সাহিত্য ডেস্ক
নিশো আল মামুন একজন প্রতিভাধর লেখক। এরই মধ্যে নিজের নামকে পৌঁছে দিয়েছেন সাধারণ পাঠকের কাছে। ২০১২ সালে ‘অমিমাংসীম সমাপ্তি’ উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে তার সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ। লিখেছেন উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক, কবিতা, ও শিশুতোষ গল্প। ২০১৯ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রকাশ হয়েছে উপন্যাস ‘সুখের গহিনে শোক’। এ উপন্যাসটি পাঠকের মাঝে স্থান দখল করে নিয়েছে দারুণ ভাবে। তিনি ১৯৮৬ সালের ১ জুলাই জামালপুরের বকশীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন।
লেখালেখির সামগ্রিকতা নিয়ে নিশো আল মামুন মুখোমুখি হয়েছেন দৈনিক অধিকার’-এর।
দৈনিক অধিকার : আপনার লেখালেখির শুরু কখন এবং কিভাবে?
নিশো আল মামুন : হঠাৎ করেই তো আর কোন কিছু হয় না। লেখা-লেখিটা কিভাবে শুরু হয়েছে এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলতে পারব না। ছোট বেলা থেকেই প্রচুর বই পড়তাম। বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লিখতাম। কলেজে পড়ার সময় গ্রুপ থিয়েটারেও কাজ করেছি। যখন লন্ডনে পড়তে গেলাম তখন যে জায়গাটাতে ছিলাম সেটি ছিল খুব শান্ত নির্জন লোক শূন্য জায়গা। বসন্তের দিনগুলোতে সমস্ত এলাকা অপরূপ ভাবে সেজে উঠত। কোন কোন দুপুর বেলায় চারদিক তাকালেই মন হুহু করে উঠত। দাউদ হায়দারের একটা কবিতা খুব শুনতাম, আমার অসম্ভব একটি প্রিয় কবিতা- ‘আমার ও অরুণার প্রেম ছিল, সেই কথা বলা হল না। বসন্ত দিনে আমাদের দেখা হয়নি, বসন্ত দিনে আমাদের বিচ্ছেদ হলো।’
এক ধরনের শূন্যতায় ভুগতাম, মনে কি যেন নাড়িয়ে যেত। ঐ মনের নাড়া দেওয়ার ব্যাপারটা থেকেই লিখতে শুরু করি। সে সময় প্রায় অনেক গুলো কবিতা লিখেছিলাম। পাণ্ডুলিপির নাম রাখলাম হলদে শালিকের বারান্দা, পাণ্ডুলিপিটা ইস্টেপেনিগ্রিনে হারিয়ে গেল। খুব দুঃখ পেলাম। এরপর লিখলাম উপন্যাস অমীমাংসিত সমাপ্তি। এ ভাবেই সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ।
দৈনিক অধিকার : আপনার পরিবারের মধ্যে কেউ কী লিখতেন? যার থেকে অনুপ্রেরণা বা প্রভাব আপনার মধ্যে পড়েছে?
নিশো আল মামুন : আমার পরিবারের মধ্যে কেউ লেখা-লেখি করতেন না, এবং কী আমার চারপাশেও আমি কাউকে লিখতে দেখিনি। আমার যখন দুই তিনটা উপন্যাস প্রকাশ হলো এরকম প্রশ্ন আমার মধ্যেও হয়েছিল। আমার পূর্ব পুরুষদের মধ্যে কেউ কী লিখতেন? কাউকে খুজে পাইনি। তবে আমার দাদা একটু অন্যরকম পুরুষ ছিলেন। খুব ভাল বাঁশি বাজাতে পারতেন। একটা রূপার বাঁশি ছিল তার। এক দুপুর বেলায় গাছের ছায়ায় বসে বাঁশিতে সুর তুললেন। পাশেই ভারতের তুর পাহাড়। বাঁশির সুর শুনে এক রূপবতী ব্যকুল হয়ে ছুটে এসেছিলেন। দাদী প্রচণ্ড অভিমান করে তার বাপের বাড়ি চলে গেলেন। পরদিন দাদা দাদির কাছে যেয়ে উপস্থিত। বললেন, শাহারা তুমি অযথা রাগ করছ। আমি যে বাঁশি বাজানো বিদ্যায় একটুও ফাঁকি দেইনি, তার প্রমাণ কালকের ঐ ঘটনা। দাদা এক জায়গার বেশি দিন থাকতেন না। মনে হয় দাদার কিছুটা অংশ আমার মধ্যে প্রভাব ফেলেছে।
তাছাড়া পরিবারের মধ্যে কেউ লেখা লেখি করলেই যে লেখক হওয়া যাবে বিষয়টি তেমন নয়। তা হলে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পরে সবচেয়ে বড় লেখক হতেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
দৈনিক অধিকার : যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন বা বিখ্যাত হয়েছেন তাদের শুরুতে একটা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। আপনার পরিবার লেখক হওয়াটাকে কিভাবে নিচ্ছেন?
নিশো আল মামুন : লয়ার মিডেল ক্লাস থেকে হায়ার মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশা হলো সন্তান ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। আমিও মিডেল মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির সন্তান। আমার পরিবারের ক্ষেত্রেও চাওয়া পাওয়াটা আর দশটা সাধারণ পরিবারের মতই। সাধারণ পরিবারের একজন সন্তান এক্সেপসনাল কিছু একটা করতে গেলে প্রতিকূলতা তো অবশ্যই আছে। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল মানিক বন্দ্যেপাধ্যায় সাহিত্য চর্চায় মননিবেশের ফলে একাডেমিক পড়াশুনার ব্যাপক ক্ষতি হয়। এক সময় ডাক্তার ভাই পড়াশোনার খরচ দেওয়া বন্ধ করেন। তবে মা নীরাদাসুন্দরী মানিক বন্দ্যেপাধ্যায়কে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। মানুষ মাত্র স্বপ্নচারী আর স্বপ্নচারী মানুষগুলোয় বিশ্বকে এগিয়ে নিয়েছে। আমার পরিবার আমার কাজ বা মতাদর্শনকে সব সময় শুভকামনা করেন।
দৈনিক অধিকার : ‘ভোরের ঝরা ফুল’ উপন্যাসে সবটুকু মমতা ঢেলে দিয়ে অন্বেষা চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন। তাছাড়া উপন্যাস কাছে দূরে, শেষ ম্পর্শ অবিশ্বাস্য সুন্দর সব সৃষ্টি আপনার, এই যে উপন্যাস বা গল্প লিখার আইডিয়া বা ম্যাসেজটা কিভাবে পান? মানে কিভাবে গল্পটা মাথায় তৈরি হয়?
নিশো আল মামুন : একটা গল্প মাথায় কিভাবে তৈরি হয় তা আমি অস্পষ্ট ভাবে বলতে পারব আমার মনে হয় এটা সম্পূর্ণ রহস্যের মত। আইডিয়াটা আসে হায়ার ইন্টেলিজেন্স থেকে। যেখানে আদি থেকে অনন্ত পর্যন্ত সকল তথ্য ও জ্ঞান সংরক্ষিত রয়েছে। আমার একটা গল্প বলি। একবার খুব ভোরবেলায় টেবিলে লেখার জন্য বসে আছি। কিন্ত কোন লেখায় আসছে না। অনেকক্ষণ ঝিম ধরে বসে আছি হঠাৎ অদ্ভুত এক ব্যাপার ঘটল। দেখি বিশাল এক সোনালী মাঠ। মাঝখানে একটা প্রাচীন বৃক্ষ। এরকম বৃক্ষ আমি এ জীবনে দেখিনি পাতার রঙ গুলোও এই সাত রঙের বাইরে। বৃক্ষের নীচে একজন হাজার বছর বয়সের বৃদ্ধ বসে আছেন। চুল দাড়ি গুলো হালকা সোনালী। যেন এই দৃশ্যটা কয়েক সেকেন্ড ধরে আমি স্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম। আমার নিজের জীবনে নানা ঘটনা বিভিন্ন সময় আমাকে ভাবিয়েছে। এই ঘটনার দুই একটা ব্যাখ্যাও আমি দার করিয়েছি। প্রথমত, একটা রহস্যের মত যা বিজ্ঞানের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটা বলি, আমার সাবকনসাস লেবেল এই কাজটা করিয়েছে। যেন এই ব্যাপারটি থেকে একটা ভালো উপন্যাস, গল্প লেখি। আসলে জ্ঞানের পরিধি অনেক অনেক বড় যা মানুষের ক্ষুদ্র জ্ঞানে অনেক কিছুই জানা সম্ভব নয় । আমরা এখনো খুব অল্প বিষয়ই জানতে পেরেছি।
দৈনিক অধিকার : নতুন কি লিখছেন?
নিশো আল মামুন : একটা উপন্যাস শেষ করেছি দুইদিন হল। এখন লেখছি গল্প । স্মৃতিচারণ লেখা। ইচ্ছে আছে দশ এগারোটা গল্প নিয়ে একটা বই করব।
দৈনিক অধিকার : একজন ভালো লেখক হওয়ার জন্য কী কী গুরুত্বপূর্ণ?
নিশো আল মামুন : অনেক কিছুই গুরুত্বপূর্ণ। হঠাৎ করেই কিছু বলা সম্ভব নয়, কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে আর অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে। জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। এই দুটো বিষয় খুব জরুরী। পশু পাখির ভাষা বুঝার জ্ঞান আমাদের থাকলে ভালো হত। সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। লেখা নির্ভর করে একটা সময়ের উপর। উদাহারণ দিই, রামায়ণ এবং ইলিয়ড ও ওডিসি প্রায় একই সময় রচনা। হোমার সুদূর গ্রীসে আর বাল্মিকি ভারতে অনেক দূরত্ব দুটি দুই ভাষায় মজার বিষয় হলো অলংকার শব্দচয়ন এবং ঘটনার বর্ণনা ও চরিত্র দু’রকম হলেও হোমার এবং বাল্মিকির মূল ঘটনাটি কিন্ত একই রকমের। এখানে সীতাকে নিয়ে গিয়েছিল রাবণ ওখানে হেলনকে নিয়ে গিয়েছিল মেনালাস এখানেও দশ বছর পর সীতা মুক্ত হয়েছিল। ঐ খানেও দশ বছর পর গ্রীকরা ট্রয় দখল করে হেলেন কে উদ্ধার করেছিল। এখানে রাম লক্ষণ সহায়তা নিয়েছিলেন এক প্রাণীর যার নাম হনুমান। ওখানেও গ্রীক বাহিনী একটি কাঠের প্রাণীর সহায়তা নিয়েছিলেন সেটি ঘোড়া। যুদ্ধে যাবার আগে রামায়ণ মেঘনাদ আর ট্রয়ের হেক্টরের বক্তব্য একই রকম । কী ভাবে এমন মিল সম্ভব হলো? এই কারণই এখানে সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ । আইডিয়াটা টিউন হয়েছিল ঠিক ঐ সময়টাতেই।
দৈনিক অধিকার : আপনার গভীরতম ভাবনা বা দর্শন কী?
নিশো আল মামুন : জীবনের কঠিনতম মুহূর্ত তৈরি না হলে গভীরতম ভাবনা বা দর্শন বলে কিছু থাকে না। আমার এই রকম কঠিন মুহূর্ত তৈরি হয়নি।
দৈনিক অধিকার : তবুও?
নিশো আল মামুন : আমার গভীরতম ভাবনা হলো সময়কে মেপে চলা। আজ থাক কাল করব আমাদের একদম করার কোন সুযোগ নেই। প্রত্যেকটা শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে সাথে আমরা সবাই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তাই মনের গভীর থেকে যে কাজ গুলো করতে মন চায় সেই কাজ গুলো সম্পূর্ণ করা। কে কী বলল বা ভাবল তা দেখার বা শোনার প্রয়োজন নেই। সব সময় নিজের সাথে নিজের প্রতিযোগিতা করা।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড