• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আমার চোখে মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয় (পর্ব- ১২)

হিমেল একজন “ইন্টারেস্টিং” মানুষ

  অধিকার ডেস্ক    ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৯:৪৩

উপন্যাস প্রকাশন
ছবি : সম্পাদিত

একজন ব্যতিক্রমী মননের মানুষ মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়। ব্যতিক্রমী তার লেখার ধারা। কেউ কেউ মনে করে তিনি বিচিত্র রঙের গল্পকার। কারও কাছে সুচিন্তিত সমালোচক, আবার কারও কাছে সূক্ষ্ম বিশ্লেষক। অনেকের কাছে অবশ্য তিনি বর্তমান সময়ের সেরা ক্রিকেট বোদ্ধা হিসেবে পরিচিত।

সম্প্রতি তিনি পাঠক মহলে বেশ কৌতূহল সৃষ্টি করেছেন ‘নামহীন দামহীন’ শীর্ষক বিশ্ব ব্যতিক্রমী এক আত্মজীবনীর মাধ্যমে। আসলে কেমন মানুষ হিমালয়? কাছের মানুষদের চোখে তার ব্যক্তিত্ব কেমন? ব্যতিক্রমী চিন্তার এই মানুষটিকে নিয়ে লিখেছেন তার সঙ্গে কিংবা আশেপাশে থাকা কিছু নিকটবর্তী মানুষ। তাদের বলা কথাগুলো নিয়েই ‘উপন্যাস প্রকাশন’ এর উদ্যোগে ‘দৈনিক অধিকার’ এর ধারাবাহিক আয়োজন, ‘আমার চোখে মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়'।

আজ প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিক এ আয়জনের ১২তম পর্ব। এ পর্বে লেখক হিমালয়কে নিয়ে লিখেছেন- প্রকৌশলী আরিফুল হোসেন তুহিন

বুয়েটে শেরেবাংলা হলের ১০০৯ রুমে তখন আমার মোটামুটি অগুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্ব নিয়ে সময় কাটিয়েছিলাম। হালকা-পাতলা ইন্টারনেটে লেখালিখি করে আর মূল্যহীন বিষয়সমূহকে প্রচণ্ড মূল্যবান বানিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করেই দিন কাটত। এইসব তর্কাতর্কির নিয়মিত সঙ্গী বন্ধু রাজী একদিন জানালো এই শেরে এ বাংলা হলেই নাকি একজন কামেল লেখক বাস করেন। যিনি প্রচুর চা খেয়ে থাকেন বলেও বন্ধু উল্লেখ করল।

সুতরাং চা এবং লেখা, উভয়েই সিদ্ধহস্ত এই কামেল বান্দাকে দেখার জন্যে আমি একদিন উদ্যোগ নিলাম। তার প্রোফাইলেও দুই হাতে দুই চায়ের কাপের ছবি। এইরকম ইন্টারেস্টিং মানুষকে না দেখার প্রশ্নই উঠে না। সুতরাং এক শুভ দিনে তার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। পরিচিত হবার পরে প্রথম যেই বিষয়টি আমার চোখে পড়ল, সেটি হলো তার কথাবার্তার সুনির্দিষ্ট নিচু টোন। বক্তব্যের বিষয়ানুসারে তাল/লয় ইত্যাদির পরিবর্তন হলেও তার টোন সবসময় কিছুটা নিচু।

বন্ধু রাজী তার নাম বলেছিল হিমেল। যদিও ওর বই, ইন্টারেনট প্রোফাইল সবখানেই ওর নাম লেখা হিমালয়, আমি প্রথম “হিমেল” এর বেড়াজাল থেকে কখনও বেরোতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে ওর অনেক ভক্ত শিষ্য জুটেছে, একধরনের জনপ্রিয়তাও সেই সাথে এসেছে। হয়ত আমি এইসবের আগেই ওকে চিনতাম দেখে পুরোনো নামটা ছেড়ে উঠতে পারি নাই। আমি ঠিক নিশ্চিত না। অথবা বিখ্যাত মানুষকে অন্য অনেকের আগে চেনার দাবীর মাধ্যমে সাধারণত মানুষজন তার নিজের প্রাসঙ্গিকতা বাড়ানোর চেষ্টা করে। তাকে হিমেল ডেকে হয়ত সেই চেষ্টা আমিই করে যাচ্ছি। তবে আমার ব্যক্তিগত হাইপোথিসিস হচ্ছে এইটার বিরুদ্ধে।

হিমালয়

বাঁয়ে মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়, ডানে আরিফুল হোসেন তুহিন

হিমেল কেন বিখ্যাত এর কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। হিমেল সম্পর্কে আমার ধারণার আকৃতি, প্রকৃতি অনেক পরিবর্তন হলেও, মূল শেইপটা একই আছে। বন্ধু রাজীর মুখে বর্ননা শুনে প্রায় দশ বছর আগে যাকে মনে হয়েছিল “ইন্টারেস্টিং” মানুষ, এই দশ বছর পরেও ফাণ্ডামেন্টালি হিমেল সম্পর্কে আমার জাজমেন্ট মূলত একই, হিমেল একজন “ইন্টারেস্টিং” মানুষ।

আগের পর্ব পড়তে : হিমালয় একটু অভিমানী, মানুষ হিসেবে একটু ঠোঁটকাটা

এইখানে এর চেয়ে বেশী বিশেষণ ব্যবহার করার আগে প্রথমেই আমি বলে নিতে চাই আমার চোখে হিমেল আসলে কী করার চেষ্টা করছে। সত্যি কথা বলতে কী, এই ব্যাপারটা যথেষ্ঠ ঘোরালো। আর্থারকোনান ডয়েলের শার্লক হোমসের প্রথম উপন্যাস, এ স্টাডি ইন স্কারলেট এ, ড ওয়াটসনও একই ধরনের ধাঁধায় পরেছিল।

শার্লক হোমসের জ্ঞানের সীমা শীর্ষক একটি তালিকা করেছিল, যেখানে তার জ্ঞান এবং জ্ঞানের অভাব দুইই ছিল; যেমন রসায়নে প্রগাঢ় জ্ঞান এবং অন্যদিকে পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘোরে সেটি হোমস জানত না। ড ওয়াটসন শেষে সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি শার্লক হোমস আসলে কি করতে চাচ্ছে।

হিমেলের ব্যাপারটাও আমার কাছে একই মনে হয় সময় সময়। আমি ওর দুইটি গল্প গ্রন্থ, প্রযত্নে হন্থা, বীক্ষণ প্রান্ত, নামহীন দামহীন বইটির মোটামুটি অর্ধেকটা, অনেকগুলো ব্লগ, কিছু ফেসবুক পোস্ট পড়েছি, ওর সাথে প্রচুর মুখোমুখি আড্ডা হয়েছে। এই সবকিছু মিলিয়ে আমি মূলত জানি না হিমেল আসলে কী করতে চাচ্ছে।

তবে হিমেলের আল্টিমেইট উদ্দেশ্য না বুঝলেও, তার কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। হিমেল মূলত তার চারপাশের সমাজ এবং তার মাঝে চলতে থাকা প্রসেসগুলোকে বুঝতে চাচ্ছে। তবে এই বোঝার ক্ষেত্রে সে মূলত নিজের তৈরী তত্বে জোর দিচ্ছে। বিশুদ্ধ চিন্তার মাধ্যমে জ্ঞান তৈরীর এই প্রচেষ্টা ইতিহাসে নতুন নয়। গ্রীক দার্শনিকরা এই পদ্ধতিকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিতেন।

এমন কিইউরোপিয়ান এনলাইটেনমেন্ট এর যুগে প্রচুর লেখক এই পদ্ধতি ব্যবহার করেই মূলত রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি এথিক্স ইত্যাদি জটিল বিষয় সম্পর্কে প্রচুর লিখেছেন। জন লক, টমাস হবস, বেন্থাম,ডেভিড হিউম, এডমুণ্ড বার্ক, জন স্টুয়ার্ট মিল, ম্যালথাস এরা সবাই এই পদ্ধতি কম বেশী ব্যবহার করেছেন। হয়ত কিছুটা এম্পিরিসিজমের নির্যাস মিলিয়ে।

যেহেতু জ্ঞানের অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি আর অনুসরন করা হয় না, এই কারণেই এই পদ্ধতি অনুসরন করে তৈরী জ্ঞানের একটি সুন্দর ইংরেজি নাম আছে, পলেমিক (Polemic)। আমরা যখন ডিবেইট করি কোনো বিষয়ে, আমরা চেষ্টা করি প্রতিপক্ষকে আমাদের অবস্থানটিতে কনভিন্স করতে। তখন আমরা প্রচুর “রেটরিকাল টুলস” ব্যবহার করি যা অনেক সময়ে এই ধরনের পলেমিকস। এই পদ্ধতিতে যা তৈরী হয় তাকে সহজভাবে ইনফর্মড অপিনিয়ন (informed opinion) বলা যায়।

জ্ঞান বলা যায় কিনা, সেটি নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। জ্ঞানের দর্শনে বিস্তর বিতর্ক আছে, কীভাবে জ্ঞান তৈরী হয় সেটি নিয়ে।

হিমেলের প্রতি আমার প্রধান ক্রিটিসিজম মূলত তার মেথড নিয়ে। আমার কাছে মনে হয় জ্ঞান উৎপন্নের জন্যে যে মেথড হিমেল বেছে নিয়েছে, তার ভ্যালিডিটি নিয়ে নৈর্বত্তিকভাবে বিচার বিবেচনা করা কঠিন হবে। যদিও হিমেল অনেক ডাটার কথা বলে, কিন্তু আমার পর্যবেক্ষণে ওর ডাটা কালেকশনের উপায়গুলো সমস্যাযুক্ত। সেগুলো মূলত কনফার্মেশন বায়াস (Confirmation Bias) দ্বারা আক্রান্ত সম্ভাবনাই বেশী। সিস্টেমেটিক কোন এপ্রোচ ওর না থাকায়, বিভিন্ন ডাটা থেকে হিমেল যেসকল সিদ্ধান্তে আসে, সেগুলো ভালো ধরনের স্ক্রুটিনির বিপরীতে টিকে থাকার সম্ভাবনা কম। সবচেয়ে বড় বিষয় হল, হিমেলের লেখালিখিতে আমি একধরনের Sweeping Generalization এর অস্তিত্ব খুজে পাই, যা যেকোনো বৈজ্ঞানিক স্ক্রুটিনির দ্বারা ভুল প্রমানের বড় সম্ভাবনা আছে।

আঠারো/উনিশ শতকের মত করে আমরা এখন আর জ্ঞান উৎপাদন করি না মূলত একটি নির্দিষ্ট কারণে। আমরা মূলত আমাদের ইন্টুইশনকে আগের মতো আর বিশ্বাস করি না। গত ৪০০ বছরের জ্ঞানের ইতিহাসকে যদি একবাক্যে লেখা যায়, সেটি হবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের কমন সেন্স আমাদের যা শেখায়, তা আদপে ভুল। অধিকাংশ বিষয় সম্পর্কে আমাদের পার্সেপশন ভুল থাকে। এমনকি আমাদের স্মৃতি পর্যন্ত রেট্রোস্পেকটিভলি পরিবর্তিত হয়ে যায়।

এইরকম ব্যাপক আনরিলিয়াবিলিটি এর মুখোমুখি হবার কারণে আমরা মূলত নিজেদের বিশ্বাস করা ছেড়ে দেয়েছি। জ্ঞানের চর্চা তাই অনেক বেশি সিস্টেমেটিক এবং প্রমাণ সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে।

এতকিছুর বিপরীতে এটি খুবই সহজ স্বাধীনভাবে চিন্তার সাহস হারিয়ে ফেলা। সেই ক্ষেত্রে হিমেলের স্বাধীন চিন্তার সাহসের প্রশংসা করতে হয়। তবে অবশ্যই যথাযথ স্কেপটিসিজমের সাথে।

এতক্ষণ হিমেলের জ্ঞান উৎপাদনের প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বললেও, জ্ঞান বিতরণের পদ্ধতি নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করছি। আমার পর্যবেক্ষণে এই ব্যাপারটাতেই হিমেলের সবচেয়ে বেশী ইনোভেশন রয়েছে। হিমেলের মোটামুটি বেশ বড় একটি ভক্ত/শিষ্য ইত্যাদি তৈরী হয়েছে। সক্রেটিস এথেন্সের রাস্তায় হেটে লোকের সাথে ঝগড়া বিবাদ করতেন তাদেরকে ভূল প্রমান করার জন্যে। সেটি ছিল সক্রেটিসের জ্ঞান বিতরণের উপায়।

সক্রেটিস শেখাতেন মূলত স্কেপটিসিজম। নিজের লালিত বিশ্বাসগুলোকে প্রশ্ন করার উপযুক্ত টুলস তিনি দিয়ে গেছেন তার শিষ্যদের। কিন্তু তিনি “কাল্ট” গঠন করেন নাই, পিথাগোরিয়ান অথবা সোফিস্টদের মতো। এর মূল কারণ সক্রেটিস মনে করতেন, সবাইকে চিন্তা করতে শেখানো বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শেখাতেন মেথড পদ্ধতি। সেই পদ্ধতি দিয়ে কে কি চিন্তা করবে সেটির বিষয়ে তার আগ্রহ তুলনামূলক কম ছিল। হিমেলের বক্তব্য কখনই পদ্ধতি নিয়ে নয়।

বরং নিজের পদ্ধতিকে কিছুটা ঢেকে রাখাই ওর অভ্যাস। সেই কারণে অনেক চিন্তাই শেষ পর্যন্ত “সিদ্ধান্ত” হিসেবে প্রকাশিত হয়। ভক্ত/শিষ্যদের উপর এত সিদ্ধান্ত নাজিল হওয়ার ঘটনা অন্তত আমার চোখে কিছুটা হলেও বিপদের কারণ হতে পারে। আমার চিন্তার বিষয় হচ্ছে, ভক্ত শিষ্যরা হিমেলের এই বিপুল সিদ্ধান্তের বোঝা কতটুকু ক্রিটিক্যালভাবে দেখতে পারছে। বিশেষত হিমেলের ব্যক্তিজীবনেও এই ভক্তশিষ্যদের উপস্থিতি অন্তত জ্ঞানতৈরীর মানুষের জন্যে নিরাপদ নয়। এর মাধ্যমেই তৈরী হয় “বাবল”। ইকো চেম্বার।

আরেকটি সম্ভাবনা হচ্ছে হিমেল আসলে জ্ঞান তৈরি করতে চাচ্ছে না। তবে যেহেতু কী চাচ্ছে তার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া কঠিন, সেহেতু অন্তত provisionally হলেও এই অনুমান আমাকে করে নিতে হচ্ছে। আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গিতে হিমেল যা করছে তা এক ধরণের “উদ্যোগ”।

সেক্ষেত্রে আমার মতো গভীর সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষের পক্ষে তার বিচারবিবেচনা করা কঠিন। অবশ্য এই দৃষ্টিভঙ্গিতে তার ভক্ত/শিষ্যের ব্যাপারগুলোর একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যেকোন উদ্যোগ আসলে শেষ পর্যন্ত কালেকটিভ অ্যাকশন এর বাস্তবায়ন। সুতরাং “সম্পর্ক” জরুরী বিষয় এই ক্ষেত্রে। শেষ পর্যন্ত হিমেল আমার কাছে “ইন্টারেস্টিং” মানুষ। স্বাধীন চিন্তার সাহসের অভাবযুক্ত এই স্থবির দেশে হিমেল সাহসের সাথে ভিন্ন চিন্তা করছে, এই ব্যাপারটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমি যেহেতু এখনও নিশ্চিত নই হিমেল কি করতে চায়, সেহেতু আমি আগ্রহের সাথেই অপেক্ষা করব হিমেলের ভবিষ্যত কর্মকাণ্ডের দিকে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড