• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : নীল অপরাজিতা

  ইয়াসিন আযীয

১৬ জুন ২০১৯, ১৪:২১
গল্প
ছবি : প্রতীকী

আসবো স্যার? কে, রমজান? এসো। স্যার আজ শেষ দিনতো—সব চাইতে বেশি লেখা আইছে। আজ কটা হলো মোট? স্যার, সব মিলাইয়া পঁচিশটা। রাখো, এই টেবিলের ওপরেই রাখো। আর ওখান থেকে পুরনো লেখাগুলোও নিয়ে এসো। জি স্যার, আনতাছি। রমজান বলতে পারো—সব মিলে আমাদের কাছে কটা লেখা জমা পড়েছে? স্যার, আগের হইল গিয়া এক’শ আটানব্বইটা, আর আজকের পঁচিশটা। সব মিলাইয়া দুই’শ তেইশটা। দু-ই’শ তেইশ—বল কী! জি স্যার, আমিতো সব গুইনা গুইনা রাখছি। তাইলে এহন আমি যাই স্যার। সিওর। ও, শোন—সাড়ে দশটার দিকে এসে, আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যেও। মনে হয় আজ আর বাসায় ফেরা হবে না। এতগুলো লেখা হতে, সেরা দশটা লেখা বাছাই করতে হবে। আজ রাতের পর আর সময় হাতে নেই।

কদিন যাবত এত ব্যস্ত সময় যাচ্ছে যে, লেখাগুলো দেখার মতো একটু সময় পেলাম না। এতগুলো লেখা কিভাবে যে পড়ে শেষ করব। তার উপর সম্পাদনার কাজতো আছেই! একটা কাজ করলে কেমন হয়। মাঝখান থেকে কয়েকটা লেখা নিয়ে ‘ভালবাসা দিবস সংখ্যায়’ ভ্যালেন্টাইন’স স্মৃতিচারণ হিসেবে ছেপে দেই? না না, এটা করা মোটেই ঠিক হবে না। এতে হয়ত সেরা লেখাটাই বাদ পড়ে যাবে। এছাড়াও ‘মাসিক আড়াই হাজার পত্রিকার’ সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে। আর যারা কষ্ট করে, যত্ন নিয়ে লেখাগুলো পঠিয়েছে—তাদের সাথে প্রতারণা করা হবে।

যাক এবার শুরু করি। কী! সম্পাদক বানান ভুল। এরা যে নিজেদের কি মনে করে—যত সব। আরে লিখতে চাস, কিছু বই পড়। বই-টই কিছু পড়বে না—একেক জন।

অনেকক্ষণ ধরে সাপ্তাহিক আড়াই হাজার পত্রিকার সম্পাদক, মো. গোলাম কাদের সাহেব, অনেকগুলো লেখা পড়লেন; কিন্তু মনের মত কিছু পেলেন না। অনেকেই গল্প লিখে ফেলেছে—কিন্তু লেখা আহ্বান করা হয়েছিল, ভ্যালেনন্টাইন’স স্মৃতিচারণ নিয়ে।

গোলাম কাদের সাহেব এক গ্লাস পানি খেয়ে—আবার নতুন একটা লেখা পড়তে শুরু করলেন- ‘আমি রাতুল। একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছি। আমি আজ যে স্মৃতিচারণটা করব, সেটা অনেক দিন আগের ঘটনা। আমি তখন অনার্সে পড়ি। আমি যে কলেজে পড়তাম, সেটা আমাদের বাড়ি থেকে তেমন একটা কাছে না, আবার দূরেও না। বেশির ভাগ সময় হেঁটেই যেতাম। কারণ রাস্তা তেমন একটা ভাল না হওয়ায় গাড়ি পাওয়া যেত না ঠিক মতো। আমাদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূর গেলেই একটা উঁচু বেইলি সেতু, ওটা পেরুলেই আমাদের—দুটো মেয়ের সাথে দেখা হতো। আমাদের কলেজ থেকে আধা কিলোমিটার দক্ষিণে যে গার্লস কলেজ ছিল, ওরা সেখানে পড়তো। আমরাও ছিলাম দুজন। একই পথের যাত্রী হওয়া সত্ত্বেও কখনো কথা হতো না ওদের সাথে আমাদের।

প্রভাবশালী দুটি রাজনৈতিক দলের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে আনেকদিন বন্ধ ছিল কলেজ। এর মাঝে আবার, আমার বন্ধুটা ওর মামাদের কাছে ইউরোপ কান্ট্রিতে পাড়ি জমালো। একা একা আমার ভীষণ মন খারাপ। ও ছাড়া আমার আর কোন ভাল বন্ধু ছিল না। যার সাথে জীবনের সব কিছু শেয়ার করা যায়। তাই কলেজ খোলার পরও একা একা যেতে ইচ্ছে করছিল না। পরীক্ষা খুব নিকটে চলে আসায় অবশেষে বাধ্য হলাম। কিন্তু আশ্চার্য ব্যাপার বেইলি সেতুটা পাড় হয়ে কিছু দূর যেতেই দেখি, সেই মেয়ে দুটোর—একজন। আমি ওকে হাঁটতে হাঁটতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। ওর সাথে কথা বলতে, পরিচিত হতে ইচ্ছে করল। জানতে ইচ্ছে করল আমার মতো সেও একা কেন। মেয়েদের সাথে আগবাড়িয়ে কথা বলা, পরিচিত হওয়া—আমার চরিত্রের সাথে কখনোই যায় না। তাই প্রায় একসাথে অনেক দিন যাওয়া আসা করেও আমাদের দুজনের কারোরই একাকিত্ব ঘুচল না। একদিন বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলাম; কিন্তু খুব কাছাকাছি গিয়েও মেয়েটিকে দ্রুত অতিক্রম করে চলে গেলাম—কিছুই বলা হল না। পরের দিন সকালে কঠিন প্রতিজ্ঞা করে বের হলাম—আজ মেয়েটির সাথে কথা বলবোই। কিন্তু সেদিন আর পেলাম না ওকে।

এদিকে আমাদের কলেজের আবৃত্তি পরিষদ, স্বরচিত কবিতা পাঠের আয়োজন করে। সেখানে আমার কবিতা পাঠ করার কথা। তাই দ্রুত যাচ্ছিলাম কলেজের দিকে। পথিমধ্যে মেয়েটিকে চোখে পড়েছে, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে ভুলে গিয়েছিলাম প্রতিজ্ঞার কথা। কখন যে অতিক্রম করে গিয়েছিলাম মেয়েটিকে টেরিই পাইনি।

হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠের ডাক শুনে—পিছন ফিরে তাকালাম। দেখি, সেই মেয়েটি। দেখেই আবার হাঁটতে শুরু করি। আমি বুঝতেও পারিনি, এবং কি বিশ্বাসও করতে পারিনি—আমাকেই ডাকছে। পুনরায় যখন একটু জোরে ডাক দিল—এই যে, শুনতে পাচ্ছেন? এবার আমার ঘোর কাটল। পিছন ফিরে থমকে দাঁড়ালাম। মেয়েটি নিকটে আসতেই বললাম—স্যরি, আপনি আমাকে ডাকছেন—বুঝতে পারিনি।

বুঝতে পারেননি কেন? আপনি ছাড়া কী কেউ আছে এখানে? —বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে হাসিমাখা কন্ঠে বলল, এই নিন আপনার কবিতা বোধ হয়—ডাইরির ভেতর থেকে পড়ে গিয়েছিল। আমি হাত বাড়িয়ে নিলাম ওটা, কিন্তু কোন কথাই আসছিল না ভেতর থেকে। আমি যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে এটুকু বলেই দ্রুত হাটতে থাকি।

অনুষ্ঠানের পর, ফেরার পথে মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। অবশেষে মেয়েটি এলো। আমি এগিয়ে গিয়ে কৃতজ্ঞতার স্বরে বললাম—আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ওটা হারালে আমি কষ্ট পেতাম। মেয়েটি কিছু বললনা শুধু মিষ্টি করে হাসল। আমরা দুজন পাশাপাশি হাঁটছিলাম কিন্তু দুজনেই নীরব। আপনি রাতুল না? নীরবতা ভেঙে মেয়েটি হঠাৎ প্রশ্ন করল। হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানেন কিভাবে? মেয়েটি আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই বলল—আপনার একটা ছবিও আছে আমার কাছে। মেয়েটির কথা শুনে আমি একেবারে থ’মেরে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম, আশ্চার্য বেপারতো আমার নাম জানে, ছবিও আছে! আপনি আমার নাম জানেন কিভাবে? আর ছবিইবা কোথায় পেলেন? মেয়েটি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—আপনার ফুপাত ভাইয়ের ওয়াইফ, মানে আপনার জরি ভাবি—সে আমার বড় বোন পরীর বান্ধবী। জরি আপার বিয়ের সময় আপনি গিয়েছিলেন, আমিও গিয়েছিলাম আমার বোনের সাথে। ওই বিয়ের অনুষ্ঠান থেকেই আপনার নাম জানি। ছবিটাও ওখান থেকেই পাওয়া। আপনি যেহেতু আমাকে চিনতেন, তাহলে এতদিন পরিচয় দেননি কেন? আপনি আমার সিনিয়র। সিনিয়র হয়ে আমাকে আপনি আপনি করছেন, ভালো শুনাচ্ছে না কিন্তু। আমি বুঝতে পারলাম মেয়েটি আমার প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছে। আচ্ছা আপনার, মানে তোমার সাথে যে মেয়েটা ছিল—ও কোথায়? আমি আপনার সামনে থাকা সত্ত্বেও, আমার সম্পর্কে জানতে না চেয়ে আমার বান্ধবী সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন—ওকে আপনার পছন্দ হয়েছিল নাকি? আহা, আগে বলবেন না! ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে—বলেই মেয়েটি এভারেস্ট জয় করার মতো হাসিতে ফেটে পড়ল। ওর কথা শুনে আমি লজ্জায় বিব্রত হচ্ছিলাম। এবার হাসি থামিয়ে বলল—একটু দুষ্টামি করলাম, মাইন্ড করলেন না তো?

কাথায় কথায়, দুজনের একসাথে চলার পথ শেষ হয়ে গেল। ও বিদায় নিয়ে চলে গেল ওর বাড়ি, আমিও চলে এলাম। এরই ফাঁকে ওর নাম-ঠিকানা, কিসে পড়ে—অনেক কিছুই জানলাম। এভাবে একসাথে আসা-যাওয়ার গল্পটা অনেক লম্বা হতে থাকল। ওর সাথে তৈরি হল বন্ধুত্ব। একটি মেয়ের সাথে একটি ছেলের বন্ধুত্বের সম্পর্ক হতে পারে, একথা এর আগে আমি কখনো বিশ্বাস করিনি। অল্প দিনের মধ্যেই আমরা একে অপরের অত্যন্ত কাছের বন্ধুতে পরিণত হলাম। আমরা একে অপরের সাথে সুখ-দুঃখ শেয়ার করতাম—হোক সেটা ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক। একজন আরেক জনকে না দেখলে অস্থির হয়ে যেতাম। স্বভাবতই আমাদের কা¬সের সময় মিলতো না। তারপরও আমরা একসাথেই যেতাম। একসাথে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে হয়ত আগেই বের হতাম; কিংবা ছুটির পর একে অপরের জন্য অপেক্ষা করতাম। উল্টো হওয়া সত্ত্বেও মাঝে মাঝে আমি ওর কলেজের দিকে গিয়ে, ওকে এগিয়ে আনতাম। ওর গানের গলা ছিল অসাধারণ। রবীন্দ্রসংগীত, কী যে যত্ন নিয়ে গাইত না! এখনও যেন আমি কানে আওয়াজ পাচ্ছি, ইন্দ্রাণী সেনের মত ও গাইছেঃ “তুমি যদি সুখ নাহি পাও/ যাও সুখেরি সন্ধানে যাও/ আমি তোমারে পেয়েছি আমার হৃদয়েরও মাঝে/আর কিছু নাহি চাইগো।” ও জানত আমি ভাল কবিতা আবৃত্তি করি, তাই ও আমার কাছ থেকে প্রায়ই আবৃত্তি শুনতে চাইত। কবিতা লিখতেও ও আমাকে উৎসাহ যোগাত। তাই আমার অনেক গুলো লেখা আমি ওকে উৎসর্গ করি। আমার লেখাগুলো পড়ে প্রায়ই ও আমাকে বলত—আপনিতো একদিন বড় কবি হয়ে যাবেন; তখন হয়তো আপনি আমাকে ভুলেই যাবেন। ও আমাকে আপনি করে বলত। তাই আমি বলেছিলাম বন্ধুত্বের মধ্যে আপনি শব্দটা মানায় না। আমাকে তুমি, তুমি করেই বলো। ও বলত, আপনি আমার সিনিয়র—কখনোই আমি ওটা পারব না। আজ লিখতে বসে, ওকে নিয়ে একটা মজার ঘটনা মনে পড়লো, যা না বললেই নয়।

একদিন আমি আমার কয়েক বন্ধু মিলে ক্যাম্পাসের সামনে দাঁড়িয়ে আলাপ করছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা অপরিচিত মেয়ে আমাদের দিকে আসছে। মেয়েটির পরনে নীল রঙের থ্রীপিচ। আর একটু কাছে আসতেই দেখি মেয়েটির কাঁধের ব্যাগ, কানের দুল, পায়ের স্যানন্ডেল, হাতের চুড়ি এবং কি হাতের ডাইরিটা পর্যন্ত নীল রঙের। মেয়েটি সোজা আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর কাঁধের ব্যাগ থেকে নীল রঙের একটা কলম বের করে ডাইরি ও কলম বাড়িয়ে দিয়ে বলল—প্লিজ আমাকে একটা অটোগ্রাফ দিন। আমি কী করব বা বলবো বুঝতে পারলাম না। ঘোরের মধ্যেই ডাইরি ও কলমটা নিলাম। অটোগ্রাফ দিতে গিয়ে দেখি, কলমটি থেকে নীল রঙের কালি বের হচ্ছে! ধন্যবাদ। আপনি ভাল আছেন? হু, ভাল আছি। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক... আমাকে চিনতে হবে না—বলেই কাল-বৈশাখী ঝড়ের বেগে চলে গেল। আমি মেয়েটির চলে যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে, অচেনা রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।

আসলে সেদিন আমার কাছে যে ‘নীল অপরাজিতা’ এসেছিল, সে আসলে বন্ধু বলি আর সহযাত্রী বলি—সেই মেয়েটি। সেদিন ছিল ওর জন্মদিন। তাই আমাকে অবাক করে দেওয়ার জন্য, ওর প্রিয় রঙ নীলে নীলে সেজে একেবারে ‘নীল অপরাজিতা’ হয়ে গিয়েছিল। আর আমি ওর নীলের ফুলঝুড়ি দেখতে দেখতে, চেহারার দিকে তাকানোর সময়ই পাইনি। এই ঘটনার পর, ও আমার সাথে অনেক দিন কথা বলেনি। প্রথমে বুঝতে পারিনি ও কেন আমার সাথে কথা বলছে না। অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে যখন আশা ছেড়ে দিলাম, তখন হঠাৎ একদিন পিছন থেকে ডাক দিল—এই যে মিস্টার, শুনছেন? অভিনয় তো ভালই জানেন দেখছি!

দেখ, আমি কিন্তু তোমার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। আর আমার সাথে কথা না বলে কেনইবা আমাকে কষ্ট দিচ্ছ, তাও বুঝতে পারছি না। আমি আবার আপনাকে কষ্ট দিলাম কবে? বরংঞ্চ আপনিই তো সেদিন আমাকে না-চেনার ভান করে যে কষ্ট দিয়েছেন, তা এখন পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পারিনি! জানেন সেদিন আমার বার্থডে ছিল—কথাটি বলতে বলতে ওর কণ্ঠটা ভারী হয়ে যাচ্ছিল। তাহলে সেদিনের সেই ‘নীল অপরাজিতা’ তুমি ছিলে! আর আমি কিনা... থাক থাক, এখানেও অভিনয় করতে হবে না আপনাকে। বিশ্বাস কর, আমি সেদিন তোমাকে সত্যি সত্যি চিনতে পারিনি। এক সত্যি। দুই সত্যি। তিন সত্যি—বলছি। সত্যমিথ্যা বাদ দেন। সেদিন আমাকে কেমন লেগেছিল সেটা বলেন। বলতে পারব না। কেন? আমিতো সেদিন তোমার নীলের কম্বিনেশন দেখেছি শুধু। তোমার মুখের দিকে তাকানোর সময়ই পাইনি—তাহলে কী তোমার জন্মদিনের আনন্দটা মাটি করে দিতাম! আপনি যে আমার জন্মদিনের আনন্দ মাটি করে দিয়েছিলেন—তাহলে তা বুঝতে পেরেছিলেন? আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললাম—তোমাকে সেদিন কেমন লেগেছিল শুনবে না? ও উৎসাহ নিয়ে বলল—কেমন লেগেছিল? একদম ডানাকাটা নীল পরীর মতোই—আমার বন্ধুরা ঠিক ওরকমই বর্ণনা দিয়েছিল। কী বলেছিল আপনার বন্ধুরা? একজন বলেছিল—কীরে বন্ধু নীল পরীটা আকাশ থেকে নাইমা, সোজা তোর কাছে অটোগ্রাফ চাইল কেন রে? কোনো মন্ত্রতন্ত্র জানছ নাকি! আর একজন বলেছিল আরে বলিস না, ওতো সেদিন স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি কইরা বিখ্যাত হইয়া গেছে, মাগার আকাশের পরীরা পর্যন্ত অটোগ্রাফ চায়! ভেরি ইন্টারেস্টিং। তো আপনি কি বললেন তাদের? আমি তো তোমাকে চিনতে পারিনি—তা না হলে সত্যি কথাটাই বলতাম। সত্যি কথা মানে? - ও অনেক আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল। বলতাম, ও পরী না—পরীর আপন ছোট বোন। কথাটা শেষ না হতেই দুজনে হেসে ফেললাম। আমি হাসি থামিয়ে বললাম—তুমি সেদিন আমার কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিয়ে ছিলে কেন—বলো তো? ও অনেকক্ষণ কি যেন ভেবে তার পর বলল—আপনার কবিতার বিষয়, শব্দের ব্যবহার একদম পাকা কবিদের মতো। একদিন যে আপনিও এদেশের একজন স্বনামধণ্য কবি হবেন—তা আমি নিশ্চিত। আর তখন আমার মতো মানুষ আপনার কাছে যাওয়ার সাহসই হয়ত পাবে না—তাই আগে থেকেই নিয়ে নিলাম।

একটা জিনিস বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি ওকে কখনোই ওর প্রকৃত নামে ডাকিনি। আমি ওকে ডাকতাম নীলা বলে। নীলা নামটা আমিই দিয়েছিলাম। তখন আমাদের দেশে ভ্যালেন্টাইন‘সডে পালন ছিল একেবারে নতুন। যদিও নীলার সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিল না—ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক—যা আগেই উল্লেখ করেছি। আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক পরিপক্কতা লাভের ম্মৃতিটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য আমি নীলাকে ভ্যালেন্টাইন‘সডেতে কিছু গিফট্ দিব—মনস্থির করেছিলাম। তেরো ফেব্রুয়ারি কিছু ফুল, একটা কবিতা ও একটা গল্পের বই, ওর প্রিয় শিল্পীর দুটা গানের অ্যালবাম এবং কিছু চকলেট কিনে, সুন্দর করে প্যাকিং করে রাখলাম। কিন্তু এতেও আমার মন ভরছিল না। আমি ভেবে দেখলাম ওকে দেয়া ফুলগুলো একদিন শুকিয়ে যাবে, বই ছিড়ে কিংবা হারিয়ে যেতে পারে, গানের অ্যালবাম নষ্ট হয়ে যেতে পারে আর চকলেট গুলো খেয়ে ফেলা হবে। কিন্তু ওকে আমার এমন একটা জিনিস দিতে হবে যা কখনো শুকাবে না, ছিড়বে না, হারাবে না, পঁচবে না, গলবে না, পানিতে ডুববে না, আগুনে পুড়বে না অর্থ্যাৎ কোন ভাবেই কোন কিছু হবে না—যতদিন বেঁচে থাকবে মেয়েটি, ততদিন থাকবে আমার উপহারটি। পৃথিবীতে ওরকম জিনিস পাওয়া সম্ভব? - নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম। হ্যাঁ, ওরকম একটা জিনিস আমি পেয়েছিলাম অবশেষে। আমার দেয়া বাইয়ের শুরুর সাদা পৃষ্ঠায় ‘নীলা’ শিরোনামে একটা বিশাল কবিতা লিখলাম ওকে নিয়ে। সেখানে আমি ওকে নীলা নামে ডাকলাম। আর আমার দেয়া “নীলা” নামটি ছিল আমার চোখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার।

ভ্যালেন্টাইন‘সডের দিন গিফট আদান প্রদান শেষে আমি আর নীলা কখনো হেটে, কখনো রিক্সায় চড়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ালাম। আমাদের বন্ধুত্বটা আরও গভীর থেকে গভীরতর হল। এরই মাঝে নীলার ফাইনাল পরীক্ষা নিকটে চলে এলো—যার কারণে ওর ক্লাস সাস্পে- হয়ে গেল। ও বাড়িতে বসেই প্রস্তুতি নিতে থাকল। তাই ওর সাথে আমার দেখা হল না অনেক দিন। অবশেষে ওর পরীক্ষা শুরু হল। পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে, দুদিন গিয়ে আমি ওর সাথে দেখা করে এলাম। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর, ও আমার সাথে একদিন দেখা করে বলল—‘আমি কয়েক দিনের জন্য ঢাকা যাচ্ছি। আপনি ভাল থাকবেন।’ কদিন থাকবা ঢাকায়? এই...ধরুন দশ-বারো দিন। দশ-বারো, দিন! —আমি বললাম।

এরপর দশ মাস কেটে গেল—আমি ওর কোন খবর পেলাম না। ওর রেজাল্ট বের হয়েছিল অনেক আগেই। আমি ওর কলেজে গিয়েছিলাম রেজাল্ট আউটের দিন। ভেবেছিলাম আজ হয়ত দেখা হবে, কিন্তু তাও হল না। ওর রোলটা আমার জানা ছিল—দেখলাম ভাল রেজাল্ট করেছে। নীলার ইচ্ছা ছিল রেজাল্ট ভালো হলে আরও অনেক দূর পড়বে।

আমি আবার সেই আগের মতই একা হয়ে গেলাম। আমার এবারের একাকিত্বটা আরও প্রকট হয়ে দেখা দিল। পৃথিবীটা বড় শূন্য, বড় ফাঁকা মনে হতে লাগল। পড়ালেখা কিংবা কোন কাজেই মন বসে না। হঠাৎ একদিন আমার মনে হলো—নীলা যেহেতু জরি ভাবির বান্ধবীর ছোট বোন, সেহেতু তার কাছে গেলে হয়ত কোন খবর পাওয়া যেতে পারে। প্রায় দৌঁড়িয়েই গেলাম তার কাছে। বললাম বিস্তারিত।

পরীর বোন? ওরতো সেই কবেই বিয়ে হয়ে গেছে। জরি ভাবির কথা শুনে আমার পৃথিবীটা যেন হাজার মাইল বেগে ছুটতে লাগল। কবে? কোথায়? কার সাথে?—নিজেকে একটু সামলিয়ে নিয়েই প্রশ্নগুলো একাধারে করে গেলাম জরি ভাবিকে। জরি ভাবি, ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন—ও যখন পরীক্ষা শেষে ঢাকায় বেড়াতে যায়, এর কিছু দিন পর পরীদের বাসায় পরীর ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে এসে পরির হাজবে-ের এক বন্ধু ওকে পছন্দ করে এবং বিয়ের প্রস্তাব দেয়। অনুষ্ঠানে পরীর বাবা-মাও উপস্থিত ছিলেন। যদিও ছেলের বয়সটা একটু বেশি ছিল, তারপরও ছেলে ব্যবসা করে, ঢাকায় বাড়ি আছে নিজেদের—শুনে ওর বাবা-মারও পছন্দ হয় ছেলেকে। ব্যস তারা কথা দিয়ে ফেলেন। ওর কি, মত ছিল বিয়েতে? না। তাহলে? ও বলেছিল—আমি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করব না। আরও লেখাপড়া করব। তার পর? ওর বাবা বলেছিলেন—লেখাপড়া করবি সে ভালো কথা। বিয়ের পর জামাইকে বলবি, পড়ালেখার ব্যবস্থা করে দিতে। এই কথা শোনার পর, ও গোপনে পরীকে বলেছিল—আপু আমি একটি ছেলেকে পছন্দ করি। তুমি এই বিয়ে ভেঙে দাও। পরী আপা ওর কথা শোনেনি? পরী বলেছিল—তুই যে ছেলেকে পছন্দ করিস সেই ছেলেও কি তোকে পছন্দ করে? ও কি বলেছিল? ও বলেছিল আমি জানি না। তবে আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও—বাড়ি গিয়ে ওর সাথে কথা বলে জানাব। কিন্তু এদিকে পরীর বাবা, দরজার আড়াল থেকে সব কথাই শোনে। তোমাকে আর বাড়ি যেতে হবে না। পাকা কথা দিয়ে ফেলেছি। আমি এককথার মানুষ—আর কিছু বলতে চাইনা। সবাই তাকে ভীষণ ভয় পেত। তাই কেউ কোন প্রতিবাদ করেনি। এর পর একরকম জোর করেই বিয়েটা দিয়ে দেয়া হল। ও, যে ছেলেকে পছন্দ করতো, তুমি কি জানো ভাবি—সেই ছেলেটা কে? জানি। কে ? বাড়ি কোথায়? তুমিই—সেই ছেলে। আমি! তুমি এত কিছু জানো—এতদিন আমাকে বলোনি কেন? বললে, তুমি হয়ত কষ্ট পাবে, তাই বলিনি। এতদিন কি কম কষ্ট পেয়েছি? আচ্ছা ভাবি, ওরা ঢাকায় কোথায় থাকে—তুমি বলতে পার? অফিসের কাজে আমাকে তো প্রায়ই ঢাকা যেতে হয়... আমার কথা শেষ না হতেই ভাবি বলল—তুমি ওর সাথে দেখা করবা এই তো? তার আর দরকার নেই। তোমার পরিচয় নিয়া ঝামেলা বাধতে পারে। ওর স্বামী যদি জানতে পারে তোমার সাথে ওর কোন রকম সম্পর্ক ছিল তাহলে হয়ত ব্যাপারটা... কি হবে?—প্রয়োজনে আমি ওকে নিয়ে আসব।

দেখ তোমরা ছেলেরা যত সহজে কোন কিছু গড়তে পার কিংবা ভাঙতে পার—আমাদের সমাজের মেয়েরা তা এখনো পারে না। ভাবির কাছে ঠিকানাটা পাওয়ার জন্য অনেক রিকোয়েষ্ট করলাম। কিন্তু ভাবি একবার বল্ল আমার কাছে ঠিকানা নেই, একবার বল্ল বিয়ের ছয় মাস পর, ওর স্বামী ওকে নিয়ে স্পন্সারে ইতালি চলে গেছে। তাই বুঝতে পারলাম না—কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা।

জরি ভাবির ঘর থেকে বের হতে হতে ভাবলাম নীলার কোন খবর না পেলেই হয়ত ভাল হত। আর সেদিন থেকেই মনে হল—নীলা আমার শুধু বন্ধুই ছিল না আরও অনেক কিছু ছিল। আসলে মানুষ কোন কিছু না হারালে, তার প্রকৃত মূল্য বুঝতে পারে না। আমিও নীলাকে হারিয়ে বুঝলাম—আমিও ওকে ভালবাসি।

নীলাকে উদ্দেশ্য করে, একা একাই বলতে থাকলাম—নীলা তুমি সেই যে ঢাকা যাওয়ার সময় বলেছিলে—আপনি ভাল থাকবেন। আমি তোমার আশীর্বাদে আজও ভাল আছি। তুমিও যেন তোমার স্বামী, সংসার নিয়ে ভাল থাক—এই কামনা করি। নীলা তুমি যে বলেছিলে আমি বিখ্যাত কবি হলে তোমার কাথা মনে রাখব না। না, আমি কবি হইনি। তুমি চলে যাওয়ার পর আমি আর একটিও কবিতা লিখিনি। বলো, কে শুনবে আমার কবিতা। কে দেবে অনুপ্রেরণা। আমাকে তো তোমার মত করে আর কেউ আজও বুঝতে পারে নি। নীলা তুমি আমাকে ভালোবাস—আগে বলনি কেন? আগে বলনি কেন? আসলে, ও বলেছে—আমি বুঝতে পারিনি! নীলা প্রায়ই আমাকে বলতো—আপনার সাথে কথা আছে; কিন্তু কথাটা যখন বলতো তখন মনে মনে ভাবতাম সামান্য এই কথাটার জন্য ঘটা করে কথা আছে বলার মানে হয় না। আবার মাঝে মাঝে বলত ধ্যাত—আপনি কিছুই বোঝেন না। সেই কথা আছে, কিছুই বোঝেননার মানে—আজ আমি বুঝেছি অবশেষে। না বুঝতে পারলেই হয়ত ভাল হতো।

আসলে আমরা দুজন দুজনকে ভালোবেসেছিলাম ঠিকই কিন্তু মুখ ফুটে বলিনি কোনদিন। আসলে আমাদের দুজনের কাছেই প্রেমের সম্পর্কের চাইতে বন্ধুত্বের সর্ম্পকটাই বড় ছিল। আমরা সেই বন্ধুত্বের সর্ম্পকটাকে কুলষিত করতে চাইনি কখনো।

নীলার কথা বলার সাবলীল ভঙ্গি, মিষ্টি হাসি—আমি কোনদিন ভুলতে পারব না। ও আমার হৃদয়ের অনেকটা স্থান দখল করে ছিলো, আজও আছে, হয়ত আগামী দিনগুলোতেও থাকবে।

রায়হানুল ইসলাম রাতুল শিল্প এলাকা, চট্টগ্রাম। লেখাটা পড়তে পড়তে সম্পাদক সাহেব টেবিলের ওপর মাথা রেখে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড