• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৩ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ (১২তম পর্ব)

  রিফাত হোসেন

২৮ অক্টোবর ২০১৯, ১৬:৪৩
গল্প
ছবি : প্রতীকী

সারাকে দেখে সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইতি আর সায়েম, একে অপরের দিকে নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। যেন দু’জনেই কাঁদোকাঁদো স্বরে বলতে চাইছে, ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়।’

কিন্তু না! কথাটা কেউ কাউকে বলল না। মনের মধ্যেই গোপনে যত্ন করে রেখে দিলো। পরে হয়তো কাজে লাগাবে৷ আচ্ছা, কথা কী গোপনে যত্ন করে রাখার জিনিস? অবশ্যই। কারণ কিছু কিছু কথা আছে, যা হুটহাট করে বলে দেওয়া যায় না। এতে কথার অপচয় হয়। সেগুলো স্বযত্নে রেখে দিতে হয়। যাতে করে সঠিক সময়ে কাজে লাগানো যায়। কিন্তু সারা? তার তো কৌতূহলের শেষ নেই। সে ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়েই আছে মেয়েটার দিকে। শুধু তাকিয়েই থেমে যায়নি। সে মনে মনে গভীর ভাবনায় ডুবে আছে।

- কে এই মেয়ে? হঠাৎ কোত্থেকে উড়ে এলো? তাও আবার সায়েমের কাছে। বিশেষ কোনো ব্যক্তি? হাবভাব দেখে তো মনে হচ্ছে পাক্কা গিন্নী। অথচ সাইজ দেখে মনে হচ্ছে ছোট্ট বাচ্চা। তবে স্টাইল টা দারুণ মেয়েটার। কেমন মায়াময়ী চাহনিতে তাকিয়ে আছে সায়েমের চোখের দিকে। আড়চোখে আবার আমাকেও দেখেছে। তার চোখেমুখে অবশ্য কৌতূহলের ছিটেফোঁটা-ও নেই। মনে হচ্ছে অপ্রকাশিত ভাবে মিটমিট করে হাসছে। এ হাসি সাংঘাতিক রহস্যময়। মানুষ প্রেমে পড়লে ঠিক এভাবেই হাসে। আচ্ছা, মেয়েটা-ও কী কারোর প্রেমে পড়েছে? কিন্তু কার? সায়েমের!

সারা মনে মনে এইসব ভাবছিল। কিন্তু শেষের কথাটা নিজের অজান্তেই বলে ফেলেছে ও। একপ্রকার ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কথাটা বের হয়ে গেছে। সারা নিজের মাথায় টোকা দিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘ছি. সারা ছি! তোর ভাবনাচিন্তা কী এ জীবনে আর পজিটিভ হবে না? সবসময় কী নেগেটিভই থাকবে? এই নেগেটিভ চিন্তাভাবনার জন্যই তুই জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছিস। কিন্তু আর না। সায়েমকে হারাতে দিস না কোনোভাবেই। তোর নেগেটিভ চিন্তাভাবনার জন্য তো একেবারেই না।’স

সারা বিড়বিড় করতে করতে সিড়ির বাকি স্টেপ গুলো পেরিয়ে রাফার পাশে এসে দাঁড়ালো। রাফা তখন পুরোপুরি ঘুরে সারার দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি। যেকোনো যুবক এই হাসির প্রেমে পড়ে যাবে। ইচ্ছে করে না পড়লেও বাধ্য হবে প্রেমে পড়তে। - আচ্ছা সায়েম-ও কী এই হাসির প্রেমে পড়ে গেছে? ও তো একটা যুবক ছেলে। আর মেয়েটাও যুবতী। প্রেমে পড়া অসম্ভব কিছু না। তার উপর সায়েমকে বাধ্য করার জন্য এই হাসি তো আছেই।

সারা পূনরায় নেগেটিভ কিছু ভাবছে। যা মোটেও ভালো লক্ষ্মণ নয়। গুরুজনেরা বলে থাকেন, মানুষ যখন সারাক্ষণ খারাপ কিছু চিন্তা করে, দিনশেষে তার সাথে ঠিক সেই খারাপ কিছুই ঘটে। অবশ্য এখন সকাল। খারাপ কিছু ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু রিস্ক নেওয়া যাবে না। তাই সারা এবার কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল - একদম এভাবে হাসবে না। তোমার এই হাসির জন্য অন্যের কপাল পুড়তে পারে। তাই হাসিটা থামাও তাড়াতাড়ি। আর বল কে তুমি?

সারার কথা শুনে রাফা হাসিটা থামিয়ে দিলো। সারা ভেবেছিল মেয়েটা পাল্টা প্রশ্ন করবে - একটা হাসির জন্য কীভাবে অন্যের কপাল পুড়বে? হাসিতে কী আগুন থাকে?

কিন্তু না। মেয়েটা এইরকম কোনো প্রশ্নই করল না। উল্টো সারার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে মেয়েটা হনহনিয়ে ঘরের ভিতরে চলে গেল। সারা মনে মনে বলল- হুট করে তুমি করে বললাম বলে কী রাগ করল মেয়েটা?

প্রশ্নটা রাফাকে সরাসরি করার জন্য সারা ঘরের ভিতরে এলো। রাফা তখন ইতির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সারা ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল- প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চলে এলে কেন? তুমি করে বলাতে কী রাগ করেছ? প্লিজ রাগ করো না। আসলে প্রথমে আপনি করেই বলেছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম তুমি আমার বয়সে এবং হাইটে ছোট। তাই পরেরবার তুমি করে বলে ফেললাম। আমি আবার ইতির মতো না। যে একদিনের ছোট-বড় যাই হোক, তাকে আপনি করে বলব।

এইটুকু বলে সারা থেমে গেল। রাফা আবারও হাসি দিলো। সারা কিছুটা পিছনে ঘুরে সায়েমকে দেখে নিলো একবার। সায়েম ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। সারার খুব ভয় হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে, এই বুঝি সায়েম মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেল। কিন্তু না। সায়েম প্রেমে পড়ছে না। সে হয়তো বিরক্ত হচ্ছে। যা ওর চোখমুখের অবস্থা দেখেই স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে।

তাই সারা আর কোনো ভনিতা না করে কড়া গলায় বলল- চুপ করে আছ কেন? বল কে তুমি? সায়েম আর ইতির সাথে কী সম্পর্ক তোমার?

সারার রাগান্বিত কণ্ঠস্বর শুনে রাফা হকচকিয়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো। ওকে এখন থেকে অনেক কিছুই সামলাতে হবে। তাই সাধারণ একটা কথাকে অসাধারণ ভাবে নিয়ে ভয় পাওয়ার কোনো মানেই হয় না। রাফার খোলা চুলগুলো চোখের সামনে এসে গেছে। তাই হাত দিয়ে চোখের কাছ থেকে চুলগুলো সরিয়ে নিয়ে বলল - তার আগে বলুন আপনি কে?"

সারা বেশ অবাক হলো। বাইরের একটা মেয়ে এসে ওকে বলছে, ‘আপনি কে।’ এত বড় সাহস! বিষয়টি সারার কাছে অপমানজনক ও বটে। সারার ইচ্ছে করছিল মেয়েটাকে "আচ্ছা" করে ধমক দিতে। কিন্তু ইতি এগিয়ে আসছে দেখে সারা কিছু বলল না। ইতি সারার পাশে এসে বলল, ‘তুমি ওকে চিনবে না আপু। ও ভাইয়ার বন্ধু, ফাহাদ ভাইয়ার বোন। এমনিই একটু দেখা করতে এসেছে।’

ইতির কথা শুনে সারা ভ্রু-কুঁচকে তাকালো। সায়েম হতভম্ব হয়ে মাথায় হাত দিলো। রাফা এবার জোরে জোরে হাসতে লাগল। ইতি বুঝতে পারছে না ওর কথা শুনে হঠাৎ করে সবার রিয়েকশন এইরকম হয়ে গেল কেন? তবে ওর চিন্তা হচ্ছে খুব৷ খুব চিন্তা। বারবার মনে হচ্ছে, কথাটার মধ্যে কোনো গণ্ডগোল আছে। নাহলে সবার চোখ-মুখের অবস্থা এভাবে পরিবর্তন হয়ে যেতো না। ইতি ভাবতে লাগল কথাটার মধ্যে কী গণ্ডগোল আছে৷ কিন্তু না, কোনোভাবেই ভেবে বের করতে পারল না। কথাটা বলে ও কোনো অপরাধ ও করে ফেলেনি। তার মানে সবার অদ্ভুত রিয়েকশন অর্থহীন।

ইতি আবার কিছু বলতে যেতেও থেমে গেল সারার নড়েচড়ে দাঁড়ানো দেখে। সারা তড়িঘড়ি করে সায়েমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এরপর বলল - এটাই কী সেই মেয়ে? যে সেদিন বসের রুমে আপনাকে জড়িয়ে ধরেছিল? ওইযে আমাকে বললেন মেয়েটা ফাহাদের বোন। আপনাকে পছন্দ করে। সবসময় পাগলামি করে। একটা সাইকো।

রাফা দাঁত কিড়মিড় করে তাকালো। সায়েমের ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যেতে। ইতি নিজের কথার গণ্ডগোলটা বুঝতে পারল এতক্ষণে। ভয়ে ভয়ে তাকালো সায়েমের দিকে। যেব খুব বড় অপরাধ করে ফেলেছে। অবশ্য ওটাকে অপরাধই বলা যায়৷ কারণ সায়েম ওকে আগেই বলেছিল সারা জানে ফাহাদের বোন ওকে পছন্দ করে। এবং সেদিনের জড়িয়ে ধরা মেয়েটি ফাহাদের বোনই ছিল।

হঠাৎ রাফার কথা শুনে ভাবনা থেমে গেল সবাই। রাফা বলল - আমার স্বামীর বাড়িতে আমি তো আসবোই। কিন্তু মিস সারা, আপনি এখানে কী করছেন? দেখে তো মনে হচ্ছে অফিসে যাচ্ছিলেন। তো যান না অফিসে।

সারা চোখ পাকিয়ে তাকালো সায়েমের দিকে। কিন্তু না, সায়েম কিছু বলল না। ও মাথা নিচু করে আছে। সারা চোখে গরম আবেশ নিয়ে এলো। রাফাকে ভয় দেখানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ও। সারা ভাবছে, ‘মেয়েটা খুব সেয়ানা। কায়দা করে মজা করতে শিখেছে। তবে আমিও নাছোড়বান্দা। ওর মতো মেয়েকে খুব ভালো করেই শায়েস্তা করতে পারি আমি।’

মেয়েটার উপর এমনিতেই রাগ ছিল সারার৷ কারণ মেয়েটা ওর অধিকারে ভাগ বসাতে এসেছিল। সারা সবসময় চাইতো, ওর আর সায়েমের বিয়ে হলে প্রথমে সায়েমের বুকে মাথা রাখবে ও৷ কিন্তু ওদের বিয়ের আগেই অন্য একটা মেয়ে হুট করে সায়েমকে জড়িয়ে ধরেছিল। যা দেখে সারা কষ্ট পেয়েছিল। রাগ-ও হয়েছিল অনেকটা। সেই রাগ আজকেই মেটাবে সারা। তাই সারা চোখে রাগান্বিত একটা ভাব এনে বলল, ‘বড়দের সাথে মজা করতে তো ভালোই শিখেছ৷ কিন্তু এটাও জেনে রাখা ভালো যে, সবাই তোমার মজা করাটাকে সহ্য করবে না। যেমন আমি। আমি আসলে তোমাকেই সহ্য করতে পারছি না। এর কারণটা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারছি না এখন। তবে কোনো একদিন প্রাকটিক্যালি দেখিয়ে দিবো।’

রাফা হেসে দিয়ে বলল, ‘অনেক তো বললে মিস সারা আপু। এবার তো থেমে যাও প্লিজ। তুমি বরং নিজের কাজে যাও। আমাকে আমার সংসারটা গুছিয়ে নিতে দাও।’

- এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে মেয়ে। আমার রাগ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা-ও নেই। আর কীসের সংসারের কথা বলছ তুমি?

- স্বামী-স্ত্রী মিলে যে সংসার হয়, আমি সেই সংসারের কথাই বলছি। আর আমাকে মেয়ে মেয়ে বলে ডেকো না। তুমি সম্ভবত সায়েমকে ভাই বলে ডাকো, তাই না? সেক্ষেত্রে আমাকে ভাবী বলে ডাকতে পারো।

সারা স্তব্ধ হয়ে গেল রাফার কথা শুনে। ও বুঝতে পারছে না এইসব কী হচ্ছে। সায়েমের চুপ করে থাকা ওকে আরো ভাবাচ্ছে। রাফার কথা কতটা সত্যি, সেটা শুধুমাত্র সায়েমই সঠিক করে বলতে পারবে। তাই সারা সায়েমকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ও এইসব কী বলছে সায়েম? আপনারা নাকি স্বামী-স্ত্রী? এটা কী সত্যি? কিন্তু কীভাবে সম্ভব?’

সায়েম নিজেকে সামলিয়ে মনের মধ্যে একটু দৃঢ়তা আনলো। এমন একটা ভাব ধরল, যেন হঠাৎ করে ওর হুশ জ্ঞান ফিরে এসেছে। কিন্তু সারার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না সায়েম। রাফার কাছে গিয়ে বলল, ‘এবার চুপ করো রাফা। তোমার বকবকানি অনেক শুনেছি। তোমাকে আগেও বলেছি, আর এখনো বলছি, আমি তোমাকে কখনোই মেনে নিতে পারবো না৷ কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি না। তোমার সব কথা আমার কাছে অর্থহীন। কালকের ঘটনাটা আমার জন্য একটা দূর্ঘটনা। যা একটু পরেই আমি ভুলে যাবো। এই সম্পর্ক টিকবার নয়৷ এইটুকু বুঝার ক্ষমতা নিশ্চয়ই তোমার মধ্যে আছে, যে সব সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার পিছনে একটা উদ্দেশ্য থাকে। কেউ কেউ সংসার করার উদ্দেশ্যে একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে সারাজীবন। কেউ কেউ আবার দায়িত্ববোধের উদ্দেশ্যে একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে। কিন্তু তোমার আর আমার সম্পর্কের কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমি সারাকে ভালোবাসি। আমি ইতিকেও ভালোবাসি৷ সারার আর আমার সম্পর্কের একটা উদ্দেশ্য আছে। তা হলো আমরা একসাথে সারাজীবন থাকতে চাই। আমরা সংসার করতে চাই। আর ইতি আমার বোন৷ ছোট থেকেই ওর সাপোর্টার হয়ে আমি আছি৷ আমাদের এই ভাই-বোনের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্য একটাই, তা হলো দায়িত্ববোধ, আর ভালোবাসা। ওর প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। এবং আমার প্রতি ওর-ও একটা দায়িত্ব আছে। কিন্তু তোমার প্রতি আমার না আছে ভালোবাসা, আর না আছে কোনো দায়িত্ব। তুমি আমার বন্ধুর বোন৷ আমিও বোনের চোখে দেখি তোমাকে। জাস্ট এইটুকুই। এখানে কোনো ভালোবাসা নেই। আর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কোনো উদ্দেশ্য-ও নেই। তোমার প্রতি আমার শুধুই ঘৃণা আছে৷ কারণ তুমি জঘন্য একটা অপরাধ করেছ। আমাকে ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে, আমার জীবনটা অন্ধকারে নিয়ে গিয়েছে তুমি।’

রাফার চোখে জল। সারা চোখেও জল। তবে দু'জনের চোখের জলের অর্থ ভিন্ন। শুধু ভিন্নই নয়, পুরো আকাশ-পাতাল ব্যবধান। সারার চোখের সামনের সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। ও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে এতসব কিছুর অর্থ কী। কিন্তু রাফা কেন কাঁদছে? অপরাধবোধ থেকে? উঁহু, রাফা কাঁদছে কারণ সায়েম ওকে মেনে নিতে চাইছে না বলে। কিন্তু ও মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছে, এত সহজে হাল ছাড়া যাবে না। এইসব হওয়ারই ছিল। তাছাড়া ‘অদৃশ্য মানব’ তো বলেই দিয়েছে, একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। সায়েম বুঝতে পারবে মানুষের ইচ্ছের উর্ধ্বে হলো নিয়তি। যেখানে স্রষ্টা নিজেই নিয়তি ঠিক করে রেখেছেন, সেখানে ব্যক্তি কীভাবে নিয়তি পরিবর্তন করবে? সেই সাধ্য তো ব্যক্তির নেই৷

রাফা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ইতিকে বলল, ‘প্লিজ ইতি আপু, তুমি একটু সায়েমকে বুঝাও। দেখ, আমি যা করেছি শুধুমাত্র সায়েমকে ভালোবাসি বলেই করেছি। এখন সায়েম আমাকে দূরে ঢেলে দিতে পারে না।’

ইতি কিছু বলার আগেই সায়েম এগিয়ে এসে রাফার গালে একটা থাপ্পড় মেরে দিলো। রাফা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সায়েম একই জায়গায় দ্বিতীয়বারের মতো আঘাত করল। যা আসলেই যন্ত্রণাদায়ক৷ কিন্তু রাফা তা প্রকাশ করল না। নীরবে সহ্য করে মৃদু হাসি দিলো। সায়েমের কাছে এসে বলল, ‘তোমার এই স্পর্শের জন্যই তো এতদিন অপেক্ষা করে ছিলাম। যদিও স্পর্শটা যন্ত্রনাদায়ক। কিন্তু নো সমস্যা, আমি সামলে নিবো৷ ভালোবাসার সেই গভীর স্পর্শ পাওয়ার জন্য একটু যন্ত্রণা সহ্য করাই যায়, কী বলো মিস্টার সায়েম?’

সায়েম অবাক হয়ে তাকালো রাফার দিকে। এই মেয়ে দিনদিন নিজের নির্লজ্জতার সীমা অতিক্রম করছে। সায়েম চোখ দু'টো বাঁকা করে ইতির দিকে তাকালো। শরীরে হাই লেভেলের রাগ থাকা স্বত্ত্বেও ইতি মুচকি হাসি দিলো। সারা এইসব আর সহ্য করতে না পেরে চলে এলো সেখান থেকে। ওর কান্না পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। এখন বাড়িতে যাওয়া যাবে না। আর অফিসেও যাওয়া যাবে না। বসকে বলে আজকে ছুটি নিতে হবে।

সারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠল। রিকশাওয়ালাকে একটা ঠিকানা বলে দিলো। সবারই মন ভালো করার জন্য প্রিয় মানুষ, প্রিয় একটা স্থান, কিংবা একটা মাধ্যম থাকে। সারা-ও ঠিক সেরকমই একটা মাধ্যম নিজের উপর এপ্লাই করার জন্য যাচ্ছে। যদিও ও জানে না, আধো ও স্বাভাবিক হতে পারবে কিনা। কাছের একজন হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট কী এত সহজে ভুলা যায়? তবে কথায় আছে না, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়। সেরকমই প্রিয় মানুষকে হারানোর বেদনা প্রিয় মানুষকে দিয়েই ভুলতে হয়। তবে এক্ষেত্রেও কিছু ভিন্নতা আছে। সব কাঁটা যেমন এক থাকে না, তেমনি সব প্রিয় মানুষ-ও একরকম থাকে না।

এদিকে সায়েম রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে রাফার দিকে। রাফাকে যত অপমান করছে, কষ্ট দিচ্ছে, রাফা ঠিক ততটাই সহ্য করে যাচ্ছে সব। সায়েম জানে ওকে আরো নিষ্ঠুর হতে হবে। কিন্তু সেটা কী ওর পক্ষে আর সম্ভবত। নিষ্ঠুরতাময় সেই সায়েম তো কবেই হারিয়ে গেছে। সেই পুরোনো সায়েম হলে বহু আগেই সব পিছুটান ফেলে চলে যেতো একা একা। নিজের মতো করে লাইফটাকে ইনজয় করত। কিন্তু আজকের সায়েম সেটা পারছে না। আর পারবেও না। কারণ দায়িত্ববোধ নামক এক পিছুটান ওকে কাবু করে রেখছে। ও কারোর ছেলে, কারোর ভাই আর কারোর স্বামী। যদিও নিজেকে কারোর স্বামী বলে মানতে পারছে না সায়েম। দুঃস্বপ্ন বলে ভুলে যেতে চাইছে সব। সায়েমের ইচ্ছে করছে রাফাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। কিন্তু সেটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না কোনোভাবেই। অন্যায় রাফা করেছে। সেই শাস্তি ওর পরিবারকে দেওয়া উচিত নয়৷ রাফার কিছু হয়ে গেলে সায়েম ফাহাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না কখনোই। কিন্তু ও এটা বুঝতে পারছে না ফাহাদ রাফার কোনো খোঁজখবর নিচ্ছে না কেন? প্রায় একদিন আর একটা রাত রাফা বাড়ির বাইরে।

সায়েম কিছুক্ষণ চুপ থেকে কড়া গলায় রাফাকে বলল, ‘আচ্ছা, তোমার ভাই আর মা কোথায়? তুমি দু'দিন ধরে লাপাত্তা, অথচ ওদের কোনো হৈচৈ নেই। এর কারণ কী?’

- অদৃশ্য মানব কখনোই কাঁচা কাজ করে না।

সায়েম অবাক হয়ে বলল - এই অদৃশ্য মানবটা আবার কে?

- সেটা জেনে তোমার কাজ কী? তুমি আদার বেপারী, জাহাজের খোঁজ করে তোমার কী লাভ?

সায়েম রাগী কণ্ঠে বলল - বেয়াদবি না করে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও রাফা। বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হও সেটা ভুলে যেও না। কারণ এই বেয়াদবির দোষটা তোমার উপর পড়ার আগে তোমার পরিবারের উপর গিয়ে পড়বে৷ কারণ সবাই বলবে পরিবারের লোকজন তোমাকে শিক্ষা দিতে পারেনি।

- আচ্ছা বাবা সরি। আর বেয়াদবি করব না। তবে এই অদৃশ্য মানব নিয়ে আমাকে আর কিচ্ছু জিজ্ঞেস করো না।

- সেটা তো সময়ই বলে দিবে। আগে বল ফাহাদ কোথায়?

- কী জানি কই আছে?

- মানে কী? ও কি জানে না তুমি এইরকম একটা কাণ্ড ঘটিয়েছ? সায়েম মুখটা ‘হা’ করে কথাটা বলল। রাফা মৃদু হাসি দিয়ে বলল - জানলে কী আর এতক্ষণ শান্তিতে থাকতে পারতাম আমি? সে তো আমার বজ্জাত ভাই।

- আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি দু'দিন ধরে বাড়ির বাইরে, ও তো কোনো খোঁজখবর নিচ্ছে না তোমার।

- আমি তো বাড়ি থেকে বেরিয়েছি একটা কাজে। ভাইয়া জানে আমি এখনো সেই কাজেই আছি। যদিও এতক্ষণে ভাইয়া সব জেনে গেছে। কারণ তোমার মা আমার থেকে নম্বর নিয়ে সকালে ফোন দিয়েছে।

- ফাহাদ তোমার কথাতে বিশ্বাস করে নিলো। এতটা বোকা ফাহাদ। তুমি বললে কাজে যাচ্ছ, অথচ ও কিছু বলল না।

- " বলেছিল তো। আসলে বেশ কয়েকদিন ধরেই আমার বেখেয়ালি পনার জন্য ভাইয়া আমাকে বকাবকি করেছে। এমনিতেই আমার মন খারাপ ছিল। সেই সুযোগটাই কাজে লাগালাম আমি। আমি না, অদৃশ্য মানব। তার প্ল্যান অনুযায়ী আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বাড়িতে গিয়ে আমাকে নিয়ে এলো সাথে করে। ভাইয়া ভেবেছিল বান্ধুবীর সাথে থাকলে আমার মন ভালো থাকবে। তাই ওর সাথে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। ভাইয়ার সাথে ফোনে কথা হয় আমার। সেজন্য কোনো সন্দেহ করেনি।"

- নিজের ভাইয়ার সাথে এইরকম মিথ্যাচার করার আগে তোমার মনে হয়নি, তুমি ফাহাদকে ঠকাচ্ছ৷ ওর বিশ্বাসকে অপমান করছ৷ আর তোমার সেই বান্ধুবীই বা কেমন! তোমার অন্যায়গুলোতে স্বায় দিয়ে যাচ্ছে।

রাফা কিছু বলল না। হঠাৎ দরজা ঠেলে কেউ একজন ভিতরে প্রবেশ করল। সায়েম চোখ ডিপডিপ করে তাকালো সামনের দিকে। অস্ফুটস্বরে বলল - ফাহাদ।

(চলবে...)

আরো পড়ুন ১১তম পর্ব- ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড