• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আহমদ ছফার পিএইচডি গবেষণা : সফলতা-ব্যর্থতা

  মোহাম্মদ আব্দুর রউফ

২৩ জানুয়ারি ২০২০, ১২:১৪
ছবি
ছবি : আহমদ ছফা

এক শিক্ষাজীবনের শেষপান্তে এসে এক সময় আহমদ ছফা গবেষণাকর্মে মনোনিবেশ করেন। বাংলা একাডেমির তিনবছরের পিএইচডি ফেলোশিপ প্রোগ্রামে ছফা আবেদন করেন। যথারীতি ইন্টার্ভিউ কার্ড পান। ছফা বোর্ডে উপস্থিত হন। পরীক্ষক হিসেবে বোর্ডে ছিলেন ডক্টর আহমদ শরীফ, প্রফেসর মুনীর চৌধুরী এবং ডক্টর এনামুল হক। এ সময় বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন কবীর চৌধুরী। পরীক্ষাবোর্ডে ছফাকে অনেকটা তোপের মুখে পড়তে হয়। পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির নূন্যতম যোগ্যতা স্নাতকোত্তর। ছফা এখনো স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় বসেনি।

ডক্টর এনামুল হক বেশ রুষ্ট। ছফা বলেন-‘তিনি দরখাস্তের ওপর চোখ বুলিয়ে গুরুগম্ভীরস্বরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার সাহস তো কম নয় যে, এমএ পরীক্ষা না দিয়েই একেবারে পিএইচডি করার দরখাস্ত নিয়ে হাজির।’ (আহমদ ছফা রচনাবলি ১ : ১৮১) ছফা দমে যায়নি; দমে যাওয়া তার ধাতে নেই। ছফার জবাবটি ছিল বেশ নাটকীয়, সেই সঙ্গে সাহসোচিত। ছফার সাফ জবাব- ‘চারুচন্দ্র চন্দ্যোপাধ্যায় এমএ পাস না করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। মোহিতলাল মজুমদারও এমএ পাস ছিলেন না, তথাপি এখানে শিক্ষকতা করেছেন। আমি তো এমএ পাস করবই, দু’চার মাস এদিক ওদিকের ব্যাপার। দরখাস্ত করে অন্যায়টা কী করেছি?’ (আহমদ ছফা রচনাবলী ১ : ১৮২)

মানতেই হয়, সাহসোচিত জবাব। পরীক্ষাবোর্ডে এভাবে কোনো পরীক্ষার্থী উত্তর দিতে পারে তা কল্পানাতীত। ছফা দিয়েছেন। ছফার সাহিত্য প্রতিভাই ছফাকে সাহস যুগিয়েছে। শেষে পরীক্ষাবোর্ড শর্ত পূরণ ছাড়াই ছফাকে পিএইচডি গবেষণা প্রোগ্রামে মনোনয়ন দেয়। ছফা ভর্তি হন। মাসিক বৃত্তি বারশত টাকা। ছফার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের শিরোনাম : ‘আঠার শ’ থেকে আঠার শ’ সাতান্ন সাল পর্যন্ত বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে তার প্রভাব।’

দুই কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য আহমদ ছফা পরদিন বাংলা বিভাগে যান। এ সময় বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন মুনীর চৌধুরী। তিনি ছফাকে বলেন- ‘তোমার থিসিসটা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রেশন করার সময় বাংলা বিভাগ থেকেই করতে হবে।’ (আহমদ ছফা রচনাবলি ১ : ১৮২) ছফা মৌন থাকেন। মুনীর চৌধুরী বুঝতে পারলেন, প্রস্তাবটি ছফার মনোপূত হয়নি। এবার মুনীর চৌধুরী কিছুটা দাবির সুরেই বলেন- আমরা তোমাকে তিন বছর পড়িয়েছি। মাঝখান থেকে তুমি হুট করে পলিটিক্যাল সায়েন্সে পরীক্ষা দিয়ে বসলে। বুঝেছি, তুমি আমাদের ছাড়তে চাও। কিন্তু তোমাকে আমরা ছাড়ব কেন? তুমি বাংলা বিভাগের অধীনে কাজ করতে রাজি না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস রেজিস্ট্রেশন করতেই দেব না। (আহমদ ছফা রচনাবলি ১ : ১৮২/১৮৩)

মুনীর চৌধুরী ছফার কাছে শিক্ষকসুলভ দাবিটিই করেছেন। কিন্তু শেষের শর্তটি ‘তুমি বাংলা বিভাগের অধীনে কাজ করতে রাজি না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস রেজিস্ট্রেশন করতেই দেব না।’- এটি কোনোভাবেই দাবির মধ্যে পড়ে না; শিক্ষকসুলভও নয়। শিক্ষকদের এ রকম আচরণ অনেক সময় ছাত্রদের সারাজীবন বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মুনীর চৌধুরী এক সময় ছফাকে ভাষাতত্ত্বে গবেষণার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। ছফা সুযোগটি গ্রহণ করেননি।

প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানে ছফার চোখে পানি এসে যায়। কেন প্রত্যাখ্যান করলেন? জবাবে আহমদ ছফা বলেন- আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম এবং তিন বছর পড়াশোনা করেছি। খুব ভাল ছাত্র না হলেও আমার বুদ্ধি-বিবেচনা নিতান্ত তুচ্ছ পর্যায়ের ছিল না। মাতৃস্তন্যে শিশুর যেরকম অধিকার, শিক্ষকদের স্নেহের ওপরও ছাত্রদের সেরকম অধিকার থাকা উচিত। সেই স্নেহ আমি শিক্ষকদের কাছ থেকে পাইনি। তার পরিণতি এই হল যে, আমি বাংলা বিভাগ ছেড়ে দিলাম এবং প্রাইভেট প্রার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাসকোর্সে পাস করলাম। বিএ পাস করার পর ঠিক করেছিলাম, অধিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার আমার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমাকে আবার প্রাইভেটে পলিটিক্যাল সায়েন্সে এমএ পরীক্ষা দিতে হল।

সমস্ত বিষয়টা আমি এভাবে চিন্তা করলাম। শিক্ষকের কাছ থেকে সামান্য উৎসাহ, অনুপ্রেরণা যখন আমার ভীষণ প্রয়োজন ছিল, সেই সময়ে কেউ আমার দিকে মুখ তুলে তাকাননি। যখন আমি নিজের চেষ্টায় উঠে আসতে শুরু করেছি, সকলে আমাকে অনুগ্রহ বিতরণ করে কৃতজ্ঞতা পাশে বাঁধতে চাইছেন। আমি মনে মনে স্থির করলাম, যে বস্তু প্রয়োজনের সময় হাজারবার কামনা করেও পাইনি, সেই বিশেষ সময়টি চলে যাওয়ার পর তার কিছু ক্ষতিপূরণ যদি আমার কাছে সেধে এসে ধরাও দেয়, আমি তা গ্রহণ করতে পারব না। এই গ্রহণ করতে পারছি না বলেই চোখে পানি এসে গিয়েছিল। (আহমদ ছফা রচনাবলী ১ : ১৮৩)

ছফা অভিমান করেই বাংলা বিভাগ ছেড়ে দেন। এবারও ছফা সেই একই অভিমান নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে গবেষণাকর্মে ভর্তি হন। এবার সুপারভাইজার বেছে নেওয়ার পালা। ছফা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে মনে মনে সুপারভাইজার হিসেবে ঠিক করেন। একদিন ছফা প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের বাসায় উপস্থিত। প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক একটি চৌকিতে নাক অবধি কাঁথা টেনে ঘুমাচ্ছেন।

ছফা সুপাভাইজার হওয়ার নিবেদন পেশ করায় তিনি পাশ ফিরে কাঁথাটি নাকমুখ অবধি আবার টেনে দিলেন। দ্বিতীয়বার আর্জি পেশ করায় প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক আবার উত্তরদিকে পাশ ফিরলেন। প্রফেসর রাজ্জাকের এই আচরণে ছফার আঁতে ঘা লাগে। ছফা এককা- করে বসেন। তিনি বলেন- আমি দু’হাত দিয়ে তাঁর শরীর থেকে কাঁথাটি টেনে নিয়ে দলা পাকাতে পাকাতে বললাম, আমার মত একজন আগ্রহী যুবককে আপনি একটি কথাও না বলে তাড়িয়ে দিতে পারেন, এত বিদ্যা নিয়ে কী করবেন? বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত তিনি চৌকির ওপর উঠে বসলেন। পরনের সাদা আধময়লা লুঙ্গিটা টেনে গিটঠু দিলেন। তারপর চশমটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে কাচ মুছে নাকের ডগায় চড়ালেন। খুব সম্ভব বাইফোকাল গ্লাস। আমি তাঁর দৃষ্টিশক্তির তীব্রতা অনুভব করলাম। কোন মানুষের চোখের দৃষ্টি এত প্রখর হতে পারে আমার কোন ধারণা ছিল না। তিনি আমার খদ্দরের পাজামা-পাঞ্জাবি পরনের স্পঞ্জ এবং ধুলোভর্তি মলিন চরণ সবকিছুর ওপর একঝলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। তারপর আঙ্গুল দিয়ে একটা আধাভাঙা কাঠের চেয়ারে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ওইহানে বয়েন। (আহমদ ছফা রচনাবলী ১ : ১৮৭) প্রফেসর রাজ্জাক শেষ পর্যন্ত সুপারভাইজার হতে সম্মত হন। এবং তিনি আহমদ ছফাকে ‘মৌলভী আহমদ ছফা’ বলে সম্বোধন করেন। প্রফেসর রাজ্জাকের সম্বোধনটি প্রায়ই এ রকম- ‘মৌলবি আহমদ ছফাকে এক পেয়ালা চা দে।’ প্রফেসর রাজ্জাক শেষদিন পর্যন্ত ছফাকে ‘মৌলবি আহমদ ছফা’ বলে সম্বোধন করেছেন। অর্ধক নারী অর্ধেক ঈশ্বরীতেও একই সম্বোধনা দেখা যায়। কারণটি রহস্যময়; অদ্যাবধি জানা যায়নি।

তিন দেখা যাচ্ছে, আহমদ ছফা ধাপেধাপে রীতিমত সংগ্রাম করে গবেষণার বিষয়বস্তু, ফেলোশিপ, বিভাগ, তত্ত্বাবধায়ক সবই ঠিকঠাক করেন। কিন্তু শেষতক আহমদ ছফা গবেষণাটি শেষ করেননি। কেন ছফা গবেষণা শেষ করলেন না-এটি পাঠকের কৌতূহলের বিষয়। উত্তর পেতে আমাদের আবার ছফার কাছেই ফিরতে হয়। একাধিক কারণে ছফার পিএইচডি গবেষণাকর্মটি সামনে এগোয়নি। একটি কারণ হতে পারে, ছফার মানসিক কষ্ট। এসময় ছফার কোন অর্থ সংস্থান ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারন্যাশনাল হলে তিনি থাকতেন। প্রতিমাসে বার’শ টাকা স্কলারশিপ পেতেন।

এই টাকা তুলতে গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক ও বিভাগীয় চেয়ারম্যানের যৌথ স্বাক্ষর লাগতো। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ কেন্দ্র করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক ছফাকে অপছন্দ করে। রাষ্টবিজ্ঞানের চেয়ারম্যান স্বাক্ষর দিতে অস্বীকার করে। ফলে ছফার মাসিক বৃত্তির টাকা আটকে যায়। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদে যা হয়, ছফারও সেই দশা। অর্ধক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী উপন্যাসে আহমদ ছফা বলেন- আমি একজন সামান্য রিসার্চ স্কলার। মাসের শেষে মোট বার শ’ টাকা আদায় করার জন্যে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান এবং সুপারভাইজার- দু’জনের দ্বারস্থ হতে হয়। দু’জনের একজন যদি সই দিতে রাজি না হয়, তাহলে স্কলারশিপের টাকা ওঠানো সম্ভব হয় না। এর পরপরই যখন কন্যা শামারোখঘটিত সংবাদ ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের কানে গেল, তিনি আমার স্কলারশিপ ওঠানোর ফরমে সই করতে অস্বীকৃতি জানালেন। প্রিয় সোহিনী, চিন্তা করে দেখ কি রকম বিপদের মধ্যে পড়ে গেলাম। জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা বলতে যা দাঁড়ায়, আমার অবস্থাও হল সেরকম। শিক্ষকেরা জাতির বিবেক একথা সত্য বটে। এই বিবেকনামীয় ভদ্রলোকেরা সময় বিশেষে কী রকম নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারেন, আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। (আহমদ ছফা রচনাবলী ৬ : ৬০)

এছাড়া একাত্তর পরবর্তীসময়ে সরকারের সমালোচনা করায় ছফা সরকারের রোষানলে পড়েন। ছফার ভাষ্য- ‘তৎকালীন সরকার আমার প্রতি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে আরম্ভ করলেন। তার ফল এই দাঁড়াল যে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি থিসিস লেখার যে গবেষণাটি করছিলাম ছেড়ে দিতে হল।’ (আহমদ ছফা রচনাবলী ৪ : ১৩২)

তবে এইসব উত্তরও যৌক্তিক বলে মনে হয় না। এতটুকু মানসিক চাপে অথবা স্কলারশিপের টাকা তুলতে না পারলে ছফা গবেষণা ছেড়ে দেবেন- এমন দুর্বল প্রতিভা ও মানসিকতা কোনটাই ছফাতে নেই। মূলত গবেষণাকাজ ছফার কাছে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। বিষয়টি ছফার কাছে কাজের কাজ মনে হয়নি। ছফা বলেন- ‘কিছুদিন বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটির পর আমার মনে হল গবেষণা করার চেয়ে বাজে কাজ আর দুনিয়াতে নেই।’ (আহমদ ছফা রচনাবলী ৪ : ১৩৩) অনেকগুলো প্রসঙ্গ মিলিয়ে দেখা যায়, ছফার মানসিক প্রশান্তি ছিল না। তারপরও তিনি চাইলে থিথিস পেপার জমা দিতে পারতেন। তিনি দেননি। আসল কথা, ছফার কাছে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়। ছফার গবেষণা কাজটি সম্পূর্ণ না-হওয়ার আরও একটি কারণ চিহ্নিত করা যায় যদ্যপি আমার গুরু গ্রন্থে। এটি ছফার স্মৃতিচারণমূলক রচনা। জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে ছফা এ গ্রন্থটি রচনা করেন। পিএইচডিতে ভর্তির পর ছফা একান্তভাবে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন। এসময় ছফা প্রায় নিয়মিত আবদুর রাজ্জাকের বাসায় আসেন। প্রফেসর রাজ্জাকের বুকসেলফে ছফা বালজাকের রচনাবলি, ফ্লবেয়ারের উপন্যাস, ভিক্টোর হুগোর বইসহ ফরাসি সাহিত্যের বিপুল রচনাসম্ভার দেখতে পান। এতোগুলো বিদেশি সাহিত্যকর্ম দেখে ছফার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। ভেতরে ভেতরে তীব্র আগ্রহ জেগে ওঠে। কিন্তু সরাসরি বই ধার চাইতে ছফা সাহস দেখালেন না। কিছুটা কৌশলীপন্থায় ছফা এগুতে থাকেন। গবেষণাকর্ম সম্পাদনার জন্য কী কী বই পড়া যায় অথবা কীভাবে শুরু করা যায় এরকম পরামর্শ চান। প্রফেসর রাজ্জাকও পরামর্শ দেন- ‘প্রথম লাইব্রেরিতে ঢুইক্যাই আপনার টপিকের কাছাকাছি যে যে বই পাওন যায় পয়লা একচোটে পইড়া ফেলাইবেন। তারপর একটা সময় আইব আপনে নিজেই খুঁইজ্যা পাইবেন আপনের আগাইবার পথ।’ (আহমদ ছফা রচনাবলী ১ : ১৯৪)

সেই যে ছফা বিশ্ব জ্ঞানভান্ডারের বিপুল জগতে প্রবেশ করেন, সেখান থেকে আর বেরুতে পারেননি। ছফার পঠিত বইয়ের তালিকায় দেখা যায়- ডিক উইলসনের এশিয়া অ্যাওয়েকস, গুনার মিরডালের এশিয়ান ড্রামা, টয়েনবির ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলেশন, ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের কনডিশন অব দ্যা ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড, অ্যাডাম স্মিথের দ্যা ওয়েলথ অব নেশন, কাল মার্কসের দাস ক্যাপিটাল, ম্যাকসভেবরের প্রোটেস্টান্ট এথিকস অ্যান্ড স্পিরিট অব দ্যা ক্যাপিটালিজম, রিলিজিয়ানস অব ইন্ডিয়া, কমরেড আবদুল হকের পূর্ব বাংলা আধা-সামন্ততান্ত্রিক, আধা ঔপনিবেশিক, মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন, নরেন্দ্রনাথের দ্যা হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল মিউজিক, সমরসেনের বাবুবৃত্তান্ত, রামকৃষ্ণের কথামৃত ইত্যাদি। এই বইগুলোর নাম আমরা যদ্যপি আমার গুরু গ্রন্থে পাই। এছাড়াও আহমদ ছফার চিঠিপত্রে এ রকম আরও বহু দেশবিদেশি বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। এই সব বই পড়ে ছফার মধ্যে এমন ভাবান্তরের সৃষ্টি হয় যে, তিনি পুনরায় গবেষণায় ফিরতে পারেননি অথবা চাননি।

চার পিএইচডি থিথিসে ভর্তির পর আহমদ ছফা দীর্ঘদিন জ্ঞানসমুদ্রে ডুবে থাকেন। সেখান থেকে সমাজ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, সাহিত্যশিল্প ও দর্শন প্রসঙ্গে নবনব ধারায় নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। অধিত বিদ্যাবুদ্ধি ছফার মানসচেতনায় নানা ভাবভাবনার সঞ্চার করে। ফলে থিথিসের মত প্রচল গবেষণাকর্ম তাঁর কাছে বিবেচিত হয় ‘বাজে কাজ’। তাই তিনি গবেষণায় ফিরতে পারেননি অথবা ফেরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। থিথিস লেখার লোকের অভাব নেই। কিন্তু আহমদ ছফার মতো প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখার লোক বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। তাই থিথিস না লেখাতে গবেষণা জগতের ক্ষতি হয়নি। বরং উল্টো সাপে বর হয়েছে।

বাংলা সাহিত্যে প্রযুক্ত হয়েছে বেশ কয়েকটি উৎকৃষ্ট মানের কথাসাহিত্য, কবিতা আর প্রচুর সংখ্যক প্রবন্ধগ্রন্থ। এগুলো নিয়ে এখন গবেষণা চলছে, এবং চলবে। তবে ছফার মধ্যে কিঞ্চিত দুঃখবোধ থাকলেও থাকতে পারে। আহমদ ছফা বলেন- আমার একটা অপরাধবোধ রয়েছে। প্রচলিত নিয়ম ভেঙ্গে সুযোগ দেওয়ার পরও আমার পক্ষে পিএইচ-ডি করা সম্ভব হয়নি। একা একা যখন চিন্তা করি আমার মনে একটা অপরাধবোধ ঘনিয়ে আসে। হয়ত আমি নিজের উগ্র অহংটাকে বড় বেশি প্রাধান্য দিয়ে প্রফেসর মুনীর চৌধুরীর উদারতার প্রতি অবিচার করেছিলাম। আজকাল সেরকম একটা অনুভূতি আমার মধ্যে জাগ্রত হয়। বোধহয় সেজন্য আমার পক্ষে পিএইচ-ডি করা সম্ভব হয়নি। এটা হচ্ছে আমার অনুভব। পিএইচ-ডি শেষ করতে না পারার জন্য বাস্তব কারণ তার জন্য প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে আমি দায়ী মনে করি। (আহমদ ছফা রচনাবলী ১ : ১৮৪)

‘দায়ী’ শব্দটি দিয়ে আহমদ ছফা বোধকরি প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের শিষ্যকে জাগিয়ে তোলার মহাত্মশক্তিকে বোঝাতে চেয়েছেন। গুরুর দায়িত্ব শিষ্যকে পথ দেখানো। প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক সেই দায়িত্বটুকুই পালন করেছেন। আহমদ ছফাকে বড় কাজ করবার প্রেরণা যুগিয়েছেন, পথ বাতলে দিয়েছেন। এতে ছফার থিথিস লেখার মতো ছোট্ট একটি কাজ হয়তোবা হয়নি। তাতে কি? আহমদ ছফা মাত্র কয়েক দিনের পরিশ্রমে বাঙালি মুসলমানের মন এর মতো একটি অতুল্য প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করতে পারেন। তাঁর কি থিথিস লেখার দরকার আছে? গুরুর পরিচয় কী অথবা কীভাবে আমরা গুরুকে চিনে নেব। একজন যথার্থ গুরুর পরিচয় প্রসঙ্গে গদ্যকার প্রমথ চৌধুরী বলেন- যিনি যথার্থ গুরু, তিনি শিষ্যের আত্মাকে উদবোধিত করেন এবং তার অন্তর্নিহিত সকল প্রচ্ছন্ন শক্তিকে মুক্ত এবং ব্যক্ত করে তোলেন। সেই শক্তির বলে সে নিজের মন নিজে গড়ে তোলে, নিজের অভিমত বিদ্যা নিজে অর্জন করে। বিদ্যার সাধনা শিষ্যকে নিজে করতে হয়। গুরু উত্তরসাধক মাত্র। (প্রমথ চৌধুরী, প্রবন্ধ সংগ্রহ : ১৫০)

আরও পড়ুন- দুদ্দু শাহ : গান ও কবিতায় আঁকা একজন বাস্তবিক শিল্পী

আমার মনে হয়, প্রফেসর রাজ্জাক এই কাজটি করেছেন। তিনি ছফার আত্মাকে উদবোধিত করেছেন। তাঁর ভেতরের প্রচ্ছন্ন আত্মশক্তিকে জাগিয়ে তুলেছেন। ছফাও সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন। জেগে উঠেছেন, নিজেকে মেলে ধরেছেন। গবেষণার প্রচল পদ্ধতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। জ্ঞানবিজ্ঞানের অলিতেগলিতে বিহার করেছেন; সমৃদ্ধ করেন নিজেকে; বাংলা সাহিত্য সম্ভারকে ।

বিবেচিত গ্রন্থ আহমদ ছফা (২০০৮), আহমদ ছফা রচনাবলী ১, (সম্পাদনা : নূরূল আনোয়ার), খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, বাংলাবাজার, ঢাকা। আহমদ ছফা (২০০৮), আহমদ ছফা রচনাবলী ৪, (সম্পাদনা : নূরূল আনোয়ার), খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, বাংলাবাজার, ঢাকা। আহমদ ছফা (২০০৮), আহমদ ছফা রচনাবলী ৬, (সম্পাদনা : নূরূল আনোয়ার), খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, বাংলাবাজার, ঢাকা। প্রমথ চৌধুরী (১৯৫২), প্রবন্ধ সংগ্রহ, বিশ্বভারতী, ৬ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড। কলকাতা ১৭।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড