• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

প্রবন্ধ

মাহফুজামঙ্গল : কাব্য-ইতিহাসে এক অনন্য কাব্যকীর্তি

  মোহাম্মদ আব্দুর রউফ

২৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৫:৩২
ছবি
প্রচ্ছদ : কাব্যগ্রন্থ ‘মাহফুজামঙ্গল’

সৃজনশীল অথবা মননশীল হোক, লেখক তো তার সৃষ্টিকর্মের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকেন। কোনো লেখককে বুঝতে হলে তার সাহিত্যকর্মের মধ্যদিয়েই যেতে হয়। বাংলাদেশের সাহিত্যে মজিদ মাহমুদ একটি প্রতিষ্ঠিত নাম। পাঠকের কাছে তার পরিচয়, ‘মাহফুজামঙ্গলের কবি’। কিন্তু কবিতা ছাড়াও তিনি গল্প লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, লিখেছেন শিশুতোষ রচনা। কয়েকটি ঈদসংখ্যায় মজিদ মাহমুদের উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ সবশাখাতেই আছেন সাহিত্যসখা মজিদ মাহমুদ। সব পরিচয়ের উর্দ্ধে কবি-পরিচয়; ‘মাহফুজামঙ্গলের কবি’। কেন? তার তো আরো কবিতাগ্রন্থ আছে। অদ্যাবধি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা পনের। তাকে তো ‘বল উপাখ্যানের কবি’ বলা হয় না; বলা হয় না ‘আপেল কাহিনির কবি’ অথবা ‘লঙ্কাবি-যাত্রার কবি’। অথচ এইসব কাব্যগ্রন্থ আরও পরিণত বয়সে লেখা। এখানে আরও পরিশীলিত চিন্তার ছাপ পরিদৃশ্যমান। তবু পাঠকসমাজ ভালোবেসে মজিদ মাহমুদকে ‘মাহফুজামঙ্গলের কবি’ বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে থাকে। অথচ এই গ্রন্থটি তার তারুণ্যে লেখা। এসময় কবির বয়স দুই কুড়ির কাছাকাছি। কবিতাও তাই বলে, ‘বছর বিশেক আগে যে মাটি আমাকে ধরেছিল প্রথম / একাত্তরের হানাদার আগুন তার চিহ্ন রাখেনি, এখন / ছাপান্ন হাজার মাইলের সীমাবদ্ধতায় কেটে যায় দিন’। মাহফুজামঙ্গল কবির প্রথম লেখা প্রথম কবিতার বই। কৌতূহল জাগে, কি আছে এই গ্রন্থে।

দুই কবি মজিদ মাহমুদের মাহফুজামঙ্গল পাঠ নিতে গেলে প্রথম কবিতাটির প্রথম চরণেই মনে হবে, এমনটি তো আগে পড়িনি- অন্তত বিষয় নির্মাণ ও উপস্থাপনা-ঢঙে। অথচ এটি একটি প্রেমকাব্য। প্রণয়প্রসঙ্গ বলতে গেলে বেশ সুপরিচিত ও পুরোনো কাব্যরসদ। প্রাচীনকাল থেকে কবিতার রস যুগিয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও যোগাতে থাকবে। বিদ্যাপতি-চন্ডীদাসের প্রেমপদাবলির সঙ্গে আমরা বেশ পরিচিত। দীর্ঘদিন এই প্রকৃতির সুফিবাদ অথবা আধ্যাত্মিক চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কাব্যকথনকলা পাঠককে আনন্দ দিয়ে আসছে। কিন্তু আধুনিক ও উত্তরাধুনিকতার আগমনে সেই মধ্যযুগের প্রেমময় অধ্যায়টি প্রায় স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে অথবা ঐতিহ্যে পরিণত হচ্ছে। কেবল একাডেমিক ডিসকোর্সেই বেঁচে আছে। এই সময় আমরা মজিদ মাহমুদের হাতে মাহফুজামঙ্গল রচিত হতে দেখি। রচিত হতে দেখি- ‘মাহফুজা তোমার শরীর আমার তছবির দানা / আমি নেড়েচেড়ে দেখি আর আমার এবাদত হয়ে যায়।’ এই রকম দু’একটি কাব্যচরণ কি সমগ্র কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া সম্ভব? এই কবিতাগুলির পাঠ নিলেই আমাদের অতীত ঐতিহ্যময় পদাবলি সাহিত্যের কথা মনে পড়ে, প্রেমপদাবলির কথা পড়ে; পদকর্তাদের মনে পড়ে, মনে পড়ে রাধাকৃষ্ণের প্রেমপ্রণয়-প্রসঙ্গগুলো। অথবা কাব্যশিরোনামেই মনে পড়ে যায় মঙ্গলকাব্যের কথা। মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল অথবা ভারতচন্দ্র, বিজয়গুপ্ত, মুকুন্দরামসহ আর কত কী। জানি, আমরা প্রেমপদাবলি পড়ছি না অথবা মঙ্গলকাব্যও পড়ছি না। মজিদ মাহমুদও একবিংশ শতাব্দীতে নেনো টেকনোলজির যুগের কবি হয়ে বৈষ্ণব পদাবলি লিখছেন না অথবা মঙ্গলকাব্য লিখছেন না। তিনি আধুনিক কবিতাই লিখছেন। এবং খণ্ড কবিতাই লিখছেন। দারুণ এসব খণ্ড কবিতার মধ্যে একটি অখণ্ড চিন্তার ছাপ পরিদৃশ্যমান। বিষয়টি এত সহজ ছিল না। বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক বিবর্তনের একটি পথরেখা তিনি নির্মাণ করেছেন। যে পথরেখা ধরে বিভিন্ন পদাবলি সাহিত্য, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, সুফিবাদ, আধ্যাত্মিকতার কাব্যজগত, রবীন্দ্রনাথ আত্মীকরণসহ সমসাময়িক সময়, সমাজ ও সমাজস্থ মানবমনের হাসিকান্না, দুঃখকষ্টের কাব্যবয়ান এই মাহফুজামঙ্গল। তিন মাহফুজামঙ্গলের পাঠক-আলোচক-সমালোচক সবার কাছে প্রশ্ন একটাই। কে এই মাহফুজা? কোথায় তার নিবাস; কী তার পরিচয়। কবির সঙ্গে সম্পর্কটাইবা কী ইত্যাদি। অন্তহীন প্রশ্ন নিয়ে পাঠক নিজেই নিজের মুখোমুখি। কখনো কখনো কবির শরণাপন্ন। কবি নীরব। রবীন্দ্রনাথের ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতার নায়িকার মতো মজিদ মাহমুদও কৌশলে মৌন থাকেন; মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে রহস্যময় একচিলতে হাসি। মাহফুজা দেবী না মানবী-এই নিয়ে দোলাচলে থাকেন অনেকেই। মাহফুজাকে দেবী বলে ভাবতে চান কেউকেউ। পাঠকের এই ভাবনার স্বাধীনতাটুকু আছে। আমিও মাহফুজাকে নিয়ে ভাবি, তবে আমি একে মানবীরূপেই ভাবতে চাই। কেবল মানবী বললেই হয় না, কবিপ্রেয়সী। মনোজগতের বাসিন্দা অথবা হয়তো বাস্তবেও ছিল। কবি হয়তোবা প্রেমেও পড়েছেন; বিরহযন্ত্রণাও সয়েছেন। সত্যিকার সুগভীর বিরহযন্ত্রণা ছাড়া এরকম একটি কাব্যরচনা করা কি সম্ভব? সেটিও আসল কথা নয়। প্রেমে তো অনেকেই পড়ে; কবিতাও লেখে। আসল কথা, আত্মযন্ত্রণাকে শিল্পে রূপান্তর-প্রসঙ্গ। মজিদ মাহমুদ এই কাজটি বেশ যত্নের সঙ্গেই করতে পেরেছেন মাহফুজামঙ্গল কাব্যে।

চার প্রেয়সীকে ভালোবেসে নামকরণ তো নতুন নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে দেখি ভবতারিণীকে ‘মৃণালিনী’ নামে ডাকতে। নজরুলকে দেখি আশালতা সেনগুপ্তাকে ‘প্রমিলা’ নামে ডাকতে। শেষের কবিতায় দেখি যুবক-যুবতীরা ভালোবেসে একে অপরের নামধান ইচ্ছেমতো ছেটেছুটে ছোট করছে যাতে নামটি হৃদয়গভীরে পৌঁছতে পারে। বোধকরি,‘মাহফুজা’ নামটিও নবনামকরণের মতোই একটা কিছু। আমার মনে হয়, এই নামের আড়ালে কবি প্রকৃত নারীকে আড়াল করেছেন। এজন্য কবিকে দোষারোপ করা চলে না। সেই স্বাধীনতাটুকু কবিদের থাকে। বরং এটি অভিনন্দনযোগ্য। তিনি তো আর ইতিহাস লিখছেন না; কবিতাই লিখছেন। সেখানে কল্পনা আর বাস্তবতার সমন্বয় থাকতেই পারে। নামটি বেশ সুপরিচিত। আমাদের চারপাশে এরকম নামের অনেক মেয়েই দেখতে পাই। তবে এরসঙ্গে ‘মঙ্গল’ শব্দটি প্রযুক্ত হয়ে একটি ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। এটি তো কবি-কৃতিত্ব। নামটি ঐতিহ্যের পরিচায়ক-এ রূপান্তরিত হয়েছে। এবং এটি পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে। কেবল সাধারণ পাঠক নয়, সাহিত্য-শিল্পানুরাগী-বঙ্গলেখকজনের কাছেও। পরবর্তীকালেঅনেক লেখকের গ্রন্থ অথবা কবিতার নামকরণ করতে দেখি মুসলমানমঙ্গল, আয়েশামঙ্গল, নূরজাহান, ‘এবাদতনামা’, ‘কুরসিনামা’ নামের নানা বই। তালিকা করলে ছোট হবে না। কেবল তরুণ লেখকই নয়, প্রতিষ্ঠিতরাও এর আওতাভুক্ত। বোঝা যায়, মাহফুজামঙ্গল বইটির প্রভাব কতটা গভীর। পাঁচ ‘মাহফুজা’ নামের আড়ালে কবি প্রকৃত নারীকে আড়াল করলেও তার পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন বেশ কাব্যিকঢঙে। তবে সেটি গল্পের মতো করে নয়; কবিতার মতো করে, কবির মতো করে। রহস্যময় কাব্যচাদরে ঢেকে, নানা রকম ইঙ্গিত-প্রতীক-সংকেত আর রূপকের আশ্রয়ে। তাই বলে তার কাব্যভাষা দুর্বোধ্য নয়। বোধগম্যতার প্রতি তিনি সচেতন থাকেন সুতীব্রভাবে। তিনি হয়তো বিশ্বাস করেন, ভাষা কবিতার পক্ষে বড় দরকারি সম্পদ। তিনি সযত্নে সেটি সুরক্ষা করেন। তার কবিতা হয়ে সুউপভোগ্য, রোমাঞ্চকরও। এবার মাহফুজা প্রসঙ্গে আসি।

কবির চোখের সামনেই মাহফুজা ভূমিষ্ট হয়েছে মাত্র ইঞ্চি তের শরীর নিয়ে। অসহায় মাহফুজা। ঢাকতে পারেনি নিজের নগ্নতা। কবির মমত্বই তাকে করেছে মহান। কবি নিজেই তাকে ‘দক্ষিণ তর্জনী ধরে’ শিখিয়েছেন হাঁটা। কিন্তু এই অসহায় মাহফুজা ভরাযৌবনে রূপান্তরিত হচ্ছে বিপুল শক্তির আধারে। শক্তির পরিমাপটি বোঝাতে কবি উপমার আশ্রয় নিচ্ছেন- ‘এতটুকু শরীর এমন শক্তির আধার / এরচে বেশি নয় ইংল্যান্ডের রানীর ক্ষমতা।’একই কবিতায় মজিদ মাহমুদ বলছেন-

তুমি তো পাঁচ হাজার বছর আগের মাহফুজা তুমি তো পাঁচ লাখ বছর আগের মাহফুজা তুমি তো সৃষ্টির প্রথম মাহফুজা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হোক তোমার শাসন।

লক্ষণীয়, কবি মাহফুজাকে ভূমিষ্ঠ হতে দেখছেন। আবার তাকে সৃষ্টির প্রথম মাহফুজা বলছেন। আপাতত বৈপরীত্য মনে হলেও এর অন্তরালে রয়েছে সুগভীর সংযোগ ও দার্শনিক সমন্বয়বোধ। অর্থাৎ মাহফুজাকে কোনো একক নারীসত্তায় সীমায়িত করছেন না। বরং এই একক নারী মোড়কে সমগ্র বাঙালি নারীজাতির একটি অনুপুঙ্খ প্রতিচ্ছবি তুলে আনতে সচেষ্ট হন। খণ্ডিত নয়, অখণ্ডিত জীবনচিত্রই তার কাব্যান্বিষ্টবস্তু। তার শিল্পসাধনা। সমগ্র কাব্যশরীর জুড়ে এর সমর্থন মিলবে। প্রেমিকপুরুষের আজন্ম-সাধনা এবং তার আঁতের কথাই তুলে এনেছেন কবি মজিদ মাহমুদ। ‘ঈশ্বরকে ডাক দিলে মাহফুজা সামনে এসে দাঁড়ায় / আমি প্রার্থনার জন্য যতবার হাত তুলি সন্ধ্যা বা সকালে / সেই নারী এসে আমার হৃদয়মন তোলপাড় করে যায়’। স্মর্তব্য, নারীকে হৃদয়ের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার যে পুরুষব্যাকুলতা সেটি এই কবিতার বলা যায় মৌল প্রতিপাদ্য-প্রসঙ্গ। তবে এতটুকুই সব নয়। এতটুকুই সব হলে কবিতাটি হয়তোবা হালকা হয়ে যেতো।

‘কুরশিনামা’ ও ‘এবাদত’ নামের কবিতাদুটি দুটি পাতায় মুদ্রিত অথবা দৃশ্যমান হলেও এর অদৃশ্যমান ব্যাপ্তি যোজন-যোজন ব্যাপী। কবি বলছেন, ‘আমি এখন রাধার কাহিনি জানি / সুরা আর সাকির অর্থ করেছি আবিষ্কার’। মানব-ইতিহাসের ভারতবর্ষীয় সাধনা-বৃত্তান্ত নানারকম পুরাকাহিনির সঙ্গে এই কবিতাগুলোর কোথাও না কোথাও সংযোগসূত্রের সন্ধান মেলে। শিখ-বৌদ্ধ, হিন্দু-মুসলমানসহ উপমহাদেশের মানুষের নানামাত্রিক সাধ্যসাধনার কথা আমরা জানি। কবিরা কখনো চর্যাপদে, কখনো পদাবলি সাহিত্যে, আবার কখনোবা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের আদলে অথবা বাউল পদাবলিতে নরনারীর প্রেমতত্ত্ব অথবা প্রেমতত্ত্বের মোড়কে আধ্যাত্মিক সাধনার কথা বলেছেন। কবীর, নানক, চৈতন্য, লালন, সিরাজ, রবীন্দ্রনাথ- এরাতো এই অঞ্চলেরই বাসিন্দা। এদের প্রভাব পরবর্তীকালের কবিদের মধ্যে থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রান্তিক-জীবনের উপলব্ধি-‘জীবনে জীবন যোগ করা / না হলে, কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।’ - ‘জীবনে জীবন যোগ করা’র শিল্পপ্রচেষ্টা মজিদ মাহমুদের কাব্যসাধনায় পরিদৃশ্যমান। নারীর সঙ্গে পুরুষের, পুরষের সঙ্গে নারীর; অথবা স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির, সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার; এজীবনের সঙ্গে সেজীবনের, একালের সঙ্গে সেকালের, সর্বকালের সর্বমানের পারষ্পরিক মিলবার আকুতি এবং মুক্তির আকাক্সক্ষাই মজিদ মাহমুদের কাব্যের মৌলপ্রবণতা।

এই প্রবণতাই মজিদ মাহমুদের হাতে শিল্পসুধায় রূপান্তর হচ্ছে। পাঠক নিজেরাই নিজেদের মতো করে রস আস্বাদন করতে পারে। ইচ্ছেমতো নানামুখি ব্যাখ্যাবিশ্লেষণও দাঁড় করাতে পারে। এই গ্রন্থের কবিতাগুলোতে পাঠক নিজেকে খুঁজে পেতে পারে; খুঁজে পেতে পারে তার পূর্বপুরষকে। ‘তোমার স্মরণে লিখেছি নব্য আয়াত / আমি এখন ঘুমে-জাগরণে জপি শুধু তোমার নাম।’ - এইসব কাব্যচরণে আমরা নিজেকে খুঁজে পাই, নিজেদেরকে ফিরে পাই বারবার। ফিরে পাই লায়লী-মজনুকে, ইউসুফ-জোলেখাকে, শিরি-ফরহাদকে। রাধা, কৃষ্ণ, পদ্মাবতী, রত্নসেন, মনোহর,মনসুর হাল্লাজ, সাজু, রূপাই, রোহিণি, সীতা, সাবিত্রী, কুন্দনন্দিনী, বিনোদিনী, এজিদসহ এরকম অসংখ্য মানুষ কি এই কাব্যচরণের আওতাভুক্ত নয়? অনাদিকালের প্রেমযুগল স্রোতে ভেসে আসা সব জীবনের সঙ্গে মজিদ মাহমুদ বর্তমান প্রজন্মের একটি সংযোগসেতু নির্মাণ করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে নতুন কাব্যচেতনা ও উপস্থাপনা ঢং তার এ ধরনের কাব্যপ্রকল্প সৃজনে সহায়ক-শক্তিরূপে কাজ করেছে। এটি তার বাকপ্রতীম সক্ষমতা। সেই সঙ্গে কাব্যসক্ষমতারও শিল্পস্মারকচিহ্ন।

ছয় মাহফুজার অবস্থান ও ব্যাপকতা বেশ দূরদেশ পর্যন্ত সুপ্রসারিত-সুবিস্তৃত। কোন একটি সুনির্দিষ্ট গ্রাম বা মহল্লার সীমা-পরিসীমায় সীমাবদ্ধ নয়। যদিও কবিতায় ইউরোপের গ্রিকসভ্যতা, মিশরের নীলনদ, দানিয়ুবসহ বেশ কিছু স্থানের নাম উল্লেখ দেখা যায়। মাহফুজা মূলত এই পৃথিবীর বাসিন্দা। তাকে যেতে হয় ন্যান্সি রিগানের শয়নকক্ষে, রাইসার শয়নকক্ষে। মাহফুজার কারণেই ধসে যায় ট্রয় নগরী, মরে যায় গ্রিকসভ্য মানুষ। গ্রাম থেকে কৃষক এসেছিল এক আরজি নিয়ে, সারাদিন প্রতীক্ষায় ছিল, কাউকে বলেনি, কাউকে বলা যায় না। শুধু নাকি মাহফুজাকেই বলা যায়। বেরুবাড়ির কৃষকের বাড়িতেও যেতে হয় মাহফুজাকে। না-গেলে আবাদ রহিত হবে। অর্থাৎ সবখানেই মাহফুজাকে যেতে হয়; আবাদ সচল রাখার স্বার্থে। কৃষক, আবাদ, মাহফুজা- এই সব শব্দের মধ্যে বোধহয় রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। এরকম তো নয় যে মাহফুজাই জমি, মাহফুজ কৃষক? শোনা যায়, জনক রাজা নাকি কৃষিকাজ করতেন। লাঙ্গলের ফলায় পেয়েছিলেন সীতাদেবীকে। কোন জমিতে চাষ দিয়েছিলেন অথবা কখন, কীভাবে সীতাকে পেয়েছিলেন- এসব প্রসঙ্গ আজও ব্যাখ্যাতীত।

মাহফুজাকে দেখলে কবির ভেতরে মরুভূমির তৃষ্ণা জেগে ওঠে। মাহফুজা নাকি কবির নিজস্ব অংশ। কবিকে বলতে শোনা যায়- ‘যাত্রা শুরুর করার আগে যা আমি / হারিয়ে ফেলেছিলাম..’ ইসলামি মিথোলজিতে দেখা যায়, আদমের পাজরের বাম পাশের হাড় থেকে বিবি হাওয়ার সৃষ্টি। তবে কি মাহফুজা হাওয়ার প্রতিরূপ আর কবি আদমের প্রতিরূপ? আবারকবিকে বলতে দেখা যায়- ‘আমরা ছিলাম জমজ ভাইবোন / একই মায়ের উদরে আমরা শুয়ে ছিলাম নিশ্চুপ’। বিষয়টি কম রহস্যময় নয়। নানামুখি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অবকাশ রয়ে যায়। যাই হোক, মাহফুজার সঙ্গে কবির সম্পর্কের গভীরতা অনুমান করা যায়। মাহফুজা মজিদ মাহমুদকে দারুণভাবে আলোড়িত করে, বিমোহিত করে, মুগ্ধ করে। আকর্ষণ করে, বিকর্ষণও করে। কাছে টানে, দূরে ঠেলে দেয়। ধরা দেয় না। এমনকি রবীন্দ্রনাথ-নজরুলও নাকি পায়নি মাহফুজাকে। কিটস, শেলি, বোদলেয়ার, নেরুদাও খুঁজেছে। তাহলে কি মাহফুজারা অধরাই থেকে যায়? নারীপ্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যও কি কিছুটা একই প্রকৃতির নয়? ‘বুঝা যায় আধো প্রেম, আধখানা মন / সমস্ত কে বুঝেছে কখন।’ অথবা রমণীমনের দুর্বোধ্যতার প্রসঙ্গটি রবিঠাকুর রমণীর মুখ দিয়েই বলিয়েছেন এভাবে- ‘রমণীর মন / সহস্রবর্ষের, সখা, সাধনার ধন।’

সাত পাঠকের কাছে মাহফুজা রূপকথার রহস্যময়ী নায়িকা হলেও কবির কাছে কি তাই? সম্ভবত নয়। কবি মাহফুজাকে চেনেন। মাহফুজার ভেতর-বাইরে, রূপলাবণ্য, দোষগুণ, পূর্বজন্ম-পরজন্ম ইত্যাকার নানা প্রসঙ্গ কবির জানা আছে। কেননা, মাহফুজা তো কবিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাহফুজার মান-অভিমান, আকর্ষণ-বিকর্ষণ চলতে থাকে। মাহফুজার নেতিবাচক প্রসঙ্গও মজিদ মাহমুদের চোখ এড়িয়ে যায় না। প্রেমের পাশাপাশি হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা-এরকম রিরাংসাও তো নারীর মধ্যে দেখা যায়। তবে কবি এসব অনাবিষ্কৃত গোপন প্রসঙ্গ জানতে চান না। কবিকে বলতে শুনি- ‘আমিও যেন না জানি তোমার অনাবিষ্কৃত বিষয় / তোমাকে জানলে মানুষের নষ্ট হবে আহারে অরুচি / করবে না আবাদ বন্ধ্যামাটি’। লক্ষণীয় বিষয়, কবি কিন্তু মাহফুজার কোন প্রসঙ্গ গোপন করছেন না। এবং তাকে আংশিকভাবে উপস্থাপনও করছেন না। ভালোমন্দ, ইতিবাচক-নেতিবাচক সব মিলিয়ে পুরোপুরি মাহফুজাকেই দেখাচ্ছেন।আকাশ বা স্বর্গলোক থেকে নেমে আসা অথবা পাতালফুরে উঠে আসা কোন দেবী নয়। কল্পজগতের মানবী মাহফুজাকে বাস্তব জগত ও জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে রহস্যময়ী-নারীরূপে উপস্থাপন করেছেন। এই দেশের পলিতেই জন্ম, বেড়ে ওঠা, খাঁটি বাঙালি নারী মাহফুজা। প্রস্থানের পর আবার নতুনরূপে আগমন। নতুন মাহফুজার স্বরুপ জানা যাবে ‘যা ছিল সব নিয়ে গেলি’ কবিতায়।

তোর স্থলে এসেছে এক নূতন রমণী তোর মতো সে হিংসুটে নয় কৃপণ নয় তুই তো আমায় দিয়েছিলি দিনের একটিমাত্র সময় অপরাহ্নের সঠিক সময় না গেলে তোর মান ভাঙাতে পুরো দুটো দিন যেতো যার কিন্তু সেই রমণী তোর স্থলে এসেছে যে সকাল-সন্ধা চিলেকোঠায় বসে থাকে আমার জন্যে সবার জন্যে আর তোর পানলতিকার পাতাবাহার টবের গ-িবদ্ধ মাটি ছেড়ে তোর বদলে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে তোর হাস্নাহেনা গন্ধ শুঁকে থমকে দাঁড়ায় তোর অলকের সুবাস নিতে

পুরাতন মাহফুজার স্থলে আমরা নতুন মাহফুজাকে দেখতে পাচ্ছি। তার মানে মাহফুজারা চিরকালীন নয়। মাহফুজা আসে, মাহফুজা যায়। চিলেকোঠা, পাতাবাহার, পানলতিকা, বারান্দার গ্রিল, ঘরের অলিন্দ, হাস্নাহেনা ফুল, ফুলের টব ঘর-সংসারের ইত্যাকার নানাবিধ প্রসঙ্গ ঠিকই থেকে যাচ্ছে। কেবল থাকছে না মাহফুজা। তবে রেখে যাচ্ছে নব মাহফুজাকে। দেখা যাচ্ছে, নতুন মাহফুজা আসছে ঐ স্থলে। এবং বিষণ্ণচিত্তে স্মরণ করছে অগ্রজ মাহফুজাকে। এটি কি আমাদের যাপিত জীবনচিত্র নয়? অনুজ মাহফুজা কি অগ্রজ মাহফুজার উত্তরাধিকারী নয়? নয় কি জীবনের আবর্তন?

আমরাও কি মাহফুজা ছাড়া এক মুহূর্তেও শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারি? সমসাময়িককালে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে গেলেও রংবেরঙের আলোয় বসে ফুডমেনু হাতে করে আমাদের মাহফুজার দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয়। কি খাবে মাহফুজা। মাহফুজা অথবা মাহফুজার উত্তরসূরিরাই সিদ্ধান্তটা দেয়। কোরবানির পশু কিনতে গেলেও টেলিফোন করতে হয় মাহফুজাকে। গরু ছোট না বড় হবে, একটি না দুটি, কালো না সাদা, শিং ছোট না বড়- এরকম আরও কত কী। সবই মাহফুজার জন্যে। এমনকি ‘আমার ধ্বনি, আমার কবিতা, আর / আমার সন্তান, আমার সম্পদ তোমারই নামে’। ভেবে দেখলে তো তা-ই। মাহফুজা ছাড়া কি আমাদের সন্তান আসবে? আমরাই কি মাহফুজা ছাড়া আসতে পেরেছি? অথবা আমাদের পূর্বপুরুষ, পিতারা, পিতামহরা- এরাও কি মাহফুজা ছাড়া আসতে পেরেছেন? এজন্যই কি কবি বলেন-‘তুমিই তো সৃষ্টির প্রথম মাহফুজা’। এই গ্রন্থ কেবল কবিতাগ্রন্থ নয়। অনেক দর্শনচিন্তার সূত্রসন্ধান রয়েছে এখানে। আট মাহফুজারা কেমন আছে এই সমাজে? এই মারি আর মড়কের দেশে। আদিকাল থেকেই মাহফুজারা নির্যাতিত-নিপীড়িত-নিষ্পেষিত; উপেক্ষিত, অবহেলিত। বিত্তহীন-বেসাতহীন, ঘরহীন-বাড়িহীন, চালচুলাহীন মাহফুজাদের কেমন করে দিন কাটে। প্রান্তিক মাহফুজাদেরকে অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিজেদেরকে কাগজের নোটের কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে। মাহফুজাদের দুঃখগুলো কবিমনে আপন করে নেন। ‘মাহফুজামঙ্গল সাত’ সংখ্যক কবিতায় পাচ্ছি- ‘যখন বুকের পানপাত্র কেনে কাগজের নোট / তখন তোমাকে দেখি আমি নষ্টা যুবতীর বেশে / দারুণ আঘাতে আলগা হয় তোমার অরক্ষিত?ক্ষেত, হঠাৎ দেখে ফেলি ব্লাউজ পেটিকোটহীন / ভবিষ্যের অন্ধকারে ঢেকে আসে আমাদের দিন।’ অথচ মাহফুজাদের প্রতিভক্তি হিন্দু নারীর মত। আমরাই তো মাহফুজাদের দুঃখ দিয়েছি। এখনও দিচ্ছি। প্রায়শ্চিত্তের উপায় খুঁজছেন কবি। ‘আমার মত যদি শত কোটি মানুষের প্রণাম / তোমার পায়ে নেমে আসে তাহলে পেতে পারি ক্ষমা। ’মজিদ মাহমুদ মাহফুজাদের মঙ্গলই কামনা করেছেন। কাব্যের নামও রেখেছেন মাহফুজামঙ্গল। কবি মাহফুজাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে চান; দিতে চান তাদের প্রাপ্য সম্মান। তাদেরকে মর্যাদা ও ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত দেখতে চান। কবির বাসনা- ‘পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হোক তোমার শাসন।’ অর্থাৎ মাহফুজাদের শাসন। পরবর্তীকালে কাটাপড়া মানুষ (২০১৭) কাব্যে মজিদ মাহমুদকে মাহফুজাদের পক্ষে তীব্রভাবে সোচ্চার হতে দেখি। নয় রবীন্দ্র-গবেষক আহমেদ রফিক এই কবির হাতে মাহফুজামঙ্গল এরপর একটি ‘সমাজমঙ্গল’ প্রত্যাশা করেছেন। এই গ্রন্থের কবিতাগুলির নিবিড়পাঠে এটি বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এইগ্রন্থে কেবল মাহফুজার মঙ্গলকামনা করা হয়নি; একইসঙ্গে সমাজমঙ্গলও দারুণভাবে দৃশ্যমান। মাহফুজা তো এই সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং একটি বৃহৎ অংশ। দৃষ্টান্তরূপে ‘চারপাশ’ কবিতাটির কথা বলতে চাই। এ কবিতায় কবিকে নানারকমসামাজিক চিহ্নিত করতে দেখা যাচ্ছে। কেবল চিহ্নিতই করছেন না; মাহফুজার দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করছেন বারবার। ‘মাহফুজা তুমি দেখো তুমি দেখো’ অথবা ‘মাহফুজা তুমি একটু তাকিয়ে দেখো’- এই কাব্যভাষা মস্তিস্কের বুদ্ধিজাত নয়। দুঠোঁটের মাঝখানের বাকপ্রত্যঙ্গ থেকেও আসেনি; এসেছে কবিহৃদয়ের গভীরতর তলদেশ থেকে। কবি যে মাহফুজাপ্রেমে মজনু হয়ে ধ্যানমগ্ন আছেন, কেবল তা-ই নয়; পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ববোধের ক্ষেত্রে মজিদ মাহমুদের সচেতনতা সুতীব্র, সুগভীর। আপন মানুষের কাছেই তো বলা যায় সব কথা, সব আবেদন-নিবেদন। মজিদ মাহমুদও মাহফুজাকে দিয়েই শুরু করেছেন। পরবর্তীতে ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম, কাটাপড়া মানুষ, লঙ্কাবি যাত্রা, শুঁড়িখানার গানসহ বিভিন্ন কাব্যকবিতার ভেতর দিয়ে মজিদ মাহমুদএই প্রকৃতির কাব্যভাবনা আমজনতার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছেন। এবার দেখি কিছু কাব্যপঙক্তি- ‘মাহফুজা / তুমি একটু তাকিয়ে দেখো আমাদের চারপাশ ও খেলার মাঠগুলো’ অথবা ‘আমাদের চারপাশে কন্দনরত শিকলসমূহ /রাতে ফিরে না আসা সন্তানসমূহ / পথবালিকার আঁচল থেকে কেড়ে নেওয়া পয়সাসমূহ / লেকের পানি চাপা দেয়া মাটিসমূহ / জঠরের ভেতরে নিহত কথাসমূহ / ভিক্ষায় ব্যবহৃত প্যাথড্রিন শিশুর নেতিয়ে পড়া শরীরসমূহ’- এই কাব্যচরণগুলোতে দেখা যাচ্ছে, পথশিশু, পথবালিকা অর্থাৎ নিম্নবিত্তে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুঃখকষ্টগুলোকে আশ্রয় করে কাব্যকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। ‘রাতে ফিরে না আসা সন্তান’-এর স্বজনদের হাহাকার ধ্বনিত হচ্ছে। এদের দুঃখমোচনের মধ্য দিয়ে তো সমাজমঙ্গল-আরাধ্য লক্ষ করা যাচ্ছে। সমাজসচেনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক চিন্তাচেতনাও লক্ষণীয়। ‘মাহফুজা তুমি একটু তাকিয়ে দেখো আমাদের ঘরগুলো / বিশ্বায়নে বেচে দেয়া আমাদের কন্যাদের যৌবনগুলো / নেতাদের পকেটে হারিয়ে যাওয়া আমাদের দেশগুলো / ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসা সামরিক উর্দিগুলো / বাচার আকাক্সক্ষা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া প্রাণগুলো / আমাদের জীবনের হারিয়ে যাওয়া সারাৎসারগুলো / তুমি দেখো / তুমি দেখো।’

বোঝা যাচ্ছে, মাহফুজামঙ্গল বিহারীলালের সারদামঙ্গল অথবা সাধের আসন-এর মতো কেবল প্রেমবয়ানসম্বলিতব্যক্তিক হাহাকার নয়। মাহফুজামঙ্গল কেবল মাহফুজানামের একক নারীর মঙ্গলাকাক্সক্ষার নিমিত্তেও নয়। এখানে একক নারীমোড়কে সমগ্র নারীজাতির মঙ্গলাকাক্সক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। সমগ্র বাঙালির মঙ্গলাকাক্সক্ষা, সমগ্র বাংলার মঙ্গলাকাক্সক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। কি সামাজিক, কি পারিবারিক; কি রাজনৈতিক, কি অর্থনৈতিক- বাঙালির যাপিতজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতির আত্মীকরণের ভেতর দিয়ে বহুমাত্রিক সুর ও স্বরের সুসমন্বয়ে মাহফুজামঙ্গল বাংলা কাব্য-ইতিহাসেএক অনন্য কাব্যকীর্তির শিল্পস্বাক্ষর। দশ কেবল বিষয়সৌন্দর্য ও অঙ্গশৈলী নয়, মজিদ মাহমুদের কাব্যভাষাও নিজস্ব। ভাষা প্রসঙ্গে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের মন্তব্য-‘রচনার প্রধান গুণ এবং প্রথম প্রয়োজন, সরলতা এবং স্পষ্টতা।’ মজিদ মাহমুদের কবিতা পড়তে গেলে মনে হয় ভাষাশৈলি তার কবিতার মান্যসম্পদ। তার কবিতায় বিরামচিহ্নের ব্যবহার নেই বললেই চলে। এতে রস আস্বাদনে অসুবিধা হচ্ছে না। কিছুকিছু শব্দের নিজস্ব বানানরীতিও চোখে পড়ে। দুর্বোধ্য, ওজস্বী, তৎসম শব্দের প্রয়োগ কম। সহজ-সরল-প্রাঞ্জল ও বোধগম্য শব্দ দিয়ে গদ্যছন্দে তিনি কবিতাভাব তৈরি করেন। এক্ষেত্রে ঝুঁকিও থাকে। কিন্তু মজিদ মাহমুদ তো ভাষার যাদুকর। নিজস্বভাষিক যাদুকৌশলেতিনি সবসময় ঝুঁকিমুক্ত থাকেন এবং কিছু প্রচলতি সহজ-সরল শব্দ দিয়ে তিনি ক্রমান্বয়ে রহস্যের জাল বুনতে থাকেন। শব্দ বিবেচনাবোধ, বিষয় নির্বাচনে জীবনঘনিষ্ঠতা, সত্যান্বেষী-দার্শনিকবোধবুদ্ধির সঙ্গে উপস্থাপনা-স্টাইলের অভিনবত্বে মাহফুজামঙ্গল বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে এক অনাস্বাদিত-অভূতপূর্ব শিল্পকর্ম। জীবনযাত্রার হতাশা-ব্যর্থতা, জীর্ণতা, গ্লানি, প্রেম-প্রবঞ্চনা; সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা, নাগরিক যুগযন্ত্রণায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা সত্যিই কঠিন। এই সব নেতিবাচক পরিবেশ-প্রতিবেশের মধ্যে থেকেও এই গ্রন্থের কবিতাগুলোপাঠকে অনেকটাই আনন্দের মুখোমুখি করবে বলে বিশ্বাস করি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড