আবদুল মান্নান সৈয়দ
কাজী নজরুল ইসলামের নীরব হয়ে যাওয়ার দশ বছর পরে ১৯৫২ সালে পরবর্তী কবি-সমালোচক বুদ্ধদেব বসু ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে লিখছেন, ‘কৈশোরকালে আমিও জেনেছি রবীন্দ্রনাথের সম্মোহন, যা থেকে বেরোবার ইচ্ছেটাকেও অন্যায় মনে হতো — যেন রাজদ্রোহের শামিল; আর সত্যেন্দ্রনাথের তন্দ্রাভরা নেশা, তার বেলোয়ারি আওয়াজের জাদু — তাও আমি জেনেছি। আর এই নিয়েই বছরের পর বছর কেটে গেল বাংলা কবিতার; অন্য কিছু চাইলো না কেউ, অন্য কিছু সম্ভব বলেও ভাবতে পারলো না। যতদিন না ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নিশেন উড়িয়ে হৈ-হৈ করে নজরুল ইসলাম এসে পৌঁছলেন। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের মায়াজাল ভাঙলো।’ ‘নজরুলের দোষগুলি সুস্পষ্ট, কিন্তু তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সমস্ত দোষ ছাপিয়ে ওঠে; সব সত্ত্বেও একথা সত্য যে রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম মৌলিক কবি।’ ‘নজরুল ইসলাম নিজে জানেননি, তিনি নতুন যুগ এগিয়ে আনছেন; তার রচনায় সামাজিক রাজনৈতিক বিদ্রোহ আছে, কিন্তু সাহিত্যিক বিদ্রোহ নেই।’ (‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’, বুদ্ধদেব বসু)
বুদ্ধদেব বসুর উক্তিসমূহ পরীক্ষা করে দেখতে চাই এখানে। বুদ্ধদেব বসু পরিষ্কার বলেছেন এবং স্বীকার করে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের পরে নজরুল ইসলামই প্রথম মৌলিক কবি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রসঙ্গ তিনি তুলেছেন ওই প্রবন্ধে, কিন্তু তাকে আমল দেননি। সাহিত্যের পরম্পরার দিক থেকে একথা সত্য ও প্রয়োজ্য বলে আমরা মনে করি না। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুর পরে নজরুল ইসলাম তিনটি কবিতা ও গান রচনা করেন: ‘সত্যেন্দ্র প্রয়াণ’, ‘সত্য কবি’ ও ‘সত্যেন্দ্র প্রয়াণগীতি’; ‘সত্য কবি’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীর উপস্থিতিতে নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন এক সত্যেন্দ্র-শোক-সভায়, স্বল্পায়ু সেবক নামে একটি দৈনিক পত্রিকায় নজরুল সত্যেন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি সম্পাদকীয় রচনা করেছিলেন — সেটি চিরতরে লুপ্ত হয়েছে। অগ্রজ কবির প্রতি নজরুল এই-যে কবিতার জন্যে অবিরল শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন, তা কেন? তার কারণ সত্যেন্দ্রনাথের কিছু উপচার নজরুল গ্রহণ করেছিলেন — তার মধ্যে একটি অন্তেবাসী মানুষের জন্যে কবির ভালোবাসা; আরেকটি পুরাণের পুনঃপ্রয়োগের ভিতর দিয়ে নতুন ও অনুভূত সত্যের উন্মোচন; শব্দ ও ছন্দব্যবহারের কলাকুশালতাও; সত্যেন্দ্রনাথের চিত্রলতাকে নজরুল চিত্রকল্পে রূপান্তরিত করেছিলেন। নজরুল তার উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ থেকে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রবীন্দ্রসংগীতের হাফিজ বলে নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় করান। অগ্রজদের কাছ থেকে এত রকম মালমশলা নিয়ে এগিয়ে গেলেন যিনি তিনি পূর্বজকে অস্বীকার করবেন কেন? বুদ্ধদেব বিষয়টি তলিয়ে দ্যাখেননি। কল্লোল যুগের ত্রয়ী নায়ক বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত আপনাপন কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথের ‘বেলোয়ারি আওয়াজের জাদুতেই মুগ্ধ হয়েছিলেন, পরে তারা যার যার নিজস্ব পথে অগ্রসর হয়ে গেছেন, কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাছ থেকে গভীরতর পরিগ্রহণ করেছেন এবং তাকে নিজস্ব কাজে লাগিয়েছেন। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ওই শক্তি বাঙালি সমালোচকরাও সম্যক উপলব্ধি করতে পারেননি।
রবীন্দ্রনাথের পরে প্রথম মৌলিক কবি বলছেন নজরুলকে বুদ্ধদেব, ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অত্যুচ্চ প্রশংসা করেছেন, কিন্তু বিশ্লেষণে বিভ্রান্তি ঢুকে পড়েছে তার। বুদ্ধদেব বোঝেননি যে নজরুলের সামাজিক- রাজনৈতিক বিদ্রোহই তার সাহিত্যিক বিদ্রোহ। সামাজিক-রাজনৈতিক বিদ্রোহকে নজরুল তত্ত্বরূপে নয় — কবিতা রূপেই উপস্থাপিত করেছেন। বিষয়টির অসামান্য বিশ্লেষণ করেছেন কবি জসীম উদ্দীন তার ‘নজরুল ইসলাম’ নামক প্রবন্ধে। জসীম উদ্দীন লিখছেন, ‘নজরুলের দেশাত্মবোধক অধিকাংশই প্রবন্ধ, কবিতাকারে রচিত। এখানে সুন্দর কথা নয় ভালো কথা পদ্যাকারে রচিত। কড্ওয়েলের ভাষায় এগুলিকে ‘hightened language’ বলা যাইতে পারে। কবিতার জন্মকালে সমাজের দলপতিরা যে-সব কথা সকলকে জানাইবার প্রয়োজন মনে করিতেন তাহা এই ‘hightened language’-এ রচিত হইত। মানুষের প্রয়োজনে এগুলি রচিত হইত বলিয়া প্রয়োজন ফুরাইলে আর সেগুলির অস্তিত্ব থাকিত না। কিন্তু সেগুলির ভিতর দিয়া যে ছন্দ ও প্রকাশভঙ্গিমা ফুটিয়া উঠিত পরবর্তী যুগের লোকেরা তাহা অন্য কথা প্রচার করিতে ব্যবহার করিত। নজরুলের দেশাত্মবোধক কবিতাগুলি যদিও ‘ভালো কথা’ বলিবার প্রয়োজনে রচিত হইয়াছে তবু তাহার মধ্যে একটা কথার রঙিন নকশার মতো মাঝে মাঝে এমন ‘সুন্দর কথা’ আছে তাহা যে কোনো পাঠককে মুগ্ধ করিয়া তোলে।’ জসীম উদ্দীন নজরুলের বিভিন্ন কবিতা থেকে এরকম একগুচ্ছ কবিতাংশের সঞ্চিতাও তৈরি করে দিয়েছেন:
১ পুঁথির বিধান যাক পুড়ে তোর বিধির বিধান সত্য হোক।
২ খুঁজিছে এই ভণ্ডের দল, মূর্খরা তবে শোনো, মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
৩ মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।
৪ ডুবে ইসলাম, আসে আঁধার, ইব্রাহিমের মতো আবার কোরবানি দাও প্রিয় বিভব।
৫ চোখে চোখে আজ চাহিতে পারো না, হাতে রলি, পায়ে মল, মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেলো নারী, ভেঙে ফেলো ও শিকল!
৬ সদ্য প্রসূত প্রতি শিশুটি পিয়ায় অহর্নিশ শিক্ষা দীক্ষা সভ্যতা বলি তিলে তিলে মারা বিষ।
জসীম উদ্দীন উল্লেখ করেছেন প্রাসঙ্গিক নজরুলের দুটি কবিতার: ‘প্রলয়োল্লাস’ ও ‘অন্ধ স্বদেশ দেবতা’। তার মন্তব্যও উদ্ধৃত করে দিচ্ছি এখানে: ‘এই কবিতা দুইটিতে কবির কাব্যধারা শতদল বিস্তার করিয়া তাঁহার ভিতরের প্রচারধর্মকে একেবারে অন্তর্হিত করিয়া দিয়াছে। কবির ভাবধারা আর প্রচারধর্ম এখানে একীভূত হইয়াছে।’ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নি-বীণার (১৯২২) অন্তর্ভূত প্রথম কবিতা ‘প্রলয়োল্লাস’ যেন নজরুল ইসলামের সমস্ত কবিতার ভূমিকা। বিষয়টি সামান্য: নতুনের জয়ধ্বনি। কিন্তু এই কথাটিই যেন ছন্দমিলে নৃত্য করে উঠেছে। উপান্ত স্তবকে কবি যখন বলছেন, ‘ঐ ভাঙা-গড়া খেলা যে কিসের তবে ডর / তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ বধূয়া প্রদীপ তুলে ধর! / কাল ভয়ংকরের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর।/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর!! ‘ভাঙা’ আর ‘গড়া’, ‘ভয়ংকর’ আর ‘সুন্দর’ — এইসব কূটাভাষিক শব্দ পাশাপাশি বসিয়ে নজরুল বাংলা কবিতাতেই যেন একটি নতুন জায়গা যোজন করলেন। সন্ধ্যা (১৯২৯) গ্রন্থর্ভূত ‘অন্ধ স্বদেশ-দেবতা’ কবিতার প্রতিপাদ্য স্বদেশব্রতী সেই মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন যারা দেশের স্বাধীনতার জন্যে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেয়। শেষ চারটি পঙক্তি এরকম: ‘ছুটেছে পথিক, সাথে চলে পথ, অমানিশি চলে সাথে, / পথে পড়ে চলে, মৃত্যুর ছলে ধরে দেবতার হাতে। / চলিতেছে পাশাপাশি — / মৃত্যু, তরুণ, অন্ধ দেবতা, নবীন ঊষার হাসি।’ এই কবিতায় রাত্রির পটভূমি, শেষ হচ্ছে সূর্যকরোজ্জল ভোরের আনন্দসংবাদে। এই কবিতারও বিষয়বস্তু কিছু না, মহৎ একটি ঘটনার নায়কদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, তাকেই কবি করে তুলেছেন পুষ্পিত একটি মঞ্জরী।
জসীম উদ্দীনের অনুসরণে আমরাও নজরুলের কবিতা থেকে ছোট একটি গুচ্ছ নিজেদের প্রয়োজনে সাজিয়ে নিতে পারি:
১ জানিস না কি ধর্ম সে যে বর্ম সম সহনশীল, তাকে কি ভাঙতে পারে ছোঁওয়াছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল। [জাতের বজ্জাতি, বিষের বাঁশীঁ]
২ গাহি সাম্যের গান — মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান! নাই দেশ-কাল-পাতের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি। [ মানুষ, সাম্যবাদী]
৩ একজনে দিলে ব্যথা সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা। একের অসম্মান নিখিল মানবজাতির লজ্জা — সকলের অপমান। [ কুলি-মজুর, সাম্যবাদী]
৪. আজ জাগ রে কৃষাণ, সব তো গেছে, কিসের-বা আর ভয়, এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়। [ কৃষাণের গান, সর্বহারা]
৫ এই ধরণীর ধূলি-মাখা তব অসহায় সন্তান। মাগে প্রতিকার, উত্তর দাও আদিপিতা ভগবান [ ফরিয়াদ, সর্বহারা]
৬ অন্তরে আর বাহিরে সমান নিত্য প্রবল হও! যত দুর্দিন ঘিরে আসে, তত অটল হইয়া রও! [ নিত্য প্রবল হও, শেষ সওগাত]
সাম্যবাদী গ্রন্থান্তর্গত ‘নারী’ কবিতাটি জসীম উদ্দীন-চিহ্নিত ‘ভালো কথা’ ও ‘সুন্দর কথা’-র শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। এই কবিতা থেকে অবিরল উদাহরণ দেওয়া যায়, প্রায় সবটাই উদ্ধৃত করে দেওয়া যায়, কয়েকটি যুগ্মক:
১ সাম্যের গান গাই — আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
২ বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
৩ বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি অর্ধেক তার করিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
৪ এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল, নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
৫ তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ তার প্রাণ? অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।
৬ পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ, কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ।
৭ স্বর্ণরৌপ্যভার নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হয়েছে অলংকার।
৮ পুরুষ হৃদয়হীন, মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ।
৯ বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি, কেহ রহিবে না বন্দী কাহারো, উঠিছে ডঙ্কা বাজি।
১০ সেদিন সুদূর নয় — যে দিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!
জসীম উদ্দীন নজরুলের দেশাত্মবোধক কবিতায় লক্ষ্য করেছিলেন প্রাবন্ধিকতা। একই সঙ্গে তিনি নজরুলের কবিতায় দেখেছিলেন ‘ভালো কথা’ ও ‘সুন্দর কথা’র সমাহৃতি। এর পাশে রাখা যাক জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কিত একটি উক্তি, তার ‘কবিতার কথা’ রচনা থেকে: ‘আমি বলতে চাই না যে, কবিতা সমাজ বা জাতি বা মানুষের সমস্যা খচিত — অভিব্যক্ত সৌন্দর্য হবে না। তা হতে বাধা নেই। অনেক শ্রেষ্ঠ কাব্যেই তা হয়েছে। কিন্তু সে-সমস্ত চিন্তা, ধারণা, মতবাদ, মীমাংসা কবির মনে প্রাক-কল্পিত হয়ে কবিতার কঙ্কালকে যদি দেহ দিতে যায় কিংবা সেই দেহকে যদি দিতে চায় আভা তাহলে কবিতা সৃষ্ট হয় না — পদ্য লিখিত হয় মাত্র — ঠিক বলতে গেলে পদ্যের আকারে সিদ্ধান্ত, মতবাদ ও চিন্তার প্রক্রিয়া পাওয়া যায় শুধু।’ নজরুল ইসলাম এই সমাজ, জাতি বা মানুষের সমস্যার কথাই বলেছেন মূলত। বলেছেন দুভাবে: কখনো সরাসরি; কখনো ‘সুন্দরীর কটাক্ষের পিছনে শিরাউপশিরা’র মতো। কবির সাম্যবাদী (১৯২৫) কবিতাগ্রন্থের কবিতাগুচ্ছ প্রায় প্রত্যক্ষ ‘ভালো কথা’র সন্নিবেশ, আর সর্বহারা (১৯২৬) কবিতাগ্রন্থের অনেক কবিতাতেই ‘ভালো কথা’র সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে ‘সুন্দর কথা’। দুটি গ্রন্থেরই নাম-কবিতার প্রারম্ভিক কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করি: ১ গাহি সাম্যের গান — যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান। [সাম্যবাদী, সাম্যবাদী]
২ ব্যথার সাঁতার-পানি-ঘেরা চোরাবালির চর, ওরে পাগল, কে বেঁধেছিস সেই চরে তোর ঘর? শূন্যে তড়িৎ দেয় ইশারা, হাত তুলেছে সর্বহারা মেঘ-জননীর অশ্রুধারা ঝরছে মাথার ’পর, দাঁড়িয়ে দূরে ডাকছে মাটি দুলিছে তরুবর। [সর্বহারা, সর্বহারা]
প্রথম কবিতাটিতে ‘ভালো কথা’ বা শ্রেয়োবোধের উচ্চারণ, দ্বিতীয় কবিতাটিতে সর্বহারাকেও সুন্দরের রূপে উপস্থাপন। নজরুলের এই দুরকম কুশলতাই আয়ত্তাধীন ছিল। যে-জীবনানন্দ দাশ বলেছেন ‘কবিতা অনেকরকম’ (জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা-র ভূমিকা) অথবা ‘কবিতা ও জীবন একই জিনিসেরই দুরকম উৎসারণ।’ (‘কবিতার কথা’), তিনি প্রত্যক্ষ কবিতাকে স্বীকার করবেন না কেন, তা আমরা বুঝতে পারি না। আমাদের বিশ্বাস: সুন্দরায়ণও বটে, আবার কবিতা ‘সিদ্ধান্ত, মতবাদ ও চিন্তার প্রক্রিয়া’তেও ফলে উঠতে পারে। শর্ত একটিই: কবিতা হয়ে উঠল কিনা। আবার, কবিতা তথা যে-কোনো শিল্পকর্ম তো অসংজ্ঞেয়। তবে, কবিতা হয়ে উঠলে তাকে ঠিকই চিনে নেওয়া যাবে।
বুদ্ধদেব বসু বলেছেন নজরুল সম্পর্কে, ‘সব সত্ত্বেও একথা সত্য যে রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম মৌলিক কবি। বুদ্ধদেব একটু ভুল করেছেন বিশ্লেষণে: সামাজিক-রাজনৈতিক বিদ্রোহকেই নজরুল সাহিত্যিক বিদ্রোহে রূপান্তরিত করেছেন। বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে যা ছিল সারা ভারতবর্ষের মনের কথা, তাকে তিনি কবিতার ভাষায় গালিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর আবর্তমান শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘বিদ্রোহী’র (অগ্নি-বীণা) শেষাংশে যখন তিনি প্রজ্বলিত হয়ে উঠছেন এরকম নিনাদিত নির্ঘোষে: ‘মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হবো শান্ত, / যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না — / বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত / আমি সেই দিন হবো শান্ত।’
সামাজিক-রাজনৈতিক বিদ্রোহকে নজরুল সাহিত্যিক বিদ্রোহে পরিবর্তিত করে নিয়েছিলেন পুরাণের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। অগ্নি-বীণা থেকে দুএকটি কবিতার অংশ উদ্ধৃত করছি: ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ কবিতায় ‘টুঁটি টিপে মারো অত্যাচারে মা, / গল-হার হোক নীল ফাঁসি, / নড়নে তোমার ধূমকেতু-জ্বালা / উঠুক সরোষে উদ্ভাসি।’ ‘আগমনী’ কবিতায় ‘পদতলে লুটে মহিষাসুর,/ মহামাতা ঐ সিংহবাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে — / শাশ্বত নহে দানবশক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পশুর।’ ইসলামের ইতিহাসকেও একই প্রয়োজনে লাগিয়েছিলেন নজরুল। গ্রন্থে বর্জিত হয়েছে, কিন্তু মোসলেম ভারত (আশ্বিন ১৩২৭) পত্রিকায় ‘মোহররম’ কবিতার শেষ দুই পঙক্তি ছিল এরকম: দুনিয়াতে দুর্মদ খুনিয়ারা ইসলাম! / লোহু লও, নাহি চাই নিষ্কাম বিশ্রাম!!’
নজরুল ইসলামের সমগ্র কবিতায় এই তিনটি ভাবনা-বেদনা প্রধানত রূপায়িত: (১) স্বদেশের স্বাধীনতা; (২) হিন্দু-মুসলমান মিলন; এবং (৩) নির্যাতিত মানুষের মুক্তি। তার চিন্তার মূলে ছিল এই বেদনাবোধ: সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষেরা উৎপীড়িত থেকে যাচ্ছে; হাজার বছর ধরে বৃহত্তর বাংলায় হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করছে বটে কিন্তু তাদের মধ্যে সত্যিকার কোনো মিলন ঘটেনি; এবং ভারতবর্ষ ইংরেজের অধীনস্থ হয়ে আছে। নজরুলী জগত এই বেদনায় পূর্ণ এবং বেদনার রূপকে মুক্তির জন্যে ডাক দিয়েছে। সমসাময়িক প্রাবন্ধিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯২৭ সালেই লিখছেন, ‘…নজরুল ইসলাম বেদনার কবি। তাঁহার প্রায় সমস্ত রচনাই বেদনার সুরে ভরপুর। আর্ত-ব্যথিত-উৎপীড়িত মানবমনের ব্যথাকেই তাঁহার রচনার মধ্য দিয়া তিনি ফুটাইয়া তুলিতেছেন। বেদনা ব্যক্তিগত মনের অভিব্যক্তি হইলেও ইহার অনুভূতি বিশ্ববাসীর মনেই খেলা করে। সুতরাং বেদনা একটা বিশ্বজনীন অনুভূতি।…কাব্যকার যখন ব্যক্তিগত বেদনার কথা ভুলিয়া বিশ্ববাসীর মনে একটা সহানুভূতির তরঙ্গ তুলিতে পারেন, তাহার রচনার ইন্দ্রজালে যখন মানুষ নিজের ব্যক্তিগত বেদনার কথা ভুলিয়া সমগ্র বিশ্বমনের বেদনাবোধের সহিত নিজ মনের যোগ সাধন করিতে পারে, তখনি কাব্যকারের রচনা সফল হয় — তখনি তাহার রচনা বিশ্বসাহিত্যে স্থান লাভের যোগ্য হয়। / নজরুলের কাব্যে বেদনার এই বিশ্বরূপ আছে বলিয়াই তাঁহার কাব্যকে আমরা বিশ্বসাহিত্য বলিয়া অভিনন্দন করি।’
এখানে যা নিরুক্ত থেকেছে, তা হলো: এই বেদনাই নজরুলকে ‘বিদ্রোহী কবি’ করে তুলেছে, সেটাই তার প্রধানতম পরিচয়। প্রেমের কবিতা লিখেছেন নজরুল, প্রকৃতির কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন ধার্মিক-আধ্যাত্মিক কবিতা, বেদনা-উৎসারিত বিদ্রোহের কবিতাতেই তার নাম চিরকালের জন্যে স্বাক্ষরিত। ঠিক এরকম কবিতা বাংলা ভাষায় আমরা দেখিনি আর। এজন্যেই বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষার তিনিই প্রথম মৌলিক কবি।’ এই চিন্তার জগতের রূপদাতা বলেই জসীম উদ্দীন তার কবিতায় দেখেছেন ‘প্রবন্ধ’। প্রবন্ধের প্রতিভাস। যে-প্রবন্ধ হচ্ছে ‘প্রকৃষ্ট বন্ধন’। কিসের? চিন্তার জগতের। বুদ্ধদেব বসুর মতো যারা মনে করেন, নজরুলের কবিতা হচ্ছে ‘চিন্তাহীন অনর্গল উৎসারণ’ তারা — আশা করি — জসীম উদ্দীনের মতো কবির কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন।
নজরুল ইসলাম ততটাই সচেতন কবিতাশিল্পী, যতটা শিল্পের জন্যে প্রয়োজনীয়। প্রথম জীবনে যাত্রাদলের সঙ্গ তার উত্তরকালীন কবিতায়-গানে কাজে লাগেনি, তা নয়; চমৎকারভাবেই লেগেছে, কিন্তু সেটাকেই একমাত্র ভাবলে তো নজরুলের প্রতি ঘোর অবিচার করা হবে। নজরুলের কবিতা আধেয়ের দিক থেকে যেমন তেম্নি আধারের ক্ষেত্রেও এত সচেতন — শব্দে-ছন্দে-চিত্রকল্পে-উপমা-উৎপ্রেক্ষায় এত সমৃদ্ধ — যে কেউ কেউ যখন তাতে পুঁথিসাহিত্যের উত্তরাধিকার দেখেন তখন তাকে আমরা ‘আরোপন’ বলতে বাধ্য হই। প্রাগুক্ত প্রবন্ধে জসীম উদ্দীন এই আরোপনের সংগত প্রতিবাদ করেছেন। স্পষ্ট বলেছেন, ‘নজরুল এই পুঁথিসাহিত্যের মানসপুত্র তো নহেনই, বরঞ্চ বাঙালি-মুসলমানের একটি উল্লেখযোগ্য দান এই পুঁথিসাহিত্যকে তিনি একাধিক প্রবন্ধে অবহেলা ও বিদ্রূপ করিয়াছেন।…পুঁথিসাহিত্যের লেখকেরা আরবি-ফারসি শব্দের ধ্বনিতরঙ্গ না-বুঝিয়াই এবড়োখেবড়ো ভাবে যেখানে ভাবপ্রকাশের উপযুক্ত বাংলা শব্দ খুঁজিয়া পান নাই সেখানে ইচ্ছামতো আরবি-পারসি শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন।’ তারপর জসীম উদ্দীন দেখিয়েছেন, ‘মুসলমানি কোনো বিষয় ছাড়া তিনি তাঁহার কবিতায় এরূপ আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেন নাই। যেখানে তিনি আগমনী বা অপর কোনো হিন্দু উৎসব আনন্দের বিষয় লইয়া কবিতা রচনা করিয়াছেন সেখানে তিনি একটিও আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেন নাই।…তাঁহার অসংখ্য প্রেমের কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দের ছড়াছড়ি নাই।’
যেমন প্রসঙ্গে তেমনি প্রকরণে নজরুল সচেতন শিল্পী। শিল্পের জন্যে, কবিতার জন্যে যতখানি ‘চিন্তার আভার ব্যবহার’ দরকার ততটাই, ততটুকুই। কবিতার তথা শিল্পের সঙ্গে তো কল্পনার মিশেলও চাই। ও না-থাকলে শিল্প হয় না, কবিতা হয় না।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড