মুনতাসির বিল্লাহ
১
একটা খুন। এই খুনকে কেন্দ্র করে বদলে দিলো একটা জীবন গল্পের মোড়। ধ্বংস হলো একটা পরিবার। মফস্বল একটা গ্রাম। রহমতুল্লাহ সাদাসিধে একটা মানুষ। বউ বাচ্চা নিয়ে সংসারে ভালোই কাটছিলো এ গ্রামে। গরীব তবে সংসারে সচ্ছলতা ছিলো। নুন আনি পান্তা ফুরই এমন অভাব পেয়ে বসেনি কখনো। গ্রামে তার সচ্ছলতা অনেককেই হিংসায় পুড়িয়ে মারতো। কিছু লোকদের ভালো লাগতো না তার সুখ দেখে । এটা যেন পৃথিবীর চিরচারিত একটা নিয়ম,কারোর সুখ সহ্য না হওয়া। হঠাৎ গ্রামে একটা খুন হলো। গুমোট পরিবেশ। গ্রামের অবস্থা ছমছমে। কিছু কুচক্রী লোক আসামি হিসেবে নাম দিলো রহমতুল্লাহর। চক্রান্তের জালে ফেঁসে গেলো সাদাসিধে খেটে খাওয়া এক দিনমজুর। আর ক্ষমতার জোরে বেঁচে গেলো অদৃশ্য খুনী। মানুষরূপী হায়েনা। ধ্বংস হলো একটা সুখের সংসার। অথচ রহমাতুল্লাহ এর ছয় নয় কিছুই জানতো না। রহমতুল্লাহ ছিলো এতটাই সাদাসিধে, যে নিজেও মেনে নিতে পারছে না তার উপর মিথ্যা অপবাদ চাপানো আর তার শাস্তি হওয়া। জেল খাটা। নিয়তি তবুও মানতে বাধ্য করলো। পুলিশ এসে নিয়ে গেলো রহমাতুল্লাহকে।
২
সাহেরা রহমতুল্লাহর স্ত্রী। সেদিন রাতে হঠাৎ বাড়িতে পুলিশ এসে স্বামীকে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তার চোখে ঘুম নেই।স্বামীকে জামিন করার জন্য একের পর এক উপরের কর্মকর্তাগণকে টাকা বিলিয়েই যাচ্ছে। এভাবে এতো দিনে গায়ে খেটে জমানো সব পুঁজি বিলীন হয়ে গেলো।তবুও সাহেরা থেমে থাকেনি, শেষমেশ স্বামীকে জামিন করে আনলো। কিন্তু ততদিনে স্বামী পাগল। এটাই তার ভাগ্যাকাশে বা গৃবালগ্নে ঝুলানো ছিলো। মানতে কষ্ট হলেও সাহেরার ভাগ্যকে মানতে হলো। পৃথিবীর শুরু লগ্ন থেকেই এ নিয়ম চলে আসছে।
স্বামীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য বের হলো সাহেরা।একে একে তার সম্পদ সব চলে গেলো। বাকি পড়ে রইলো ভিটেমাটি। সাহেরা জিদ ধরে বললো, যেই মাটি আমার স্বামীকে মিথ্যা অপবাদ দিলো। পাগল করলো। সব সম্পত্তি বিলীন করলো। সেই মাটি ছেড়ে আমি চলে যাবো। দূরে কোথাও গিয়ে দরকার পড়লে পরের বাড়ি কাজ করে স্বামীকে নিয়ে চলবো। সাহেরা পাড়ি জমালো ঢাকা। শুরু হলো জীবন যুদ্ধ, বেঁচে থাকার লড়াই। উপার্জন এখনো সীমিত। এর মধ্যে স্বামীকে প্রতি মাসে হাজিরা দিতে হয়, মাসজুড়ে ঔষধ খাওয়াতে হয়,বাসা ভাড়া, বাচ্চাদের নিয়ে সংসার চালানো, এতশত চাপের মুখোমুখি হয়ে সাহেরাকে বদলাতে শিখালো। দৃঢ় সংকল্প করে এটা তার জন্য বেঁচে থাকার লড়াই বলে। সাহেরা সারাদিন বাসায় বাসায় কাজ করে। দিনে দিনে বড় মেয়েটার মাথা গজিয়েছে। তাকে আর বসিয়ে রেখে খাওয়ানোর সচ্ছলতা এ সংসারে নেই। গার্মেন্টসে চাকরীতে পাঠালো। সংসারে ইনকামের হাত আরও দুটো খুলবে সে আশায়। ছোট ছেলে দু’টো পড়াশোনা করে।মা,মেয়ে বাবার হাতে গড়া পুরো সংসার হাতে নিলো। দিনভর কাজ করে সাহেরা আর তার মেয়ে ওভারটাইম কাজও করে, কিছু টাকা বাড়তি ইনকামের জন্য। মা মেয়ের লড়াই থেমে নেই। এভাবে চলছে একটা পরিবারের পাঁচটা মানুষের বেঁচে থাকার গল্প।
৩
কাজ করতে গেলে সাহেরাকে দেখে কেউ বুঝতে পারে না, সে কী কাজের লোক নাকি বাসারই কেউ। স্বর্ণের গহনা যা আছে তাই সব সময় হাতে কানে গলায় পরে রাখে। মুখে থাকে সবসময়ই গাম্ভীর্য একটা ভাব। বাড়তি কোনো কথা না বলে চুপচাপ কাজ সেরে উঠে চলে যায় অন্য কাজে ।তার এই চাল-চালন দেখে প্রায়ই লোকেরা জিগ্যেস করে তুমি কেনো কাজ করো ? তোমার স্বামী কী করে? তোমাকে দেখলে তো মনে হয় না তুমি নিম্ন পরিবারের। কথা গুলো শুনে সাহেরা চুপ থাকে। ফের আঁচল দিয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে বলে, ভাগ্যের জোরে। ইট-পাথরের এই শহরে কতশত চাপা কান্নারা এসে চাপা পড়ে, কেউ দেখে না। দেখেও না দেখার ভান করে। এ ইট-পাথরের শহরে কেউ কারোর জন্য না। কোলাহল এ শহরটা যেন এক নীরবতার শহর। দীর্ঘশ্বাসের শহর।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড