কমল উদ্দিন
মোরগের ডাক শুনে ঘুম ভাঙলো সালমা বেগমের। কিছুসময় বিছানার উপর থম মেরে বসে রইলেন। মোরগ ডাকছে তো ডাকছেই। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই ডাক শুনছেন সালমা বেগম। কতদিন যেন মোরগের ডাকের সুমধুর ধ্বনি তিনি শোনেনি। কতদিন পর মোরগের ডাকে তার ঘুম ভাঙলো মনে করার চেষ্টা করলেন। মনে করতে পারলেন না। তিনি তো ধরেই নিয়েছিলেন যে মোরগগুলো হয়তো মানুষের উপর অভিমান করে ভোরবেলা উচ্চস্বরে ডাকা বন্ধ করে দিয়েছে। মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজানের সুমধুর ধ্বনি আর মোরগের ডাক শুনে ঘুম ভাঙতো মানুষের।
বাড়ির পুরুষেরা ওযু করে মসজিদে চলে যেতেন আর মহিলারা জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়তেন, সূর্যোদয় পর্যন্ত সুললিত কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। ছোটমণিদের ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন, পরিপাটি করে মক্তবে পাঠাতেন কুরআন শিখতে। তারপর শুরু করতেন ঘরকন্না। এখন মানুষ ধর্মীয় বিষয়গুলো তেমন গ্রাহ্য করে না। দুনিয়ার প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে গেছে সবাই। এজন্য বোধহয় সব মোরগ মানুষের প্রতি নারাজ হয়েছে। ধর্মঘট করেছে। ভোরবেলা ডাকা বন্ধ করেছে। মানুষেরা ইচ্ছা করলেই তো ধর্মঘট করতে পারে না। তাই মসজিদে আজান বন্ধ হয়নি। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হয় মহান রবের নাম— আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার।
সালমা বেগম মন ভরে মোরগের ডাক শুনে নিলেন। আস্তে আস্তে চৌকি থেকে নেমে ওযু করে পাক-পবিত্র হয়ে ফজরের নামাজ শেষে দোয়া-দরুদ পড়লেন। প্রতিদিন সূর্যোদয় অবধি কুরআন পড়েন। আজ কুরআন পড়তে ইচ্ছা হলো না তাঁর। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। বেশ কিছুদিন ধরে সর্দি-জ্বরে ভুগছেন। তাই আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। খানিক সময় ঘুমাবেন।
ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুম হলো না সালমা বেগমের। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় বসলেন। বারান্দার সামনে ছোট পরিসরের উঠোন। তারপর ছোট্ট একটা পুকুর। পুকুরের কোল ঘেঁষে বড় একটা আমগাছ। আমগাছটা দাঁড়িয়ে আছে এ বাড়ির বহু স্মৃতির সাক্ষী হয়ে। গাছটাতে প্রচুর আম হয়। আম বিক্রি করে সালমা বেগম সংসারের খরচাপাতি চালাতে পারেন। তবে তিনি এটাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেন না। আমের সময় ছেলেমেয়েরা এসে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে যায়। এতে সালমা বেগম অখুশি হন না। বরং নিজেই ছেলেমেয়েদের খবর দিয়ে আমসহ অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে যেতে বলেন। নিজের জন্য যা রাখেন তার অধিকাংশই প্রতিবেশীদের মাঝে বিলিয়ে দেন।
অনেকেই আম কিনতে এসে কেনা আমের বাইরেও কিছু আম সালমা বেগমের কাছ থেকে বিনামূল্যে পায়। আমগাছের নিচেই পুরনো একটি টিউবওয়েল রয়েছে যা সালমা বেগমের পরিচর্যায় নতুনত্বের ছাপ লেগে থাকে সবসময়। টিউবওয়েল থেকে কিছুটা সরে এসে মোরগ-মুরগির ঘর। দুইটা কুকুর সেখানে ঘুমে বিভোর। সারারাত এ বাড়ি পাহারা দেয় তারা। সালমা বেগম শুধু নিজের জন্য নয়, তাদের জন্যও রান্না করেন। তাদেরকেও সে পরিবারের সদস্য মনে করেন। পরিবারের সদস্য মনে না করেও উপায় নেই। তাঁর তো থেকেও কেউ নেই। স্বামী মারা যাওয়ার পর সম্পূর্ণ একা হয়ে গেছেন। ছেলে ও মেয়েরা বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে থাকে। ছোট ছেলেটাকে সংসারের ভরণপোষণ যোগাতে ঘর ছাড়তে হয়েছে। এখন কুকুর দুইটা আর মোরগ-মুরগি গুলো নিয়ে তাঁর পরিবার। ওদেরকে সেবা করেই সুখানুভব করেন। 'জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর' কথাটির নিগূঢ় অর্থ তাঁর চরিত্রে ফুটে ওঠে।
উঠোনের ঠিক মাঝখানে কিছু ধান-চাল ছড়িয়ে দিলেন সালমা বেগম। মোরগ-মুরগিরা খাওয়ার যুদ্ধে নেমে গেল। বেশ কয়েকটি মোরগ-মুরগি কিনেছেন। দেখেশুনে একটা মোরগও কিনেছেন যেটা ভোরবেলা ডেকে ঘুম ভাঙাচ্ছে। মোরগটাকে নিষ্পলক কিছু সময় পর্যবেক্ষণ করলেন তিনি। মোরগ-মুরগির খাওয়ার প্রতিযোগিতা দেখেই তাঁর মন ভাল হয়ে গেল। অল্পতেই তাঁর মন ভালো হয়, রাজ্যের সব সুখ এসে ভর করে।
সালমা বেগমের একার সংসারে কাজকর্ম তেমন থাকার কথা নয়। রান্নাবান্নাসহ টুকিটাকি কাজ সেরে সময় কাটান পড়শীদের বাড়িতে। গল্প করেন। স্বেচ্ছায় পড়শীদের টুকিটাকি কাজে সাহায্যও করেন। পড়শীদের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক রয়েছে। কারও নামে তিনি গীবত করেন না। এমনকি কারো পরনিন্দা শুনতেও পারেন না। তিনি বলে থাকেন, ‘আমার কাছে সবাই ভালো। কারও সাথে মনোমালিন্য হোক এটা আমি সহ্য করতে পারি না।’
বিকালের দিকে শরীরটা বেশ ভাল মনে হচ্ছে তাঁর। হালকা মনে হচ্ছে। জ্বরও কমে গেছে। তারপরও ডাক্তারের কাছে গেলেন। শরীর খারাপ হলে তাঁর দেখার কেউ নেই। তাই সামান্য অসুস্থ্যতাকেও অগ্রাহ্য করেন না।
সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে ফিরে ঘরে বাতি জ্বালালেন সালমা বেগম। ওযু করে মাগরিবের নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষেও উঠলেন না। তাঁর প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে কী যেন উঠে আসছে। বুকের বাঁপাশে চিনচিনে ব্যাথা উপলব্ধি করছেন। কেঁপে কেঁপে উঠছে পুরো শরীর। মনের মধ্যে অস্থিরতার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। শাড়ির আঁচলটা শক্ত করে মাথার উপরের বাঁশের সাথে বেঁধে ফেললেন। কাঠের টুলের উপর দাঁড়িয়ে গলায় ফাঁস জড়িয়ে বেঁধে নিলেন।
পায়ের নিচ থেকে টুলটা সরিয়ে দিলেই তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে যাবে। সারাদিনে ঘটে যাওয়া টুকরো স্মৃতিগুলো স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। প্রতিদিনের মতো আজো সারাদিন হাসি-খুশিতে কেটেছে। অকারণ কান্না পাচ্ছে কেন তাহলে? কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না। হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। কিছুক্ষণ কাঁদার পর তিনি হঠাৎ চমকে উঠলেন! কান্না পাচ্ছে না আর। একদম হালকা লাগছে। অথচ কান্নার আগে কী মস্ত বড় পাথরই না চেপে ছিল বুকের উপর! মনের কোণে কিছু অপ্রাপ্তি আর একাকিত্ব এসে কালো মেঘ জমা করেছিল। সেই মেঘই বৃষ্টি হয়ে চোখ দিয়ে ঝরে পড়লো। মানুষের কষ্ট আর চোখের জলও যেন প্রকৃতির মেঘ আর বৃষ্টির মতো ফিরে ফিরে আসে।
তেমনি সালমা বেগমের জীবনের শূন্যতা, একাকিত্ব ফিরে ফিরে আসে, দুমড়ে-মুষড়ে দিয়ে যায় তাকে। যা কোনো মানব সন্তানকে তিনি জানতে দেননা, কেউ জানতেও চায় না। লুকিয়ে রাখে নিজের মধ্যে। প্রত্যেকেরই কিছু অপ্রাপ্তির করুণ প্রাপ্তি আছে যা আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। ভালো থাকার অভিনয় করে বাঁচতে হয়। সালমা বেগমও একাকিত্ব আর অপ্রাপ্তি নিয়ে বাঁচতে চান। মরতে চান না।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড