• বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বই আলোচনা

আর রিহলাহ : এক খণ্ড ওমানের চিত্র

  শেখ মাহমুদ ইসলাম মিজু

২৯ অক্টোবর ২০১৯, ১৪:০৫
ছবি
ছবি : ভ্রমণ গ্রন্থ ‘আর রিহলাহ’

‘সাগরের ফেনিল টেউ যেমন উপচে পড়ে এক দিকে, আরেকদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মরু বালুকার ঝিলিমিলি। পাহাড়-পর্বতের উর্ধ্বমুখী চূড়ার দার্ঢ্য এবং সবুজ উপত্যকার ছায়ায় স্নিগ্ধ বাসন্তি। প্রকৃতির মতই মানুষজন। নীরব, শান্ত, ভদ্র ঔদার্য সুষমার আবিষ্ট হৃদয় কন্দর। যাদের সৌভ্রাতৃত্বসূলভ ভদ্রতার গুণ-গান করে গেছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগেই।’

পাঠক, উপরে যে কথাটুকু পড়লেন সেটি মিশরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খেতাব প্রাপ্ত ‘ডক্টর’ মাওলানা আরীফ উদ্দীন মারুফের লেখা ‘আর রিহলাহ’ বই থেকে নেয়া। (আর রিহলাহ আরবি শব্দ, যার অর্থ ভ্রমণ) বইয়ের নাম শুনা মাত্রই কারোর বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে, বইটি আরববিশ্বের কোন এক দেশ নিয়ে লিখিত ভ্রমণকাহিনী। কিন্তু সেটি কোন দেশ নিয়ে লেখা? সেটা আমরা লেখকের ভাষ্য থেকেই জেনে নেই— ‘ওমানের সাথে আমাদের দেশের মানুষের পরিচিতি বন্ধন অত্যন্ত প্রাচীন। বিশেষত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন এবং তাফসীর প্রতিযোগিতায় যখন অংশ গ্রহণ করেছি, তখন ঘনিষ্ট ভাবে ওমানের প্রতিযোগিদের সাথে মিশেছি। হৃদয়ে ওমান সফরের প্রবল আগ্রহ অনুভব করেছি। আল্লাহ তাআলা সেই সুপ্ত বাসনাকে বাস্তবে পরিণত করেছেন কোরআন কাননের আমার পুরনো বন্ধু ড. খালেদের ওসীলায়।’

‘আর রিহলাহ’র লেখক ডক্টর মাওলানা আরীফ উদ্দীন মারুফ। পরিচয়ের জন্য নামই যথেষ্ট। প্রাচ্য-প্রতিচ্যের অনেক দেশেই তাঁর পদচিহ্ন রয়েছে । বহুমুখী প্রশংসনীয় গুণের অধিকারী ডক্টর মাওলানা মারুফ একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত হাফেজ ও মুফাসসির অন্যদিকে তিনি একজন উঁচু মানের আরবী সাহিত্যিক। তিনি রাজধানীর স্বনামধন্য ইসলামী বিদ্যাপীঠ জামিআ ইকরা বাংলাদেশের প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং মন্ত্রীপাড়া খ্যাত কাকরাইল সার্কিট হাউস মসজিদের খতীব। ইলমী প্রজ্ঞা আর রচনাবলী তাঁকে শুধু বাংলাদেশি আলেম-উলামাদের মধ্যেই নয়, সারা বিশ্বেই একটি বিশেষ স্থান করে দিয়েছে। এবং পবিত্র কাবার জিয়ারতকারী বিশ্বের বরেণ্য আলেমগণকে যেসব হাদিয়া দেয়া হয়, তারমধ্যে তালিকায় রয়েছে লেখকের আরেক বই ‘ফি লাহজাতিল ওয়াদায়ীল আখীর’।

বইটি যেহেতু ভ্রমণকাহিনী, তাই বইটিতে কি থাকবে, কি থাকবে না, তা সহজেই অনুমেয়। তদুপরি বইটি ডক্টর মাওলানা মারুফের মতো ব্যক্তিত্বের লেখা, তাই এতে ভিন্নরকম কিছু থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ, তাঁর লেখায় রয়েছে নিজস্ব দখল, তিনি লেখা-লেখি জগতের এক মহান কারিগর। শব্দকে ভেতর থেকে ফুটিয়ে তোলার এক মহাবিদ্যা জানেন তিনি, ফলে তার যে কোন লেখায় তৈরি হয় আলাদা এক ঘোর। আলাদা এক জগত। আলাদা এক মহো।

লেখক বইয়ে শুধু ওমান ভ্রমণের এবং কনফারেন্সের বক্তব্য বিবরণই দেননি, বরং যাঁদের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে তাঁদের পরিচয়ও তুলে ধরেছেন এতে। তন্মধ্যে- শায়েখ হুমুদ বিন হুমায়দ আল-ছাওয়াফী, ড. সাঈদ বিন সুলাইমান আল-ওয়াঈদি, ড. আব্দুল্লাহ আল হাশেমী, ড. আব্দুল্লাহ বিন রাশেদ আল সিয়াবী, শায়েখ যিয়াদ তালিব, ড. শায়েখ সুলাইমান আল খলিলী, প্রমুখ অন্যতম। তাদের সাথে কোথায় সাক্ষাৎ হয়েছে তারও ইতিবৃত্ত তিনি তুলে ধরেছেন। যখন যে স্থানেই গেছেন, সে স্থানের অতীত ইতিহাসসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয়েই নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় আলোচনা করেছেন।

আমরা জানি, আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত ছোট্ট একটি দেশ ওমান। আরবের অন্যান্য অংশ থেকে সাগর, পাহাড় আর মরুভূমি দিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়েছে দেশটি। তবে এই বিচ্ছিন্নতাই যেন ওমানকে সৌন্দর্য আর বিশুদ্ধতায় আরব উপদ্বীপের অন্যান্য দেশ থেকে কয়েকগুণ এগিয়ে নিয়ে গেছে। বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তর, সাগরের অথৈ নীল জলরাশি, সুউচ্চ পাথুরে পর্বত, সাদা বালুকাবেলা কিংবা বিশাল আকাশের নীলিমা ওমানের সবখানেই যেন অন্যরকম এক সৌন্দর্য ঝরে পড়ছে। ‘আর রিহলাহ’র লেখক ওমানের মাটি ও ওমানবাসীর সঙ্গে আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এভাবে— ‘ওমানের মাটিতে এটা আমার প্রথম সফর। এ দেশের প্রধান আকর্ষণ উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্বে বিস্তৃত আল হাজার পর্বতমালা। ৩০১০ মিটার উঁচু জাবালে শামস এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। ওমানের মরুভূমির বিশালাকার বালিয়াড়িগুলো ঘুরে দেখার মত। চুনা পাথরের পাহাড়ি গুহাগুলোও বিখ্যাত। বহুবছর যাবত রাজতন্ত্রের কাঠামোতে প্রতিষ্ঠিত এই দেশ। ওমানিদের আখলাক ও উন্নত চরিত্র মাধুরিমার প্রশংসা স্বয়ন পেয়ারা হাবিব সা. করেছেন। এরাই একমাত্র আরব জাতি, যারা স্বেচ্ছায় ইসলামের শীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। ওমানের তৎকালের বাদশা আবদ ইবনে জালান্দি এবং জাইফার ইবনে জালান্দির নামে নবীজী সা. পত্র পাঠিয়েছিলেন। হযরত আমর ইবনুল আছ নবীজীর সেই পত্র তাদের কাছে হস্তান্তর করেছেন। পত্রটি হযরত উবাই ইবনে কাবের হাতে লিখিত ছিলো।’

‘আর রিহলাহ’র ‘দর্শনীয় স্থানসমূহ ভিজিট’ অধ্যায়টি পড়লে জানতে পারবেন যে, পার্সিয়ান, পর্তুগিজ বা আব্বাসীয় খেলাফত সব শাসনামলের স্বাক্ষর আজও বহন করে চলেছে ওমানের বিভিন্ন গ্রাম এবং শহর, সমৃদ্ধ ইতিহাস ছাড়াও ওমানের আছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। আরবনন্দিনী ওমানের সেরা পর্যটন আকর্ষণগুলো সম্পর্কে, যেগুলো ওমানকে অনন্য করে তুলেছে।

ডক্টর মাওলানা আরীফ উদ্দীন মারুফ ‘আর রিহলাহ’কে পাঁচটি অধ্যায়ে সাজিয়েছেন। ১. সূচনা। ২. তাদাব্বুরে কোরআন। ৩. গুণীজনের সঙ্গে মোলাকাত। ৪. দর্শনীয় স্থানসমূহ ভিজিট। ৫. বিদায়। এই পাঁচটি অধ্যায়ে শিরোনামের ভিন্নতায় ওমানের ইতিবৃত্ত ওঠে এসেছে ভিন্ন ভিন্ন মুগ্ধতার স্বাদ নিয়ে। এই শিরোনামগুলো পাঠককে টানতে থাকে বইয়ের শেষতক। ‘আর রিহলায়’ বইয়ের শিরোনাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে মাওলানা মারুফ তার যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। বইয়ের প্রত্যেকেটা শিরোনাম খুবই চমকপ্রদ, চোখ আটকে থাকার মত। শিরোনাম পড়লেই যে কারো পুরো লেখাটা পড়তে ইচ্ছে করবে। যেমন— ‘ফের একুশ বছর পর’। ‘দাওয়াতের ভয়েস মেসেজ’। ‘ওমান ও ওমানবাসী’। ‘ইমাম গিতালী মসজিদের আঙ্গিনায়’। ‘শায়েখ ছাওয়াফীর দরসে অধমের বক্তব্য’। ‘শবে মিরাজের মাহফিলে’। ‘সবুজ পাহাড়ের চূড়ায়’। ‘সব প্রশংসা হে আল্লাহ একমাত্র তোমারই’। ইত্যাদি। ইত্যাদি।

মনোমুগ্ধকর পাথুরে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত প্রবহমান সমুদ্রের নীল জলরাশি দেশ ওমানকে লেখক বিদায় জানিয়েছেন এভাবে— ‘শুরু হলো দৌড়। গন্তব্য বিমানবন্দর। শায়েখ আব্দুল্লাহর আন্তরিক সহযোগিতা কখনও ভুলবার নয়। ইমিগ্রেশন শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকালাম। ও আল্লাহ! মাত্র চল্লিশ মিনিট বাকি। কী হবে আমাদের? ফ্লাইটের আধা ঘন্টা পূর্বে গেইট বন্ধ হয়ে যায়। কেবল তাই নয়, ফ্লাইট মিস হওয়ার মহা পেরেশানি থেকেও তিনি রক্ষা করলেন। বিদায় ওমান।’

মোটকথা, ‘আর রিহলাহ’র পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে শিক্ষার উপকরণ। একজন অনুসন্ধিৎসু ইতিহাস পাঠক কিংবা ভ্রমণ প্রেমিদের জন্য বইটি হবে আত্মার খোরাক। যিনি আমাদেরকে এতো সুন্দর একটি বই উপহার দিয়েছেন। যার স্বচ্ছ রুচি ও পছন্দের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে এই বইয়ে। তাকে ধন্যবাদ না দেয়াটা আমাদের বড্ড ভুল।

উল্লেখ্য, এবছর জানুয়ারি মাসে ৬০ বছরের প্রাচীন মিশরের আন্তর্জাতিক বইমেলায় বাংলাদেশী লেখক ডক্টর মাওলানা আরীফ উদ্দীন মারুফের ৪টি বই প্রদর্শিত হয়েছে। মিসরের ডেইলি পত্রিকা আকীদাতিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে লেখক তার বই চারটি নিয়ে বলেছিলেন, মক্কার দারু তইবা প্রকাশনী থেকে ‘ফি লাহজাতিল ওয়াদায়িল আখির’, দারুল হাদিস থেকে ‘রাওয়ায়ে মিন আশআরিস সাহাবাহ’মাকতাবুত তাওফিকিয়্যা থেকে ‘রিসালাতুল আমনি ওয়াস সালাম’এবং দারু তইবা থেকেই ‘আলা ইয়া আইনু ইবকি’। ‘মা’আরাতুল কাহেরা আদদাওলিলিল কিতাব’ নামে বইমেলাটি সারা পৃথিবীতে প্রসিদ্ধ। ওই মেলায় বিশ্বের প্রায় ৫৮টি দেশের ৫০০ এর অধিক প্রকাশনী অংশগ্রহণ করে। মিসরের প্রাচীন ও বিশ্ববিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘মাকতাবাতুত তাওফিকিয়্যাহ’র আমন্ত্রণে তিনি ওই বইমেলায় যান। লেখকের ‘ফি লাহজাতিল ওয়াদায়ীল আখীর’নামক বইটি ২০১৫ সালে মক্কার অভিজাত প্রকাশনী ‘দারু তিবাতিল খাযরা’ প্রকাশ করে। তখনকার আরব বইমেলাগুলোতে বইটি বেশ সাড়া ফেলে। এ নিয়ে বেশ চমকপ্রদ ঘটনাও আছে আরবের বইমেলায়। পাঠকের চাহিদাপূরণে লেখকের প্রত্যেকটি বই ই প্রকাশনীগুলোকে বেশ ক’বার ছাপাখানায় তুলতে হয়েছে।

ভ্রমণ গ্রন্থ : আর রিহলাহ লেখক : ডক্টর মাওলানা আরীফ উদ্দীন মারুফ প্রকাশনি : আর জে এম পাবলিশার্স মুদ্রিত মূল্য : ২০০ টাকা

বইটি সংগ্রহ করতে যোগাযোগ করুন- ১২২৭/এ/১ চৌধুরিপাড়া, খিলগাঁও, ঢাকা- ১২১৯ (জামিআ ইকরা বাংলাদেশ)। মোবাইল- ০১৭৯১৪০৬৬৬৩, ০১৯৩১১৩৫১২৪। অথবা অক্ষর বিডি ডটকম এর ফেসবুক পেইজে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড