রিফাত হোসেন
মাঝ রাতে ওরা ঢাকায় পৌঁছে গেছে। রাস্তায় কোনো জ্যাম ছিল না বলে খুব তাড়াতাড়ি চলে এসেছে ওরা। তারিন বলল, ‘কোথায় যাবে এখন?’
- আগের বাড়িটায় এখন আর যাওয়া যাবে না। তাই আমি অন্য একটা বাড়ি ঠিক করে রেখেছি, যেন এই কয়দিন ওখানেই থাকতে পারি।
- আমাকেও ওখানে নিয়ে চলো। সকালের আগে আমি বাড়িতে যেতে পারব না।
বাড়িতে গিয়ে অয়ন আর তারিন ফ্রেশ হয়ে নিলো। তারপর হালকা কিছু খাবার খেয়ে দু’জন দু’ঘরে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে ফোন রিংটোন এর শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তারিনের। ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে অয়ন বলে, ‘সকাল হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে এসো।’
তারিন ফোনটা কেটে দিয়ে বাথরুমে গেল। তারপর ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হলো। ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে দেখলো অয়ন কী যেন রান্না করছে। তারিন অয়নের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এত সকালে রান্না করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। বাইরে থেকে কিছু একটা কিনে আনলেই হতো।’
অয়ন মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘এই প্রথম তুমি আমার বাড়িতে থেকেছো। হয়তো এখনো আমি তোমার স্বামী হইনি। তবুও একটা দায়িত্ববোধ থেকেই যায়। তাই ভাবলাম নিজের হাতেই রান্না করে খাওয়াই তোমাকে।’
- হুম বুঝলাম। তা বাড়িটা তো খুব সুন্দর, কার বাড়ি এটা?
- এক বয়স্ক লোকের বাড়ি। তিনি অন্য একটা বাড়িতে থাকেন। আমি বেশ কিছু টাকা দিয়ে কিছুদিনের জন্য বাড়িটা ভাড়া নিয়েছি।
- ওহ্।
তারিন এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে সোফায় গিয়ে বসল। রিমোটটা হাতে নিয়ে টিভি অন করতেই ব্রেকিং নিউজ এ চোখ আটকে গেল। রিমোটটা হাত থেকে পড়ে গেল। চিৎকার দিয়ে অয়ন কে ডাক দিল। তারিনের হাত-পা সব কেমন অবশ হয়ে আসছিল। অয়ন নিজেও ব্রেকিং নিউজ দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
বেশ কিছুক্ষণ পর তারিন বিস্ময়কর কণ্ঠে বলল, ‘এইসব কী হচ্ছে অয়ন! নিলয় আর আবিরকে এভাবে মেরেছে কে? কালকে সন্ধ্যার পরেই তো ওদের সাথে কথা বলে এলাম। এইটুকু সময়ের মধ্যে ওদের মারল কে?’
অয়ন কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে ওদেরও রিফাত মেরেছে। আমরা ওখান থেকে চলে আসার পরই রিফাত গিয়েছিল ওখানে। তারপর ওদের মেরেছে। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না, সবাইকে রাস্তার পাশের ওই ল্যাম্পপোস্টের নিচে মারা হচ্ছে কেন?’
- এখান থেকে এটাই বুঝা যায় রিফাত প্রতিশোধ নিচ্ছে। ওকে তো ওই ল্যাম্পপোস্ট এর নিচে মারা হয়েছিল। তাই ও সবাইকে ওখানে নিয়ে মারছে। সবাই তো শেষ হয়ে গেল। এখন শুধু আমি আর তুমি আছি। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি আমাদেরও এভাবেই মারবে ও।
অয়ন মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ‘আমাদের মারা এত সহজ না। এর শেষ আমি দেখে ছাড়ব। এখন তুমি বাড়িতে যাও।’
- ওকে।
তারিন বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল। ঘন্টাখানিক এর মতো লাগল বাড়িতে পৌঁছাতে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছেন মাসুদ আহমেদ। লাশ দু’টো তার সামনে পড়ে আছে। এখনো ওদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে আগের খুনটার মতো এদের চেহারা বিকৃতি অবস্থায় নেই। খুব সাধারণভাবেই মারা হয়েছে এই দু’জনকে। কপালে চারটা এবং পিঠে একটা গুলি করা হয়েছে। দু’জনকে একইভাবেই মোট পাঁচটা-পাঁচটা, দশটা গুলি করা হয়েছে। খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লাশ দু’টোর দিকে তাকিয়ে আছেম মাসুদ আহমেদ। পরপর দুই রাতে তিনটা খুন হলো। আগের খুনটাও গুলি মেরে করা হয়েছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এ জানা গেছে পরপর পাঁচটা গুলি করার পরই মারা যায় অয়ন। তারপরই ওর চোখে-মুখে এবং পুরো শরীরে আঘাত করা হয়। আঘাতটা শুধু শুধু করা হয়েছিল, কারণ গুলি খেয়েই ও মারা গিয়েছিল। মাসুদ আহমেদ এর ধারণা অনেক ক্ষোভ থেকে ওই কাজটা করেছে কেউ। সাধারণত কোনো মানুষ একজনের শরীর থেকে ওভাবে মাংস খুবলে নিতে পারে না। তাই প্রথমে ভেবেছিল কোনো হিংস্র পশু ওই কাজটা করেছে। কিন্তু পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এ স্পষ্ট জানা গেছে ওকে গুলি করা হয়েছিল প্রথমেই। এবং পরে দাঁড়ালো কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। তখনই শিওর হয়েছিল ওটা জঙ্গলে থাকা কোনো হিংস্র পশুর কাজ নয়, মানষের রূপে থাকা এক পশুর কাজ।
একজন ইন্সপেক্টরের কথায় মাসুদ আহমেদের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল। তিনি বিরক্ত হয়ে ইন্সপেক্টর কে বলল, ‘কী হয়েছে?’
- স্যার, সামনের এই বাড়িটা ছাড়া আশেপাশে আর কোনো বাড়ি নেই। বেশ কিছুটা দূরে কয়েকটা বাড়ি আছে। তবে তারা এই সম্পর্কে কিছু জানে না, কারণ রাতে তারা এই রাস্তা দিয়ে কখনো যাতায়াত করেনি। এই এলাকা আগে থেকেই বেশ নির্জন। চারিদিকে শুধু গাছপালা আর জঙ্গল। যে কয়টা বাড়ি আছে তাতে জনসংখ্যা খুব কম।
- সামনের এই দু’তলা বাড়িটা কার? মালিক কে এই বাড়ির?
- এই বাড়ির মালিক ছিলেন মিস্টার জাহিদ। আপাতত তিনি এখন দেশের বাইরে আছেন। এক বছর আগে অয়ন নামের একজনের কাছে বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে তিনি বিদেশে চলে যান।
- অয়ন তো কালকের সেই ব্যাক্তিটির নাম!
- ইয়েস স্যার। কালকে যার লাশ এখানে পাওয়া গেছে তার নামই অয়ন। লাশটার পাশে বাইকের কাগজপত্র থেকে এই তথ্য জানতে পেরেছি আমরা। তালা ভেঙে পুরো বাড়ি চেক করে শুধু তার কয়েকটা ছবি পেয়েছিলাম। ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাতিত সন্দেহজনক তেমন কিছুই পাইনি। বাইকের লাইসেন্স এ থাকা উনার ছবি আর বাড়ির ভিতর থেকে পাওয়া ছবিগুলো মিলিয়ে দেখেছি আমরা, দু’জন মানুষই এক।
- তাহলে সব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এটাই বুঝা যায় যে, মিঃ অয়নের বাড়ির সামনেই উনাকে খুন করা হয়। আর ঠিক পরেরদিন রাতে আবার দু’টো লাশ পাওয়া যায় একি জায়গায়। আচ্ছা, কোনোভাবে এই তিনটে খুনের পিছনে একজন মানুষের হাত নেই তো!
- হয়তো। তবে নিউজ প্যাপারে এবং সব চ্যানেলে মিঃ অয়নের এবং এই লাশ দু'টোর ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এখনো উনাদের বাড়ির লোক বা পরিচিত কারোর খোঁজ আমরা পাইনি।
- ঠিক আছে এই লাশ দু'টোকে পোস্টমর্টেম এ পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।
মাসুদ আহমেদ এর ফোনে একটা কল আসে। তিনি কলটা রিসিভ করল। কিছুক্ষণ পর আবার ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
দুপুরের দিকে তারিন নিজের ঘরে চুপ করে বসে ছিল। তখনই মাসুদ আহমেদ এর ফোন এলো। ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে বলল তাড়াতাড়ি থানায় আসতে। তারিন নিচে এসে মিসেস রোকসানা কে বলল, ‘মা আমাকে একটু থানায় ডেকেছে।’
মিসেস রোকসানা অবাক হয়ে বলল, ‘হঠাৎ থানা থেকে তোমাকে ডাকল কেন?’
- মা, রিফাতের কেইসটা তো এখনো চলছে। তাই হয়তো কোনো কারণে ডেকেছে আমায়।
- গত ছয় মাসেও আমার ছেলের খুনিকে ধরতে পারেনি পুলিশ। আমি জানি সারাজীবনেও ওরা পারবে না আমার ছেলের খুনিকে ধরতে। কারণ ওরা সেভাবেই চেষ্টাই করছে না। গত কয়েকমাসে কী একবারও ডেকেছে আমাদের? তাহলে আজ হঠাৎ কেন ডেকেছে ওরা?
- আমি জানি না মা। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে, তাই হয়তো ডেকেছে। তাছাড়া আমরা তো চাই রিফাতের খুনির শাস্তি হোক। সে-জন্য আমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব, আমরা ততটাই সাহায্য করব উনাদের। বাকিটা উনারা যা ভালো বুঝে তাই করবে।
আরও কিছু কথা বলে কোনোরকমে মিসেস রোকসানাকে বুঝিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো তারিন। থানায় গিয়ে সরাসরি মাসুদ আহমেদ এর সাথে দেখা করল ও। মাসুদ আহমেদ তারিনকে বসতে বলে দু'টো ছবি বের করল। তারপর তারিনকে ছবি দু'টো দেখিয়ে বলল, ‘দেখুন তো, এই দু'জনকে চিনতে পারেন কিনা।’
তারিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ছবি দু’টোর দিকে। তারপর বলল, ‘না।’
- আপনি কী জানেন এই দু'জনকে কাল রাতে খুন করা হয়েছে। এবং সেখানেই খুন করা হয়েছে, যেখানে ৬ মাস আগে আপনার স্বামী রিফাতকে এবং গত পরশু রাতে আপনার বন্ধু অয়নকে খুন করা হয়েছিল।
- হ্যাঁ, সকালে ব্রেকিং নিউজ এ দেখেছি দু'জন খুন হয়েছে।
- আচ্ছা আপনার কী মনে হচ্ছে না এই চারটা খুনের পিছনে একটা বড় রহস্য আছে? বা একি ব্যাক্তি এই চারজনকে খুন করেছে?
- ' দুঃখিত, আমার এইরকম কিছু মনে হচ্ছে না। এইসব আপনাদের কাজ, আপনারা ভালো বুঝতে পারবেন। আমার বাড়িতে একটু কাজ আছে, এখন আমাকে বাড়িতে যেতে হবে।'
হো হো করে হেসে উঠল মাসুদ আহমেদ। তারিন অবাক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাল। আশেপাশে অনেকেই মাসুদ আহমেদ এর দিকে তাকিয়ে আছে। তারিন বলল, ‘আপনি এভাবে হাসছেন কেন?’
মাসুদ আহমেদ হাসি থামিয়ে বলল, ‘আপনি বোধহয় আমাকে এখনো চিনে উঠতে পারেননি তারিন। হয়তো রিফাতের বন্ধু হিসেবে কিছুটা চিনেন। তবে আপনি জানেন না আমি কী জিনিস" আপনি কী ভেবেছেন, আপনি একের পর এক মিথ্যে বলে যাবেন আর আমি কিছু বুঝতে পারবো না?’
- আপনি এইসব কী বলছেন? আমি মিথ্যে বলেছি মানে কী? দেখুন, এখানে বসে আপনার সাথে ফাজলামি করার কোনো মুড নেই আমার।
মাসুদ আহমেদ ধুম করে টেবিলে একটা থাপ্পড় দিলো। তারপর রাগী কন্ঠে বলল, ‘আপনার কী মনে হচ্ছে আমি আপনার সাথে ফাজলামি করছি? শুধু মাত্র আপনার কিছু মিথ্যের জন্য দুই রাতে তিনটে খুন হয়ে গেছে। আগেরবার যখন আপনাকে আমি জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, তখন যদি আপনি সব সত্যি বলে দিতেন তাহলে তিনজন মারা যেতো না। আর যে এইসব খুন করছে তাকেও আমরা ধরে ফেলতাম।’
তারিন আরও অবাক হলো মাসুদ আহমেদের কথা শুনে। চোখেমুখে বিস্ময় নিয়েই বলল, ‘একটু ক্লিয়ার করে সবটা বলুন প্লিজ। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
মাসুদ আহমেদ একজন কনস্টেবল কে ইশারা করে বলল, ‘উনাকে নিয়ে আসুন।’
কনস্টেবল চলে গেল। কিছুক্ষণ পর তারিনের সামনে একজন এসে দাঁড়াল। তাকে দেখে তারিন বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। হা করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না ওকে এখানে দেখতে পাবে।
(চলবে....)
‘প্রতিশোধ’ এর ৬ষ্ঠ পর্ব পড়ুন- ধারাবাহিক গল্প : ‘প্রতিশোধ’
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড