খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইন
গদ্যকে যদি বলি সাহিত্যের পুত্র সন্তান তাহলে কবিতাকে বলাই যায়, ষোড়শী কন্যা। কবিতা কন্যা বলেই ছন্দ, রস, রূপ, ঢং, সৌন্দর্য ও মাধুর্যে ভরপুর থাকে। কবিতার শরীরে প্রেমের আকুতি, ভালোলাগা-ভালবাসার চুম্বক থাকে। থাকে দ্রোহ, প্রতিবাদ ও সুগভীর দার্শনিক বক্তব্য। যা বুঝতে গেলে পাঠককে কখনো কখনো গবেষণাও করতে হয়। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হয়ে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ পাঠক কবিতার মহাত্ম না বুঝলেও তার রূপ-লাবণ্যে বিমোহিত হন, পাগল হয়ে পড়েন বা প্রেমে পড়ে থাকেন । আসলে কবিতার প্রেমই একটা সময় কবি'র প্রতি ভক্তি,শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেয়।
তাইতো পাঠকদেরকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভক্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্ত’। অথবা আরো যে কোন কবির নামে ভক্ত হয়ে যাচ্ছেন তারা। জগদ্বিখ্যাত বহু কবিই আছেন যারা তাঁদের কবিতায় দার্শনিক বক্তব্য দিয়ে গেছেন।
যেমন, জালালুদ্দিন রুমি, শেখ সাদী, ড.আল্লামা ইকবাল থেকে ইসমাইল হোসেন সিরাজি, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন ফকির, আল মাহমুদসহ অগণিত কবি ছিলেন যারা চিন্তার জগতকে প্রসারিত ও গবেষণা করার জন্য অমূল্য বাণী গেঁথে গিয়েছেন জগদ্বাসীর জন্য। সেদিক থেকে কবি তাজ ইসলামকে যদি দার্শনিক কবি হিসেবে আখ্যায়িত করি তাহলে বোদ্ধা মহল অবশ্যই মেনে নিতে বাধ্য হবেন। আর বাধ্য হবেন এই কারণে যে, তিনি তার একটি কবিতায় লিখেছেন, ‘পয়লা গলদ থাকতে পারে বিসমিল্লাহতে গলদ নাই বিসমিল্লাহতে কয় যে গলদ তার মতো আর বলদ নাই।’
বহুল প্রচলিত প্রবাদ ‘মিসমিল্লায় গলদ’ এর মূলোৎপাটন করেছেন। কারণ, ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ এটি স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত বাণী। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জগতের মালিকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ আয়াত এটি। এখানে কোন ধরণের ত্রুটি বা গলদ থাকতে পারে না। আর যদি কেউ বলে থাকেন যে, এ বাক্যটিতে গলদ আছে, তাহলে তার বোকামি হবে। বরং ইসলামের পরিভাষায় বর্ণিত ঈমানের মূলে কলঙ্ক রচিত হবে। ধিক্কৃত হতে হবে তাঁকে। কারণ এ যে, স্বয়ং রবের বাণী ও বাক্যের প্রতি চরমতম অপবাদ আরোপিত হয়। কিন্তু এমনই একটি প্রবাদ বাক্যের নামে ডাহা মিথ্যা বাক্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রচলিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। কোন কাজের শুরুতে ভুল হয়ে গেলে বলা হয়ে থাকে ' বিসমিল্লাহতে গলদ'। এখানে কবি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, আসলে বিসমিল্লাহতে গলদ খুঁজছো কেন?? পয়লাতে বা শুরুতে তোমার ভুল হতে পারে।
গ্রন্থটির শুরুতে কবি তাজ ইসলাম তার নিজের সম্পর্কে কয়েকটি ‘আমি’ শিরোমে সিরিজ কবিতা লিখেছেন। সেখানে আত্মোপলব্ধি ও বোধের পরিচয় তুলে ধরেন সিদ্ধ হাতের কারিশমায়। সেখানে ‘আমি-১’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি কে? কি আমার পরিচয় ‘খুঁজতে খুঁজতে ধ্যান মগ্ন ঘামি আমি কে আমার গভীরে আমি সন্ধানে থাকি দিবস-যামী।’
কয়েক হাজার বছর পূর্বে দার্শনিক সক্রেটিসও বলেছিলেন, আত্মোপলব্ধির বয়ান। বলেছিলেন নিজেকে জানো। নিজেকে চেনো। মুহাম্মদ (স.) বলেছিলেন, ‘নিজেকে চিনতে পারলে পরম আল্লাহকে চেনা যায়।’
কুষ্টিয়ায় বসে আমার আমিকে চেনার মহাবাণীগুলিই লালন ফকির অকপটে প্রচার করে গেছেন। কবিতা তাজ ইসলামও তাদের ব্যতিক্রম নয়। কবিতার স্তবকে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন আধ্যাত্মিকতা। দর্শনের কবিরা তো কাব্য রচনার মাধ্যমে তাঁরা নিজেকে সমর্পণ করে থাকেন দয়ালু স্রষ্টার সান্নিধ্যে। নিজের ভুল ত্রুটি গুলোর জন্য ক্ষমা চেয়ে থাকেন। আবার স্রষ্টার বিশালত্ব প্রকাশ করেন আপন মহিমায়।
কান্নার সংবাদ দিয়ে যেতে চান কবি। জগতময় কান্না। কাঁদেনি কে? আদি পিতা আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আমি, আপনি সকলেই কান্নার স্বাদ বুঝি। পরম প্রভু যদিও তাঁর বান্দার কান্নাকে পছন্দ করেন। মানুষ আবেগবশত কান্না করে। কান্না পায় দুঃখ বোধ জাগ্রত হলে। কষ্ট পেলে কান্না পায়। আনন্দেও মানুষ কাঁদে।
তাই কবি আহবান করছেন কবিতার পড়েন আর পড়ে একটু বসেন, দেখেন আরো কিছু কান্নার সংবাদ রয়েছে আপনাদের জন্য। কবির কান্নার সংবাদ এলো রোহিঙ্গাদের জীবন ও কষ্টের কিছু উপাখ্যান। এলো মানব জীবনের নানান টানাপড়েন এর বীভৎস বার্তা। দেশে দেশে মুসলমানের রক্তঝরার কান্নার সংবাদটাও দিয়েছেন কবি।
কবি লিখেছেন, ‘এইমাত্র আমাদের অগণিত অনাকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের কণ্ঠ বেয়ে ঝর্ণার মতো নেমে যাচ্ছে রক্তের প্রবাহ এই সব নির্মমতার প্রতিবাদ ভুলে কেউ যদি নিছক কেঁদে কেঁদে হৃদয় হালকা করতে চানদয়া করে থেকে যান কবিতাবাদ সত্য সত্যই আরো কিছু কান্নার খবর আছে।’
দার্শনিক সত্য প্রকাশে গুণী কবি একটা মৃদু ভাষণে প্রতিবাদ করেছেন। পাঠককে বিদ্রূপাত্মক আঘাতে জর্জরিত করতেও কুণ্ঠিত নন তিনি। মানুষ যদি প্রতিবাদ ভুলে যায়, আর ভুলে যাওয়ার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন তাহলে তো কান্নার সংবাদ আরো পেতে হবে। আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে মানুষের যাপিত জীবন।
তারপর ‘উড়ে যায় ঘাস ফড়িং’ কবিতায় কবি বলেছেন, ‘অভাবের ক্যানসারে দেহ কঙ্কাল ঘাসফড়িঙ হয়ে উড়ে যায় দুরে যায় লিপিস্টিকের চঞ্চলতা।’
কবি হৃদয় সমাচার কবিতায় বলেন, ‘নীরব হলে বুকের ব্যথা সরব হয়ে নাচে সুখের আশায় দুখের স্রোতে কষ্টে মানুষ বাঁচে।’
সহজ সরল শব্দের নৈপুণ্যতায় কবি লিখেছেন হৃদয় বিগলিত দুঃখ কষ্টের ইতিবৃত্ত। যা শুধু কবির মনের কথাই নয়। সমকালের অগনিত মানুষের মনের কথাই ধারণ করেছেন তিনি।
‘অংশত মোনাজাত’ কবিতায় কবি বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আধিপত্যবাদ ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দিকে আঙুল তুলেছেন। আর আল্লাহর দরবারে বলছেন, ‘আমার মাতৃভূমিকে কখনো সিকিম করোনা ঐ সব স্যুট -টাইয়ের ভেতর কোনটায় কতটুকু লেগে আছে ক্লিভের গর্ধব বোধগম্য হতে তাদের একবার অভিশপ্ত বানর করে দাও সহজেই যেন চিহ্নিত হয় জনতার দুশমন আর জনপদের দুশমনের চেহারা।’
এই দার্শনিক কবি তার ‘চক্ষু’ সিরিজ কবিতায় একস্থানে বলেছেন, ‘আমিও তখন হারুন পাগলার মত পথে পথে ঘুরবো উন্মাদ হয়ে চর্মচক্ষু নিয়ে জন্মান্ধের পথে হে প্রভু! রংধনু দেখি আর না দেখি আমার তৃতীয় চক্ষুর ক্ষমতা অক্ষত রাখ অনন্তকাল।’
কাব্যগ্রন্থ- আরো কিছু কান্নার খবর কবি- তাজ ইসলাম প্রকাশনী- ইনভেলাপ পাবলিকেশন প্রকাশকাল - একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড