• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

কবি আল মাহমুদের বিখ্যাত পাঁচটি কবিতা

  সাহিত্য ডেস্ক

১১ জুলাই ২০১৯, ০৯:৩৮
কবিতা
ছবি : বাংলা সাহিত্যের গীতিকবি আল মাহমুদ

সোনালি কাবিন-০১

সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু'টি, আত্নবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি আহত বিক্ষত করে চারিদিকে চতুর ভুক্‌রুটি; ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন, ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি; দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন? আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলংকার কিনি। বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না; তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা পরাজিত নয় নারী, পরাজিত হয় না কবিরা; দারুন আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।

সোনালি কাবিন-০২

হাত বেয়ে উঠে এসো হে পানোখী, পাটিতে আমার এবার গোটাও ফণা কালো লেখা লিখো না হৃদয়ে; প্র‍বল ছোবলে তুমি যতটুকু ঢালো অন্ধকার তার চেয়েও নীল আমি অহরহ দংশনের ভয়ে। এ কোন্ কলার ছলে ধরে আছো নীলাম্বর শাড়ি দরবিগলিত হয়ে ছলকে যায় রাত্র‍ির বরণ, মনে হয় ডাক দিলে সে -তিমিরে ঝাপ দিতে পারি আচল বিছিয়ে যদি তুলে নাও আমার মরণ। বুকের ওপরে মৃদু কম্পমান নখবিলেখনে লিখতে কি দেবে নাম অনুজ্জ্বল উপাধিবিহীন? শরমিন্দা হলে তুমি ক্ষান্তিহীন সজল চুম্বনে মুছে দেবো অদ্যাক্ষর রক্তবর্ণ অনার্য প্র‍চীন। বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত করো কলাবতী জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী।

নোলক আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে। নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে? -হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে। বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে। জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক সবুজ বনের হরিণ টিয়ে করে রে ঝিকমিক। বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই, আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই। কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ। সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি নাতো! ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ। এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।

জেলগেটে দেখা সেলের তালা খোলা মাত্রই এক টুকরো রোদ এসে পড়লো ঘরের মধ্যে আজ তুমি আসবে। সারা ঘরে আনন্দের শিহরণ খেলছে। যদিও উত্তরের বাতাস হাড়েঁ কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে বইছে, তবু আমি ঠান্ডা পানিতে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। পাহারাদার সেন্ট্রিকে ডেকে বললাম, আজ তুমি আসবে। সেন্ট্রি হাসতে হাসতে আমার সিগ্রেটে আগুন ধরিয়ে দিল। বলল, বারান্দায় হেটেঁ ভুক বাড়িয়ে নিন দেখবেন, বাড়ী থেকে মজাদার খাবার আসবে। দেখো, সবাই প্রথমে খাবারের কথা ভাবে। আমি জানি বাইরে এখন আকাল চলছে। ক্ষুধার্ত মানুষ হন্যে হয়ে শহরের দিকে ছুটে আসছে। সংবাদপত্রগুলোও না বলে পারছে না যে এ অকল্পনীয়। রাস্তায় রাস্তায় অনাহারী শিশুদের মৃতদেহের ছবি দেখে আমি কতদিন আমার কারাকক্ষের লোহার জালি চেপে ধরেছি। হায় স্বাধীনতা, অভুক্তদের রাজত্ব কায়েম করতেই কি আমরা সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলাম। আর আমাকে ওরা রেখেছে বন্দুক আর বিচারালয়ের মাঝামাঝি যেখানে মানুষের আত্মা শুকিয়ে যায়। যাতে আমি আমরা উৎস খুঁজে না পাই। কিন্তু তুমি তো জানো কবিদের উৎস কি? আমি পাষাণ কারার চৌহদ্দিতে আমার ফোয়ারাকে ফিরিয়ে আনি। শত দুর্দৈবের মধ্যেও আমরা যেমন আমাদের উৎসকে জাগিয়ে রাখতাম। চড়ুই পাখির চিৎকারে বন্দীদের ঘুম ভাঙছে। আমি বারান্দা ছেড়ে বাগানে নামলাম। এক চিলতে বাগান ভেজা পাতার পানিতে আমার চটি আর পাজামা ভিজিয়ে চন্দ্রমল্লিকার ঝোপ থেকে একগোছা শাদা আর হলুদ ফুল তুললাম। বাতাসে মাথা নাড়িয়ে লাল ডালিয়া গাছ আমাকে ডাকলো। তারপর গেলাম গোলাপের কাছে। জেলখানার গোলাপ, তবু কি সুন্দর গন্ধ! আমার সহবন্দীরা কেউ ফুল ছিড়েঁ না, ছিঁড়তেও দেয় না কিন্তু আমি তোমার জন্য তোড়া বাঁধলাম। আজ আর সময় কাটতে চায়না। দাড়ি কাটলাম। বই নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম। ওদিকে দেয়ালের ওপাশে শহর জেগে উঠছে। গাড়ীর ভেঁপু রিক্সার ঘন্টাধ্বনি কানে আসছে। চকের হোটেলগুলোতে নিশ্চয়ই এখন মাংসের কড়াই ফুটছে। আর মজাদার ঝোল ঢেলে দেওয়া হচ্ছে গরীব খদ্দেরদের পাতে পাতে। না বাইরে এখন আকাল। মানুষ কি খেতে পায়? দিনমজুরদের পাত কি এখন আর নেহারির ঝোলে ভরে ওঠে? অথচ একটা অতিকায় দেয়াল কত ব্যবধানই না আনতে পারে। আ, পাখিরা কত স্বাধীন। কেমন অবলীলায় দেয়াল পেরিয়ে যাচ্ছে জীবনে এই প্রথম আমি চড়ুই পাখির সৌভাগ্যে কাতর হলাম। আমাদের শহর নিশ্চয়ই এখন ভিখিরিতে ভরে গেছে। সারাদিন ভিক্ষুকের স্রোত সামাল দিতে হয়। আমি কতবার তোমাকে বলেছি, দেখো মুষ্টি ভিক্ষায় দারিদ্র্য দূর হয় না। এর অন্য ব্যবস্হা দরকার, দরকার সামাজিক ন্যায়ের। দুঃখের শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে। আ , যদি আমার কথা বুঝতে। প্রিয়তমা আমার, তোমার পবিত্র নাম নিয়ে আজ সূর্য উদিত হয়েছে। আর উষ্ণ অধীর রশ্মির ফলা গারদের শিকের ওপর পিছলে যাচ্ছে। দেয়ালের ওপাশ থেকে ঘুমভাঙ্গা মানুষের কোলাহল। যারা অধিক রাতে ঘুমোয় আর জাগে সকলের আগে। যারা ঠেলে। চালায়। হানে। ঘোরায়। ওড়ায়। পেড়ায়। আর হাত মুঠো করে এগিয়ে যায়। সভ্যতার তলদেশে যাদের ঘামের অমোঘ নদী। কোনদিন শুকোয় না। শোনো, তাদের কলরব। বন্দীরা জেগে উঠছে। পাশের সেলে কাশির শব্দ আমি ঘরে ঘরে তোমার না ঘোষণা করলাম বললাম, আজ বারোটায় আমার দেখা। খুশীতে সকলেই বিছানায় উঠে বসলো। সকলেরই আশা তুমি কোন না কোন সংবাদ নিয়ে আসবে। যেন তুমি সংবাদপত্র! যেন তুমি আজ সকালের কাড়জের প্রধান শিরোনামশিরা! সূর্য যখন অদৃশ্য রশ্মিমালায় আমাকে দোলাতে দোলাতে মাঝ আকাশে টেনে আনলো ঠিক তখুনি তুমি এলে। জেলগেটে পৌছেঁ দেখলাম, তুমি টিফিন কেরিয়ার সামনে নিয়ে চুপচাপ বসে আছো। হাসলে, ম্লান, সচ্ছল। কোনো কুশল প্রশ্ন হলো না। সাক্ষাৎকারের চেয়ারে বসা মাত্রই তুমি খাবার দিতে শুরু করলে। মাছের কিমার একটা বল গড়িয়ে দিয়ে জানালে, আবরা ধরপাকড় শুরু হয়েছে। আমি মাথা নাড়লাম। মাগুর মাছের ঝোল ছড়িয়ে দিতে দিতে কানের কাছে মুখ আনলে, অমুক বিপ্লবী আর নেই আমি মাথা নামালাম। বললে, ভেবোনা, আমরা সইতে পারবো। আল্লাহ, আমাদের শক্তি দিন। তারপর আমরা পরস্পরকে দেখতে লাগলাম। যতক্ষণ না পাহারাদারদের বুটের শব্দ এসে আমাদের মাঝখানে থামলো।

হায়রে মানুষ

একটু ছিল বয়েস যখন ছোট্ট ছিলাম আমি আমার কাছে খেলাই ছিল কাজের চেয়ে দামি। উঠোন জুড়ে ফুল ফুটেছে আকাশ ভরা তারা তারার দেশে উড়তো আমার পরাণ আত্মহারা। জোছনা রাতে বুড়িগঙ্গা তুলতো যখন ঢেউ আমার পিঠে পরীর ডানা পরিয়ে দিতো কেউ। দেহ থাকতো এই শহরে উড়াল দিতো মন মেঘের ছিটার ঝিলিক পেয়ে হাসতো দু’নয়ন। তারায় তারায় হাঁটতো আমার ব্যাকুল দু’টি পা নীল চাঁদোয়ার দেশে হঠাৎ রাত ফুরাতো না। খেলার সাথী ছিল তখন প্রজাপতির ঝাঁক বনভাদালির গন্ধে কত কুটকুটোতো নাক; কেওড়া ফুলের ঝোল খেয়ে যে কোল ছেড়েছে মা’র তার কি থাকে ঘরবাড়ি না তার থাকে সংসার? তারপরে যে কী হলো, এক দৈত্য এসে কবে পাখনা দুটো ভেঙে বলে মানুষ হতে হবে। মানুষ হওয়ার জন্য কত পার হয়েছি সিঁড়ি গাধার মত বই গিলেছি স্বাদ যে কি বিচ্ছিরি। জ্ঞানের গেলাস পান করে আজ চুল হয়েছে শণ কেশের বাহার বিরল হয়ে উজাড় হলো বন। মানুষ মানুষ করে যারা মানুষ তারা কে? অফিস বাড়ির মধ্যে রোবোট কলম ধরেছে। নরম গদি কোশন আসন চশমা পরা চোখ লোক ঠকানো হিসেব লেখে, কম্প্যুটারে শ্লোক। বাংলাদেশের কপাল পোড়ে ঘূর্ণিঝড়ে চর মানুষ গড়ার শাসন দেখে বুক কাঁপে থরথর। ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’- গান শোননি ভাই? মানুষ হবার ইচ্ছে আমার এক্কেবারে নাই।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড