• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

প্রবন্ধ

সরসিজ আলীমের : সময়ের সচেতন ও বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন শিল্পিত কবি

  বঙ্গ রাখাল

১৮ জুলাই ২০১৯, ১৪:৩১
কবিতা
ছবি : প্রতীকী

‘A poet cannot write the poetry he wants to write but on the poetry that is within him’ অর্থাৎ- কবি আপন ইচ্ছেমতো কবিতা লিখতে পারেন না, কেবল যে কবিতা স্বভাবে আছে- একেই ফুটিয়ে তুলতে পারেন। যে কোনো খাঁটি কবির জন্য এ কথা ষোল আনা সত্য। কবিতা মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। কবিতার মাধ্যমে মানুষ যত সহজে তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে অন্য কোনোভাবে তা প্রকাশ করা সম্ভব কি না সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। মানুষ যা ভাবে মনের মধ্যে তখন তার একটা রূপকল্প তৈরি হয়। তা যদি মানুষের জন্য আনন্দময় বা কল্যাণকর হয় তখন তাকে মানুষের সামনে আনার জন্য মানুষ এক প্রকার তাগিদ অনুভব করে। তাই তো তখন মানুষ লেখার মাধ্যমে অন্যের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করেন। এভাবেই মানুষ একের পর এক সৃষ্টি করে থাকেন তার সৃষ্ট কবিতা বা কোনো লেখা এবং তখন তার মোড়ক উন্মোচন করে মানুষের সামনে ধরেন, অবশ্য মানুষ এটাকে প্রকাশের তাগিদ থেকেই করে থাকেন। মানুষের অনুভূতির একটা উন্মাদনা থাকে, সেটা কখনো-সখনো নিজস্ব ব্যঞ্জনায় বা নিজস্ব রূপ রসের মাধুর্যে অপরূপ হয়ে ডাল-পালা বিস্তার করতে থাকে। সেই বিশেষ অবস্থা থেকেই তো মানুষ তার মনের সাত-রং ঢেলে তার কবিতা বা কোনো সৃজনশীল কাজ করে থাকেন। এটাই তো কবির কবিতার জনন-মুহূর্ত। সৃজনকলার নতুন নতুন ভাবনা বা কল্পনা এসে ডানা ঝাপটে বসে পড়ে কবির কাছে তখন কবি তাকে আপন কলাকৌশলের মধ্যদিয়ে অন্যের মনে সঞ্চারিত করে দিতে চান।

আমরা যদি কখনো ভাবি যে কবিতার ভাবনা কি বা কবির ভাবনাটা কেমন করেই বা সৃষ্টি হয়। তখন আপনা আপনিই তো জাবাব পেয়ে যেতে পারি কবির ভাবনার অনুপ্রেরণার মূলেই তো এই বিশাল পাঠশালার ন্যায় জগত শালা রয়েছে। এখান থেকে আমরা যে যত পারি বিদ্যা সংগ্রহ করে নিই। আমরা যদি সাধারণ দেখা আর কবির দেখা এক করে দেখি তখনই কিন্তু পোহাতে হয় আমাদের নিশিত আঁধারকাল। কারণ সাধারণ মানুষের দেখা আর একজন কবির দেখা এক নয়। একজন সাধারণ মানুষ একটা বস্তুকে যেভাবে দেখে একজন কবি তাঁর সেই দেখাকেই নানা আঙ্গিকতার মধ্য দিয়ে দেখে থাকেন। কবিতা হলো সেই জিনিস যা আমাদের বাঁচার প্রেরণা জোগায়। কবিতা তো আমাদের জীবনের খণ্ড খণ্ড গল্প। আর এ কবিতা যদি না লেখা হতো তাহলে মানবজীবন কখনো পূর্ণতা লাভ করতে পারত না। কবিতার এক অসীম শক্তি রয়েছে। যে শক্তি একজন কবিকে মহিমান্বিত করে তোলে। আর আলো আঁধারিত জগত থেকেই তো কবির কাছে কবিতা এসে ধরা দেয়। এ ধরা আবার সহজতর নয়। কবিতার জন্মকালে কবিকে পোহাতে হয় নানা যাতনা-যন্ত্রণা। যেন ভূমিষ্ঠ হওয়ার ব্যর্থতায় কবি থর থর করে কাঁপতে থাকেন, হয়ে ওঠেন অশান্ত ও অধৈর্যশালী এক রাবণ। উত্তেজনা বাড়ে; আউড়াতে থাকেন নিজের অন্তরের ধন অমৃততুল্য মহান বাণী। এ বাণীকে কবি যখন লিখিত রূপ দেন তখন কবি হয়ে ওঠেন শান্ত। যখন একটা কবিতা লেখা হয় তখন কবির তৃপ্তির সীমা থাকে না। তখন তিনি বারংবার পড়তে থাকেন তার কবিতা। একটা কবিতার কবি তো নিজেই সবচেয়ে বড় পাঠক।

যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ কবিতা পড়ে কবির মন তৃপ্ত হচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত কবি ঐ কবিতাকে কাঁটাছেড়া করতেই থাকেন। কবিতা তো সমুদ্রের বালি ও ফেনা। অসংখ্য তরঙ্গেই তো কবিতার নির্মাণ হয়। কবিতা তো মানবের মুক্তির আবিষ্কার। কবি তো জীবন্ত থাকতে চাই। কবি পেতে চাই অমরত্ব। নশ্বর এই জীবনে কবি হতে চান অবিনশ্বর। যেখানে কবি চিরস্থায়ী হয়ে বেঁচে থাকবেন। কোন জরাজীর্ণতা এসে স্পর্শ করতে পারবে না কবিকে। তাই তো কবিতা অবিনশ্বরের প্রতিপক্ষরূপ নিয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের মুখোমুখি। কবিতাই তো একজন কবিকে অমরত্ব দান করে। টিকিয়ে রাখে ইতিহাস কবিকে যুগের পরে যুগ। একটা কবিতা সাক্ষী হয় একটা যুগের, ইতিহাস হয় একটা কালের। কবিতা কখনো কবির প্রিয়া বা শত্রুর জন্য লিখিত হয় না। কবিতা সব সময়ই কবির আত্মার অমৃতবাণী হিসেবে গতিশীল হয়। কখনো কখনো কবি নিজেই কবিতাকে ভুলে যান কিন্তু কবিতা কখনো নিজেকে ভুলে যায় না। সেটি স্বমহিমায় নিজে অতীতের জামিন দেয়। মাঝে মাঝে কবি নিজেকে অস্বীকার করতে চান। জরাজীর্ণ এক ব্যর্থ মানুষ হিসেবে নিজেকে কবি নিজের অস্তিত্বের কাছে ভারী মনে করেন। কিন্তু কবিতা নিজেই নিজেকে প্লাবিত করে নিয়ে যায় কাল হতে কালান্তরে। তাই তো একটা কবিতা পৃথিবীতে বয়ে আনতে পারে শান্তি আবার অশান্তিরও কারণ হতে পারে একটা কবিতাই। কখনো কখনো কবিতাই হাতিয়ার হিসেবে মানুষের মনে আঁকতে পারে নানা আঁচড়। কবিতার আবেদন যেহেতু চিরন্তন, সুতরাং সে কারণেই কবিতাকে ত্রি কালের মধ্যে বাস করতে হয়। কবিতা বস্তুর অধীনতার নাকপাশ থেকে মুক্ত বলেই সে মর্যাদাসম্পন্ন এবং শৈল্পিক। কবি সরসিজ আলীম এ সময়ের একজন সচেতন এবং একজন বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন শিল্পিত কবি। যে তাঁর কবিতায় বিষয়বস্তুকে যেমন- নানা আঙ্গিকতার মধ্যদিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। তেমনই উন্মোচন করেছেন প্রেম, স্বপ্ন আর হতাশাময় জীবনের কুজ্ঝটিকার পর্দা। তাঁর মেদহীন কবিতাগুলোর পঙক্তিগুলো তাঁর গভীর চেতনামানসের এক জীবন্তফসল। সরসিজ তাঁর কবিতার প্রতিটি ছত্রে ছাত্রে এঁকেছেন তাঁর সময়ের নানা যাতনা, যন্ত্রণা, প্রেম আর ধূসরতাময় জীবনের খসে পড়া তারার ঝলকানি। তবু তিনি হতাশায় বুক বেঁধে নয় আশায় বুক বেঁধে সাজাতে চান এই বসুধা- জলপিঁপড়ের চলাচল শেষ হলে আবারো আরো একটি আয়নার সামনে দাঁড়ায় আরো একটি সকাল! [প্রতিদিন/ঘোড়দৌড়-পৃষ্ঠা.৫০]

আমরা চোখ মুছতে মুছতে চোখের ভুল দেখা মুছে- ফেলার চেষ্টা করতে করতে কুয়াশার ভেতর ঢুকে পড়লো এক ঝাঁক ইস্কুলগামী রোদ্দুর! [দৌড়ে যাচ্ছি/ঘোড়দৌড়-পৃ.৫১]

আর আমি স্বাপ্নের হাত ধরে আর্নেস্তো চেগুয়েভারা পথ ধরে হেঁটে চলেছি- পৃথিবীর দেশে দেশে! [দালাল/ঘোড়দৌড়-পৃ.১২]

সবুজ ঘাসের উপর পা ফেলে ফেলে শিশুপুত্র বাবার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে, বৃদ্ধ বাবা যুবক পুত্রের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে, আর তাহাদের মাথার উপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যাবার কালে নতুন ফুল নানা রঙ্গের ছিটিয়ে দিলো। [সম্পর্ক/ঘোড়দৌড়-পৃ.৩৬]

ফুল কুড়ানো হাত গাছের পাতায় দিয়েছে দোল সেই দোলে পাখিদের কণ্ঠে কলরব জাগিয়াছে [বটমূলে/বাঙালি আর বাউল পরাণ থৈ থৈ জল-পৃ.১০]

বৃষ্টি আজ মুখর শিল্পী, তোমার শাড়ি উপর একটানা তুলি টেনে যাচ্ছে, তুমি ক্রমাগত উম্মোচিত হচ্ছো নতুন রঙে, আলোর নাচন পাতায় পাতায়। [নতুন রঙে/ঘোড়দৌড়. পৃ-৫৯]

কবি যেমন আশাবাদী হয়েছেন। ঠিক তেমনই আবার নানা পাশে নানা রকম বিপর্যয়, মারামারি, হানাহানি, মানুষের মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখে তিনি বারংবার হতাশ হয়েছেন। শুধু কি তাই! তিনি গুমরে গুমরে ভেঙে ফেলছেন তার মনকে। যে মন একদিন স্বপ্ন দেখে ছিল সোনালী সকালের, পাখি ডাকা ভোরের। সে মনে আজ বাসা বাধে হতাশা আর নৈরাজ্যতা। চারিদিকে নারীর অপমান, নির্যাতন, অবহেলা। যে নারী কবির বোন, মা। সেই নারীই তো কবির প্রেমিকা। কিন্তু সেই নারীর মুখে এসিড নিক্ষেপ, নারীকে হত্যা করে ডাস্টবিনে রাখা, নানা যন্ত্রণা কবিকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে- এখন অন্ধ চোখে খুঁজে চলেছি মর্জিনাদের মুখ [মর্জিনা আমার কেউ না/ঘোড়দৌড়- পৃ.৬৩]

আমার বুকের ভেতর সেই থেকে চিৎকার করে ফিরছে- অপর এক নদী- [অপর এক নদী/ঘোড়দৌড়- পৃ.৬৪]

আমার হারানো চোখ দিয়ে শুধু তোমার পৃথিবীকে দেখছি আমি [নিম আমার প্রেমিকা/ঘোড়দৌড়-পৃ.৬২]

বৃক্ষটি আকাশ ছুঁয়েছে, আর রঙের স্রোতে ভাসছে বৃক্ষটি [শাসনতন্ত্র/ঘোড়দৌড়-পৃ.৪০]

প্রতিরাতে ঘরের খবর সে বলতে পারে না [গন্ধ গড়ানো/বাঙালি আর বাউল পরান থৈ থৈ জল. পৃ-৫৪]

তাহার কান্নাগুলো দৌড়ে যাচ্ছে ক্ষেতের ভেতর, কলাপাতার উপর [বাদুড়ের ডানা/বাঙালি আর বাউল পরান থৈ থৈ জল. পৃ-৬৩]

মাংস পুড়িতে ছিলো, রক্ত পুড়িতে ছিলো রক্ত গড়াইতে ছিলো হাতে হাতে সবাই নৃত্য করিতেছিল, ভোজ সভা নৃত্য করিতেছে। রক্ত গড়াইতেছে পাখিরা উড়িতেছে আকাশে আকাশে [ভোজন সভা/বাঙালি আর বাউল পরান থৈ থৈ জল- পৃ. ৪১]

আজ যেন মানুষের কোন মূল্য নেই। মানুষের বিপর্যয়ের জন্য মানুষেরই বিজয় উল্লাস করা সাজে। মানুষ যেন আজ যান্ত্রিক। তার অন্তরে কোন মায়া, মমতা প্রেম নেই। এ সমাজে ব্যস্ততাই যেন মানুষের এই পরিণতির জন্য দায়ী। সামাজিক ব্যতিচার ভদ্রতার লেবাসে ঢাকা সভ্যতার শ্লীল অশ্লীল বোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খায় কবির অন্তঃসত্ত্বাকে। একদিকে মানুষের মাতম অন্য দিকে হা-অন্ন, হা-অন্ন বলে ছটফটানি দেখে কি করে নীরব থাকতে পারেন একজন কবি। তাই তো কবি বিদ্রোহী হয়ে উঠে দীপ্ত স্বরে গাইলেন- আমি অস্বীকার করলাম ঈশ্বরকে আর চার পাশের মিথ্যা কে পদদলিত করতে চাইলাম আমার পিতা লাঠির জোরে আদিম সমাজের মুক্ত মানুষগুলোকে শৃঙ্খলিত করে দাস বানিয়েছে। [আলোরগতির অধিক/ঘোড়দৌড়. পৃ-২১]

চিলের ঝাঁক উড়ছে আমার আকাশে, আমার লাশ ছিনতাই করে নিয়ে যাবে পানশালার টেবিলে, আমার লাশ ঘিরে আমার প্রভুরা পান করবে উৎসব, মেয়েরা বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত হবেন। [মারা যাচ্ছি/ঘোড়দৌড়. পৃষ্ঠা-৫৪]

দুঃখেরে এই একটানা আঁধার ঘরগুলোতে ক্ষুধার্ত শাদাকালো ছবি বসে থাকে। [এক আকাশ/বাঙালি আর বাউল পরান থৈ থৈ জল. পৃ-১৮]

যে কোন দেবালয়ে ঢুকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে যেতে পারি আবার ধর্ম বিদ্বেষী হয়ে উঠতে পারি ভাঙচুর করে দিতে পারি উপাসনালয়ের নান্দনিক ভবন [দৌড়ে যাচ্ছি/ঘোড়দৌড়. পৃ-৫১]

কবি বলেছেন ধনী-আর দরিদ্র এ দুইজাতি আমাদের পৃথিবীতে। এ অবহেলিত বা দারিদ্র জাতির মানুষগুলো সংগঠিত না হলে কখনও বিপ্লব আসবে না। এ মানুষগুলো যতদিন সংগঠিত হবে না ততদিন এদের অবস্থার কোন উন্নতি হবে না। এ শাসনযন্ত্র আমাদের তিলে তিলে মারবে। ধর্মের দোহাই দেয় আমাদের শুধুই মারবে। আর বলবে তোমাদের ঈশ্বর তোমাদের যেতে দেয় না। গরিবদের সংগঠিত হতে হবে নতুবা ধ্বংস অনিবার্য। আমাদের ক্ষমতাশালী নেতারা প্রেমিক হতে পারে নি। তারা প্রকাশ্যে প্রেমিক সাজে আর অন্য ঘরে নগ্ননারীর সাথে মাস্তিতে মাতে। শিশ্নে মাংস ঝুলিয়ে তাদের শিকার করে। আজও এদেশের মানুষ ক্ষুধার্ত দিন কাটায়। খাদ্যের অভাবে নারী তার সম্ভ্রম বিকিয়ে দেয়। সন্তান বিক্রি হয় শুধু মাত্র খাদ্যের জন্য। সে দেশেই আবার নান্দনিক বর্ধনের জন্য রাস্তায় ফুলের গালিচা শোভা পায়। ফুল হাতে ফুলদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয় মহামান্য প্রেমিক নেতাদের বরণ করার জন্য- তোমরা যারা বিশ্বাস করোনি অথচ তোমরা অসংগঠিত তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য [অবিশ্বাস/ঘোড়দৌড়. পৃ-৪৬]

আমাদের মহান রাজনীতিকেরা প্রেমিক হতে না পেরে পর্নোনারীর গলা ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। [প্রেমিক/ঘোড়দৌড়. পৃ-৪৭]

বোয়াল মাছের ক্ষুধার্ত চিৎকারে আতঙ্কিত বৃক্ষটি কাপে [জঙ্গলে যাবো/ঘোড়দৌড়-পৃ.৪৭]

আমি কইলাম-উদ্যানে উদ্যানে ঠ্যাঙ নাচায় আমার বউ দশ টাকার বউ বিশ টাকার বউ... আমার কানের কাছে তোর একটানা গোঙ্গানি আমার বুকের মধ্যে আর্তনাদের মতো শ্বাস ফেলে সারা রাত তোরে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখতে মন করে... আর তুই যখন পয়সা মিটিয়ে নিয়ে অন্য ঝোপের মিটিয়ে আড়ালে চলে যেতে চাস, খুব ঘিন করে তোকে সুচরিতা। [ঘিন করে তোকে/ঘোড়দৌড়. পৃ-৪৪]

কবি সরসিজ আলীম কোন কিছুতে ভীতু নয়। তিনি বিশাল আস্তর ভেঙ্গে সমভূমি তৈরি করতেও প্রস্তুত। কোন কথা তিনি রাগটাক দিয়ে বলতে রাজি নয়। তিনি যা বলবেন তা স্পষ্টভাবে বলতেই পছন্দ করেন। তাই তো তিনি সবকিছু স্পষ্টবাদীর মতো বলে দিয়েছেন- যে মানুষটা বোকাসোকা কামুক পুরুষ যে মানুষটা বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছে মেয়েদের দিকে যে মানুষটা নিতম্বের দিকে তাকিয়ে দেখছে হংসীগমন তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করো, এসো তাহাকে জিজ্ঞেস করি, তাহার ঘরের নারীর খবর, আর প্রতিরাতে গন্ধ গড়ানো। [গন্ধ গড়ানো/বাঙালি আর বাউল পরান থৈ থৈ জল-পৃ.৫৩]

আমরা নিজের ঘরের নারীর খবর রাখিনা। অথচ অন্য কোন নারীকে দেখলে কামুক হয়ে উঠি। পেতে চাই তার বুকের উষ্ণ ওম। রাখতে চাই তার চোখে চোখ, হাতে হাত, যোনিতে ঠোঁট। আজ সাম্রাজ্যবাদ আমাদের শিক্ষা দিয়েছে প্রতিটা জিনিস নিয়েই ব্যবসা করতে হয়। ফলে এতে কবি ব্যথিত। তাই তো তাঁর কবিতায় অনিবার্য ভাবে এসে পড়ে- সাম্রাজ্যবাদের কালো থাবা এবং এর ফলাফলও শোভনযুক্ত নয়। ক্ষয়ে যাচ্ছে আমাদের বিবেকবোধ। ধবংস হচ্ছে আমাদের পরস্পর শ্রদ্ধা আর মূল্যবোধ। যেখানে নৈতিকতা শুধু বুলি।- সাম্রাজ্যবাদের জিহ্বা থেকে ঝড়ে পড়ছে লালা। উপনিবেশিক শক্তির কাছে বড্ড অসহায় ছিল তবে তুমি রবীন্দ্রনাথ, সাম্রাজ্যবাদের কাছে নগণ্য তুমি হে [আনন্দগুলো/ঘোড়দৌড়. পৃ-২৫]

সাম্রাজ্যবাদ আমাদের মূল্যবোধহীন করে তুলছে। এ বোধহীন সমাজে মানুষের প্রতি মানুষের কোনো সম্মান থাকে না। আর দায়ের তো কোনো কথায় আসে না। আমরা গুণী, সুধাজন নিয়ে মেতে উঠি ব্যবসায়। এসব কিছু কবিকে ব্যথিত করে তোলে। অতঃপর কবির কাছে নাগরিক জীবন অতিষ্ঠ হয়ে এসেছে। সে বারংবার ফিরে যেতে চাই গ্রামে। যেখানে কবির বেড়ে ওঠা, যে মাটির সোদা গন্ধ কবিকে মাতাল করে রাখতো। মনে ভরে যেতো সকালের পূর্বালি বাতাসে। ধান্যঢেউ, পাখি, বাঁশঝাড়, বৃক্ষ, জলশ্যাওলা, মায়ের তাঁতের শাড়ি, ঝরা পাতা এসব কবিকে পাগলের মতো টানতো। কবি শান্তি খুঁজেছে যে লালনের গানে আর কবি যেখানে বড় হয়েছেন সে অঞ্চল যেন লোকগানের চারণভূমি। তাকে মাতাল করে দিতো পাগলা কানাই, পাঞ্জুশাহ গাজী কালুর পালা, লালনের গান। সেজন্যই তো আমরা ঘুরে ফিরে দেখেছি তাঁর কবি তাই লোকজও জিনিসের বেশি আনাগোনা। বারংবার এসেছে তারগ্রাম, নদীর তীর, বটবৃক্ষ, একতারা হাতের বাউল পরান। তিনি যেন মাতাল পুরুষ। তিনি নারীকে ভজনা করতে চেয়েছেন বাউল বেশে। কারণ বৃহৎ বিচারে নারীইতো প্রকৃতি। বাউল মতে সাধনার জন্য পুরুষবাউল সঙ্গিনীকে প্রকৃতি হিসেবে বেছে নেন। ফলে প্রকৃতি ভজনা আর নারী ভজনা ব্যাপারটাই হাত ধরাধরি করে চলে আসে কাল হতে কালে। ...ভাঁজে ভাজ করতে করতে আমার গাঁওখানিকে ভাজ করে ফেলতো আর খুব যতন করে তুলে রাখতো তাহার মায়ের তাঁতের শাড়ির পাশে।

আমাদের গাঁওখানি হাসে খেলে, পতি দোলায় চিত্রা নদীর পার। [আপন গাঁওখানি/ঘোড়দৌড়. পৃ-১১]

ঘুমাতে পারে নাগুলো বৃষ্টিতে ভেজে পাখির ডানায় উড়ে উড়ে ক্লান্ত ডানা গিয়ে বসে বকুলের ডালে, বকুলের তলে সন্ধ্যাগানের আসর, লালন কাঁন্দে- বাঙালি আর বাউল পরান থৈ থৈ জল। [গাছেদের পাতাদের তলে/বাঙালি আর বাউল পরান থৈ থৈ জল. পৃ-৯]

তোমরা যে বটমূলে গান করো আর গান শোন সেই বটমূল আছে আমাদের নদীর কূলে আমরা সেই নদীকূলে বাজাই বাঁশি, বাঁশি শুনি সেই বাঁশির চার পাশে ভিড় করে পাখিরা থাকে- পাখিরা ঠোঁটে করে বাঁশি নিয়ে যায় আকাশ পারে। [বটমূলে/বাঙালি আর বাউল পরান থৈ থৈ জল. পৃ-১০]

এক ঝাঁক আঁধার পথের উপর জড়ো হয়ে পুঁথি পাঠ করবে পুঁথি পাঠের আসরের গা ঘেঁষে দম বন্ধ করতে করতে... [হয়তো কখনো/ঘোড়দৌড়. পৃ-২৩]

আঙুলের ঝিলিক থেকে ঝরতে থাকে বাউল লালনের গান...... [একটি সকাল/ঘোড়দৌড়. পৃ-৪৩]

মাটির দেয়াল জলকাদায় হলো মাখামাখি..... [এক আকাশ/বাঙালি আর বাউল পরান থৈ থৈ জল. পৃ-১৯]

পদ ছাপ শুকিয়ে গেলে হাল চাষ গড়াতে থাকে মাঠে মাঠে; ঢেলারা ডেকে ডেকে যায় মই গড়াতে থাকে ঢেলার উপর [ধূলি ধূসর/বাঙালি আর বাউল পরান থৈ থৈ জল. পৃ-৪২]

কবি যে সর্বজায়গা হতাশাবাদী বা স্বপ্নবাজ তা কিন্তু নয়। তিনি প্রেমিকও বটে। তিনি কখনও প্রেমিক আবার কখনও বিপ্লবী। প্রেম দিয়ে তিনি জয় করতে চান সারা বিশ্ব। নারীর পদতলে কবি এনে দিতে চান সমস্ত সুখ। যে সুখে নারী মাতাল হয়ে উঠে। সমস্ত নান্দনিকতা যেন নারীর পায়ে। নারীরা সারা শরীরের চেয়ে পায়ের আর মুখের যত্ন বেশী নেন। নারীই তো যেন সৌন্দর্যের বাস্তুভিটা। তাই তো কবি নারীর সৌন্দর্যের পদতলে লুটিয়ে দিয়েছেন নিজেকে। নারী যেন কবিতার জন্য অপরিহার্য। কারণ প্রেমই হচ্ছে কবি আর কবিতার একমাত্র আরাধ্য, সাধনার ধন। নান্দনিকতার ভুবনে ভুবনে সকল সৌন্দর্যই বুঝি নারীদের পায়ের তলে দলিত হয়! পুরুষের সকল ঔদ্ধত্য বুঝি মেয়েদের এই পায়ে এসেই গড়াগড়ি খায়? সৌন্দর্য মাত্রই তোমায় পায়ে দলিল মথিত হবে ভালোসেবে!

সমকামিতাকে সমর্থন করতে চাইলেও আমি সেই নারীকেই ভালোবাসি আজো, যে বিশ্বাস করতে পেরেছে, নারীকে কখনই পুরুষের বাম পাঁজর থেকে সৃজন করা হয়নি সকল ধর্মগ্রন্থ ঝেড়ে ফেলে নারীরা নিজেরাই ঈশ্বর হয়েছে। [নারীর তরে/ঘোড়দৌড়. পৃ-১৮]

কবি সরসিজ আলীম তাঁর কবিতার ছন্দ ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে যে কবি স্বভাবের কারণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেননি তা বলা যায় না। তিনি তাঁর কাব্য গ্রন্থদ্বয়ের ক্ষেত্রে আঙ্গিকের কৌশল, ভাষা ব্যবহারের দুঃসাহসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা রূপকের-প্রয়োগে অভীনবত্বর মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন, সমস্ত কবিতাই তাঁর নিজস্ব ও ব্যক্তিগত রুচি নিয়েই চলেন এবং একজন কবির সর্বপ্রকার নীতি, কাল ও ইতিহাস মিশে থাকে তার ব্যক্তিগত আত্ম উৎকর্ষে।* কবি সরসিজ ও তাঁর নিজস্বতার মধ্যদিয়ে তুলে এনেছেন সাপ, বেজি, শেয়াল, বোন বিড়াল, বোয়াল, ঘোড়া, শালিক, কপোতাক্ষ নদ, মাছ, নগ্ন পা, সাঁতার, বিকেল, বৃক্ষশ্যওলা, পথ-প্রান্তর, মাছরাঙা, ঘুঘু, বুনোফল, গাছের ডাল, খরিদ্দার, গাছের ছায়া, পানি-কয়লা, গ্যাস, লংমার্চ, দুর্নীতি, নারিকেল, চড়–ই, কলতলা, পুকুরের পাড়, ঝরাপাতার গান, কোকিল, কৃষ্ণচূড়া, বৃষ্টি, পুষ্প, বৃষ্টিভেজামন, পথের বাঁক, আগুন, দুষ্টুমেয়ে, ডিম, ঘুড়ি, সমুদ্র, সাগর, সজারু, বুড়িগঙ্গা, সুতো, জেলে, লালমিয়ার চিত্র কর্ম, লালনের গান, বাউল, পুথিঁপাথ, বাঁশবন, মায়ের আঁচল, মালতী লতা, চৈত্র মাস, পাতাশূণ্য বৃক্ষ, নিশি, কনডম, ছায়াবীথি, তালপাতা, শাড়ি, জুইচাপা, প্রেমপত্র, ঝিনুক, ইঁদুর, চায়ের কাপ, হাঁস, নৌকা, ঝিঁঝিপোকা, গ্রাম্যমেয়ের চুলের ফিতা, পূর্ণজন্ম, চাঁদ, পানশালা, ভাস্কর্য, চাকা, টিশার্ট, ফ্রক, কৈ মাছ, শুকনোমাটি, খড়কুটো, নদী ভাঙ্গন, হুতুম পেঁচা, পিঁপড়ে, দেবালয়, ঘন্টি, গোঙগানি, ঢাক, সাঁকো, ডাল, ভাত, আরশোলা, উঁই, কুকুর, শিংমাছ, নৌবাইচ, ষাড়ের লড়াই, পাহাড়, লালচুড়ি, ধূলার খৈ, কুমির, ডালিমফুল, ব্যাঙ, প্রেয়সীর মন, নকশিকাঁথা, রাজহংহী, সন্ধ্যাপ্রদীপ, জোনাকি, শস্যদানা, জলকাদা, মেঘ, লতাগুল্ম, জবাকুসুম, নিমফল, শানবাঁধাঘাট, টিয়াপাখি, রান্নাঘর, বউটিপ, সুতোকাটা ঘুড়ি, পথভোলা দুপুর, বাবুই পাখি, কাঁকড়া, নুন, মরিচ, ঠান্ডাজল, হেমন্ত, শিশির, কান্নাজড়িত গভীর রাত, আম্রকানন, আলতা পরা পা, এমন নানা অনুষঙ্গিক কবির কবিতাই আবাস গড়ে তুলেছে। এগুলো আমাদের যাপিত জীবনের আনুষঙ্গিক সব পরিচিতি জিনিস। যেটার মধ্য দিয়ে আমাদের যাপন করতে হয়। কবি সরসিজের বড় ক্ষমতা তিনি প্রকৃতি, প্রাণীজগৎ এবং মনুষ্যজগতকে একই রঙের প্রলেপ দিয়ে কবিতার চাষ করেছেন। আমরা আরও দেখতে পায়-কবি সরসিজের কবিতাই ওপরে বর্ণিত যাপিত অনুষঙ্গগুলো আপনা-আপনিই এসে কবিতার করতলে মাথা নুয়ে দেয়নি এগুলো এসেছে উপমা-রূপক ও প্রতীক হিসেবে। প্রতীক বা উপমা ব্যবহারের দিক থেকে কবি সরসিজ সিদ্ধহস্ত। এ রূপকের প্রয়োগ, চিত্র কল্পের ব্যবহার, সার্বজনীন আবেদন কবিকে অন্যান্য কবিদের চেয়ে পৃথক করে- পরিচিত করে তুলবে এবং মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করবে যে বলে আমি মনে করি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড