আবু জাফর সৈকত
কবি বঙ্গ রাখালের সাথে আমার পরিচয় মুহূর্তটি মনে করতে পারছি না তবে তার বইটি হাতে পাওয়ার পর পাঠক হিসেবে তার কবিতায় বুদ ও আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। কবিতার প্রচলিত ফর্ম, প্রথা ভেঙে নিজের বিশ্বাস, আবেগ বিন্যস্ত করে তার স্বার্থক আদল তৈরি করেন। কবিতায় কবির পরিণত পরিনীতি মূলত নিয়মিত চর্চা, ভাষা-শব্দের খেলায়, চিত্রকল্প নির্মাণে। ব্যক্তি অভিজ্ঞতার আলোকে ভাষা ও অনুভূতির তীব্র মিশেলে ভিন্ন এক পটভূমি তৈরি করেন কবি।
লেখালেখির জীবনে তার প্রথম প্রকাশনা প্রবন্ধ গ্রন্থ দিয়ে। এটি তার প্রকাশিত অষ্টম বই। মৌলিক গ্রন্থ হিসেব করলে ৬ষ্ঠ বই। তিনি দুটি বই সম্পাদনা করেছেন; ‘অগ্রন্থিত রফিক আজাদ’ (২০১৯) এবং ‘পাগলা কানাই ও তাঁর তত্ত্ব দর্শন’ (২০১৯)। তার সম্পাদিত ছোটকাগজগুলো হলো নিহারণ, বঙ্গস্বর, শঙ্খধ্বনি, শব্দকুঠি। ‘লণ্ঠনের গ্রাম’-এর প্রকাশ কাল সেপ্টেম্বর ২০১৯। এটি কবির দ্বিতীয় কবিতা গ্রন্থ’। অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে চার ফর্মায় প্রকাশিত বইটির মূল্য লেখা আছে ১৬০ টাকা।
কবির জীবন যাপন, অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গি তার কবিতায় স্বর নির্মাণে সহযোগিতা করে। অনেক কাব্য গ্রন্থ’ কবিতা পড়তে গিয়ে বিরক্তি সৃষ্টি হয় কেননা ঝাঁপ দিলেই অন্য একটা জগতে চলে যেতে হয়। কিন্তু আলোচ্য গ্রন্থের কবিতার তাল-লয়ের পাশাপাশি এক কবিতার সাথে অন্য কবিতার তাল-লয় খুঁজে পাওয়া যায় যা পাঠককে দীর্ঘ পাঠে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে।
নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে নিজেরই কবিতায় কবি লিখেন-
গ্রামের এক আলাভোলা ছেলে রাত গভীর হলে ক্ষয়প্রাপ্ত দেহে নিষিদ্ধ ফুলের ঘ্রাণ মাখে... (নিষিদ্ধ ফুল) আমি আমার মধ্যে লুকিয়ে থাকি। ক্ষতদেহের প্রহসনে তুলে ধরি শরীরের ঠুনকো পুরুষালী ভাব। ( জীবনের মতো করে) প্রিয় অন্ধতা আমার, বাবারও প্রিয় কালো রং। আন্ডাগ্রাউন্ড পিতা রাতের আঁধারে চষে বেড়াতেন... (প্রিয় অন্ধতা আমার)
অন্ধতা কারও জন্মগত, কারও দুর্ঘটনাজনিত, কারও বা ইচ্ছাকৃত। কবির অন্ধতা মানুষের ভাবলেসহীন জীবন-যাপনে। কী দেখলেন, কেন দেখলেন, কাকে কে কী দেখালেন? তিনি অন্ধ নাকি যাদের দেখালেন তারা অন্ধ? দৃষ্টিহীন চোখের সামনে কল্পনার আয়না ধরতে পারার যোগ্যতাই কি কেউ এই অবিশ্বাসের রাজ্যটি দেখাতে পারলেন? যে দর্শক বা দ্রষ্টা আদপে অন্ধই নন? জনতা দৃশ্যরূপ অন্ধত্ব বরণ করে আছেন? একদিকে সত্যদ্রষ্টা ঈদিপাস কিংবা টাইরেসিয়াস, অন্যদিকে সত্য দেখার চোখ হারানো অন্ধ আমরা।
আমি স্বপ্নের ঘোরে আরশের ছায়ার অন্ধ মানুষ সেজে ছিদামের বাড়িকে করি রক্ততিলক আর ছিদামের বউয়ের চুপসে যাওয়া বুকে রেখে মুখ নদীর কাছে যাই-তুলে নেই আঁজলা ভরে তৃষ্ণার জল। (সোনাভান আমার কেউ না)
তাই আমরা পদ্মের ধর্ষিত লাশ দেখি না। দেখি না বেআব্রু আত্মার লাশ। আমরা আমাদের মতো বাসর সাজাই, সুখের সংসার পাতি। আর তুই অদৃশ্যের নাওয়ে আমায় তুলে পালিয়ে সাজাস বেহুলাবাসর। (গতরে সঞ্চয় করি ভাঙা ভাঙা ভোর)
টি এস এলিয়েট গদ্য কবিতাকে স্বীকার করেন নি, গদ্য ও পদ্যের সীমানালুপ্তিকে গ্রহণ করেন নি, বরং দুটির পার্থক্যকে মেনে চলতেও উপদেশ দিয়েছিলেন। রিচার্ড এলিংটন গদ্য কবিতাকে বলা চলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এরকম উদাহরণ বহু বহু দেওয়া যাবে কিন্তু সময়ের সাথে মানুষের রুচি, বোধ, পারিপার্শ্বিক অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। গদ্য ও পদ্য নিয়ে বিতর্ক বহুদিনের যদিও দ্বিতীয় দশকের অধিকাংশ কবিই গদ্য কবিতাতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। প্রশ্ন হচ্ছে কোন ধরনের গদ্যকে আমরা গদ্য কবিতা বলতে পারি। পাঠক কবিতাকে চিনে নেন তার চেহারা দেখে। কেউ কেউ বলেন টাইপোগ্রাফি কিংবা মুদ্রনবিন্যাস এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। আবার কারও বক্তব্য ভাষার দিকে মনোযোগ দিতে হবে, বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। রবীন্দ্রনাথ পুনশ্চ কাব্যের ভূমিকাতে লিপিকা’র গদ্য কবিতা বিষয়ে লিখেছিলেন- ছাপবার সময় বাক্যগুলোকে পদ্যের মতো খণ্ডিত করা হয়নি, বোধ করি ভীরুতাই মূল কারণ।
লিপিকা মূলত ছিল ছন্দবর্জিত কবিতা যাকে আমরা বলতে পারি মুক্তছন্দের কবিতা। আমার মতে গদ্য কবিতার শক্তির জায়গাটা আলাদা রকমের। গদ্য কবিতায় আশ্রয় নেওয়া যায় পরাবাস্তবের, অজস্র রূপকের, ধারাবাহিকতা ভেঙে তৈরি হয় অসংখ্য গল্প আর ভাষাকে করে ঘোর। ফলে অনায়াসে বসতে পারে দৈনন্দিন ভাষা আর স্ল্যাং। এতসব আলোচনার মূল কারণ কবি বঙ্গ রাখালের গদ্যকবিতার কারবার। কারবার বলছি এই অর্থে- পাঠককে কাছে টানার মতো কাব্য ভাষা কবি ইতোমধ্যে সৃষ্টি করেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। কেননা লাইনের পর লাইন পড়ে ফেলার পর যে ক্লান্তি সেটা কখনো বোধ হয়নি, বরঞ্চ ভিন্ন এক স্বাদ অনুভূত হয়েছে। কবিতায় যে চিত্রকল্পতা আমাদের চিরচেনা আশেপাশের মানুষগুলোর; সবাই যেন আমাদেরই রক্ত।
নিঃসঙ্গ পৃথিবীর রোগশয্যায় মহাপিতা, ঐশ্বর্যের প্রতীক ঝুলিয়ে দৌড়ে গেলেন মাঠের দিকে-জানা নেই বিষাদের কিংবা স্মৃতির মিনারে অপ্রকাশ্য আকাশপাখির সময় হারানো সুলতার চিঠি, স্বপ্নচাঁপা কুসুমরাত্রির নদী হয়ে যাওয়া গল্প... (টুকে নেও জীবন নোট)
জীবন থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে পাওয়া শব্দ নিয়ে বঙ্গ রাখালের কবিতা। বইয়ের শিরোনাম যে কবিতা অবলম্বনে- কালো ছায়ারা জাহাজের পাটাতনে লুকিয়ে রাখে রাত্রির নিঝুম রহস্য...
অনির্দিষ্টের রাতেরা ভয় হয়ে বর্ষাকালীন সর্পের সাজ মেখে রাস্তার মোড়ে মোড়ে লতার অন্ধকার ছুঁয়ে যায় কল্পনার জাহাজ। এবাদতনামার অন্ধ আকাশও বধির... দরজার পিঠে দাঁড়িয়ে দরজা অন্ধকার। নক্ষত্রের শরীর ছুঁয়ে শ্মশানী ইঁদুর জ্বালিয়ে দেয় লণ্ঠনের গ্রাম... (শম্বুনাথ জ্বালিয়ে দেয় লণ্ঠনের গ্রাম)
শিরোনামে ‘শম্বুনাথ’ শব্দটি সম্পূর্ণ কবিতার কোথাও অস্তিত্ব নেই। তারপরও কবি কিন্তু সুন্দর এক আবহ তৈরি করেছেন। যেখানে ‘শম্বুনাথ’ যেন গ্রামগুলোকে লণ্ঠনের আলোয় আলোকিত করছে প্রতিনিয়ত। ‘শম্বুনাথ’ আসলে কবির কল্পনা নাকি ‘শম্বুনাথ’ হওয়ার প্রচেষ্টা? এর উত্তর কবির কবিতা পাঠেই পেতে পারি।
তার কবিতায় শৈল্পিকভাবে এসেছে কৃষক, মাঝি, কুমারের কথা। বিভিন্ন বিশেষণ যুক্ত করে কবি লিখেছেন মোহন মাঝি, পরানঘাটের মাঝি কিংবা অঘ্রাণের চাষি।
শালিকের তেড়ে আসা পিঁপড়াজীবন দাঁড়িয়ে থাকে কুমার নদের মাঝিদের বুকের কাছে, চোখের পাতায়... কুমারের মৃৎপাত্রে জমা হয় কৃষকমাটির মাংস পোড়া রোমালে ঘ্রাণ। (রোমালে থাকে কৃষকের রক্ত ঘামের ঘ্রাণ)
মোহন মাঝি নদীকে জানে প্রাচীন সভ্যতার সোনালি কাদামাখা সঙ্গীত মায়ের আঁচলে বেঁধে নিজের আত্মার কথাও পৌছে দেয় নদীদের কাছে (পোড়ামাটির স্তন-৮)
পরানঘাটের মাঝি-গাভীনের শহর হতে ছোট ছোট দুঃখগুলো পুঁটুলি করে মগজে রাখে আর শালিখের খুচরা জীবন চোখে সঞ্চয় করে মোমবাতির আবছা আলো। (পোড়ামাটির স্তন-১০)
কবির কবিতায় গ্রাম উঠে এসেছে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। প্রত্যেকটি কবিতাই একটি গল্পের শুরু। কিন্তু তা শেষ না হতেই নতুন আরেকটি গল্প শুরু হয়ে যায় এবং এভাবেই চলতে থাকে। এতে করে তৈরি হয়েছে কবির নিজস্ব কাব্য শৈলী। বঙ্গ রাখালের উপস্থাপনায় শৈশব আমাদের চোখে ভাসে, ফিরে যাই গ্রামের নিজ ভূমে।- সন্ধ্যারাত পার হতেই পায়ের নীচেই ধানের মলিন শৈশব- উচ্ছ্বাসের বিছানা মেলে ধরে (শীতবুড়ি মৃতের ঘুম ঘুমিয়েছিল)
মানুষ বারবার ফিরতে চায় তার শৈশব-কৈশোরে। নষ্টালজিয়া তার জীবনকে তাড়িত করে আর অনুভূতিশীল মানুষ সর্বদাই সেই সন্তাপ করে যান। বেড়ে ওঠা, পারিপার্শ্বিকতা, প্রেম-শিহরণ, মুগ্ধতা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তাড়িয়ে বেড়ানো সেই স্রোত মিশে যায় কবির মানসলোকে। কবি তাই উচ্চারণ করেন- ধানখেতে বাবার জীবন্ত ভুলে যাওয়া মাঠ এখন স্থির নয়নে মার্বেল খেলে। (জীবন কেমন ছিল)
বিশাল একটি স্পেস নিয়ে রচিত হয়েছে ‘হ্যাঙ্গারে ঝোলানো আছে রিপনের অন্ধ মার্বেল’ কবিতাটি। যে কোনো উপন্যাসিক এই একটি কবিতা দিয়ে একটি উপন্যাস রচনা করতে পারবেন। পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে পাই বিভিন্ন চেনা জনের আর অনেকগুলো স্থনে ভিন্ন ভিন্ন গল্প। গোলকনগর, চড়িয়ারবিল বাজার, পাড়াগঞ্জ, আলমডাঙ্গা বাজার, ফুলহরির মাঠ, ভাটই বাজার, সাধুখালী মুখ ঘুরতে ঘুরতে আমরা আমাদের কৈশোরের প্রেম খুঁজে পাই। ভালো লাগা একটি অনুচ্ছেদ থেকে-
একাকিত্বের নামহীন চিঠি তুমি লিখে যাও বন্ধুর কাছে... কেমন আছিস? সন্ধ্যাগুলো কি এখনো পুরাতন সেটঘরের কাছে ঘড়ি বানিয়ে উড়িয়ে আসিস না কি তোর গ্রন্থ রূপে আমাদের রাত্রির ঘুমন্ত ছন্দহারা এলোমেলো মানুষ ভাবিস। (হ্যাঙ্গারে ঝোলানো আছে রিপনের অন্ধ মার্বেল)
সাম্প্রতিক কবিতায় নিরীক্ষা প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায়। বঙ্গ রাখালের কবিতায়ও সেই প্রবণতা দেখতে পাই। পদ্মপুরাণ: অর্ধেক জীবন অর্ধেক ছেদন’ পর্বের কবিতাগুলোতে সেই প্রচেষ্টাই করা হয়েছে। কবিতায় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মিথ তুলে ধরতে গিয়ে কবি অনেক পঙ্ক্তি ব্যবহার করেছেন। আলোচনার সুবিধার্থে কিছু পঙ্ক্তি তুলে ধরছি-
কাজল রেখার অস্রুসিক্ত চোখের রাক্ষুসী মানবী শরীর (কচ্ছপ-জীবনে টুকরো স্মৃতি) এই রাতেই সদরঘাটের নদী বেপরোয়া হয়। ছুটে যায় সুপ্রাচীন মসলিনের দেশে। (সোনাভান আমার কেউ না) পুলকিত হয়- হাজার ইতিহাসের বেদনার্ত ঘোড়া। (বৃষ্টি মেয়ে) ‘আমি কবে নারী হবো’ কবিতায় নারীর কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে বলেন নারী কখনো কবির কবিতা, কখনো হতাশা কবির, কখনো লালসার শিকার। এই বইয়ের বিভিন্ন কবিতায় নারী এসেছে বিভিন্নভাবে। কখনো মা, কখনো বোন, কখনো প্রেমিকা আবার কখনো নিজেকে নারীর আসনে বসিয়েছেন। বুকের পাঁজরে ব্যথা জরায়ুতে আটকে আছে-মাংসপিণ্ড- (আমি কবে নারী হবো)
কবির ‘বুক উঠানে রোপিত আছে অনেক না বলা গল্প...। তাই রোমান্টিক-এন্টিরোমান্টিক চিন্তার জায়গা থেকে কবি লিখেন- সত্যের শহরে মিথ্যারা পাশাপাশি থাকে কবির কবিতা হবো, প্রকৃতির সৌন্দর্য হবো গাঁজার ধোঁয়া হবো আর সিগ্রেটমুখো কোনো এক পুরুষের লালসার শিকার হয়ে ভাববো-আমি কবে নারী হবো? (আমি কবে নারী হবো)
একজন কবি নতুন করে কিছু বলেন না। তার নতুনত্ব শুধু নতুনভাবে বলায়। সফোক্লেস থেকে আজ পর্যন্ত সকল কবি, সকল শিল্পী মানুষের একই বলয়ের ভাবনা ও অনুভবের কথা বলেছেন। জগতের যত অন্যায়-অনিয়ম-অনাচার আগে যেই রূপে ছিল আজও তার পরিবর্তন ঘটেনি। ধর্ষণ ধ্রুপদি থেকে শুরু করে কবির পদ্ম পর্যন্ত আজও এই পৃথিবীর প্রতিদিনকার ঘটনা। এমন একটা সময় চলছে যেখানে ফাঁসির গারদেও ধর্ষণ হয়।
খবরের পাতা খুললেই ধর্ষণ। কবিতায় বারবার তার উদ্বৃতি বিষয়কে অধিকতর গুরুত্ববহ করে তুলেছে কবি। এতো এতো চিত্র, এতো এতো অনুভূতি সবই মিছা কথা- কহনের মানুষ নাই ফাঁসির সেলে যে মেয়েটা ধর্ষিত হয় সেও নাকি বিছানায় শুয়ে মাসিকের রক্ত চেখে ছিল আর শীতের বুড়ি দৃশ্যের সাঁতার কেটে রোদে দাঁড়িয়ে বেওয়ারিশ লাশদের কফিন গুনতে গুনতে মৃতের ঘুম ঘুমিয়ে ছিল... (শীতবুড়ি মৃতের ঘুম ঘুমিয়েছিল)
তৃষ্ণার্ত বাবু নিঃশব্দে ঝুঁকে পড়ে-পদ্মের বুকে। ঘুমে ভেজা চোখের পাতা আর নেশাচুর রং চুইয়ে চুইয়ে পড়ে পদ্মের শরীর। সদ্য ফোটা ব্রা’র নিচেয় সৌন্দর্যের ডালিম ছড়ায় যৈবতীকালীন হরিণী ঘ্রাণ। নখর দেখিয়ে যে জানোয়ার প্রতি রাতে ধর্ষণ করে পদ্মের আনন্দোচ্ছ্বাস কিংবা তিলে তিলে গড়ে তোলা অরূপ গল্পের ভেসে আসা সাম্পান। (পদ্ম তোমাকে বলছি)
জীবনানন্দের কবিতায় বনলতা যেভাবে এসেছে বঙ্গ রাখালের কবিতায় পদ্ম এসেছে একটু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। রোমান্টিক ও এন্টিরোমান্টিক এর মধ্য দিয়ে কবি তার কবিতাগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। স্তন কাহন সিরিজ কবিতাগুলো কবির সাহসী উচ্চারণ।
নগ্ন শরীর হাত ভাঙ্গা মোচড়ে যাওয়া পা দেহ বিচ্ছিন্ন মাথা গাডারে বাঁধা কালোচুল খোলা স্তন (পোড়ামাটির স্তন-১)
ছিন্নভিন্ন নারী স্তন এখানে সেখানে গুচ্ছ গুচ্ছ চুল ছড়ানো চুলের ক্লিপ, রাবার, সেফটিপিন ছেঁড়া ব্লাউজ, শাড়ি এবড়ো-থেবড়ো হয়ে পড়ে আছে স্তন (পোড়ামাটির স্তন-২)
এইখানে স্তনের বর্ণনা একজন ধর্ষক কর্তৃক লালসার শিকার নারী স্তন। পোড়ামাটির স্তন-৩ ও ৪ এ বর্ণনা করা হয়েছে আম সাধারণের দৃষ্টিতে আর পোড়ামাটির স্তন-৫ ও ৬ এ বর্ণিত হয়েছে স্ত্রীর স্তন। পোড়ামাটির স্তন-৭ ও ৮ এ বর্ণিত হয়েছে একজন চিরায়ত মায়ের স্তন।
বুঝহীন সময় থেকে কবির যে যাত্রা শেখপাড়া, শান্তি ডাঙ্গার নদীর কূলবর্তী জীবন, সে জীবনে বুকে শূন্যতা পুষে কবি আলো জ্বালান। তারপরও মাঝে মাঝে ছলনা কবিকে নিয়ে যায় ভ্রান্তির দিকে। সব কি ভ্রান্তি, সব কি ভুল, নাকি কুহক মায়ায় ও আমাকে কাছে ডেকেছিল। আজ ওর বুকজুড়ে অন্য কেউ ঘুমায়। অন্য কেউ ওকে অর্চনা বলে ডাকে। (প্রিয় অন্ধতা আমার)
নিজেকে অনুভবের মাধ্যমে নিজেকে তুলে আনার প্রচেষ্টা আমরা খুঁজে পাই ‘জীবনের মতো করে’ কবিতায়। মায়ের কাছ থেকে লড়াই করার যে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তা আজীবন বুকে ধারণ করে কবি এগিয়ে চলেছেন- এক অন্ধবালক ভৈরবী ধরে... ইতিহাস নয়, লাল ঘোড়া আমাকে তাড়া করে এদিক থেকে ওদিক- শহরের পথে মা আমাকে অস্তিত্ব লড়াইয়ের কথা বলে... (জীবনের মতো করে)
জীবন তার প্রয়োজন অনুসারে রং বদলায়। দীর্ঘ কবিতায় সেই বিচিত্র রং ঢঙ কামনা করি। যেমনি দেখা যায় এলিয়টের কবিতায়। জীবনানন্দও নানা অভিঘাত ব্যক্ত করেছেন তার দীর্ঘ কবিতায়। একটা সম্ভাবনা থেকেই যায় আর তার হলো ক্লান্তি। কিন্তু মনোযোগ ধরে রাখতে কবিতা পাঠে বিরতির প্রয়োজন হয় মাঝে মাঝে। দীর্ঘ কবিতা থেকেই বুঝা যায় কবির আত্মবিশ্বাস। ‘গতরে সঞ্চায় করি ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভোর’ কবি বঙ্গ রাখারের দীর্ঘ আয়তনের একটি কবিতা। দীর্ঘ একটি পটভূমিতে কবি তুলে ধরেছেন কিছু সংসারবাদী মানুষের জীবন। সংসারবন্দি মানুষ নেশায় বুদ হয়ে ঘ্রাণ শুকে অচেনা বালিকায়। আর গন্তব্যহীন পথে তরফ বাবু ভুলে যায় সংসার। প্রাকৃতিক ক্রিয়া-কর্ম চলতে থাকে তাদের নিয়মে। পড়ন্ত জারুলের মাঠ আমনের ধানে ভরে আছে হাকিমের মন বড়বিলের চৌদিক জল থৈ থৈ করে মাঘীপূর্ণিমা রাত যাত্রা শিখনের ভিক্ষু আরশে লাফায় গোলকের মাঠের পাবদা, কৈ। (গতরে সঞ্চয় করি ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভোর)
কবিতায় উঠে আসে তরফ বাবু, সাইদা, রব্বান, গোলাম, বসন্ত কিংবা আসমান খাঁর সংসার। সাইদার বুকের ত্রিকোণমিতি কিংবা রব্বানের বেহুলা পাঠ সাইদার উঠানের কোণে নারীর পোশাক পরে মাপ-জোক করে বুকের ত্রিকোনমিতি
রব্বান বিনিদ্রিত রজনী কাটায় যাত্রার বেহুলা পাঠে (গতরে সঞ্চয় করি ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভোর)
গাছের অভাবে অপুষ্ট হয় গোয়ালের গরু, রাখালও কঙ্কাল হয় লুটপাটের জগতে। ইতিহাস হারিয়ে যায় শানবাঁধা ঘাটে আর জৌলুস হারায় উল্টো রথে। কৃষকের বুক হয় কবিতার খাতা।
গোয়ারের গরু এখনো সংবাদ রাখে অপুষ্ট কঙ্কাল রাখালের নিরুদ্দেশ যাত্রায়। (গতরে সঞ্চয় করি ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভোর)
বাদ যায় না মা মাজেদা বেগমের গল্প। যে গল্প ফিকে হতে হতে ডিজিটাল হয়ে গেছে। ধানের আল ধরে হাটে না কিশোর কিংবা কৃষকের কণ্ঠে শুনি না আর রাখালিয়া গান। বিলুপ্ত আজ গরুর গাড়ি। যে শৈশবে ছুটে চলেছি চেনেখালির বিল সেই আজ ভয়াবহ আগুন। কত চেনা মুখ অচেনা হলো চোখের সামনে জোছনার রঙ ফিকে হতে হতে ঘাতকের বুকের কাছে লটকে যায় কুকুর কিংবা বিড়ালের সিঁথির কাছে সুন্দরী বালিকার নিথর দেহ পাঠক্ষেত কিংবা ধানের আল ধরে কৃষক কণ্ঠে ভাসে চমকের বিসর্জনিক সুর। (গতরে সঞ্চয় করি ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভোর)
যে বিসর্জনিক সুর আজও বেজে ওঠে তলপেটে। ধুলার শহরে এখন আর বিকাল হয় না। প্রতিটা বিকাল এখন সর্বগ্রাসী। আগুন জ্বেলে জ্বেলে পিপাসা মিটায়।
সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষের আগ্রহ নিষেধের দিকে। মদের বোতল কিংবা সিগ্রেট কিংবা ঝাঁপির সাপ। বহুজাতিক পুরুষের মতো মাল্টিনেশনাল কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রকে করে ভালোবাসাহীন স্বামীর মতো যারা ভালোবাসার পরিবর্তে ধর্ষণ করে মন ও মগজ। থাকে মগজে মতলবি।
যারা ঝাঁপির সর্পে মাতাতে চায় রাষ্ট্রের অশান্ত বিকাল কিংবা দৃষ্টির সবুজ চোখ, অরণ্যের শহর দেখিয়ে ইশাদের নেতা বানায় আবার অন্ধরাতের ছায়ায় সিগ্রেট বানিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে ঠোঁট বাকিয়ে। তীক্ষ্ণ বুকের ব্যথায় উড়ে যায় সারস, বিছিয়ে রাখা আপাদের বিছানায়-গল্প বলার কৌণিক অপঠিত গল্প...
রাষ্ট্রযন্ত্র অনেকটা ভালোবাসাহীন স্বামীর মতো। যেমন করে ভালোবাসার পরিবর্তে ধর্ষিত হয় প্রতি রাতে নারীর প্রত্যাশিত আবেগী মন। (আজন্ম নিষেধের দিকে...)
অনুভূতি প্রকাশে কবিকে নিতে হয় কবিতার আশ্রয়, কাব্য ভাষা। বর্তমান ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের আড়ালে ‘স্বৈরচারী ঠোঁট’ যথাযথ চিহ্নিতকরণ। দলীয় সাইনবোর্ড গায়ে মেখে বিজয় উল্লাস করে।
ব্রিজের তামাশা দেখতে দেখতে সামনের দিকে হেঁটে যাই পরাশ গায়ে রূপসী নদী। জলের ভেলায় মাছেরা গঙ্গাবতী শয্যা পেতে, মায়ার আকাশ শুষে নেয় সর্বনাশের স্বৈরচারী ঠোঁট। চৈত্রের হাওয়ায় ঝিনুকদহের নদী গোগ্রাসে গিলে খায় পারফিউম সাধুর সঙ্গম ডায়াসী হাসি। (সাধুঙ্গম)
আর সেই উল্লাসে বেআব্রু হয় আমার মা-বোনের লাশ। আমরা সাধারণ হয়ে যাই পুতুল। কান্না খুঁজতে খুঁজতে আমরা হই পাথর। স্বৈরাচারী ঠোঁট খেয়ে যায় প্রেমিকার পবিত্র শরীর।
চোখের পাতায় প্রেমিকা সুতীব্র ঘোষক সেজে-কান্নার স্বর খুঁজতে খুঁজতে হয়ে যায় বনহংসির মায়াবী নদী কিংবা মাছদেহে লেগে থাকা চোখ, মাটির পুতুল ভেঙে সাধু, খেয়ে যায় প্রেমিকার পবিত্র শরীর। (সাধুঙ্গম)
ইতিহাস বারবার তুলে ধরেছেন নানা কবিতায়। আরব্য উপন্যাসের নানা চমকপ্রদ গল্প আমাদের যেমন বিমোহিত করে, কবি তেমনি আমাদের তার কবিতার মাধ্যমে সেই জগতে নিয়ে যান। শহর কবিতায় সাম্প্রতিক বাংলাদেশকেই দেখতে পাই। ইতিহাসকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে মামা, সোনা বলে নতুন ইতিহাস রচনা করছে ক্ষমতা। সে ইতিহাস প্লাস্টিক যুগের ইতিহাস। আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান কবি। মনে তৈরি হয় বিষ। তাই বিষন্ন না হয়ে উপায় থাকে না। শব্দের সাথে বিভিন্ন বিশেষণ যোগ করাতে শব্দের নতুন অর্থ-দ্যোতনা তৈরি হয়েছে। সুপ্রাচীন মেঘ, স্বপ্নের আগুন, বেয়নেট ইস্পাত, স্বৈরাচারী ঠোঁট, অবিশ্বাস্য বিষন্ন, এরকম অসংখ্য জোড়া শব্দের বিস্তার লক্ষ করা যায়। কুমারী মেঘ বিমূর্ত সকালের কাছে ক্ষুধার্ত মুখে নিংড়ে নেয় গ্রামীণ জড়তা ভরা মৃত্যুর আহ্লাদী দেহ। (পোড়া মাটির স্তন-১০)
কিছু ভাল লাগা পঙ্ক্তি না উল্লেখ করে পারছি না-
কালো ছায়ারা জাহাজের পাটাতনে লুকিয়ে রাখে রাত্রির নিঝুম রহস্য... (শম্বুনাথ জ্বালিয়ে দেয় লণ্ঠনের গ্রাম) ব্যতিত করে ভাতঘুমে ছেড়ে আসা ধানের প্রহরশোভিত গ্রাম। (গ্রাম) চন্দন মাখি ঘুম কিংবা মরণ ভেবে। (অসহায় রক্তের দাগ) রক্ত ঝরাই... খুঁজে নেয় নিজের রক্তের বাকিটা আয়ু... (রক্তের আয়ু) বুকের উঠোনে রোপিত আছে অনেক না বলা গল্প... (আমি কবে নারী হবো)
এই গ্রন্থালোচনার কোনো উপসংহার হয় না। কেননা পাঠক তা পাঠ করে নিজের মতো করেই অনুভব করেন। এমনকি কবি যখন একটি কবিতা লিখেন, তখন তার বোধ, অর্থ, দ্যোতনা জন্ম হয় কিছুদিন পরে সেই পাঠ আবার ভিন্ন অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে। মহাকালের পাঠকের কাছে কবিতার শেষ বিচারকের ভার দিয়ে আমরা কবির কবিতাই পড়তে চাই।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড