• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের কথা বলতেন ফররুখ আহমদ

  শব্দনীল

১৯ অক্টোবর ২০১৯, ১১:১০
ছবি
ছবি : মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ

বিংশ শতাব্দী থেকে যে কবি তার কবিতায় বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের কথা বলেছেন সেই কবিরই সন্তান অর্থের অভাবে মারা গেছে বিনা চিকিৎসায়। বাংলা সাহিত্যের প্রতিভাধর এই কবি সমাদৃত হয়ে আসছেন মৌলিক কবি হিসেবে। যার কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে বাঙ্গালি মুসলমানদের গৌরবগাঁথা ঐতিহ্য, ইসলামি সংস্কৃতি এবং মুসলমানদের পুনজাগরণের কথা। তিনি কখনোই বিশ্বাস করতেন না ‘কবিতা যে মানুষের উপকার বা অপকার কিছুই করতে পারে না।’ বলছি মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদের কথা।

যার কবিতায় মানুষের কল্যাণের কথা বলে আসছে তেমনি বলছে পীড়িত মানুষের হাহাকার, আর্তনাদ, অনাহারক্লিষ্ট মানুষের করুণ পরিণতি এমন কী সমকালের সঙ্কটের কথাও। বলা হয়ে থাকে, কবিতা সমকালীন দর্পণ। তা কবি ফররুখ আহমদের কবিতা দিকে তাকালে বোঝা যায়। কবির ‘লাশ’ কবিতার প্রতিটি স্তবকে ফুটে উঠেছে আত্যাচারিত মানুষের আর্তনাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুর্ভিক্ষপীড়িত ক্ষুধিত মানুষের কথা। তেমনি শাসকগোষ্ঠীর অমানবিকতা। যারা রক্তচুষে সমৃদ্ধ করেছে নিজেদের। তিনি ধিক্কারও দিয়েছেন তাদের।

‘জানি মানুষের লাশ মুখ গুঁজে পড়ে আছে ধরণীর ‘পর, ক্ষুধিত অসাড় তনু বত্রিশ নাড়ীর তাপে পড়ে আছে নিঁসাড় নিথর, পাশ দিয়ে চলে যায় সজ্জিত পিশাচ, নারী নর -পাথরের ঘর, মৃত্যু কারাগার, সজ্জিতা নিপুণা নটী বারাঙ্গনা খুলিয়াছে দ্বার মধুর ভাষণে, পৃথিবী চষিছে কারা শোষণে, শাসনে সাক্ষ্য তার রাজপথে জমিনের ‘পর সাড়ে তিন হাত হাড় রচিতেছে মানুষের অন্তিম কবর।’ লাশ/ সাগরের মাঝি (১৯৪৪)

ফররুখ আহমদ নিজের সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে পুঁজিপতিদের শাসন-শোষণে বিপক্ষে কথা বলেছেন। তিনি নিজের অনুভবের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছেন জড় সভ্যতার ভণ্ডামি। এবং বিশ্বশান্তি ও মানবিক ঔদার্যের জন্য স্ফীতমেদ শোষকশ্রেণির প্রতি তীব্র ঘৃণা, ধিক্কার জানিয়েছেন। কবি চেয়েছেন শাসন-শোষণের নিষ্ঠুর সভ্যতাকে ধ্বংস করে মানবিক সমাজ গড়তে। তাই তো তিনি ‘লাশ’ কবিতায় আবারও বলেছেন-

‘ত হানি

নিয়ে যাব জাহান্নাম দ্বারপ্রান্তে টানি

আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যু-দীর্ণ নিখিলের অভিশাপ বও

ধ্বংস হও, তুমি ধ্বংস হও।’

[লাশ/ সাত সাগরের মাঝি]

অন্যদিকে তিনি জানতে চেয়েছেন ‘পাঞ্জেরি’ কবিতার মাধ্যমে পুঁজিপতিদের শাসন-শোষণের হাত তেকে শান্তিপূর্ণ মানব সমাজ কবে পাবে মুক্তি, তারবা কতটা দেরি- ‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি? বন্দরে বসে যাত্রীরা দিন গোনে, বুঝি মৌসুমি হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে, বুঝি কুয়াশায়, জোছনা- মায়ায় জাহাজের পাল দেখে।’

ফররুখ আহমদ কখনো নিজের আদর্শের জন্য কবিতার সাথে করেননি আপোষ। ভাসেননি বিশ্বাস আর আবেগে ডোবা কবিতায়। কখনো করেননি খাঁটি কবিতার সীমা লঙ্ঘন। এই জন্য কবি আবুল ফজল বলেছেন, ‘একটা সুনির্দিষ্ট মতাদর্শে প্রবল বিশ্বাসী থেকেও ফররুখ আহমদ বিশুদ্ধ কবি ছিলেন। এ কারণে আপন লক্ষ্যে সনিষ্ঠ থেকেও কবিতার নানা গ্রোথে বিচরণ তার পক্ষে সহজ হয়েছে। আদর্শনিষ্ঠ কবিতা সাধারণত একচোখা তথা একাগ্রতা হয়ে থাকে। সুখের বিষয়, ফররুখ আহমদের বেলায় তা হয়নি। রচনার একাগ্রতায়, আঙ্গিক আর ভাবের বৈচিত্র্যে নতুন আমদানি করা শব্দ সম্ভারে এ কবি নিশ্চিতভাবে আমাদের সাহিত্যের সম্পদ বাড়িয়ে দিয়েছে।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘তার সমসাময়িক কবিকুলের মধ্যে তিনি এতখানি বিশিষ্ট, স্বতন্ত্র ও একক ছিলেন যে তাকে সহজে কাতারবন্দি করা যায় না। তাই তার তিরোধানে এমন এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে যার জন্যে আমরা বিপরীতমনারাও বেদনাবোধ না করে পারি না।’

সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, ‘ফররুখের কাব্য প্রক্রিয়ায় যেহেতু একটা বিশ্বাসের উন্মুখরতা ছিল, তাই তার পাঠকের সংখ্যা আমাদের মাঝে সর্বাধিক। বিশ্বাসের সে একটা কল্লোলিত সমর্থন পেয়েছে। আবার ব্যবহৃত শব্দের পরিধির সার্থক বিবেচনায় এবং ধ্বনি সাম্যের কারণে অবিশ্বাসীরাও তাকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি। তার কবিতায় উপমা চিত্রকল্প ছিল অসাধারণ।’

ফররুখ আহমদের কবিতায় শুধু মানবতার কথা বলেননি বলেছে নর-নারীর অবিনশ্বর প্রেমের কথাও। বলেছেন হৃদয় ঘটিত বেদনারও কথা। ‘বিদায়’ কবিতায় তিনি স্বপ্নঘোরে খুঁজেছেন প্রেয়সীকে। ছুঁয়েছেন কেশরাশি। শঙ্কিত হয়েছে হারানর ভয়ে। তিনি বলেন,

‘শুনেছিলাম স্বপ্নঘোরে তোমার নাম,

ছুঁয়েছিলাম কেশরাশি, অলকদাম,

হাজার রাতের কথায় তোমার জেগেছে ভয়;

তোমায় হারাই চিত্ত আমার শঙ্কাময়,’

ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরা জেলার শ্রীপুরের মাঝাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবির অধিকাংশ লেখাতেই ফুটে উঠেছে মুসলিম জাগরণের কথা। এই জন্য তাকে সহ্য করতে হয়েছে অনেক লাঞ্ছনা। হয়েছেন প্রতিটি পদে অবহেলিত- অনাদৃত, কাটিয়েছেন অভাব-অনাটনে দিন তবুও ছিলেন অকুতোভয় এক কলম সৈনিক। বাংলা সাহিত্যে অসাধারণ সব লেখনীর জন্য তিনি জীবদ্দশায় পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, প্রেসিডেন্ট পদক ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ এবং আদমজী পুরস্কার ও ইউনেস্কো পুরস্কার। তিনি মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। তিনি ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর পরলোক গমন করেন।

আজ এই মহান কবির প্রয়াণ দিবস। দৈনিক অধিকারের পক্ষ থেকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড