাহলে হঠাৎ অন্য কাউকে বিয়ে করার ব্যপারটা কোত্থেকে এলো? সারা বড় করে ঢোক গিলে পরপর সবটা বলতে লাগল ওদেরকে। যত শুনছে, অধরা আর মিথিলা ততই ভ্রু-কুঁচকে তাকাচ্ছে সারার দিকে। সারা যতটুকু জানতো, ততটুকুই বলল ওদের। সবটা শোনার পর মিথিলা বিস্ময়কর ভাবে বলল - যা হয়েছে, তা আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। আমরা তো জানতাম এবং দেখতাম, সায়েম তোকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। আর আমার বিশ্বাস তুইও সায়েমকে ভালোবাসিস।

- আমরা দু’জন দু'জনকে ভালোবাসি, অথচ ও অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিলো।

অধরা বলল - দেখ সারা, আমার মনে হয় তুই সায়েমকে ভুল বুঝছিস। কাউকে ঠকানোর মতো ছেলে সায়েম না। আর তোকে তো একেবারেই না। যদিও তেমন গভীরভাবে উনাকে চিনি না। বাট যেটুকু চিনি, সেই বিশ্বাস থেকেই বলছি, সায়েম হয়তো রাফা নামের মেয়েটাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে।

- সায়েম কী বাচ্চা ছেলে? যে কেউ ওকে বাধ্য করবে, আর ও বাধ্য ছেলের মতো বিয়ে করে নিবে। আমার তো মনে হয় ও ইচ্ছে করেই করেছে এইসব।

মিথিলা কণ্ঠে জোর এনে বলল - যাকে ভালোবাসিস, তাকে এইটুকু বিশ্বাস করতে পারছিস না সারা। এ আমার কেমন ভালোবাসা। তাছাড়া এটা তো শুধু অনুমান না। সায়েম নিজেই তো বলেছে ওকে ফাঁদে ফেলা হয়েছিল। তোর উচিত সত্যি ঘটনাটা জানা, এবং সায়েমকে সাপোর্ট করা। কাছের মানুষকে হারানোর যন্ত্রণা তোদের থেকে একটু হলেও আমি বেশি অনুভব করেছি সারা। সায়েম ভয় পাচ্ছে খুব। তোকে হারানোর ভয়। ও ভাবছে তুই ওকে ভুল বুঝে দূরে চলে যাবি। আর সেজন্যই ও ভয় থেকেই তোকে নিজের মনের কথাগুলো বলতে পারছে না। তুই ওকে সময় দে একটু। ওকে সাপোর্ট কর। আমি নিশ্চিত সায়েম তোকেই ভালোবাসে এখনো।

- তোদের কথা আমি মেনে নিলাম। কিন্তু এতে তো ওদের বিয়েটা মিথ্যে হয়ে যায় না, তাই না? আর আমার পক্ষে কাউকে কষ্ট দিয়ে নিজের সুখ খুঁজে নেওয়া সম্ভব না। রাফার মতো ফুটফুটে একটা মেয়েকে কীভাবে কষ্ট দিবো আমি? যদিও ও সায়েমের থেকে অনেকটা ছোট। বাট ওর ভালোবাসক তো ছোট বা কম না। ওর সব পাগলামির কথা আমি ইতির কাছ থেকে শুনেছি। এবং আমি এটাই বুঝেছি, রাফা সায়েমকে খুব ভালোবাসে। শুধুমাত্র নিজের সুখের জন্য আরেকজনকে কষ্ট দিতে আমি পারব না৷ আমার বাবা-মা আমাকে এই শিক্ষা দেননি।

- আমি তো বলছি না তুই রাফার জায়গাটা জোর করে দখল নে। আর এটা করা ঠিকও হবে না। সায়েম একটা ডিপ্রেশনে আছে সারা৷ এই সময় যদি তুই ওর থেকে দূরে চলে যাস, তাহলে ওর অবস্থাটা কী হবে ভেবে দেখ? ও তো পাগল হয়ে যাবে। ও হয়তো নিজের সব রাগ রাফার উপর দিয়ে ঢালবে। সেটা কী তোর ভালো লাগবে বল?

সারা ছলছল চোখে পলক ফেলল একবার। দুই চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। মিথিলা ওর কাছে এসে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরল। সারা ভারী কণ্ঠে বলল - আমি কী করব এখন? আমি যে এইসব সহ্য করতে পারছি না। আমার যে মরে যেতে ইচ্ছে করতাছে। আমার সাথে কেন এমন হলো বল তো৷ আমি তো কারোর কোনো ক্ষতি করিনি কখনো।

- আমিও তো কারোর কোনো ক্ষতি করিনি। তবুও তো আমার সাথে এর থেকেও খারাপ কিছু হয়েছিল৷ কিন্তু আমি তো মরে যেতে চাইনি। কখনো এইরকম ইচ্ছেও হয়নি। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে তুই মরে যাওয়ার কথা বলছিস সারা। আমি তো জানতাম আমার প্রিয় বান্ধুবী হেরে যাওয়ার মতো মেয়ে নয়। আমরা এক গোল চক্রের মধ্যে বাস করি সারা৷ এটা এমন গাভীর একটা চক্র, যেখান থেকে নিজের ইচ্ছেতে বের হওয়া যায় না। আবার একেবারে শান্তিতে থাকাও যায় না। শেষ আর শুরুর মাঝেও একটা পথ আছে সারা। সেটা হলো লড়াই। এই চক্রে লড়াই করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। মনে রাখিস, নিজ ইচ্ছায় শান্তিতে থাকাও যায় না, আবার নিজ ইচ্ছায় এই গোল চক্র ত্যাগ করাও যায় না৷ কারণ এই দু'টো স্রষ্টার হাতে। তবে মাঝের যে লড়াই শব্দটা আছে, এটা তোর হাতে। স্রষ্টা তোকে লড়াই করার শক্তি দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তোর হয়ে তিনি লড়াই করে দিবেন না। লড়াই তোকেই করতে হবে। কিছুদিন আগে একটা বই পড়েছিলাম। সেখান একজন শিক্ষক প্রশ্ন করেছিল " আল্লাহ যদি আগে থেকেই জেনে থাকেন কে জান্নাতে যাবে, আর কে জাহান্নামে যাবে৷ তাহলে শুধু শুধু পৃথিবীতে এত দীর্ঘ সময়ের জন্য মানুষজন পাঠাচ্ছেন কেন? যে জান্নাতে যাবে, তাকে সরাসরি জান্নাতে দিয়ে দিলেই হয়। আর যে জাহান্নামে যাবে, তাকে সরাসরি জাহান্নামে। তখন একজন ছাত্র বলেছিল, স্যার আমাদের ক্লাসে দশ জনের মতো খুব ভালো ছাত্র আছে, তাই না? এবং আপনি কনফার্ম জানেন ওই দশজন এক্সামে খুব ভালো রেজাল্ট করবে। তাই না? স্যার উত্তরে বলেছিল, " অবশ্যই জানি।" স্যার ওই দশজনের নাম-ও বলেছিল। এবার ওই ছাত্র বলেছিল, ‘স্যার, আপনি যেহেতু কনফার্ম এরা খুব ভালো রেজাল্ট করবে। তাহলে শুধুশুধু এদের পরিক্ষা নিবেন কেন? সরাসরি এদের রেজাল্ট দিয়ে দিন।’

স্যার তখন বলেছিল - সে কী করে হয়? সবাই তো আর একই নম্বর পাবে না। কেউ একটু বেশি তো কেউ একটু কম। আমি যদি ওদের পরিক্ষা না নেই, তাহলে বুঝবো কীভাবে, কে বেশি ভালো রেজাল্ট করছে, আর কে একটু কম রেজাল্ট করেছে।" ছাত্র তখন মুচকি হাসি দিয়ে বলেছিল - " তাহলে এই ক্ষেত্রে ভিন্ন হবে কেন স্যার? রেজাল্ট এ যেমন কমবেশি আছে, তেমনি জান্নাত- জাহান্নামেও কম বেশি আছে। আমরা পৃথিবীতে এসেছি একটা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। এই প্রতিযোগিতায় যার পারফর্মেন্স যেমন হবে, আল্লাহ তাকে ঠিক তেমনই ফলাফল দিবেন স্যার। (প্যারাডক্সিকাল সাজিদ)

অতঃপর স্যার সত্যিটা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। আর আমার বিশ্বাস তুইও একদিন উপলব্ধি করতে পারবি সারা। আল্লাহ আমাদের পরিক্ষা নিচ্ছেন। আর এই পরিক্ষায় তোর পারফর্মেন্সই বলে দিবে তোর পরিনতি। আমি শুধু এটাই বলব তুই ধৈর্য সহকারে আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। এবং নিজের মতো করে লড়াই করে সামনে এগিয়ে চল। যেমনটা আমি করছি প্রতি মুহূর্ত।

সারা মিথিলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। মিথিলার চোখেও জল এসে গেছে৷ কিন্তু ও নিজেকে সামলানোর যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছে। পাশ থেকে অধরা সারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল - মিথিলা ঠিকই বলছে সারা। তুই সায়েমকে ভুল না বুঝে ওকে সাপোর্ট কর। ঠাণ্ডা মাথায় চলতে হবে তোদের। তোদের ভুল সিদ্ধান্ত অনেকগুলো জীবন নষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ঠ। আর রাফার কথা কী বলব। আমি বুঝতে পারছি ও আবেগের বশে এইরকম কাজ করেছে। যেদিন বুঝতে পারবে জোর করে কাউকে পাওয়া যায় না, সেদিন এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। বাস্তবতা বুঝতে শিখবে। আর ঠিকমতো নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া কর। আমরা চাই আমাদের ফ্রেন্ড সবসময় যেন হাসিখুশি থাকে।

সারা চোখ মুছতে মুছতে বলল - তোরা আমার ফ্রেন্ড না-রে। তোরা আমার কলিজা৷ আমার হৃদস্পন্দন এর সাথে মিশে আছিস তোরা। আমার সৌভাগ্য যে, তোদের কে পাশে পেয়েছি আমি। তোদের মতো সাপোর্টার, আর সানির মতো একজন মানুষ। যে কি-না শত খারাপ পরিস্থিতিতেও আমাদের মন ভালো করে দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আমাদের এই বন্ধুত্বের পথচলা যেন সারাজীবন অটুট থাকে৷ তবে সানি হারামিটাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই, কখন আবার কোথায় লাপাত্তা হয়ে যায় কে জানে। সারাক্ষণ তো একি ধান্দায় থাকে, কখন কার সাথে মজা করবে৷ কখন কাকে প্রপোজ করবে। কখন কার ইজ্জতভ্রষ্ট করে দিবে।

সারার কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো অধরা আর মিথিলা। সারা নিজেও হেসে দিলো।

(চলবে...)

আরো পড়ুন ১২তম পর্ব- ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড