• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

প্রবন্ধ

‘নিঃসঙ্গ পথিক’ ইতিহাসের হীরকখণ্ড

  খোরশেদ মুকুল

২৭ এপ্রিল ২০১৯, ১৫:৫১
প্রচ্ছদ
প্রচ্ছদ : উপন্যাস ‘নিঃসঙ্গ পথিক’

ইতিহাসকে গল্পের কাঠামোতে নিয়ে আসা অনেক জটিল এবং সাহসের কাজ। আর তা যদি শুধু ইতিহাস আশ্রিত না হয়ে নিরেট ইতিহাসের আলোকে হয়ে থাকে তখন বিষয়টি আরও জটিল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ গল্পের রয়েছে নিজস্ব গতিময়তা। যা নির্দিষ্ট সূত্র ধরেই আগায়। অন্যদিকে ইতিহাসের আখ্যান নির্দিষ্ট হয় ইতিহাসের নিজস্ব অনিবার্যতায়। ফলে ইতিহাসের সঠিক-নিরপেক্ষ জ্ঞান এবং সাহিত্যের রস এখানে খুবই জরুরি। উভয় বিষয়ের অপূর্ব সমন্বয়ের নাম কবি ও প্রাবন্ধিক বাপ্পা আজিজুলের জীবনোপন্যাস ‘নিঃসঙ্গ পথিক’। আবু যার গিফারির জীবনী নিয়ে লেখা। তবে সন-তারিখভিত্তিক গতানুগতিক নয়। উপন্যাস এবং জীবনীগ্রন্থের নান্দনিক মিশেল বলা চলে। লেখকের এমন নিরীক্ষণ সাহিত্যে ঢের অপ্রতুল।

গদ্যের রীতি ছন্দের আবেশ। ছোটছোটো বাক্য। ঐতিহাসিক ঘটনার নির্মোহ বিশ্লেষণ। মানবমনের ব্যবচ্ছেদ। শব্দের দ্যোতনা প্রভৃতি বিষয় উপন্যাসকে সার্থক করে তুলেছে। এতে পাঠক একসাথে ইতিহাস জ্ঞানের পাশাপাশি সাহিত্যের অমৃত পানে মুগ্ধ হবে বলেই আশা করি।

আবু যার গিফারি আজীবন স্রোতের বিপরীতে চলা একজন নির্বিক অথচ সরল প্রকৃতির মানুষ। সরল, সাদাসিধে, দুনিয়া বিরাগী ও নির্জনতা প্রিয় স্বভাবের কারণে আল্লাহর রাসুল তাঁকে মসিরুল ইসলাম উপাধিতে ভূষিত করেন।আল্লাহর রাসুলের প্রিয় সাথী। সত্যের সাথে কখনও আপোস করেনি। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করলেও অন্যায় দেখলে দাঁড়িয়ে যেতেন শিলাদৃঢ় হয়ে। এরকম ব্যতিক্রমী এবং সত্যপ্রিয় সাহাবির জীবনী নিয়েই এগিয়েছে নিঃসঙ্গ পথিকের ঘটনাপ্রবাহ। কাহিনী বিন্যাসের পরতে পরতে উঠে এসেছে আবু যার গিফারি বর্ণিত আটাশটি হাদিস। তাছাড়া সবচে’ আশ্চর্যের বিষয় উপন্যাসে আল্লাহর রাসুলকে সম্বোধন করার সময় প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভিন্ন বিশেষণ ব্যবহার করেছেন লেখক। প্রায় ত্রিশটির মত বিশেষণ ব্যবহার করেছেন আল্লাহর রাসুলের শানে। তবে তার মধ্যে সবচে’ ব্যতিক্রম এবং বাংলাভাষায় নতুন সংযোজন হচ্ছে ‘অনাথ অনুপম মুক্তো’। এছাড়া সময় এবং ঘটনার প্রেক্ষিতে উঠে এসেছে তিন খলিফার আলোক বিচ্যুরণ।

সত্যকে গ্রহণ করার প্রবল ইচ্ছেই যুবক আবু যার গিফারিকে দস্যু সর্দার থেকে বানিয়েছে সোনালি যুগের সোনার মানুষ। নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। এমন মনের কথা বলতে গিয়ে শুরুতেই লেখক উল্লেখ করেন- ‘প্রত্যেক হৃদয়ের একটি বোধশক্তি আছে। যেমন জ্ঞানের থাকে যুক্তি। জ্ঞানের অনুপস্থিতিতে অনেক সময় হৃদয়ের এই বোধ মানুষকে পথনির্দেশ করে। আবার বোধের বিনাশে কোন কোন জ্ঞান মানুষকে বিপথগামী করে। খোঁড়াযুক্তির মারপ্যাঁচে সে বধিরের ন্যায় আচরণ করে।’ সত্য গ্রহণে তৃষিত হৃদয় সহোদর উনায়সের কথায় তৃপ্ত হতে না পেরে আবু যার নিজেই মক্কা রওনা দেয় প্রিয় নবীর সান্নিধ্য লাভের জন্য। সেখানে দেখা হয় আলি ইবন আবি তালিবের সাথে। তিনি আবু যারের পরিচয় পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয় এবং ষষ্ট স্নায়ু সজাগ করে পরখ করে জুন্দবকে। কারণ তখন খুব গোপনে চলছে ইসলামের দাওয়াত। লেখকের ভাষায়- ‘সাফা পাহাড়ের দক্ষিণ চূড়ায় আড়ালে আবডালে চুটিয়ে চলে ইসলামের আহবানের কাজ। অনেকটা নিভৃতে মুক্তো যেমন শামুকের মূল্যবান হয়ে ওঠে। হিমশৈলকে যেমন উপরিভাগ দেখে আন্দাজ করা যায় না। উদ্ভিদের শেকড় যেমন ক্রমাগত প্রোথিত হয় গভীর থেকে গভীরে।’

ইসলামের দাওয়াত গোপনে চললেও সত্যের দুর্নিবার শক্তি থামাতে পারেনি আবু যারকে। কাবার কাছে কুরাইশদের আড্ডায় প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলেন একত্ববাদের দাওয়াত। এতে অবিশ্বাসীরা বিদ্যুতবেগে তেড়ে আসে। রক্তাক্ত করে আবু যারের দেহ। এতে নিরাপত্তার কথা ভেবে রাসুলে খোদা আবু যারকে নিজ গোত্রে ফিরে যাওয়ার নসিহত দেন। সেখানেও চলে তাঁর দাওয়াতি কাজ। আখেরি নবী আল্লাহর নির্দেশে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেন। সেখানে খন্দকের যুদ্ধের পর আবু যার অনুমতিক্রমে প্রিয়নবির সাহচর্য লাভ করেন। নাম লেখালেন আসহাবে সুফফায়।

আবু যারের পিপাসার্ত হৃদয় সবসময় আল্লাহর রাসুলের সংস্পর্শ কামনা করত জ্ঞানের পিয়াস মেটানোর জন্য। যার দরুন নানা বিষয়ে ইতিহাস জ্ঞান, শরিয়তের হুকুম-আহকাম এবং নসিহত খুব সহজেই তিনি পেয়ে যেতেন। সমৃদ্ধ হয়েছেন নিজে, সতর্ক করেছেন দেশ ও জাতিকে।

রাসুলে কায়্যিনাতের মৃত্যুতে আবু যার একেবারে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এমনিতেই খুব সাদাসিধে-সরল প্রকৃতির। তার উপর রাসুলের মৃত্যুতে একদম চুপচাপ হয়ে যান। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা ছেড়েই দিয়েছেন।

নবিহীন টাল-মাটাল অবস্থায় যখন আবু বকরের খিলাফতকালে নিরবতা ভাঙে আবু যার। অবতীর্ণ হন শিক্ষকের ভূমিকায়। আবু বকর ছিলেন নবীর বাল্যবন্ধু, নবীর শ্বশুর এবং খলিফাতুর রাসুল। জাহেলি যুগের উজ্জ্বল শশী। লেখকের ভাষায়- ‘ইসলাম জাহিলিয়াতের অন্ধকার খনি থেকে যে শতশত মণিমুক্তা আহরণ করেছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান, ওজনদার ও কার্যকরী কোহিনূর রত্নটি আবু বাকর।’

আবু বাকরের মৃত্যুর পর খলিফা হন উমার। এরপরে উমরের স্থলাভিষিক্ত হন সম্পদশালী এবং সজ্জন ব্যক্তি উসমান ইবন আফফান। সেক্রেটারি নিযুক্ত হন সদ্য কৈশোর পার হওয়া মারওয়ান ইবন হাকাম। যার পিতাকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে মদিনা থেকে বের করে দেন প্রিয়নবি। সাথে যায় শিশুপুত্র মারওয়ান। মিশর ও উত্তর আফ্রিকা থেকে প্রাপ্ত জিজিয়ার পাঁচ লাখ দিরহাম তার নামে বরাদ্দ হয়। তার ভাইয়ের নামে তিনলাখ এবং যায়িদ ইবন সাবিতের নামে বরাদ্দ হয় এক লাখ দিরহাম। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে এমন বরাদ্দে অন্যান্য সাহাবির মত আবু যারও চরম বিস্মিত হন। তাছাড়া আবু যারের দেয়া নসিহত জনমনে খুব সাড়া ফেলে। এতে বিপাকে পড়ে হযরত উসমান। তাই বাধ্য হয়ে সিরিয়া পাঠিয়ে দিলেন আবু যারকে।

সিরিয়ার দায়িত্বে ছিলেন মুয়াবিয়া। ইতিহাস পাঠে উসমান-মুয়াবিয়ার যে উত্তপ্ত সম্পর্কের কথা জেনে আসছি লেখক এখানে সেটা অতিশয় শীতল করেছেন। যা নির্মোহ ইতিহাস পাঠের ফসল হিসেবেই ধরা যায়। ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।’ সত্যপ্রচারে বিরত হলেন না আবু যার। ফলশ্রুতিতে চক্ষুশূল হয় মুয়াবিয়ার। তাছাড়া ইসলামি অর্থনীতি নিয়েও চলমান নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ায় আবু যর। যার কারণে নাজুক পরিস্থিতি ঠেকাতে আবু যরকে সিরিয়া ছেড়ে রাবজায় বসবাসের অনুমতি দেয় তৃতীয় খলিফা।

কিছুদিন পর আবু যর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ‘আল্লাহ আবু যারের উপর রহম করুন। সে একাকী চলবে, একাকী মারা যাবে, এমনকি একাকী উত্থিত হবে’- রাসুল সা: এর এই ভবিষ্যৎ বাণী সত্য প্রমাণিত হয় আবু যারের এই একাকী মৃত্যুর মাধ্যমে। বিশ্বাস এবং আমলের দিক থেকে অটল থাকা সত্যপথের সৈনিক আবু যারের এমন মৃত্যু আমাদের জুগিয়ে যায় নীতির পক্ষে আজীবন লড়ার হিম্মত।

ওডি/এসএন

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড