• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ডাক্তার বনাম লেখক

  অপূর্ব চৌধুরী

২৯ জুন ২০১৯, ১২:০২
কবিতা
ছবি : প্রতীকী

মাঝে মাঝে বিড়ম্বনায় পড়ি। নিজের কারণে নয়, পেশার কারণে। ভিনদেশি কারো কাছে নয়, দেশি শিক্ষিত লোকজনের কাছে। জিজ্ঞাস করে বসেন, ভাই আপনি ডাক্তারিও করেন আবার লিখেন, কেমনে কী?

কাল তো এক ভদ্রমহিলা রীতিমতো বলেই বসলেন, ‘কেমন যেন দুটো ব্যাপার কন্ট্রাডিক্টরি!’

অবাক হলাম, সাথে হাসি পেলো লোকজনের অজ্ঞতা দেখে। জানার পরিধি ছোট হলেই দেখার চোখটাও যে এতো ছোট হয়, জানা ছিল না। এমন করে বলে যেন, ডাক্তার হলে লেখালেখি অপরাধ! তিনি যেন সারাদিন ছুরি কাঁচি আর স্টেথো নিয়ে দৌড়বেন। তার কোনো কবিতার আকাশ নেই, কোনো হৃদয় তার চোখে মেঘের আড়ালে বৃষ্টি দেয় না, তিনি কোনো হরিণী চোখ দেখে শীষ দিতে জানেন না, বিজ্ঞানের কঠিন সত্যকে তিনি গল্পের মতো বলতে পারবেন না!

যাক, প্রসঙ্গ যখন এলো, ভিন্ন গল্প বলি। ডাক্তার লেখকদের গল্প। লেখক ডাক্তারদের গল্প। প্রাচীন গ্রিক দেব এপেলোকে ধরা হতো মেডিসিন এবং কাব্যের দেব। জিউস এবং লেটোর সন্তান এপোলো ছিল প্রাচীন গ্রীকের সবচেয়ে বেশি গুনের অধিকারী দেব । সংগীত থেকে আরোগ্য, যুদ্ধ থেকে প্রকৃতি, অনেক গুনের অধিকারী এপোলো ছিল গ্রিক এবং রোমান মিথের চিকিৎসক দেব।

এবার যাই মধ্যযুগের ইবনে সিনা র কাছে। এগারো শতকে ইসলামিক এই স্কলার ছিলেন একাধারে গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক, সাহিত্যিক এবং চিকিৎসক। ফাদার অফ মেডিসিন নামে পরিচিত আবিসিনা বা আবু আলী সিনা, জন্মেছেন আজকের উজবেকিস্তানের বুখারে। ৪০ টি বই লিখেছেন চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর, ১৫০ টি বই লিখেছেন দর্শন, সাহিত্য, কাব্য, এমনকি ধর্ম তত্ত্বের উপর। তার বিখ্যাত Canon of Medicine বইটি ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের বেশিরভাগ মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১৭ শতাব্দি পর্যন্ত মেডিসিনের প্রধান বই হিসাবে পড়ানো হতো। এমেরিকান একটি প্রকাশনী ১৯৭৩ সালেও বইটির একটি সংস্করণ প্রকাশ করেন!

অনেকেই কোপার্নিকাসের নাম শুনেছেন। পৃথিবীর পরিবর্তে সূর্যকে কেন্দ্র করে সৌরজগতের মডেল ঘোষণা দিয়ে যিনি আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছেন, পোল্যান্ডে জন্ম এই কোপার্নিকাস একাধারে গণিতজ্ঞ, রাজনীতিক, জ্যোতির্বিদ, লেখক, এমনকি ইকোনোমিস্ট ছিলেন, সাথে তিনি একজন চিকিৎসক ছিলেন।

আজকের ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি রাজনীতির জনক, ফাদার অফ লিবারেলিজম বলা হয় যাকে, সতেরো শতাব্দীর জন লক ছিলেন দার্শনিক, লেখক, রাজনীতিক, বিজ্ঞানী এবং সর্বশেষে ওই সময়ের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক। দর্শনের গভীর তত্ত্ব এমফেরিসিজমের উপর লেখার পাশাপাশি বিজ্ঞানের উপর কাজ করেছেন সেই সময়ের বিখ্যাত রবার্ট বয়েল, রবার্ট হুক দের সাথে। বিংশ শতাব্দীতে সিগমন্ড ফ্রয়েডের থিওরি অফ মাইন্ড লকের এমফেরিকেল দর্শন তত্ত্বেরই আধুনিক সংস্করণ।

আইরিশ কবি ও উপন্যাসিক ওলিভার গোল্ডস্মিথ এডিনবরা ইউনিভার্সিটিতে ডাক্তারি পড়েছিলেন, কিন্তু ডিগ্রি না নিয়ে তাস খেলে আর লেখালেখি করে কাটিয়েছেন।

উনিশ শতকের ইংরেজ সেরা কবি জন কিটসের নাম শুনেনি, সাহিত্যে পড়া এমন স্টুডেন্ট তেমন নেই, যিনি একজন চিকিৎসক ছিলেন। পঁচিশ বছর বয়সে যক্ষায় মারা যাওয়া এই জগৎ খ্যাত রোমান্টিক কবি আজকের কিংস কলেজ লন্ডনে মেডিসিনের উপর পড়েছিলেন।

রাশিয়ান লেখক, নাট্যকার, ছোট গল্পের জনক বলা হয় যাকে, সেই আন্তন চেকভ ছিলেন একজন ভালো চিকিৎসক । ফরাসি মোপাসাঁ র সাথে চেকভের ছোট গল্প বিশ্ব সাহিত্যের এক অনবদ্য সৃষ্টি। লেখালেখি এবং চিকিৎসা শাস্ত্র, দুটোই চালিয়ে যাওয়া এই মহান লেখক দুষ্টমি করে বলতেন, ‘Medicine is my lawful wife, and literature is my mistress.’

জার্মান এপিক লেখক গ্যেটের বন্ধু শিলার ছিলেন জার্মানির ইতিহাসে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ, দার্শনিক, কবি, প্রাবন্ধিক এবং চিকিৎসক।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর উপন্যাস লিখে যিনি ওই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ছিলেন, ইংরেজ লেখক, নাট্যকার সমারসেট মম একাধারে চিকিৎসক, ডিপ্লোম্যাট, সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট এবং মহাযুদ্ধের সময় রেড ক্রসে কর্মরত ডাক্তার ছিলেন।

অনেক ডাক্তাররাও জানে না যে আধুনিক মেডিসিনের জনক উইলিয়াম ওসলার, কানাডিয়ান এই বিখ্যাত ডাক্তার, আমেরিকার মেরিল্যান্ডে বিখ্যাত জন হপকিন্স হসপিটালের প্রতিষ্ঠাতা, হিস্ট্রি অফ মেডিসিনের গুরু, বেডসাইড ক্লিনিকেল ট্রেইনিংএর প্রচলন করেন প্রথম যিনি, যা আজকে থার্ড ইয়ারে ক্লিনিকেল ওয়ার্ড ট্রেইনিং নামে পরিচিত সারা বিশ্বে, ব্যক্তিগত ভাবে প্যাথোলজিস্ট এবং এমন ডাক্তাররা কম আছেন যারা পড়েনি তার বিখ্যাত মেডিসিন টেক্সট বুক The Principles and Practice of Medicine, তিনি একাধারে এক ক্ষুরধার লেখক, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ এবং ডাক্তারদের ডাক্তার ছিলেন!

শার্লক হোমসের জনক আর্থার কোনান ডোয়েল একজন ভালো চিকিৎসক ছিলেন তার সময়কালে। এডিনবরা বিশ্ববিদ্দালয়ে মেডিসিনে পড়াকালীন অনেক ডিটেকটিভ লেখার পাশাপাশি এই লেখক চক্ষু বিশেষজ্ঞ ছিলেন।

নিউরোলোজিস্ট সিগমন্ড ফ্রয়েডের লেখক সত্তাই তার মনো ব্যাখ্যার তত্ত্বকে এতটাই প্রভাবিত করেছে যে বিংশ শতাব্দীতে দর্শন থেকে সাহিত্য, রাজনীতি থেকে বিজ্ঞান, সর্ব ক্ষেত্রেই ফ্রয়েডের মনস্তত্বের ব্যাখ্যা প্রভাব ফেলেছে।

অনেক পুরনোদের কথা বললাম। এবার না হয় একটু নতুনদের কথা বলি।

কাবুলে জন্ম নেয়া, ইরানে আশ্রয় পাওয়া, প্যারিসে কৈশোর কাটানো এবং সর্বশেষে আমেরিকায় রিফিউজি হয়ে কেলিফোর্ণিয়ার সান্ডিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারনাল মেডিসিনে রেসিডেন্সি করা A Thousand Splendid Suns, The Kite Runner এর মতো বিশ্ব সাহিত্যকে নাড়া দেয়া বিপুল জনপ্রিয় দুটি গ্রন্থের প্রণেতা একুশ শতকের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক খালিদ হুসাইনি পেশায় একজন ডাক্তার।

দেশের লেখকদের কথায় আসি। প্রবীণ দুজন লেখকদের কথা বলতেই হয়। ঢাকা মেডিকেল থেকে পাস করা বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত লেখিকা আনোয়ারা সৈয়দ হক একাধারে সাইকিয়াট্রিস্ট, উপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, এবং শিশু সাহিত্যিক। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রাণ রসায়নবিদ শুভাগত চৌধুরী এ পর্যন্ত 50 টি বই লিখেছেন। লেখিকা তাসলিমা নাসরিন ময়মনসিং মেডিকেল থেকে পাশ করে বিসিএস দিয়ে ঢুকে সলিমুল্লা মেডিকেল কলেজে এনেসথেসিয়া বিভাগে কাজ করতেন দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত। মনোচিকিৎসক মোহিত কামাল অনেকদিন ধরে গল্প লিখছেন। দেশের লেখালেখির প্রধান ধারায় লিখে যাচ্ছেন রাজশাহী মেডিকেল থেকে বের হওয়া বাংলা একাডেমির পুরস্কার প্রাপ্ত কথা সাহিত্যিক জাকির তালুকদার, চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে আগত ক্রাচের কর্নেল লেখার জন্যে খ্যাত মেডিকেল এনথ্রোপোলজিস্ট শাহাদুজ্জামান।

বাংলা সাহিত্যের তিন দিকপালের গল্প বলে শেষ করি। কবিতায় রবীন্দ্রনাথ, কথা সাহিত্যে শরৎচন্দ্র এবং ছোটগল্পে বনফুল। তিনজনের একটা মজার মিল ছিল। তিন জনই রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক কালের। না, এটা মিল নয়। তিন জনই সে যুগে চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তখন মডার্ন মেডিসিন বা ডাক্তার বলতেই ছিল না। রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন হোমিওপ্যাথির প্রাকটিস করেছেন। নিজে, পরিবারে, লেখক বন্ধুদের, এমনকি প্রজাদেরকেও হোমিও ওষুধ দিতেন। ভ্রমণে গেলে বাক্স পেট্রার সাথে হোমিও দাওয়াইয়ের সুটকেস থাকতো। চিঠিপত্রেও তিনি হোমিও প্রেসক্রিপশন লিখে পাঠাতেন শুভাকাঙ্খীদের। শরৎচন্দ্র বার্মার রেঙ্গুনে থাকাকালীন দীর্ঘ সময় শ্রীকান্তের মতো উপন্যাস লেখার কালে হোমিওপ্যাথির চর্চা করতেন, কেরানির চাকরির পাশাপাশি পাড়ায় রোগী দেখতেন বিকেলে। পরে কলকাতায় ফিরে ভাগলপুর এবং বালিগঞ্জে থাকাকালীন হোমিও প্রাকটিস অব্যাহত ছিল আরো কিছুদিন। বাংলা সাহিত্যের মোপাসাঁ বনফুল ওরফে বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এলোপ্যাথিক ডাক্তার, প্যাথোলজিস্ট।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড