• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৪ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধারাবাহিক গল্প : এক পলকের একটু দেখায় (প্রথম পর্ব)

  সাবিকুন নাহার নিপা

২৮ অক্টোবর ২০১৯, ১৮:০৯
গল্প
ছবি : প্রতীকী

তাওসিফ ট্রেনে বসতেই টের পেল তার ক্ষুধায় পেট জ্বলছে। ব্যাগটা রেখে বাইরে গেল খাবার আনতে। দুটো বার্গার, একটা স্যান্ডউইচ আর কোক নিয়ে ফিরে আসতে সর্বমোট সময় লাগল ২০ মিনিট। এসে সিটে বসতেই দেখতে পেল সামনের সিটে মাথা রেখে একটা মেয়ে ঘুমাচ্ছে। সে অবাক হলো, মেয়েটা আসলো কখন আর ঘুমালো বা কখন। ট্রেন চলতে শুরু করলেই মেয়েটা উঠে গেল। এক পলক তাওসিফকে দেখে পাশে রাখা ব্যাগটা হাতড়ে পানির বোতল বের করে পানি খেতে লাগল।

আড়চোখে কিছুক্ষণ মেয়েটাকে দেখল তাওসিফ। মেয়েটা একমনে বাইরে তাকিয়ে আছে। ওর একবার ইচ্ছে করল মেয়েটার সাথে গল্প করতে কিন্তু মেয়েটা পাত্তা দিচ্ছে না বলে সাহসটুকু পাচ্ছে না। গত দশ দিন ধরে লুকিয়ে একা থেকেছে বলে কথা বলারও কোনো মানুষ পায়নি। সৈকত টারও আবার ফোন বন্ধ। আমেরিকায় যাওয়ার আগে কি একবার সৈকতের সাথে দেখা হবে না!

পকেট থেকে ফোন বের করে সৈকতের নম্বরে বার দুয়েক চেষ্টা করে ফোনটা অফ করে রাখল। ইচ্ছে করছে ফোনটা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলতে। বিয়ের দিন পালিয়ে আসার পর সৈকতকে তো ও জানিয়েছিল আমেরিকা যাওয়ার কথা তবুও ও ব্যাপারটা আমলে নিল না।

বিরক্তিতে মনটা বিষিয়ে গেল। পেটের খিদেটাও মরে গেছে এতক্ষণে। ফোনটা আবারও হাতে নিয়ে সৈকতকে লিখল, ‘আমার সাথে যোগাযোগ কেন করছিস না? সব ঠিক আছে তো?’ মেসেজ সেন্ট করে ফোনটা পকেটে রেখে চোখ বন্ধ করল তাওসিফ।

ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সেটা তাওসিফের মনে নেই। ঘুমানোর আগে টাইম দেখেনি। ঘুম যখন ভাঙল তখন ট্রেন একটা স্টেশনে। হকারদের চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙেছে। ঘুম ভাঙতেই পেটের খিদে টের পেল আবারও। দুটো বার্গার গপ গপ করে গিলে পানি খেয়ে সামনের দিকে তাকাতেই দেখল মেয়েটা নেই।

তাওসিফ ভাবল মেয়েটা হয়তো নেমে গেছে। কিন্তু ট্রেন চলতেই দেখতে পেল মেয়েটা ভিড় ঠেলে আসছে। মেয়েটার পরনে এখন শাড়ি। ঘুমিয়ে পড়ার আগেও মেয়েটাকে সালোয়ার কামিজ পরা দেখেছে। শাড়ি পরার পর মেয়েটাকে দেখতে একদম অন্যরকম মনে হচ্ছে। তাওসিফ মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, - আপনি কি রাতের খাবার খেয়েছেন? মেয়েটা চমকে ডান বামে তাকাল। তারপর তাওসিফের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, - না। মেয়েটার কণ্ঠস্বর শুনে তাওসিফ চমকে গেল। কি মিষ্টি গলা! এই মেয়ে কি গান গাইতে পারে! তাওসিফ আবারও বলল, - আমার সাথে খাবার আছে। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে খেতে পারেন? মেয়েটা এবারে হেসে মাথা নেড়ে না বলল।

তাওসিফের একটু রাগ হলো। একে তো আগ বাড়িয়ে কথা বলেছে তার ওপর মেয়েটা কি না ওর সাথে ভাব দেখাল! বিক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে আবারও ঘুমের ভান করল।

হঠাৎই কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তাওসিফ দেখল মেয়েটা কাঁদছে। ফুপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। প্রথমে তাওসিফ কিছু বলল না। পরে কৌতূহল দমন না করে জিজ্ঞেস করল, - আপনি কি কোনো সমস্যায় পড়েছেন? মেয়েটা চোখ মুছে মুখে হাসির রেখা টেনে বলল, - না তো! তাওসিফ কি বলবে খুঁজে পেল না। তবে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল মেয়েটার ইগ্নোর করা দেখে। কি দরকার ছিল আগ বাড়িয়ে কথা বলা! এবার মেয়েটা তাওসিফ কে জিজ্ঞেস করল, - আচ্ছা ট্রেন পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে? - মনে হয় সাড়ে ১১টা বেজে যাবে। - ওহ। - আপনি কোথায় যাবেন? - ঢাকায়। - সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু কোথায় যাবেন? - এয়ারপোর্টে। - আমিও তো ওইদিকে যাব। - আচ্ছা। এইটুকু বলার পর মেয়েটা চুপ করে থাকল। তাওসিফ আবারও জিজ্ঞেস করল, - আপনার বাড়ি কি সিলেটে? - হ্যাঁ। আপনার? তাওসিফ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, - আমারও। মেয়েটা একটু হাসল। আবার আগের মতোই চুপ করে রইল। তাওসিফ ও এবার বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।

মাঝরাতে সৈকতের ঘুম ভাঙল। হাতড়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল বন্ধ হয়ে আছে। মনে হয় চার্জ শেষ। ইমিডিয়েটলি এটা চার্জে লাগাতে হবে। তাওসিফকে ফোন করতে হবে। যে করেই হোক ওর আমেরিকা যাওয়া বন্ধ করতে হবে। এর মধ্যে নার্স কেবিনে ঢুকতেই সৈকত অনুনয় করে বলল, - প্লিজ ম্যাম আপনি কি আপনার ফোনটা দেবেন? নার্স সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, - আপনার শরীর এখন কেমন? পায়ের ব্যথা কি আছে? সৈকত খুব বিরক্ত হয়ে গেল। আবারও মোবাইলের কথা বলতেই নার্স বলল, - গার্লফ্রেন্ড বুঝি? সৈকত কিছু না বলে তাওসিফের নম্বরে ফোন দিল। প্রথমবার ফোন রিসিভ করল না তাওসিফ। দ্বিতীয় বারে কল কেটে ফোন বন্ধ করে রাখল। সৈকত মেসেজ দিল। কিন্তু তাও কোনো রেসপন্স নেই। নার্স আবার জিজ্ঞেস করল, - আপনার গার্লফ্রেন্ড এর বুঝি খুব রাগ? সৈকত ক্লান্ত গলায় বলল, - আমার ঘুমের দরকার। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।

সৈকত চোখ বন্ধ করেই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুই ভুল করছিস ভাই। ভুল করছিস।

প্ল্যাটফর্মে নেমেই তাওসিফ ফোনটা ফেলে দিল। শেষ মুহূর্তে যদি এই ফোনের জন্য যদি বাবা ধরে ফেলে তাহলে এতদিনের সব কষ্টই বৃথা।

এয়ারপোর্টে এসে ভিতরে ঢুকতে যাওয়ার সময় আবারও মেয়েটার সাথে দেখা হলো তাওসিফের। তাওসিফ অবাক হওয়ার ভান করে বলল, - আপনি এখানে? মেয়েটা স্বভাবসুলভ হেসে বলল, হ্যাঁ । আপনিও তো এখানে। - আমার ফ্লাইট ১টা বেজে ১৫ মিনিটে। আপনার? মেয়েটা সে কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, - পড়াশোনার জন্য যাওয়া? - হ্যাঁ। ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশনে ডিপ্লোমা করতে যাচ্ছি। - ওহ। - চা খাবেন? - নাহ। - আপনি তো কিছু খেলেনই না। মেয়েটা সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, - আচ্ছা আমি যাই কেমন! - আচ্ছা। আপনার কি কেউ আসবে? - হ্যাঁ। বেখেয়ালিভাবে তাওসিফ জিজ্ঞেস করে ফেলল, - কে আসবে? মেয়েটা স্বাভাবিক গলায় বলল, - আমার মায়ের লাশ আনা হচ্ছে।

মেয়েটা চলে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ বসে রইল তাওসিফ। মেয়েটার মা মারা গেছে অথচ কি স্বাভাবিকভাবেই না কথা বলছে! এই জন্যই বোধ হয় মেয়েটা কাঁদছিল।

তাওসিফের বুকের ভিতর এক সূক্ষ্ম ব্যথা এসে ভর করল। আজ দশদিন ধরে নিজের ফ্যামিলি থেকে পালিয়ে বেরাচ্ছে। আচ্ছা ওর মা এখন কী করছে? কাঁদছে না কি ওর ওপর রেগে আছে! রাগ থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ ও যা করেছে সেটা ক্ষমার অযোগ্য। বিয়ে না করে সব টাকা নিয়ে পালিয়ে এসেছে আমেরিকা যাওয়ার জন্য। এছাড়া আর কোনো পথ ছিল না ওর কাছে। বাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না আর ও প্রতিজ্ঞা করেছে যে করেই হোক স্বপ্নপূরন করতে হবে। আর এর মধ্যে মা ও তার বান্ধবীর মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করল। তাওসিফ তবুও চেয়েছিল বিয়ে করতে। কিন্তু বিয়ের সপ্তাহ খানেক আগে জানতে পারে যে মেয়েটার পায়ে সমস্যা আছে। তখন খুব রেগে গিয়েছিল। তখনই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে বাবা মাকে শিক্ষা দেবে আর সেই সাথে মেয়েটাকেও শিক্ষা দেবে। কি করে মেয়েটার সাহস হলো নিজের দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও তাওসিফ অনুভব কে বিয়ে করার! - স্যরি আমি আমার পার্স টা রেখে গিয়েছিলাম।

ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে দেখল মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। তাওসিফ কিছু বলল না। মেয়েটা চলে আসার সময় তাওসিফ ডেকে বলল, - মিস আপনার নামটা তো জানা হলো না! মেয়েটা পিছু ফিরে তাকিয়ে বলল, - কানেকশন যখন হলো তখন দেখা তো হবেই। এরপর যেদিন দেখা হবে সেদিন না হয় নাম বললাম!

তাওসিফ আর কথা বাড়াল না। ও এখন নতুন স্বপ্নে বিভোর। আর কয়েক ঘণ্টা পর স্বপ্নের পথে যাত্রা শুরু করবে তারপর আর পিছু তাকাতে হবে না।

তাওসিফ এগিয়ে গেল। একবারও পিছনে দেখল না। তাকালে দেখতে পেত কেউ একজন পলকহীন চোখে ওকে দেখছে।

রাত দুটো বেজে যাওয়ার পরও প্রমার চোখে ঘুম নেই। আজ সারাদিন ফোনটা বন্ধ রেখেছিল। ফোনটা খুলতেই মেহের ফোন করল। ফোন ধরতেই মেহের চিৎকার করে বলল, - তোর কি হয়েছে? ফোন কেন বন্ধ রেখেছিস? প্রমা ঠান্ডা গলায় বলল, তুই জানিস না! - দেখ প্রমা ওসব ভুলে যা। লাইফে মুভ অন করতে হবে তো! - হ্যাঁ তা তো হবেই। - তাহলে ওসব ভুলে যা। লাইফ টাকে এখন আবার নতুন করে শুরু কর। - করব। কিন্তু তার আগে তাওসিফ অনুভবের মুখোমুখি হওয়া দরকার। - তুই ঠিক কি করতে চাইছিস? - আপাতত আমার প্রথম ও প্রধান কাজ তাওসিফ কে খুঁজে বের করা। মেহের কিছু বলতে গেলেও প্রমা শুনলো না। ফোন কেটে দিয়ে বিরবির করে বলল, - তোমার সময় শুরু হচ্ছে তাওসিফ অনুভব। প্রমা চৌধুরীর চোখের জল যে সস্তা নয় সেটা এবার তোমাকে বুঝতে হবে।

চলবে.....

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড