হাসনাত নাগাসাকি
বিচারালয়
কাঠগড়া থেকে নেমেই গ্যালিলি বললেন - মহামান্য আদালত, সব কিছুই ঘূর্ণায়মান। নক্ষত্র, পৃথিবী, চাঁদ, অক্ষিগোলক, হৃদয়, মানুষের হৃদয়ের ফাঁদ; এমনকি সত্য, এমনকি মিথ্যা, আপনার হাতের কলম, কলমের নিভ।
মহামান্য আদালত, ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখুন, পশ্চাতে আপনার ছায়া পৃথিবীর সেরা কৌতুক। এখনো যারা ঘুরঘুর করে ঘুরছে এই বিচারালয়ে, মূলত বের হবার পথ ভুলে গিয়ে, তাদেরকে আদেশ দিন জামা-পাতলুন উল্টায়ে পড়ে আসতে; এবং সঙ্গমকালে তারা যেন সমধিক ঘূর্ণন রপ্ত করে।
মহামান্য আদালত, আমরা যারা আপনাকে মহামান্য বলি- আপনি কি বাড়ি ফিরে রেচনক্রিয়া করতে করতে অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন? আমাদের নির্বুদ্ধিতায়?
গ্যালিলিও গ্যালিলি ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর দিকে দীর্ঘশ্বাস ছুঁড়ে বললেন- মানুষ কি ক্রমেই অস্বীকার করছে প্রপিতার নাম? মানুষ কি দেখতে পাচ্ছে না যারযার মাথার খুলির ক্রম নিমজ্জন? একদিন, যেদিন অন্ধকারে টলে উঠবে বিচারালয়, টলে উঠবে চেয়ারের পায়া- আমি বলবো, এখানে একটি মিথ্যার জাদুঘর হোক।
গ্যালিলিও গ্যালিলির অকস্মাৎ হিসু পেলে- পৃথিবীর সর্বত্র তিনি দেখতে পেলেন পাপ ও পঙ্কিল ক্ষত। বিচারালয় তাকে জেলে পাঠালেন
বাঁশি
আমার হাতে বারোটা বাঁশি ছিল আমি বাজাবো ভাবলাম
প্রথমটা বাজাতেই শৈশবের পুকুর ফুলে উঠলো আমি সেই পুকুরে বাঁশিটা ফেলে দিলাম
আমার হাতে এগারোটা বাঁশি ছিল একটা বাঁশি ধার দিলাম বন্ধুকে সে এখন মানসিক রোগী একটা দিলাম কৈশোর-নদীকে - নদীরা কথা রাখে না
আব্বা বললেন- সামনেই মাঘের শেষ, মেলা বসবে তালতলা মাঠে
মেলা থেকে ফিরে আমার হাতে তিনটা বাঁশি আছে আমি বাজানোর সিদ্ধান্ত নিলাম
যৌবনে তুমি এলে যৌবনে তুমুল তুমি এলে
তোমার চোখগুলো আফ্রিকার ঘনবন তোমার চিবুক সাইবেরিয়া আমি ভাবলাম- ভূমধ্যসাগর হয়ে এদিকে আসা যাক, এদিকে- আমার জন্মের দিকে
আমার মা একটা মিছিল আমার বোন পতিতার হাসি
মাকে একটা বাঁশি দিলাম- জন্মের ঋণ বোনকে একটা বাঁশি দিলাম- খদ্দের না পেলে তার চলবে কী করে! আর, তোমাকেও একটা বাঁশি না দিয়ে পারি?
আমার হাতে এখন বাকি আমি আমি নিজেকে বাজাবো ভাবলাম।
নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে
নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে মধ্যবিত্ত পিতাদের মিথ্যা বলা শিখে নিতে হয়।
শিশুটিকে বলতে হয় -বাজারে আজ ভালো মাছ পাওয়া যায়নি, মুরগীও ফুরিয়ে গেছে। আপেলগুলো বিচ্ছিরি রকম পোকা-কাটা ছিলো। বলতে হয়- পুঁইশাকে অনেক পুষ্টি, প্রতিদিন পুঁইশাক ভালো।
নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে মধ্যবিত্ত স্ত্রীর মুখ বৃষ্টিহীন থমথমে আষাঢ়-বিকেল; সূচ্যগ্র ফুটো হলেই সে আকাশ ভেঙে পড়লো বলে।
এইসব ঘনঘোর দিনে আসন্ন প্রলয় ভয়ে কুঠুরির কোণে চুপচাপ ঠাই নেয় মধ্যবিত্ত পাখির ছানারা।
নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে, পাল্লা দিয়ে না বাড়লে ঘাম আর সময়ের দাম- কিচেনে পাতিল আর ঢাকনারা সহ্য করে ধুপধাপ নির্দোষ সাজা। তখন কখনো কখনো মিথ্যারা শিল্প হয়ে ওঠে, মুখগুলো বুড়ো হতে থাকে সেইসব সহনশিল্পে। মাথাগুলো নিচু হয়, ফুলগুলো বিক্রি হয় কুঁড়ি থাকতেই।
দেশটা এগিয়ে যাচ্ছে - প্রতিদিন বাড়ছে দাম- এটাই প্রমাণ। দেশটা এগিয়ে যাচ্ছে - মানুষের নাভিশ্বাস আকাশ সমান। মিথ্যার পাহাড় ঠেলে দেশটা এগিয়ে যাচ্ছে - মানুষ শুধু এগুতে পারছে না! যাত্রীদের ফেলে রেখে যেই ট্রেন ছুটে যায় - সেই ট্রেন ভূতুড়ে, অচেনা।
কবির সম্মুখে
কবির সামনে উদ্ধত নয়, সংযত হও; পা নামিয়ে বসো, মন্ত্রী। যেমন সর্বদ্রষ্টা বিদগ্ধ পিতার সামনে ন্যুব্জ হয়ে বসে কিশোর সন্তান, যেমনি পর্বতের পাদদেশে দাঁড়ায়ে অকস্মাৎ নিজের ক্ষুদ্রতা বুঝতে পারে অবোধ বালক - তেমনি ছোট হও, আরো ছোট হয়ে বসো কবির সম্মুখে।
সকলেই জানেন, এ দেশ একদিন নদীমাতৃক ছিল, বাতাসেও সোঁদা মাটির সুগন্ধি ছিল। সকলেই জানেন, এ নদী নিঃশর্তে সন্তানের তৃষ্ণা মেটাতেন। কবিতার মতোই নরম পলির বুকে পরতে পরতে তার ছন্দোবদ্ধ প্রতিরোধ-ইতিহাস।
এ সোনার দেশে একদিন - ফুঁ দিয়ে বৃষ্টি ঝরাতো কবি। কবিতার কর্ষণে পলির বুকে মাথাচাড়া দিয়েছে ফসল, দুঃসময়ের মুখোমুখি অগ্নিপ্রাচীর হয়ে বুক বাড়িয়ে দিয়েছিল কবি।
তোমাদের ঔদ্ধত্যে আজ কবিতারা নির্বাসনে; মঞ্চে বেজে যাচ্ছে, আর, মাছির ভনভন।
কবির সম্মুখে উদ্ধত নয়, সংযত হও, গলা নামিয়ে কথা বলো, রাষ্ট্র। কবি এক সর্বদ্রষ্টা আজব আয়না। তোমার ভেতরের থৈথৈ পাপ পলকেই দেখে ফ্যালে কবি। সাক্ষী ইতিহাস, একটি নগর পত্তনে অথবা পোড়াতে একটি কবিতাই যথেষ্ট।
সুতরাং হাঁটু গেড়ে বসো মুখোমুখি, একজন দয়ালু পিতা ক্ষমা করে দিতেও পারেন সন্তানের অতলান্ত পাপ।
আরও পড়ুন: কোকিল একটি পাখি
ওডি/এসএন
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড