তানজিলা আলম
সকালে হুট করে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর যখন আবিষ্কার করলাম হাতের চিনচিনে ব্যথা তখন অব্ধি রয়ে গিয়েছে, তখনি মনে পড়ল বিগত কয়েকদিনের কল্পনাতীত খাটাখাটনির অবশেষে সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। এ ক’দিন ফরেনসিক মেডিসিনের প্র্যাকটিকেল লিখতে গিয়ে মনে হয়েছিল এরচেয়ে প্রতিদিন আইটেমের টেবিলে ক্লাস টিচারের মুখোমুখি বসে ভাইভা দেয়া অনেক সহজ। এতদিন মনে হত প্র্যাকটিকেলের অসমাপ্ত লেখাগুলো আমার দিকে বিদ্রূপমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বালিশের পাশে রেখে দেয়া সেই প্র্যাকটিকেল খাতার দিকে তাকিয়ে আজ বিদ্রূপাত্মক হাসি হাসতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে।
বারবার মাথার ভেতর বেজে চলা অদৃশ্য ঘণ্টা কিছুক্ষণ পরপর জানান দিচ্ছে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে পড়া উচিৎ। একটু পর যখন পুরো হোস্টেল জেগে উঠবে, তখন বাথরুমের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আফসোস করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। মাথার সেই অদৃশ্য ঘণ্টাকে আজ আর পাত্তা দিলাম না। হাজার হোক, অন্য দিনের মতো আজ আর আমাকে ফরেনসিক প্র্যাকটিকেল লিখতে হবে না! এরচেয়ে বরং ফেসবুকে ঘুরে আসা যাক। প্র্যাকটিকেলের যন্ত্রণায় এতদিন ফেসবুকে বেশি সময় দিতে পারিনি, আজ ইচ্ছেমত সময় ওড়াব।
সেই ভাবনা তার নিজের জায়গায় পড়ে রইল। ফেসবুকে ঢুকে মনে হল আজব এক জগতে ঢুকে পড়েছি। কয়েকদিনের মধ্যে পৃথিবীতে এত ঘটনা ঘটে গিয়েছে আর আমি কেবল এইমাত্র জানতে পারলাম! ধীরে ধীরে ফেসবুকে কীভাবে ডুবে গিয়েছিলাম তা বুঝতেও পারিনি । যখন ঘোর কাটল, ততক্ষণে নয়টা পঁয়ত্রিশ বেজে গিয়েছে। সর্বনাশ! ম্যাম সকাল দশটার মধ্যে চলে আসবেন বলেছিলেন।
দ্রুত গুছিয়ে নিয়ে যখন কলেজে পৌঁছলাম, তখন দশটা বেজে এগার মিনিট। স্বস্তির খবর হচ্ছে ম্যাম তখনো কলেজে আসেননি। আর অস্বস্তিকর কথা হচ্ছে নিজেকে ছাড়া আমার ব্যাচের কাউকেই আমি কলেজে দেখতে পাচ্ছি না। কোথাও ভুল হয়ে গেল না তো! আমার স্পষ্ট মনে আছে কাল মেসেঞ্জার গ্রুপে বলে দেয়া হয়েছে ম্যাম সকাল দশটা নাগাদ চলে আসবেন। ম্যামের না হয় দেরি হতে পারে, তাই বলে স্টুডেন্টরাও দেরি করবে নাকি! হাতে ধরে রাখা মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে নিজেকে কেমন বোকা বোকা মনে হচ্ছে। কয়েকদিন আগে রিস্টার্ট করতে গিয়ে ‘ফ্রি ফেসবুক’ অ্যাপ আনইন্সটল হয়ে গিয়েছে। মোবাইলের ব্যালেন্সও শূন্যের কোঠায়, ইমারজেন্সী তো সেই কবেই নেয়া হয়ে গিয়েছে! কি ভেবে এই মোবাইল নিজের সঙ্গে এনেছি তা কিছুতেই মাথায় ঢুকছিল না। বহু ভেবেচিন্তে অবশেষে একটা কাজ খুঁজে পেলাম। আর কিছু না হোক, অন্তত গেমস খেলে সময় ক্ষেপণ তো করা যাবে!
গেমসে যখন পুরোপুরি ডুবে গিয়েছি, তখনি কে যেন কাঁধে চাপড় মারল। মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে তৃষ্ণাকে দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। আমি তাহলে দিন তারিখের হিসেবে গোলমাল করিনি!
পাশে বসে অনুমতির তোয়াক্কা না করে তৃষ্ণা আমার ব্যাগ থেকে পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে কয়েক ঢোক পানি গিয়ে ফেলল। আমার অগ্নি দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘ম্যাম এখনো আসেননি?’
কথা না বলে আমি ওর হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম। আজ ভীষণ গরম পড়েছে। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে বলে রক্ষা। কয়েকদিন যে হারে বিদ্যুৎ নিজের আগমন আর প্রস্থান ঘটাচ্ছে, তাতে এখনো যে বহাল তবিয়তে বেঁচে আছি এই অনেক। লোডশেডিংয়ের কথা মনে পড়ায় গেমস বন্ধ করে মোবাইল ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম, অবশিষ্ট চার্জের অপচয় হতে দেয়া যাবে না।
তৃষ্ণা ওর ব্যাগ থেকে টিফিন বক্স বের করে বলল, ‘সকালে নাস্তা করতে পারিনি, তাড়াহুড়ো করে চলে আসতে হয়েছে। আসার সময় আম্মু সঙ্গে দিয়ে দিল। তুই নাস্তা করেছিস?’
ওর কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল তাড়াহুড়ো আমারও ছিল, তাই নাস্তা করা হয়ে ওঠেনি। তৃষ্ণা বাসায় থাকে বলে ওকে নাস্তার কথা মনে করিয়ে দেয়ার মানুষ থাকলেও হোস্টেলে বসবাস করা আমার সেসবের বালাই নেই। বেশিরভাগ সময় নাস্তা ছাড়াই কলেজে ছুটে আসতে হয়, ক্লাসের কোনো এক ফাঁকে ক্যান্টিনে ঢুঁ মেরেই নিজের প্রতি আমার সমস্ত দায়িত্ব শেষ। টিফিন বক্সে অবহেলায় ফেলে রাখা মায়োনেজ মাখানো পাউরুটি আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি অগ্রাহ্য করতে না পেরে বক্স থেকে পাউরুটি নিয়ে বিশাল কামড়ে মুখে চালান করে দিলাম। মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে তৃষ্ণাকে বললাম, ‘তোর প্র্যাকটিকেল খাতা বের কর। মিলিয়ে দেখি সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা।’
তৃষ্ণা ওর খাতা এগিয়ে দিল। ওর প্র্যাকটিকেল খাতা দেখে আমার দু’চোখ কপালে উঠে গেল। ঢোক গিলে পাউরুটির অবশিষ্টাংশ পেটে পাঠিয়ে দিয়ে বললাম, ‘তোর প্র্যাকটিকেল খাতা এত মোটা কেন? এত কী লিখেছিস?’
চোখ নাচিয়ে তৃষ্ণা ফিকফিক করে হেসে বলল, ‘আমি তো সব লিখেছি, তুই বরং দেখ কী কী বাদ দিয়েছিস।’ ওর কথা শুনে আমার চিন্তা আরো বেড়ে গেল। এত কষ্ট করে এতগুলো লেখা লিখেছি, কোনটা বাদ গেল? শেষ পৃষ্ঠা উল্টে দেখলাম আমার চেয়ে ও ষাট পৃষ্ঠা বেশি লিখেছে। চোখের পানি আটকে আমি দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ইনডেক্স মেলানো শুরু করলাম। ইনডেক্সে কোন ঝামেলা হয়নি, আমি সবগুলোই লিখেছি। তৃষ্ণার প্র্যাকটিকেল খাতার পৃষ্ঠা উল্টে দেখলাম লেখার মাঝে ও বিশাল বিশাল গ্যাপ দিয়েছে। মেজাজ গরম করে বললাম, ‘এত ফাঁকা রেখেছিস কেন?’
তৃষ্ণা পাল্টা মেজাজ দেখিয়ে বলল, ‘তুই এত ছোট ছোট অক্ষরে কেন লিখেছিস? লাইনের মাঝে তো গ্যাপই রাখিসনি।’ ওর কথা শুনে আমি দমে গেলাম। আমার খাতায় সত্যিই তেমন গ্যাপ নেই। যখন লিখতে শুরু করেছিলাম, তখন মাথায় কোন ভূত চেপে গিয়েছিল কে জানে! গ্যাপ দিতে গেলে মনে হচ্ছিল খামোখা পৃষ্ঠার অপচয় করছি। এখন আফসোস হচ্ছে। লিখেছিলাম যখন, তখন খাতার সৌন্দর্যের প্রতি একটু মনোযোগ দিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? মাথা থেকে অতীতের ভুল ঝেড়ে ফেলে ফিসফিস করে বললাম, ‘আমার প্র্যাকটিকেল খাতা তো অনেক ছোট লাগছে। ম্যাম যদি বলেন এত ছোট খাতায় সাইন করবেন না, তখন কী হবে?’ তৃষ্ণা ভাবলেশহীন গলায় বলল, ‘কী আর হবে! আরেকবার লিখবি।’ ওর কথা শুনে ভীষণ অভিমান হল। আমার এই বিপদে এ ধরনের কথা এমন নির্বিকার চিত্তে বলতে ওর একটুও কষ্ট হল না? আমতাআমতা করে বললাম, ‘ম্যাম কি সত্যিই সাইন করবেন না?’ - এত ছোট খাতা সাইন নাও করতে পারেন। - আমি কি তাহলে চলে যাব? - যেতে পারিস। - সত্যিই যাব? নাকি একটু অপেক্ষা করে দেখব? ম্যামকে আগে দেখাই। ম্যাম যদি বলেন কোনো সমস্যা হবে না, তাহলে তো বেঁচে গেলাম। থেকে গেলে এই একটা সুযোগ অন্তত থাকবে, চলে গেলে তো তাও থাকবে না। তুই কী বলিস? - তাহলে বসে থাক। তৃষ্ণার কথা শুনে ভয় আর রাগ ক্রমশ আমাকে জেঁকে বসল। ম্যাম কখন আসবেন আর কখন খাতা দেখাব, সেই দুশ্চিন্তায় নিজের মন স্থির করতে পারছি না। অন্যদিকে তৃষ্ণা বকবক করেই চলেছে। একবার হাই তুলে বলল, ‘কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি। মনে হচ্ছে এখানেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ি।’ আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ‘ঘুমোতে চাইলে ঘুমিয়ে পড়। খামোখা আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছিস কেন? আমি নিজের যন্ত্রণায় মরছি, আর আরেকজন এসেছে ঘুমের গল্প শোনাতে। স্ট্রেঞ্জ!’ - অত রেগে যাচ্ছিস কেন? আগে শোন কাল কি হয়েছে। - আমার অত শোনার ইচ্ছে নেই। তুই তোর বকবকানি থামা। - আরে, শুনেই দেখ না! কাল রাতে ঘুমোতে যাবার সময় দেখি প্রিতুল লুকিয়ে লুকিয়ে বারবার কি যেন দেখছে। দূর থেকে মনে হচ্ছিল কাগজের টুকরো। ওকে দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাই আমিও ওর ওপর থেকে নজর সরাইনি। ঘুমোতে যাবার আগে সেটা ডায়েরির মাঝে গুঁজে রেখেছিল। ও যখন ঘুমিয়ে পড়ল, তখন ডায়েরি খুলে দেখলাম ওটা একটা প্রেমপত্র। - কি? সত্যি? - তাহলে আর বলছি কী! তোর বিশ্বাস হয় আমি মেডিকেলে থার্ড ইয়ারে পড়ে এখন পর্যন্ত একটা লাভ লেটার পেলাম না অথচ ক্লাস এইটে পড়ুয়া আমার ছোটভাই এর মধ্যেই প্রেমপত্র পেয়ে গিয়েছে? আমি চোখ নাচিয়ে বললাম, ‘ক্লাসমেট?’ - আরে, নাহ! জুনিয়র। - জুনিয়র! তৃষ্ণার কথা শুনে এবার সত্যিই আমার চোখদুটো কপালে উঠে গেল। তাকে বললাম, ‘তোর ভাই পড়ে ক্লাস এইটে, ওকে আবার কোন জুনিয়র প্রেমপত্র লিখে পাঠাবে?’ তৃষ্ণা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল, ‘মেয়েটা সেভেনে পড়ে। চিঠির শেষে লিখেছে- আনিকা। সপ্তম শ্রেণি। খ সেকশন। রোল ৩৬।’ - বাহ! পুরো এড্রেস লিখে দিয়েছে। তোর ভাইয়ের হবু গার্লফ্রেন্ডের বেশ ট্যালেন্ট আছে দেখছি। অন্যদিকে তুই রামছাগলই রয়ে গেলি। আচ্ছা, রামছাগলের স্ত্রীলিঙ্গ কি হবে? তোর বিশেষণে ওটা একদম মিলে যায়। পিচ্চি মেয়েটার কাছ থেকে কিছু তো শিখতে পারিস, নাকি?
আমরা যখন হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম, তখন ম্যাম এসে উপস্থিত। ম্যামের পিছুপিছু আরো কয়েকজন স্টুডেন্ট এসেছে। প্রথমদিন গুটিকয়েক স্টুডেন্ট এসেছে, বাকিরা অন্যদিন আসবে। এত কম স্টুডেন্টের খাতা সাইন করাতে বেশি সময় লাগবে না ভেবে আনন্দ লাগছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল প্র্যাকটিকেল খাতা দেখে ম্যামের প্রতিক্রিয়া কি হবে তা এখনো আমার জানা নেই। একটু আগের হাসিমুখ নিমিষে উধাও হয়ে গেল।
এদিকে ম্যাম আবার অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। প্রথমে তৃষ্ণা নিজের খাতা এগিয়ে দিয়েছিল, ম্যাম সেটা হাতে নিতেই একজন কর্মচারী এসে জানাল, লোকাল থানা থেকে ওসি এসেছে। খাতা রেখে ম্যাম সেখানে চলে গেলেন। ম্যাম একবার উঠেছেন মানে হচ্ছে তার ফিরতে অনেক সময় লাগবে। এর আগেও অনেকবার আইটেম দিতে গিয়ে ম্যামের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। ফরেনসিক মেডিসিন ডিপার্টমেন্টটাই এমন, হুটহাট পুলিশের লোকজন চলে আসে কিংবা ডাক্তারি রিপোর্ট নিতে ভিক্টিম এসে পড়ে। তখন সেই কাজ শেষ করতে ম্যামকে ক্লাস রেখে উঠে পড়তে হয়।
সবাই এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কথা বলছে। তাদের প্র্যাকটিকেল খাতার দিকে তাকিয়ে আমার দুশ্চিন্তা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে, শক্ত কিছু দিয়ে নিজের মাথায় বাড়ি মারতে ইচ্ছে করছিল। ওদিকে ম্যামের আসার কোন খবর নেই। বসে থাকতে থাকতে হাত পা যখন ধরে গিয়েছিল, তখন ম্যাম ফিরলেন। এবার আর ম্যাম বসার সুযোগ পেলেন না, তার আগেই আরেকজন কর্মচারী এসে জানাল একজন ভিক্টিম এসেছে। ম্যাম আবার গেলেন, তবে এবার একটু পরেই ভিক্টিমকে নিয়ে ফিরে এলেন। একজন মেয়ে আবদার করল, ‘ম্যাম, আমরা অনেকক্ষণ ধরে এসেছি। আমাদের খাতাগুলো যদি আগে সাইন করে দিতেন!’ ম্যাম হেসে বললেন, ‘আগে আমাকে এই কাজটা করতে হবে, তারপর তোমাদের খাতা সাইন করব। বেশি সময় লাগবে না। এতক্ষণ অপেক্ষা করেছ, এখন আর একটু সময় অপেক্ষা করো।’
আমার অবশ্য আর বিরক্ত লাগছিল না। ততক্ষণে আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ চলে গিয়েছে ভিক্টিমের ওপর। এতদিন ক্লাসে ঢোকার সময় দূর থেকে ভিক্টিমদেরকে রুমে বসে থাকতে দেখেছি আর আজ এত কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছি। নিজের ভেতর অন্য এক অনুভূতি লক্ষ্য করলাম। এতদিন বই পড়ে মনে হয়েছে একজন ভিক্টিম যখন ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে কনসেন্ট দিতে আসে, তখন সে একটি খোলা বইয়ের মতো হয়ে যায়। সে এখানে এসে এমন কিছু কথা বলে, যা হয়তো বাকি জীবনে অন্য কারো কাছে মুখ খুলে প্রকাশ করবে না। এখানে এসে জীবনের অনেক লুকোনো অধ্যায় তাকে প্রকাশ করতে হয়। এতদিন যা ভেবে এসেছি, আজ তা মিলিয়ে দেখার সুযোগ পাওয়া গেল।
নিজের মনে লুকিয়ে থাকা অস্বস্তি টের পেতেও আমার কালক্ষেপণ হয়নি। ভিক্টিম হিসেবে যে এসেছে, তাকে নারী না বলে মেয়ে বলাই শ্রেয়। বড়জোর ষোল বা সতের বছর বয়স হবে! সেলোয়ার কামিজ পরিহিত অবস্থায় ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে, তবু ছোটখাটো শরীরের মেয়েটিকে দেখে একে কিছুতেই সতের বছরের বেশি মনে হল না। এই রুমে যারা আছে, তারা সবাই এই মেয়েটির চেয়ে বয়সে বড়। তাই হয়তো সে অস্বস্তি বোধ করছিল। ম্যাম তাকে একটি চেয়ার দেখিয়ে সেখানে বসতে বললেন। মেয়েটি চুপচাপ মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে রইল। তার অস্বস্তি খেয়াল করে আমরা নিজেদের মাঝে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
আমার মনের খচখচানি বেড়ে চলেছিল। প্র্যাকটিকেল খাতা সাইন করাতে আজ একজন ছেলে এসেছিল, বাকি সবাই মেয়ে। আমি বুঝতে পারছিলাম না রুমে একজন পুরুষ উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও ম্যাম তাকে বাইরে যেতে বলছেন না কেন। আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল মেয়েটি সম্ভবত রেপ ভিক্টিম, ধর্ষণের স্বীকার হয়ে তাকে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে আসতে হয়েছে। মেয়েটির বয়স অনুযায়ী এটা ছাড়া অন্যকিছুর জন্য এখানে আসার কথা নয়। রেপ ভিক্টিমের কনসেন্ট নেয়ার সময় কোনো পুরুষের উপস্থিতি এলাউ করা হয় না, বিশেষ করে আমাদের দেশে বলতে গেলে এটা একরকম নিষিদ্ধ। ছেলেটার ওপরও রাগ হচ্ছিল। যদিও মেয়েটি কি বলছে সেদিকে তার মনোযোগ ছিল না, সে অন্যদের সঙ্গে নিচুস্বরে কথা বলছে। তবু আমার মনে হয়েছে তার নিজেরই রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। আমি মেয়েটির দিকে আড়চোখে তাকালাম। তাকে বেশ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। চেহারায় লজ্জিত ভাব ফুটে উঠলেও তাকে দেখে মনে হচ্ছে না এতগুলো মানুষের সামনে কথা বলতে সে তেমন বিব্রত বোধ করছে। এবার আমার মধ্যে খানিকটা কৌতূহল জেগে উঠল। একজন রেপ ভিক্টিম কখনোই এত স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারত না। আমি মনোযোগী হয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলাম।
ম্যাম তখন মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘তোমার বয়স কত?’ মেয়েটি নিজের বয়স বলতে গিয়ে একটু চিন্তায় পড়ে গেল। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে পড়াশোনা খুব বেশি করেনি। নিজের বয়সও হয়তো তেমন করে মনে রাখেনি। কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘চইদ্দ হইব।’ মেয়েটির কথায় আঞ্চলিকতার টান আছে। বয়স বলতে গিয়ে যেভাবে জিহ্বায় জড়তা কাজ করছিল, তাতে মনে হচ্ছিল তার মাঝে আত্মবিশ্বাসের বেশ অভাব আছে। ম্যাম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘চৌদ্দই হবে? নিশ্চিত তো?’ মেয়েটি আগের মতো বলল, ‘তের-চইদ্দই হইব। এর বেশি হইব না।’ - তের নাকি চৌদ্দ? একটা বলো! তোমার জন্ম কত সালে?
ম্যামের প্রশ্নের জবাবে মেয়েটি এবার ঠিকঠাক তার জন্মসাল বলল। ম্যাম আরো কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। মেয়েটিকে এখানে কে নিয়ে এসেছে, মামলা কে করেছে এ ধরনের কিছু প্রশ্নের উত্তর সে ঠিকমতোই দিল। এরপর মেয়েটিকে ম্যাম কেস সংক্রান্ত এমন কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন যা আমার মাথার ওপর দিয়ে গেলেও মেয়েটি ঠিকই বলে ফেলল। হয়তো থানায় এ ধরনের কথাবার্তা শুনেছে বলে সেগুলোকে তার কাছে অবোধ্য কিছু মনে হয়নি। ম্যাম এবার জানতে চাইলেন, ‘প্রথম মাসিক কবে হয়েছে?’ মেয়েটি লজ্জায় পড়ে গেল। ম্যাম বললেন, ‘লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। তোমাকে এটা বলতে হবে। নইলে আমি এই ফর্মে কীভাবে লিখব?’ মেয়েটি লজ্জায় মাথা নুইয়ে বলল, ‘মনে নাই।’ - মনে নেই বললে হবে? তখন তো তুমি বুঝতে শিখেছ। সেদিনের কথা নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে! আছে না?
মেয়েটি মাথা নেড়ে সায় দিল, সেদিনের কথা তার মনে আছে। তার মাথা নাড়ানোর ভঙ্গি দেখে আমার হাসি পেয়ে গেল। সেই দিনটির কথা সম্ভবত সব মেয়েরই মনে থাকে। ম্যামের কথা শুনে তার দিকে নজর গেল। ম্যাম বলার চেষ্টা করছেন, "তখন তুমি কোন ক্লাসে পড়তে? একটু ভেবে বলো।" মেয়েটি নিজের ওড়নার এক প্রান্ত দাঁত দিয়ে চেপে ধরে বলল, ‘মনে নাই।’ ম্যাম আড়মোড়া ভেঙ্গে বললেন, ‘তখন কোন ক্লাসে পড়তে, সেটাও মনে নেই?’ - ক্লাস ফোর নইলে ফাইভে পড়তাম। - এখন কোন ক্লাসে পড়? হিসেব কষে সঠিক সময় বের করার জন্য ম্যাম জানতে চাইলেন। - পড়ি না। - কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছ? - এইটে উঠছিলাম কিন্তু তারপর আর পড়ি নাই। - এই বছর এইটে উঠেছিলে? - হুম, এই বছরই।
ম্যাম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে অন্য একটি কাগজ টেনে নিয়ে খসখস করে কি যেন লিখলেন। ততক্ষণে আমি ম্যামের চেয়ারের পেছনে চলে এসেছি, মাথা বাড়িয়েও লেখাটা ঠিকমতো পড়তে পারলাম না। আমাকে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখে মেয়েটি আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল। হয়তো ভাবছিল তার মাসিকের খোঁজ নিয়ে আমি কি করব! লজ্জা পেয়ে আমি একটু পিছিয়ে এলাম। ম্যাম মেয়েটির কাছে জানতে চাইলেন, ‘শেষ কবে মাসিক হয়েছিল?’ - কয়েকদিন আগেই। দশ পনের দিন হইব। - সঠিক সময় বলতে পারবে না? মেয়েটি মাথা নেড়ে জানাল সে বলতে পারবে না। ম্যাম এবার আরেকটি প্রশ্নে চলে গেলেন, ‘তুমি বাড়ি থেকে কবে পালিয়েছ?’ মেয়েটি বলল, ‘আগের সপ্তাহে।’ - আগের সপ্তাহে মানে কবে? কী বার পালিয়েছিলে? তারিখ মনে আছে? - সেইটা তো মনে নাই। - কবে পালিয়েছ, তাও মনে নেই? এটাও ভুলে গিয়েছ? ম্যামকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি একরাশ হতাশায় ডুবে গিয়েছেন। আমার মাথায় তখন অন্য একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। মেয়েটি বাড়ি থেকে পালিয়েছিল মানে কী? সে কি রেপ ভিক্টিম নয়? অথচ তাকে রেপ ভিক্টিম ভেবে আমি এতক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছিলাম। ফরেনসিক মেডিসিনের বইয়ে রেপ ভিক্টিম এক্সামিনেশন সম্পর্কে যা লেখা আছে, তার সঙ্গে কতটা মিলে যায় তা দেখতেই এত আগ্রহ নিয়ে আমি তাদের কথা শুনছিলাম। এখন মনে হচ্ছে তেমন কিছু নয়, ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। হয়তো এ কারণেই রুমে উপস্থিত থাকা একমাত্র ছেলেটিকে ম্যাম বাইরে যেতে বলেননি।
আমার আগ্রহ নতুন করে বেড়ে গেল। তের চৌদ্দ বছর বয়সী একটি মেয়ের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের দেশে অহরহ এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সেই ঘটনা সরাসরি কোন মেয়ের কাছ থেকে শোনা হয়নি। আজ প্রথম এমন একটি ঘটনার সাক্ষী হতে পেরে খুশিই হলাম। তবে মেয়েটি এবারও কিছু বলতে পারল না। কেবল বলল, "এই শুক্কুরবারের আগে পালাইছিলাম।" আজ সোমবার। এই শুক্রবারের আগে পালিয়েছে, অর্থাৎ, কমপক্ষে চারদিন আগে পালিয়েছে। আমার মাথায় ঢুকছিল না মেয়েটি কেন ঠিকঠাক সময় বলতে পারছে না। কিছু তারিখ আছে, যেগুলো মেয়েরা নিজেদের মাথায় পুরোপুরি গেঁথে নেয়। এই মেয়ে সেগুলো মনে রাখেনি, এমনকি সেসব নিয়ে তার মাঝে কোন ভাবান্তরও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
ম্যাম চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘এই শুক্রবারের কদিন আগে, সেটা মনে আছে?’ মেয়েটি এবারও ডানে বায়ে মাথা নেড়ে নিজের অপারগতার কথা প্রকাশ করল। পাশ থেকে একজন বলে উঠল, ‘তুমি যে পালিয়েছিলে, তার কয়দিন আগে জুম্মাবার ছিল তা মনে আছে? তোমার বাড়ির লোকজন জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়েছিল নিশ্চয়ই! তুমি যেদিন বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিলে, তার কয়দিন আগে জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়েছিল? খেয়াল আছে?’ না, মেয়েটি এবারও কিছু বলতে পারল না। তার কাছ থেকে সঠিক জবাব পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে ম্যাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘যে ছেলের সঙ্গে পালিয়েছিলে, তার নাম কি?’ - রবিউল। - রবিউলের বয়স কত? - জানি না। - এটাও জানো না! ম্যাম আরেকবার হতাশ হয়ে বললেন, ‘রবিউলের বাড়ি কোথায়?’ মেয়েটি ঠোঁট টিপে বলল, ‘কইতে পারি না।’ এবার ম্যাম নিজের দু’চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘এটাও জানো না? না জেনেই তার সঙ্গে চলে গেলে?’ মেয়েটি লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। ম্যাম বললেন, ‘তাহলে পালিয়ে যাওয়ার পর কার বাসায় উঠেছিলে?’ - হের বন্ধুর বাড়ি। - বন্ধুর বাসায় কেউ ছিল না? - আছিল। মেয়েটি নির্লিপ্ত গলায় বলল। - তারা তোমাদের দুজনকে থাকতে দিল? - দিল তো! - তারা তোমাকে তোমার বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করেনি? তোমার বাবা মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি? - না, হেরা কিছু জিগায় নাই। - কদিন ছিলে সে বাড়িতে? - পাঁচ ছয়দিন হইব? - পাঁচদিন নাকি ছয়দিন? - হইব কিছু একটা। মেয়েটির কথা শুনে আমার হাসি পেয়ে যায়। কয়েকজন শব্দ করেই হেসে ফেলল। ম্যামের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম তিনিও হাসি চাপতে চেষ্টা করছেন। যে মেয়ে এখনো দিনতারিখের হিসেবে গোলমাল করে ফেলে, সে কিভাবে নিশ্চিন্তে আরেকজনের হাত ধরে পালিয়ে গেল! ম্যাম এবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাকে তাহলে খুঁজে পাওয়া গেল কিভাবে? তুমি নিজেই ফিরে এসেছিলে?’ মেয়েটি বলল, ‘না, পুলিশ খুঁইজ্জা বাইর করছে।’ - পুলিশ কিভাবে খুঁজে পেল? আশেপাশের লোকজন পুলিশকে খবর দিয়েছিল? - না, আমার মা থানায় ডায়েরি করছিল। ডায়েরি করার পর পুলিশ রবিউলের দুই ভাইরে হাজতে ঢুকাইছে। - তোমার বাড়ির লোকজন রবিউলকে চিনত। - হঁ, চিনত। না চিনলে পুলিশ ঐখানে গেল ক্যামনে? - তাও কথা। রবিউলের বাড়ির মানুষজন পুলিশকে তোমার খোঁজ জানিয়েছে? - না। হেরা তো জানত না আমরা কই আছি। পুলিশই খুঁইজ্জা বাইর করছে। - পুলিশ রবিউলকে ধরেছে?’ - না, ধরতে পারে নাই। পুলিশ আহনের খবর শুইন্না পালাইয়া গেছে। - তোমাকে রেখেই পালাল? প্রেম করে বিয়ে করা বউ রেখেই পালিয়ে গেল? ভাল কথা, তোমাদের বিয়ে হয়েছিল। মেয়েটির মাথা নেড়ে বলল, ‘বিয়া হয় নাই।’ ম্যাম বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘বিয়ে ছাড়াই এই কদিন কাটিয়ে দিলে?’ মেয়েটি এবার বোধহয় লজ্জা পেল। ডান হাতে মুখ চেপে হাসি আড়াল করে বলল, ‘কয়েকদিনের মইদ্ধে বিয়া হওয়ার কথা আছিল।’ কনসেন্ট ফর্মে কিছু লিখে মেয়েটির কাছে ম্যাম জানতে চাইলেন, ‘রবিউল কী করে?’ - কইতে পারি না। পালাইয়া যাওয়ার পর আর হের লগে কথা হয় নাই। মেয়েটি তার কথা বুঝতে পারেনি ভেবে ম্যাম আবার বললেন, ‘রবিউল কী কাজকর্ম করে সেটা জিজ্ঞেস করেছি।’ মেয়েটি হাতের আঙ্গুলে ওড়নার প্রান্ত পেঁচিয়ে জবাব দেয়, ‘কিছু করে না মনে হয়।’ ম্যাম কী বলবেন বুঝতে না পেরে অবশেষে বললেন, ‘এটাও মনে হয়?’ - সারাদিন তো আমাগো বাড়ির পিছনে লুকাইয়া আমার লগে কথা কইত। কাজকাম থাকলে কি আর অত সময় পাইত? - তাকে জিজ্ঞেস কর নি? মেয়েটি ঠোঁট উল্টে বলল, ‘না।’ ম্যাম আফসোসের সুরে বললেন, ‘তুমি তো তার সম্পর্কে কিছুই জানো না। কিছু না জেনেই চলে গেলে?’ মেয়েটি এবার শক্ত গলায় বলল, ‘তিনমাসের পরিচয়ে আর কত জানুম?’ এবার আর কেউ বিস্মিত হতে পারছিল না, এই মেয়েকে দিয়ে যে যেকোনো কিছু সম্ভব তা এতক্ষণে সবাই মেনে নিয়েছিল। তবু ম্যাম বললেন, ‘তিন মাসের পরিচয়েই অপরিচিত একজনের সঙ্গে চলে গেলে?’ মেয়েটি অভিমান নিয়ে বলল, ‘তিন মাস আর পাইলাম কই? রবিউলের লগে পরিচয়ের কয়েকদিন পরই অন্য জায়গায় বিয়া হইয়া গেল। ঐ বাড়ি থিইক্যা আইসা তারপর আবার যোগাযোগ হইল। এরপর না পালাইলাম!’ - তোমার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল! ম্যামের কণ্ঠে বিস্ময় আর বাঁধ মানছিল না। মেয়েটি নির্লিপ্ত গলায় জবাব দেয়, ‘হঁ।’ ম্যাম এবার হালকা ধমকের সুরে বললেন, ‘এ কথা আগে বলনি কেন? কবে বিয়ে হয়েছিল?’ - কয়দিন আগেই। - কয়েকদিন আগে হয়েছে, তা বুঝতে পারছি। কবে হয়েছিল সেটা মনে নেই? মেয়েটি লজ্জিত হয়ে বলল, ‘মনে নাই তো! মনে না থাকলে কি করুম?’ - স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছে? - না। - ডিভোর্সও হয়নি? এর মাঝেই তুমি আরেকজনের সঙ্গে চলে গেলে! মেয়েটি চুপচাপ বসে থাকে। কোনো জবাব দেয় না। ম্যাম জানতে চাইলেন, ‘সে এখন কোথায়?’ - কে, রবিউল? পুলিশ আমারে মায়ের কাছে দিয়া যাওনের পর হের লগে তো আর কথা হয় নাই। - রবিউল না, তোমার স্বামীর কথা বলছি। - কে জানে কই আছে! - তার সঙ্গে যোগাযোগ নেই? - না। বিয়ার পর হেরা পিডাইয়া আমারে বাড়ি থিইক্যা বাইর কইরা দিছে। আর যাই নাই।
একটি মেয়ের জীবনে ঘটে যাওয়া এত তথ্য কনসেন্ট ফর্মে প্রয়োজন হয় না তবু ম্যাম তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলেন। হয়তো আমার মতো তিনি নিজেও কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারেননি কিংবা মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে যা কিছু ঐ ফর্মে লিখতে হবে, তা লিখে নিচ্ছিলেন। তিনি আবার বললেন, ‘শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে তারপর রবিউলের সঙ্গে পালিয়েছ? এত তাড়াহুড়ো করার কি দরকার ছিল? তাকে বিয়ে করতে চাইলে আগে স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স নিয়ে নিতে!’ মেয়েটি নিচু গলায় বলল, ‘মা আবার আমার বিয়া ঠিক করছিল।’ ম্যাম কি বলবেন তা হয়তো বুঝতে পারছিলেন না। আমাদের মধ্য থেকে একজন বলল, ‘এক সংসার থেকে ফিরে আসতে না আসতেই আরেকটি বিয়ে? তোমার তো ডিভোর্সও হয়নি।’ মেয়েটি ভেঙ্গচি কেটে বলল, ‘আমার স্বামী এহন কই আছে কেউ জানে না। হেয় বাইত্তে নাই। অনেকদিন ধইরা তার কোন খোঁজ পাওয়া যাইতাছে না। কোন চিপায় গিয়া মরছে, কে জানে!’ ম্যাম মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিয়ে যদি দিতেই হয়, তোমার মা তাহলে রবিউলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইল না কেন?’ মেয়েটি বেশ নড়চড়ে বসল। শান্ত গলায় বলল, ‘মা রবিউলরে পছন্দ করে নাই। রবিউল গাঞ্জা খায়, এইটা মা পছন্দ করতো না। হেয় আরো অনেক নেশা করে।’ - রবিউল নেশা করে জেনেও তুমি তার সঙ্গে পালিয়ে গেলে? - আমি জানতাম না। পালাইয়া যহন রবিউলের বন্ধুর বাসায় গেছি, তহন টের পাইছি। ম্যাম কেন যেন মেয়েটির কথা বিশ্বাস করলেন না। সন্দেহ পোষণ করে বললেন, ‘তোমার মা জানতো আর তুমি জানতে না?’ - মা আমারে কইছিল কিন্তু আমি বিশ্বাস করি নাই। - হুম, তা- এরপর কি করবে ভেবেছ? - কি আর করুম! পুলিশ রবিউলরে ছাইড়া দিলে হেরে বিয়া করুম! - এখনো মাথা থেকে বিয়ের ভূত নামাতে পার নি? রবিউলকে পুলিশ খুঁজে পেলে এত সহজে ছাড়বে বলে মনে হয় না। তোমার মা কেস উঠিয়ে নিলে ছাড়তে পারে। তোমার মা কি কেস উঠিয়ে নিবে? - নিব না মনে হয়, মা রবিউলরে সইজ্জ করতে পারে না। - তাহলে বিয়ে করবে কিভাবে? প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটি কেবল হাসল। তার হাসি দেখে মনে হল রবিউলকে বিয়ে করার ব্যাপারে সে একেবারে নিশ্চিত। ম্যাম মেয়েটিকে আরো কিছু প্রশ্ন করলেন। এরপর কনসেন্ট ফর্মে মেয়েটির সিগনেচার নিয়ে তাকে সঙ্গে করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
রুম থেকে ম্যাম চলে যাওয়ার পর গুণগুণ শব্দে একেকজন কথা বলতে শুরু করল। সব কথা মেয়েটিকে ঘিরে, কোন এক ফাঁকে তারাও পুরো ঘটনার সাক্ষী হয়ে গিয়েছিল। ম্যাম যখন ফিরে এলেন, তখন একজন বলল, ‘ম্যাম, রবিউল কি ছাড়া পাবে?’ ম্যাম স্মিত হেসে বললেন, ‘মনে হয় না। বাংলাদেশে এ ধরনের আইনের খুব কড়াকড়ি চলছে। মেয়েটির যেহেতু আঠারো বছর হয়নি, তাই ছেলেটি একবার ধরা পড়লে তার ছাড়া পাবার সম্ভাবনা অনেক কম। তাছাড়া মেয়েটির কথা শুনে মনে হল না ছেলেটির প্রভাবশালী কোন আত্মীয় আছে। টাকাপয়সাও হয়তো তেমন নেই। অন্যদিকে মেয়েটির মা তুলনামূলক প্রভাবশালী, শেষপর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে।’ এতক্ষণ মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকা প্রশ্নটা অবশেষে করেই ফেললাম, ‘মেয়ের বাবা মাও তো মেয়েকে আঠারো বছরের আগে বিয়ে দিয়েছে। মেয়েটি যদি এবার বাবা মায়ের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করে, তাহলে কী হবে?’ ম্যাম হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘এমন কিছুই হবে না। দেখলে তো ওদের কাছে বিয়েটা কত সহজ। দুই তিনটা মামলাও ওদের জন্য নতুন কিছু নয়। তোমার কাছে বিষয়টা যত কঠিন মনে হচ্ছে, ওদের কাছে তেমন কিছুই মনে হয় না। আজ একটি ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, দুইদিন পরে মেয়েটি হয়তো আরেকজনের সঙ্গে পালাবে। একটা সময় পর মেয়ের মায়েরও আর মামলা করার ইচ্ছে বা ধৈর্য থাকবে না। এমনই হয়।’
ম্যাম আর কথা না বাড়িয়ে প্র্যাকটিকেল খাতায় সাইন করে দিলেন। আমার খাতাটাও সাইন করা হয়ে গেল। সবশেষে রুম থেকে যখন বেরিয়ে আসার সময় হল, তখন মনে পড়ল আজ সকালে এই প্র্যাকটিকেল খাতা নিয়ে কত দুশ্চিন্তায় ছিলাম! অথচ বেরিয়ে যাওয়ার সময় দুশ্চিন্তার পরিবর্তনে একরাশ অবসন্নতা নিয়ে যাচ্ছি, পুরোটাই সেই অপরিচিত মেয়েটির জন্য। তার নামটাও আমি জানি না। আজ মেয়েটির সামনে যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা সবাই মেয়েটির চেয়ে কমপক্ষে আট নয় বছরের বড়। সবাই বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে এ পর্যন্ত এসেছে। কারো কারো জীবনে হয়তো এরচেয়েও নাটকীয় কোন ঘটনা আছে। আবার কেউ কেউ হয়তো কল্পনাই করতে পারে না মানুষের জীবনে এত ঘটনা ঘটতে পারে! আমরা কেউ কখনো অন্য কারো জীবনের সম্পূর্ণ গতিপথ জানতে পারি না। তাতে অবশ্য কিছু আসে যায় না, জীবন সবসময় নিজস্ব গতিপথে এগিয়ে চলে।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড