• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা

  সাহিত্য ডেস্ক

১৫ আগস্ট ২০১৯, ১৩:১৯
ছবি
ছবি : জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে অন্নদাশঙ্কর রায়

নরহত্যা মহাপাপ, তার চেয়ে পাপ আরো বড়ো করে যদি যারা তাঁর পুত্রসম বিশ্বাসভাজন জাতির জনক যিনি অতর্কিত তাঁরেই নিধন।

নিধন সবংশে হলে সেই পাপ আরো গুরুতর, সারাদেশ ভাগী হয় পিতৃঘাতী সে ঘোর পাপের যদি দেয় সাধুবাদ, যদি করে অপরাধ ক্ষমা। কর্মফল দিনে দিনে বর্ষে বর্ষে হয় এর জমা একদা বর্ষণ বজ্ররূপে সে অভিশাপের। রক্ত ডেকে আনে রক্ত, হানাহানি হয়ে যায় রীত। পাশবিক শক্তি দিয়ে রোধ করা মিথ্যা মরীচিকা। পাপ দিয়ে শুরু যার নিজেই সে নিত্য বিভীষিকা।

ছিন্নমস্তা দেবী যেন পান করে আপন শোণিত। বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! থেকে নাকো নীরব দর্শক

ধিক্কারে মুখর হও। হাত ধুয়ে এড়াও নরক।

এই সিঁড়ি রফিক আজাদ

এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে, সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে- বত্রিশ নম্বর থেকে সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে অমল রক্তের ধারা ব’য়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।

মাঠময় শস্য তিনি ভালোবাসতেন, আয়ত দু’চোখ ছিল পাখির পিয়াসী পাখি তার খুব প্রিয় ছিলো- গাছ-গাছালির দিকে প্রিয় তামাকের গন্ধ ভুলে চোখ তুলে একটুখানি তাকিয়ে নিতেন, পাখিদের শব্দে তার, খুব ভোরে, ঘুম ভেঙে যেতো।

স্বপ্ন তার বুক ভ’রে ছিল, পিতার হৃদয় ছিল, স্নেহে-আর্দ্র চোখ- এদেশের যা কিছু তা হোক না নগণ্য, ক্ষুদ্র তার চোখে মূল্যবান ছিল- নিজের জীবনই শুধু তার কাছে খুব তুচ্ছ ছিল: স্বদেশের মানচিত্র জুড়ে প’ড়ে আছে বিশাল শরীর… তার রক্তে এই মাটি উর্বর হয়েছে, সবচেয়ে রূপবান দীর্ঘাঙ্গ পুরুষ: তার ছায়া দীর্ঘ হতে-হ’তে মানিচিত্র ঢেকে দ্যায় সস্নেহে, আদরে!

তার রক্তে প্রিয় মাটি উর্বর হয়েছে- তার রক্তে সবকিছু সবুজ হয়েছে। এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে, সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে- স্বপ্নের স্বদেশ ব্যেপে সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে অমল রক্তের ধারা ব’য়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।

ধন্য সেই পুরুষ শামসুর রাহমান

ধন্য সেই পুরুষ, নদীর সাঁতার পানি থেকে যে উঠে আসে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে; ধন্য সেই পুরুষ, নীল পাহাড়ের চূড়া থেকে যে নেমে আসে প্রজাপতিময় সবুজ গালিচার মতো উপত্যকায়; ধন্য সেই পুরুষ, হৈমন্তিক বিল থেকে সে উঠে আসে রঙ-বেরঙের পাখি ওড়াতে ওড়াতে।

ধন্য সেই পুরুষ, কাহাতের পর মই-দেয়া ক্ষেত থেকে যে ছুটে আসে ফসলের স্বপ্ন দেখতে দেখতে। ধন্য আমরা, দেখতে পাই দূর দিগন্ত থেকে এখনো তুমি আসো আর তোমারই প্রতীক্ষায় ব্যাকুল আমাদের প্রাণ, যেন গ্রীষ্মকাতর হরিণ জলধারার জন্যে। তোমার বুক ফুঁড়ে অহঙ্কারের মতো ফুটে আছে রক্তজবা, আর আমরা সেই পুথের দিকে চেয়ে থাকি, আমাদের চোখের পলক পড়তে চায় না, অপরাধে নত হয়ে আসে আমাদের দুঃস্বপ্নময় মাথা।

দেখ, একে একে সকলেই যাচ্ছে বিপথে অধঃপাত মোহিনী নর্তকীর মতো জুড়ে দিয়েছে বিবেক-ভোলানো নাচ মনীষার মিনারে, বিশ্বস্ততা চোরা গর্ত খুঁড়ছে সুহৃদের জন্যে সত্য খান খান হয়ে যাচ্ছে যখন তখন কুমোরের ভাঙা পাত্রের মতো, চাটুকারদের ঠোঁটে অষ্টপ্রহর ছোটে কথার তুবড়ি, দেখ, যে কোন ফলের গাছ সময়ে-অসময়ে ভরে উঠেছে শুধু মাকাল ফলে।

ঝল্সে-যাওয়া ঘাসের মতো শুকিয়ে যাচ্ছে মমতা দেখ, এখানে আজ কাক আর কোকিলের মধ্যে কোন ভেদ নেই। নানা ছল-ছুতোয় স্বৈরাচারের মাথায় মুকুট পরাচ্ছে ফেরেবক্ষাজের দল।

দেখ, প্রত্যেকটি মানুষের মাথা তোমার হাঁটুর চেয়ে এক তিল উঁচুতে উঠতে পারছে না কিছুতেই। তোমাকে হারিয়ে আমরা সন্ধ্যায় হারিয়ে যাওয়া ছায়ারই মতো হয়ে যাচ্ছিলাম, আমাদের দিনগুলি ঢেকে যাচ্ছিলো শোকের পোশাকে, তোমার বিচ্ছেদের সঙ্কটের দিনে আমরা নিজেদের ধক্ষংসস্তূপে ব’সে বিলাপে ক্রন্দনে আকাশকে ব্যথিত করে তুলেছিলাম ক্রমাগত; তুমি সেই বিলাপকে রূপান্তরিত করেছো জীবনের স্তুতিগানে, কেঁননা জেনেছি জীবিতের চেয়েও অধিক জীবিত তুমি।

ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর রৌদ্র ঝরে চিরকাল, গান হয়ে নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা; যাঁর নামের ওপর কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া, ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর পাখা মেলে দেয় জ্যোৎস্নার সারস, ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর পতাকার মতো দুলতে থাকে স্বাধীনতা, ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর ঝরে মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধক্ষনি।

৩২ নম্বর মেঘের ওপারে আনিসুল হক

আকাশের ওপারে আকাশ, তার ওপরে মেঘ, মেঘের মধ্যে বাড়ি— ৩২ নম্বর মেঘমহল। ৩২ নম্বরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনি। আপনার গায়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে পাইপ।

ছাদের কিনারে সানশেডে উড়ছে কবুতরগুলো। উঠানে সাইকেল-রিকশা চালাচ্ছে লাল সোয়েটার পরা রাসেল। পানের ডিব্বা নিয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশের গোল টেবিলটাতে সুপারি কাটায় ব্যস্ত আপনার রেণু। জামাল মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের সময় পাওয়া ক্যাপটা পরে আয়নায় তাকাচ্ছেন। ছাদের ঘরে বেহালা বাজাচ্ছেন কামাল। মেঘে মেঘে ছড়িয়ে পড়ছে বেহালার মূর্ছনা।

আকাশের ওপারে আকাশ, তার ওপরে মেঘ, মেঘের মধ্যে বাড়ি—৩২ নম্বর মেঘমহল। সেইখানে দোতলার ঝুল-বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুরু লেন্সের ভেতর থেকে পূর্ণ চোখে তাকিয়ে আপনি দেখছেন...

যেমন করে দেখেছিলেন একাত্তরের মার্চে ওড়ানো সবুজের মধ্যে লাল সূর্য আর হলুদ মানচিত্রখচিত পতাকা; যেমন করে তাকিয়ে দেখেছিলেন সত্তরে একাত্তরে রোজ আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা স্বাধীনতা-পাগল মানুষগুলোকে; যেমন করে সাতই মার্চের মঞ্চে দাঁড়িয়ে লক্ষ-কোটি চোখে দেখতে পেয়েছিলেন একটা জাতির জন্মের ফুল ফোটা; যেন আপনি রিলকে, পৃথিবীর শেষতম কবি যিনি শিল্পীর মগ্নতা নিয়ে নিরীক্ষণ করেন কী করে কলি থেকে পাপড়ি উন্মীলিত হয়, ফুটে ওঠে ফুল। আকাশের ওপারে আকাশে মেঘমহলের ৩২ নম্বরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনি তাকিয়ে আছেন— বারবার দেখেও আপনার আশ মিটছে না; শিল্পী যেমন ছবি আঁকা শেষ করে ক্যানভাস থেকে দূরে গিয়ে পুরোটা ছবি বারবার করে দেখেন; লেখা সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পরও রবীন্দ্রনাথ যেমন বারবার পড়তেন তাঁর কবিতা আর পাণ্ডুলিপিটাকে বানিয়ে ফেলতেন একটা আস্ত শিল্পকর্ম; তেমনি করে আপনি দেখছেন আপনার আঁকা ছবিটাকে দূর থেকে, কিন্তু পূর্ণ চোখে। তেমনি করে আপনি পড়ছেন আপনার লেখা কবিতাটাকে। অপার্থিব শিল্পসুষমায় অপরূপ দিব্যকান্তি আপনি দেখছেন কী রকম জ্বলজ্বল করছে আপনার শিল্পকর্মখানি— দেখছেন কী রকম করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে বাঙালিরা— দেখছেন কী রকম মুক্ত কণ্ঠে তারা গাইছে আমার সোনার বাংলা— স্বকণ্ঠে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনানোর কবিজনোচিত উজ্জ্বলতা আর মগ্নতা অবয়বজুড়ে; ভোরের সোনালি আলোয় কাঁচা-পাকা চুলে স্বর্গীয় দ্যুতি।

রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল আর জীবনানন্দ দাশের পাশে দাঁড়িয়ে আপনি বলছেন, ‘ওই দেখুন, ওই যে আমার কবিতা— কবিগুরু, ওই যে আপনার সোনার বাংলা, বিদ্রোহী কবি, ওই যে আপনার জয় বাংলা, জীবনানন্দ বাবু, ওই যে আপনার রূপসী বাংলা,

ওই তো আমার কবিতা আমার কবিতার নাম বাংলাদেশ, ওই তো আমার কবিতা আমার কবিতার নাম বাংলাদেশ, ওই তো আমার কবিতা আমার কবিতার নাম বাংলাদেশ, চির অপরূপ চির মধুর চির অপরাজেয় বাংলাদেশ।’

আপনি চশমা খুলে হাতে নিলেন, আপনার উজ্জ্বল চোখ দুটি থেকে গড়িয়ে পড়ল দুফোঁটা অশ্রু।

অনেক নিচে মর্ত্যের এক চার কোনা ঘরে লেখার টেবিলে বসে আছি— আমার চোখ ভিজে গেল আমি পাশ-টেবিলে রাখা বাংলাদেশের পতাকাটা বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, কে বলেছে আপনি নাই, এই তো আপনি আছেন—এইখানে, সবখানে, সমস্ত বাংলায়— এইখানে বাংলার লাল ও সবুজে আমাদের অশ্রু আর ভালোবাসায়, আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার আর এগিয়ে যাওয়ার অমোঘ মন্ত্রে— ‘মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না...’

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড