• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ছোট গল্প : ডাকপিয়ন, একটি জীবন থেকে নেয়া গল্প

  আহমেদ ইউসুফ

১৯ মে ২০১৯, ১০:৪৬
গল্প
ছবি : প্রতীকী

সময়টা উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দী মাত্র শুরু তখন, বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে জন্ম এবং বেড়ে উঠা আমার শৈশব। মক্তব শেষ করে সবেমাত্র প্রাথমিকে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয় আমার। গল্পটা প্রাথমিকের সাথেই এমন স্মৃতি বিজড়িত এতটা সতেজ। তখনকার সময়েও স্কুলে যাওয়ার জন্য আমাদেরকে মা কিংবা বাবা স্কুলের অফিসে গিয়ে সেই একদিন ভর্তি করিয়ে দেওয়ার পর আর বৎসরে আরেকবার যেতে হত না। এখনকার সময়ে যেমন মায়েরা স্কুলের গেটের সামনে কিংবা গেস্ট রুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার রীতি প্রচলিত, পাড়াগাঁয়ে তখনও সেটা তৈরি হয় নি। হয়ত বড় শহরগুলোতে কিছুটা লক্ষণীয় হতেও পারে। আমাদের স্কুলটা সামাজিক হওয়ায় এবং সমাজের মানুষেরা এর সকলে ব্যয়ভার বহন করত বিধায় নিয়মনীতিগুলোও অন্য সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একটু ভিন্ন ছিল। প্রতিদিন নিয়ম করে আমাদের দু-বার স্কুলে যেতে হত। তখন আমরা এটাকে বলতাম সকালের ক্লাস, বিকালের ক্লাস। সকালের ক্লাস করে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন দুপুর বারোটার মত বাজত। আবার দুপুর দুইটা নাগাত মা নিজ হাতে পুকুরে গসল করিয়ে খাইয়ে দিয়ে স্কুলে পাঠাত। স্কুল থেকে আমাদের বাড়ি দেড় কিলোমিটারের দূরত্বে হওয়ায় এই পথটুকু প্রতিদিন হেটেই আসা যাওয়া করতাম। মনে পড়ে একসাথে দল বেঁধে কয়েকজন আসা যাওয়া করতাম। তখন আবার যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে বর্বর হামলা চালাচ্ছিল, পুরো বাংলাদেশের প্রায় সকল শ্রেণী পেশার মানুষ খবরের পাতা দেখে বুঝে না বুঝে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের জন্য দোয়া করত প্রতিদিন নিয়ম করেই। মাঝেমধ্যে গ্রাম-গঞ্জে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের মূর্তি বানিয়ে সেটি পুড়ানোর ঘটনা ঘটত অহরহ। দল বেধে আমরাও অংশ নিতাম এসবে, সত্যি বলতে আনন্দ পেতাম এসবে। আর প্রায় স্কুল থেকে আসার সময় মিছিল করতে করতে আসতাম। মিছিলটা ইরাকের এবং সাদ্দামের হোসেনের পক্ষে আর জর্জ ডব্লিউ বুশের মূর্তির গলায় জুতার মালা পরানো পর্যন্ত থাকত, সম্ভব হলে গলা ফাটিয়ে আরো কয়েকবার মিছিলের স্লোগান দেয়া ছিল অতি আনন্দের ব্যাপার।

যাক মূল গল্পে আসি, তখন সকালের ক্লাস শেষ করে দুপুরে যখন প্রতিদিন বাড়ি ফিরতাম, পথে দেখতাম কুচকুচে কালো রঙের বুড়ো একটি লোক নীল রঙের ছোট ফতুয়া ধরনের একটা পাঞ্জাবী গায়ের থেকে খুলে বাম কাঁধে রেখে পরার লুঙ্গিটাকে দু’পাশ থেকে একটু উঠিয়ে কোমরে কুচি দিয়ে ডান কাঁধে একটু ছোট আকৃতির একটি চটের বস্তা (আমাদের গ্রামের ভাষায় সালার বস্তা বলি) নিয়ে কুঁজো হয়ে খালি পায়ে হেটে হেটে আসত। প্রতিদিন রাস্তায় প্রায় একই মোড়ে ওই বুড়োর সাথে দেখা হত। মনে পড়ে বাবা-মা শিখিয়ে দিয়েছিল বড়দের দেখলে সালাম দিতে হয়, তাই স্কুলে আসতে যেতে নিয়ম করে সবাইকে সালাম দিতাম, সাথে এই বুড়োকেও। কিন্তু কথা হচ্ছে যদি কখনও ভুল করেও সালাম দিতে দিতে বুড়োকে পাস করে ফেলতাম! কেন জানি বুড়ো খুব ক্ষেপে যেত। তাই একটু দুরে থেকেই উনাকে সালাম দিয়ে দিতাম। কিন্তু প্রথম প্রথম বুঝতাম না বুড়ো প্রতিদিন ওই চটের বস্তায় কি নিয়ে আসে! কিংবা কেনই আসে। আবার গ্রামের মানুষের মধ্যে তখন আরেকটা চলিত কথার প্রচলন ছিল ‘ছেলে ধরা’, এরা নাকি বাচ্চাদের বস্তা করে ধরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়। তাই বুড়োর উপর মাঝেমধ্যে সন্দেহ হত আবার ভয়ও হত, এই বুড়ো যদি ছেলে ধরা হয়! কিংবা তার কাঁধের বস্তায় বেঁধে যদি আমাকে ধরে নিয়ে যায়!

এদিকে আমাদের স্কুলের পাশে দো-চালা একটা মোটামুটি বড় ঘর ছিল, ওই ঘরের সামনে একটা বড় লাল লোহার বক্স ছিল। সবাই এটাকে ডাকঘর বলত। তখন অতশত বিস্তারিত বুঝতাম না এই ডাক ঘর আসলে কি! কিংবা এর গুরুত্ব কতটুকু বা ডাক বিভাগ আসলে কিভাবে কাজ করে থাকে! এসব ব্যাপারে ছিলাম অনেক টা অজ্ঞ, কিন্তু এটুকুন বুঝতাম ডাকঘরে চিঠি-পত্র আসে, দূরের মানুষদের সাথে যোগাযোগের এটিই একমাত্র মাধ্যম। কারণ দূরে থাকার মধ্যে বড় জেঠু চাকুরীর সুবাদে চট্টগ্রাম থাকতেন মাঝেমধ্যে তিনি চিঠি পাঠাতেন, আর মেজো এবং সেজ কাকু সৌদিতে থাকতেন মাঝেমধ্যে তাদের চিঠি আসত। মনে পড়ে প্রতিদিন তাই নিয়ম করে তখন স্কুল ছুটি হলে ডাকঘরে গিয়ে পোষ্ট মাষ্টারকে জিজ্ঞাস করে নিতাম আমাদের কোন চিঠি আছে কিনা। তখন ওই ঘরে বসে থাকা পোষ্ট মাস্টার লোকটিকে দেখতাম একটা বড় মোট ফ্রেমের চশমা চোখে দিয়ে বড় বড় দু-তিনটা কাঠের তৈরি লম্বা জিনিস দিয়ে দিয়ে চিঠির খামের উপরে জোরে জোরে চাপ দিতেন। ঠক ঠক আওয়াজ এখনও কানে বাজে। তো পোষ্ট মাষ্টার চাচা তার কাজের ফাঁকে পরিচয় জিজ্ঞাস করে তথ্য জানিয়ে দিত, বেশিরভাগ সময়েই হতাশ হয়ে ফিরতাম। কিন্তু কদাচিৎ কখনো যদি একটা চিঠির খবর পেতাম আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত খুশি হতাম। আনন্দে আত্মহারা হয়ে সেদিন দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি যেতাম আর সাথের বন্ধুদের কাছেও সেদিন নিজের গুরুত্বটা একটু বেড়ে যেতে এই কারণে যে 'ওদের চিঠি আসছে' আবার চিঠির খাম দু ধরনের ছিল। একটা দেশীয় খাম আরেকটা বিদেশি খাম। যদি বিদেশী খাম হত, তাহলে সেই আনন্দ আর দেখে কে। বাড়ির রাস্তা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করার আগেই দাদা-দাদু আর মাকে জোরে ডেকে বলতাম, মা মা চিঠি আসছে। সবাই তখন দৌড়ে তাড়াহুড়ো করে চিঠির খাম সযত্নে খুলে চিঠি পড়ত, যেনো প্রিয় মানুষের মুখ থেকেই কথা শুনবে, অনেকদিন বাদে তার দেখা। আবার যিনি পড়তেন মাঝেমধ্যে দুই একটি বাক্য দু-তিনবার করেও পড়ত। আবেগ আর ভালোবাসার গভীর এক মিলনমেলা ছিল। তো আমাদের চিঠি পড়ার ভার থাকত আমার ছোট কাকুর উপরেই। কারণ বাড়িতে বাবা আর ছোট কাকু ছাড়া অন্যরা সুন্দর করে চিঠি পড়ার সাহস দেখাত না, কিন্ত বাবা শিক্ষকতার কারণে সকাল আটটা নাগাত বাই সাইকেল নিয়ে ঘর থেকে বের হতেন আবার ফিরতেন সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাতটার সময়, আবার কখনও আরও পরে। যার সুবাদে ছোট কাকুই চিঠি পড়তেন নিয়মিত। আবার কখনও আশ-পাশের মানুষদের চিঠি পড়ানোর জন্য আমাদের বাড়ি এসে বসে থাকত অনেকে। কারণ চিঠি পড়তে নির্দিষ্ট ব্যাক্তি এবং যোগ্যতা দুই-ই প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে মাঝে মধ্যে কোন কারণে ক্লাস ছুটি হতে একটু দেরি হলে চটের বস্তা কাঁধে ওই কালো বুড়োকে আমাদের স্কুলের সামনে বিশাল মাঠের একপাশে দোচালা টিনের ডাকঘর নামে চেনা ঘরটিতে প্রবেশ করতে দেখতাম। তখন একটু একটু করে ওই বুড়ো সম্পর্কে ভয় কাটে এবং বুঝতে পারি যে বুড়ো হয়ত ডাকঘরের সংশ্লিষ্ট কেউ। একদিন ক্লাস ছুটির পরে চিঠির জন্য ডাকঘরে গিয়ে যখন দেখলাম বুড়ো পাশে এসে দাড়িয়ে কাঁধের বস্তাটা নামিয়ে রাখল। ক্ষণিক পরে তার ওই বস্তা পোষ্ট মাস্টার চাচা খুলে গোটা সত্তর থেকে আশিটার মত চিঠির খাম বের করে নীল। এবং কিছুক্ষণ পরে আরও কিছু সিল মারা চিঠির খাম আবার ওই বস্তায় সযত্নে পুরে দিল। তারপরে ওই চটের বস্তা সম্পর্কে বুঝতে পারি এবং বুড়ো সম্পর্কে ভয়ভীতিটা কেটে যায়। তখন শুধু ওই বুড়োকে বাবা মায়ের শিখিয়ে দেওয়া সালাম দিতাম। কিন্তু এখন খুব মনে পড়ে উনার কথা। লোকটা অনেক দূর থেকে হেটে হেটে আসত। অজানা এক গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ওই কালো কুচকুচে বুড়ো লোকটিকে আরেকবার সালাম দিতে খুব ইচ্ছা করে।

যুগ পাল্টে তখন আস্তে আস্তে আমি আর ডাকঘরে যেতাম না, পরে পোষ্ট মাষ্টার মাঝেমধ্যে বছরে দুএকবার চিঠি নিয়ে বাড়ি আসতেন। এর পর এক সময় আর চিঠি আদান প্রদান হয়ে উঠে নি। প্রিয় ডাকঘরের দরজায় সেই কবে একটা বড়সড় ঝুলন্ত তালা দেখেছি, কিন্তু আর কাউকে খুলতে দেখি নি। কারণ এখন খুব সহজেই দূরে থাকা প্রিয় মানুষগুলোকে আমিও জানতে পরি। এমনকি ইচ্ছা হলে দেখাও সম্ভব। কিন্তু সেই আবেগ, একটি চিঠির খামে লেগে থাকা হাতের স্পর্শের মায়া, চিঠি হাতে নিয়ে কয়েকবার চুমু খাওয়া এবং কালো বুড়ো লোকটিকে আর খুঁজে পাই নি।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড