• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর দ্রোহের কবিতা

  সাহিত্য ডেস্ক

১৬ অক্টোবর ২০১৯, ১৪:১৪
কবিতা
ছবি : প্রতীকী

হাড়েরও ঘরখানি

মানুষের প্রিয় প্রিয় মানুষের প্রানে মানুষের হাড়ে রক্তে বানানো ঘর এই ঘর আজো আগুনে পোড়ে না কেন?

ঘুনপোকা কাটে সে-ঘরের মূল-খুঁটি আনাচে কানাচে পরগাছা ওঠে বেড়ে, সদর মহলে ডাকাত পড়েছে ভর দুপুরের বেলা প্রহরীরা কই? কোথায় পাহারাদার?

ছেনাল সময় উরুত দ্যাখায়ে নাচে নপুংশকেরা খুশিতে আত্মহারা ।

বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে রাজনীতিকের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের পাপ বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে জাতির তরুন রক্তে পুষেছে নির্বীর্যের সাপ-

উদোম জীবন উল্টে রয়েছে মাঠে কাছিমের মতো।

২ কোনো কথা নেই- কেউ বলে না, কোন কথা নেই- কেউ চলে না, কোনো কথা নেই- কেউ টলে না, কোন কথা নেই- কেউ জ্বলে না- কেউ বলে না, কেউ চলে না, কেউ টলে না, কেউ জ্বলে না।

যেন অন্ধ, চোখ বন্ধ, যেন খঞ্জ, হাত বান্ধা, ভালবাসাহীন,বুক ঘৃনাহীন, ভয়াবহ ঋন ঘাড়ে চাপানো-শুধু হাঁপানো, শুধু ফাঁপানো কথা কপচায়- জলে হাতড়ায়, শোকে কাতরায় অতিমাত্রায় তবু জ্বলে না। লোহু ঝরাবে, সব হারাবে- জাল ছিঁড়বে না ষড়যন্ত্রের? বুক ফাটাবে, ক্ষত টাটাবে- জাল ছিঁড়বে না ষড়যন্ত্রের?

৩ আমি টের পাই, মাঝ রাত্তিরে আমাকে জাগায় স্মৃতি- নিরপরাধ শিশুটির মুখ আমাকে জাগায়ে রাখে নিরপরাধ বধুটির চোখ আমাকে জাগায়ে রাখে নিরপরাধ বৃদ্ধটি তার রেখাহীন করতর আমাকে জাগায়ে রাখে।

মনে পড়ে বট? রাজপথ. পিচ? মনে পড়ে ইতিহাস? যেন সাগরের উতলানো জল নেমেছে পিচের পথে মানুষের ঢেউ আছড়ে দোহাই কূলে? মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না কারো? কি বিশাল সেই তাজা তরুনের মুষ্ঠিবদ্ধ হাত যেন ছিঁড়ে নেবে গ্লোব থেকে তার নিজস্ব ভূমিটুকু!

মনে কি পড়ে না ঘন বটমূল, রমনার উদ্যান একটি কন্ঠে বেজে উঠেছিলো জাতির কন্ঠস্বর? শত বছরের কারাগার থেকে শত পরাধীন ভাষা একটি প্রতীক কন্ঠে সেদিন বেজেছিলো স্বাধীনতা। হাতিয়ারহীন, প্রস্তুতি নেই, এলো যুদ্ধের ডাক, এলো মৃত্যুর, এলো ধ্বংশের রক্ত মাখানো চিঠি। গ্রাম থেকে গ্রামে, মাঠ থেকে মাঠে গঞ্জের সুবাতাসে সে-চিঠি ছড়ায় রক্ত-খবর, সে-চিঠি ঝরায় খুন, স্বজনের হাড়ে করোটিতে জ্বলে সে-চিঠির সে আগুন।

৪ ভরা হাট ভেঙে গেল। মাই থেকে শিশু তুলে নিল মুখ সহসা সন্দিহান, থেমে গেল দূরে রাখালের বাঁশি, পাখিরা থামালো গান, শ্মশান নগরী, খাঁ-খাঁ রাজপথে কাকেরা ভুললো ডাক।

প'ড়ে রলো পাছে সাত পুরুষের শত স্মৃতিময় ভিটে, প'ড়ে রলো ঘর, স্বজনের লাশ, উনুনে ভাতের হাঁড়ি, ভেঙে প'ড়ে রলো জীবনের মানে জ্বলন্ত জনপদে- নাড়ি-ছেঁড়া উন্মুল মানুষের সন্ত্রাসে কাঁপা স্রোত জীবনের টানে পার হয়ে গেল মানচিত্রের সীমা।

৫ মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না তবু? গেরামের সেই শান্ত ছেলেটি কী রোষে পড়েছে ফেটে বন্ধুর লাশ কাঁধে নিয়ে ফেরা সেই বিভীষিকা রাত সেই ধর্ষিতা বোনের দেহটি শকুনে খেয়েছে ছিড়ে-

মনে কি পড়ে না হাতে গ্রেনেডের লুকোনো বিস্ফোরণ? তারও চেয়ে বেশি বিস্ফোরণের জ্বালা জ্বলন্ত বুকে গর্জে উঠেছে শত গ্রেনেডের শত শব্দের মতো।

গেরামের পর গেরাম উজাড় উঠোনে উঠেছে ঘাস। হাইত্ নের’ পরে ম’রে পড়ে আছে পালিত বিড়াল ছানা, কেউ নেই, শুধু তেমাথায় একা ব্যথিত কুকুর কাঁদে।

আর রাত্রির কালো মাটি খুঁড়ে আলোর গেরিলা আসে-

৬ ঝোপে জঙ্গলে আসে দঙ্গলে আসে গেরিলার দল, হাতিয়ার হাতে চমকায়। হাত ঝলসায় রোষ প্রতিশোধ। শোধ রক্তের নেবে তখতের নেবে অধিকার। নামে ঝনঝায়- যদি জান যায় যাক, ক্ষতি নেই; ওঠে গর্জন, করে অর্জন মহা ক্ষমতার, দিন আসবেই, দিন আসবেই, দিন সমতার।

৭ দিন তো এলো না ! পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ছিঁড়ে নেয়া সেই ভূমি দূর্ভিক্ষের খরায় সেখানে মন্বন্তর এলো । হত্যায় আর সন্ত্রাসে আর দুঃশাসনের ঝড়ে উবে গেল সাধ বেওয়ারিশ লাশে শাদা কাফনের ভিড়ে, তীরের তরীকে ডুবালো নাবিক অচেতন ইচ্ছায়।

৮ আবার নামলো ঢল মানুষের আবার ডাকলো বান মানুষের আবার উঠলো ঝড় মানুষের

৯ গ্রাম থেকে উঠে এলো ক্ষেতের মানুষ খরায় চামড়া- পোড়া মাটির নাহান, গতরে ক্ষুধার চিন্ মলিন বেবাক, শিকড় শুদ্ধ গ্রাম উঠে এলো পথে।

অভাবের ঝড়ে-ভাঙা মানুষের গাছ আছড়ে পড়লো এসে পিচের শহরে ।

সোনার যৌবন ছিলো নওল শরীরে নওল ভাতার ঘরে হাউসের ঘর, আহারে নিঠুর বিধি কেড়ে নিলো সব- সোনার শরীরে বেচে সোনার দোসর ।

দারুন উজানি মাঝি বাঘের পাঞ্জা চওড়া সিনায় যেন ঠ্যাকাবে তুফান। আঁধার গতর জেলে, দরিয়ার পুত বুকের মধ্যে শোনে গাঙের উথাল ।

তাদের অচেনা লাশ চিনলো না কেউ ঝাঁক ঝাঁক মাছি শুধু জানালো খবর।

বেওয়ারিশ কাকে বলো, কার পরিচয় ? বাংলার আকাশ চেনে, চেনে ওই জল আমার সাকিন জানে নিশুতির তারা, চরের পাখিরা জানে পাড় ভাঙা নদী আমি এই খুনমাখা মাটির ওয়ারিশ ।

১০ স্বপ্ন হারানো মানুষের ঢল রাজপথে আসে নেমে স্বজন হারানো মানুষের ঢল রাজপথে আসে নেমে ক্ষুধায় কাতর মানুষের ঢল রাজপথে আসে নেমে পোড়ায় নগরী, ভাঙে ইমারত, মুখোসের মুখ ছেঁড়ে ছিঁড়ে নিতে চায় পরাধীন আলো প্রচন্ড আক্রোশে।

১১ আমি কি চেয়েছি এতো রক্তের দামে এতো কষ্টের, এত মৃত্যুর, এতো জখমের দামে বিভ্রান্তির অপচয়ে ভরা এই ভাঙা ঘরখানি? আমি কি চেয়েছি কুমির তাড়ায়ে বাঘের কবলে যেতে?

আর কতো চাস? আর কতো দেবো কতো রক্তের বলী? প্রতিটি ইঞ্চি মাটিতে কি তোর লাগেনি লোহুর তাপ? এখনো কি তোর পরান ভেজেনি নোনা রক্তের জলে?

ঝড়ে বন্যায় অনাহারে আর ক্ষুধা মন্বন্তরে পুষ্টিহীনতা, জুলুমে জখমে দিয়েছি তো কোটি প্রান- তবুও আসেনা মমতার দিন, সমতা আসেনা আজো।

১২ হাজার সিরাজ মরে হাজার মুজিব মরে হাজার তাহের মরে বেঁচে থাকে চাটুকর, পা-চাটা কুকুর বেঁচে থাকে ঘুনপোকা, বেঁচে থাকে সাপ।

১৩ খুনের দোহাই লাগে, দোহাই ধানের দোহাই মেঘের আর বৃষ্টির জলের দোহাই, গর্ভবতী নারীর দোহাই এ-মাটিতে মৃত্যুর অপচয় থামা

আসুক সরল আলো, আসুক জীবন চারিদিকে শত ফুল ফুটুক এবার।

১৪ জাতির রক্তে ফের অনাবিল মমতা আসুক জাতির রক্তে ফের সুকঠোর সসতা আসুক আসুক জাতির প্রানে সমতার সঠিক বাসনা।

বাতাসে লাশের গন্ধ

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই আজো আমি মাটিতে মৃত্যূর নগ্ননৃত্য দেখি, ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে- এদেশ কি ভুলে গেছে সেই দু:স্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ?

বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে- মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ । এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো, জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আধাঁর ।

আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায় । এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আরষ্ট কুমারী জননী, স্বাধীনতা – একি তবে নষ্ট জন্ম ? একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?

জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন ।

বাতাশে লাশের গন্ধ- নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দোলে মাংসের তুফান। মাটিতে রক্তের দাগ - চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়।

এ চোখে ঘুম আসেনা। সারারাত আমার ঘুম আসেনা- তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার, নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ, মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস শরীর ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে । আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি ঘুমুতে পারিনা…

রক্তের কাফনে মোড়া – কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা । স্বাধীনতা, সে আমার – স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন - স্বাধীনতা–সে-আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল ।

ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা ।

শব্দ-শ্রমিক

আমি কবি নই- শব্দ শ্রমিক। শবেদের লাল হাতুড়ি পেটাই ভুল বোধে ভুল চেতনায়, হৃদয়ের কালো বেদনায়। করি পাথরের মতো চূর্ণ, ছিঁড়ি পরান সে ভুলে পূর্ণ। রক্তের অথে রক্ত বিছিয়ে প্রতিরোধ করি পরাজয়, হাতুড়ি পেটাই চেতনায়। ভাষা- সৈনিক আমি জানি শুধু যুদ্ধ, আমার সমুখে দরোজা রুদ্ধ- তাই বারুদে সাজাই কোমল বর্নমালা, তাই শব্দে শানিত আনবিক বিষ-জ্বালা। ধূর্জটি-জটা পেতে রোধ করি অবক্ষায়ের সংশয়, আমার এ-হাতে শব্দ-কাস্তে ঝলসায়।

ভাষার কিষান চোখ মেলে চেয়ে দেখি, চারিপাশে ঘোর অসম জীবন, সভ্য পোশাকে পাশবিক বন। সমতার নামে ক্ষমতাকে কোরে রপ্ত, আমি জানি কারা জীবনে ছড়ায় পুঁজ, পোকা, বিষ তপ্ত- জানি আমাদের কারা ধুতুরার ফুলে অন্ধ করেছে অবেলায়, ছুঁড়ে দিয়ে গেছে নষ্ট নগ্ন বেদনায়। আমি সেই পোড়া ভিত ভেঙ্গে জেগে উঠেছি জীবনে, আমি সেই কালো ঘোড়ার লাগাম ধ'রে আছি টেনে। বুকের ভাষাকে সাজিয়ে রনের সজ্জায়, আমি বুনেই দিই শব্দ-প্রেরনা মানুষের লোহু মজ্জায়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড