• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

প্রবন্ধ

জাতের নামে বজ্জাতি

  মেহেদী হাসান তামিম

১৪ জুলাই ২০১৯, ১১:২৬
কবিতা
ছবি : প্রতীকী

শেক্সপিয়ার কোন ধর্মের ছিলেন, তার গায়ের রং কেমন ছিল! কালোরাম না ধলোরাম ছিলেন? তার রাজনৈতিক বোধ বিবেচনা দর্শন মতাদর্শই বা কিরূপ ছিল!

অথবা

পিকাসো, দান্তে, ভিঞ্চি, কামু, জিব্রান, নেরুদা, রুশদী— চোখ বন্ধ করে আপাতত যেসব বিদেশি সাহিত্যিকদের দেখতে পেলাম, তাদের কথাই বললাম। চোখ খোলা রেখে বলতে হলে কালি কাগজ শেষ হয়ে যেত, তবু নাম শেষ হতো না। তাদের রাজনৈতিক আদর্শ কি ছিল? তারা শিল্প বিপ্লব, ফ্রেন্স রেভ্যুলেশন, নকশাল আন্দোলন, কাশ্মির যুদ্ধের পক্ষ শক্তি না কি বিপক্ষের!

আচ্ছা গোর্কী কোন ধর্ম পালন করতেন? তিনি কি চার্চে যেতেন নিয়মিত? নাকি বাবা-মাকে চার্চে যাবার কথা বলে, ঘর থেকে বেরিয়ে এক টিকেটে দুই ছবি দেখতে সোজা সিনেমা হলে চলে যেতেন!

অতদূর না যাই, আশেপাশেই চরিত্রেই থাকি। রবিবাবুর দর্শন কি ছিল, চরিত্র কেমন, তিনি কি বিশ্বাস করতেন? তাদের লিখার মান বাদ দিয়ে ব্যক্তিজীবন নিয়ে গবেষণা করার পর, যদি বিবেচনা করতে হতো তাদের সাহিত্য পড়ব কিনা তাহলেই সেরেছে; জ্ঞানট্যান না খেয়ে পেট শুকিয়ে হাজ্ঞানী হয়েই মরতে হতো বৈকি!

কাজী নজরুল ইসলাম, আমাদের জাতীয় কবি। দ্বিতীয় বিয়ে একজন করেছিলেন, তাও হিন্দু নারীকে। এই খবর তো মোটামুটি সকলেই কমবেশি জানি। আচ্ছা কেউ কি জানেন, বলতে পারবেন, উনি প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে তারপর দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন কি না। নজরুল তাঁর দ্বিতীয় বউ আশাপূর্ণা সেনগুপ্তকে কি নাম দিয়েছিলেন, জানেন তো, প্রমীলা দেবী। বলিহারি যাই!

মুসলিম কবির একি দুর্দশা। তিনি নাকি আবার এই হিন্দু স্ত্রীটিকে ভীষণ ভালোবাসতেনও। তাদের দাম্পত্য জীবন ৩৮ বছরের। বিয়ের কাবিনে কি লিখা ছিল জানেন, আশাপূর্ণা দেবী চাহেন তো ইসলাম গ্রহণ করবেন। কেহ কাউকে ধর্মকর্মের ব্যাপারে জবরদস্তি করবেন না। আমরা যারা, কাজী নজরুলকে মুসলিম কবি বলে দুন্দুভিতে দ্রিমিদ্রিমি দামামা বাজাই তারা কি এ কথাটা জানি! জানলেও কি কখনো বলেছি তা। আচ্ছা বলেন তো আমরা খুব সচেতনভাবে সে কথাটি কেন এড়িয়ে যাই! হিন্দু রমণী- প্রমীলা দেবী তাঁর জীবদ্দশায় নজরুলের সাথে এক ঘরে এক ছাদের নীচে সংসার করলেন। সেই মহিলা তাঁর ধর্ম-কর্মাদি পালন করেছেন। সেটিও রীতিমতো সকাল বিকেল ঘরের কোণে মূর্তি বসিয়ে, দূর্বা ছিটিয়ে, ধুন জ্বালিয়ে। আচ্ছা তাদের কেউ কি একঘরে করার কথা ভেবেছিল!

মানব ধর্মের কবি, মুসলিম কবি কাজী নজরুল ইসলাম একজন হিন্দু মহিলার সাথে ঘর তো ঘর করলেনই, আবার ঘরে হিন্দু ধর্ম পালনের অনুমতিও দিলেন! আস্তাগফিরুল্লাহ, এসব অধর্মে তিনি সায় দিলেন কি করে!

তবে একজন সনাতন ধর্মের নারীর সাথে ঘর-সংসার করে নজরুলের কিন্তু কোনো সমস্যাই হয়নি। বরং সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চার চারটি সন্তানের গর্বিত পিতা হয়েছেন। তাদের দুজনে একসাথে লালনপালন করেছেন। সন্তানদের নামগুলোও রেখেছেন হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে। নজরুল ইসলামের কি ধর্মের বিধিবিধান সম্পর্কে জানা ছিল না! তিনি কি জানতেন না, কোনো মুসলিম কোনো হিন্দুধর্ম অথবা অন্য কোনো ধর্মের কেউ যতক্ষণ ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করেন, তাকে বিয়ে করতে পারেন না!

ছে ছে ছে।

যে কবি এতবড় অধর্ম করে গেলেন তাকেই মুসলিম ধর্মের কবি বলে এত নাচানাচি! ধর্মের অমান্যকারী যে কবি— একটি মুসলিম জাতি রাষ্ট্রের জাতীয় কবি কি করে হয়! জাতের নামে বজ্জাতি যত্তসব।

আসলে ব্যাপারটা কি জানেন! নজরুল-রবীন্দ্রনাথ আপনার আমার আমাদের সমাজের ভাবনা থেকে অন্তত আরও একশবছর এগিয়ে ছিলেন। তারা প্রকৃতই কবি ছিলেন। তাই তারা মানবতার দর্শনকেই লালন-পালন করে আমাদের পথ দেখিয়ে গিয়েছেন।

এত এত কবি সাহিত্যিকগনের সৃষ্ট সাহিত্যের বিচার তাঁর ধর্ম কর্ম জীবনাচরণ রাজনৈতিক মতাদর্শ বা চরিত্রের গঠন বিবেচনা করে করা যায়না। তা হলে তো, পৃথিবীর তাবৎ নামীদামী কবি সাহিত্যিকদের নাম মুখ উচ্চারণ করামাত্র পাপ হয়ে যেত।

যখন সেটি হয় না, তাদের রচনাগুলোই যেখানে তাদের বিচার করার মূল বিবেচ্য, তাহলে কোনো কবিকে নিয়েই আমাদের এত এলার্জি থাকা উচিত নয়। তার জীবন, দর্শন, মতাদর্শ, ধর্ম, রাজনৈতিক বিশ্বাস কোনভাবে বিবেচ্য নয়, বরং বিবেচ্য তার সৃষ্টি।

কেউ যদি আমার ঘরানার, আমার মতাদর্শের কবি সাহিত্যিক না হন, তার সৃষ্টিকে বাজেয়াপ্ত করে দিব? ব্যক্তি আদর্শকে অস্বীকার করা যায় কিন্তু তাঁর সৃষ্ট শিল্প ও সাহিত্য কর্মকে কখনো নয়।

কবিকে অবজ্ঞা করার অধিকার কারুর আছে! কবি শামসুর রাহমান, একজন হেলাল হাফিজ বা নির্মলেন্দু গুন, কবি হিসেবে যতটা স্মরণীয়, বরণীয় হবেন একজন আল মাহমুদ, একজন ফররুক আহমদ, একজন আরজ আলী মাতুব্বর, আহমেদ শরীফ, আহমেদ ছফা অথবা একজন তসলিমা নাসরিনকেও তাদের সৃষ্ট সাহিত্যের বিচারে গ্রহণ ও মূল্যায়ন করা আবশ্যক।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড