মামুন সোহাগ
আজ আসিফ সাহেবের ছোটবেলার, দুরন্ত সেই শৈশব কৈশোর কাটানো স্মৃত গুলো খুব মনে পড়ছে। শহরের কাছেই সেই ছোট গ্রাম। গ্রাম ধরে বেয়ে চলা চিত্রানদী। ছোট্ট গ্রামের বড় বাজার, হাটের দিন কত যে জমজমাট হতো। মায়ের কাছে হাজারো বায়না ধরে দুই টাকা নিয়ে বাজারে গিয়ে বন্ধুদের সাথে মজা করে পিয়াজি ভাজা আর হাতি ঘোড়া মিষ্টি খাওয়া।
ঝাপসা ঝাপসা স্মৃতি, অনেক দিন বাদে মনে করতেও কষ্ট হচ্ছে। আসিফ সাহেব চশমাটা খুলে, ইজি চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিলেন। তার মনে পড়ছে বাজারের পাশে স্কুল, স্কুল মাঠে গাড় লাল সূর্য বুকে নিয়ে দাড়িয়ে আছে শহীদ মিনার। রোজার ঈদে বাড়িতে গিয়ে দেখেছিল স্কুলে নতুন দোতলা বিল্ডিং হয়েছে। আসিফদের সময় এই দোতলা বিল্ডিং, এই শহীদ মিনার ছিলোনা । তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে লেখাপড়ার যে উন্নতি হয়েছে, ক্লাসে ক্লাসে কম্পিউটারের ব্যবহার হচ্ছে, তখনকার দিনে এসব চোখেই পড়ত না । শহরে গেলে অবশ্য দুয়েক স্কুলে যদিও দেখা যেতো, তবে তাদের জন্য সেটা খুব দুরহ ছিলো ।
আসিফের সাহেবের চেম্বারে যখন গ্রামের সহজ সরল মানুষেরা আসে, তখন সে আর নিজেকে সামলাতে পারেনা। জগতের প্রতিটি মানুষ স্মৃতি প্রেমী। স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে চাই সবাই। অনেকে নিজ স্মৃতিকে অন্যমানুষের মাঝে জীবন্ত করে দেখতে চাই। ঠিক সেভাবেই শৈশবে ফিরে যায় আসিফ, কল্পনায়, আহা! কত যে আনন্দের স্মৃতি! স্মৃতি গুলো যেন এখনও নতুন ।
আসিফ যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে, বৃত্তি পরীক্ষা দিবে। বাবা গফুর মিয়া দিনমজুর পরের জমিতে লাঙল চষে। মা রাহেলা বানু দিনের বেশীরভাগ সময় পরের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। গফুর মিয়া সারাদিন ভূতের মত খেটে যা আয় করে, তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরায় এর অবস্থা। রাহেলা বানুও বসে থাকেনা তাই। সারাটা দিন চলে বিরামহীন দুজনেরই পরিশ্রম।
একদিন দুপুরবেলা বাড়ির মোরগটা রান্না করে রেখে কাজে গিয়ে ছিলো রাহেলা। মা রাহেলা ভাবছে, ছেলে মজা করে খাবে। সেই যে কবে গ্রামের মরহুম রফিকউদ্দিনের চল্লিশাতে দু’টুকরো মাংস দিয়ে পেট পুরে ভাত খেয়েছিলো, ছেলে বোধয় সেটাও ভুলে গেছে। মনে থাকবেই বা কি করে মাঝেমধ্যে তো বাড়িতেও জোটে না দু’টুকরো মাংস।
আজ বাড়িতে কেউ নেই। আসিফ স্কুলে গেছে, ওর বাবা মাঠে গেছে কাজে। তোড়জোড় করতে গিয়ে সেদিন ঘরের সিকেতে মাংসের হাড়িটা রাখতে ভুলেই গিয়েছিলো রাহেলা। খুব ভোরে ছেলেকে ঘুম থেকে ডেকে দেবার সময় বলেছিলো, ‘আসিফ যে মোরগটা সকাল সকাল তোর ঘরে পায়চারি করে বেড়ায় সেটার আজ দফারফা হবে রে, তুই পেট পুরে খাবি’।
আসিফের সাথে বলা ঐ ভোর বেলার কথাটা আর সত্য হয়নি। পাশের বাড়ির বেড়াল দু’টো চেটেপুটে সব মাংস শেষ করে ফেলেছে। হাড়ির তলানিটা জমে আছে মাত্র। তারপর বহুদিন চলে গেছে, আসিফের আর মাংস খাওয়া হয়ে ওঠেনি। দারিদ্রতা মানুষকে বাঁচতে শেখায়, ঢুকরে ঢুকরে কেঁদে বালিশ ভেজানো আবেগ না দারিদ্র্যতা। তীব্র প্রতিজ্ঞা নিয়ে বাঁচতে হয় প্রতিটা দারিদ্র্যের। সেসব প্রাকৃতিক ভাবেই শিখে যায় আপনা-আপনিই।
এইতো আসিফদের সংসার। চলছে, খারাপ কিসে! দুঃখগুলোকে ছেলের সামনে এক মুখ হাসি দিয়ে উড়িয়ে দেবার জন্য একধরনের নিয়ম হয়ে যায় গফুর- রাহেলার। তারা কখনো আসিফকে কষ্টের ভাগ নিতে বলেনি। কখনো মাঠে লাঙল টানতে যেতে বলেনি, একবেলা পরের বাড়ির বাজার করে দিতে পর্যন্ত বলেনি মা। ঝড়-ঝাপটা, জ্বর-কাশি যতই আসুক না কেনো, রাহেলা বিরতিহীন কাজ করেছে। গফুর মিয়াও লাঙল কাঁধে মাঠে গেছে।
স্বপ্ন একটাই, আসিফ বড় হোক। তাদের স্বপ্ন তাদের ছেলে ডাক্তার হবে। মানুষের মত মানুষ হবে। পাশের গ্রামের ডাক্তার বাবু যখন টাকার জন্য গফুরের ইনজেকশন দেয়া বন্ধ করে দেয় তখন, সে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলো জীবনের মানেটা আসলে কি। কতটা হিংস্র হলে মানুষ মানুষকে পশু ভাবতে পারে। এরা কুকুর শেয়ালের সাথে করা আচরণগুলোরও পূর্ণরূপ দিতে পারে।
এদিকে ধীরে ধীরে ভেতরে থাকা রাহেলা-গফুরের রোগগুলোও শরীরে বিস্তার হতে লাগলো। সন্তানকে ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার বানাবার স্বপ্ন কে না দেখে। যে ছেলেটা মামার চায়ের দোকানে চা-বিস্কুট দেয়, পানি টানে ওর বাবা-মাও চেয়েছিলো। ছেলে ওমুকের মত ডাক্তার হোক, ইঞ্জিনিয়ার হোক। যে মেয়েটিকে রোজ যাত্রাপালার গানে অর্ধ নগ্ন হয়ে নাচানাচি করতে দেখা যায় তার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। রাহেলা -গফুর শত কষ্টেও সন্তানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।
কিন্তু ভাগ্যও আবার সমান হয়না সবার। আসিফের মতো সবার ভাগ্যে রাহেলা-গফুরের মত বাবা-মা জোটে না। নিয়তি আসিফকে কোন দিকে নিয়ে যাবে সেটা তখনও সে জানে না, জানেন না রাহেলা-গফুরও। তবুও তারা চায় অাসিফের ভালো হোক, ও ডাক্তার হোক। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফরম পূরণের জন্য সবার টাকা জমা পড়ে গেছে, আসিফের বাকি। সেদিন স্কুল থেকে হেড স্যার আসিফকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন টাকা না দিলে এবার কোনোভাবেই আর পরীক্ষার সুযোগ পাবে না আসিফ। হেডস্যার অনেক দেখেছে আর সে পারবেনা। বোর্ডফিটা তো অন্তত দিতে হবে।
এদিকে বাবার বাম পা বেশ-কিছুদিন নড়াচড়া করানো যাচ্ছে না, তিনি খুব অসুস্থ। কাজকর্ম করতে পারছেনা। মা একাই কোনরকমে সংসার কোনরকমে চালাচ্ছে। পাড়ার লোক সবাই বলাবলি করছিলো গফুরের প্যারালাইজড হয়ে গেছে। কাঁচা বাঁশ দু’ফালি করে চিরে, তাতে পেরেক মেরে ভর করে হাটাহাটি করে চলে গফুর, চারিদিক শুধু অভাব আর অভাব আসিফদের সংসার। আসিফ নিয়ম করে প্রতিরাতে কাঁদতে শুরু করে। তাকে পড়তে হবে। পরীক্ষা দিতে হবে, যেভাবেই হোক। পরের বাড়ি কামলা দেবার সিদ্ধান্ত নেয় আসিফ। যারা কামলা নিতে ইচ্ছুক তারা সব শুনে আগে টাকা দিতে চেয়েছে। নির্দিষ্ট ক’বছরের হিসেব বেধে দিয়েছে অবশ্য তাকে, এতদিন সে এ বাড়ি ছাড়া আর কোথাও যেতে পারবেনা। খুব বেশী সুবিধে অসুবিধে হলে বিবেচনা করে দেখা যাবে।
বাড়িতে জানালে আসিফের মা কোনোভাবেই সেটা মেনে নিতে পারেনি। নিজের রক্ত বিক্রি করে হলেও টাকা আনবে, যেভাবেই হোক আনবে, আনবেই। তবুও ছেলেকে কাজ করতে দিবেনা, পড়াশোনার ক্ষতি হোক সেটা তিনি চাইনা। প্রতিশ্রুতি দেয় ছেলেকে। ছেলের পরীক্ষার টাকা জোগাড় করবার জন্য মায়ের খাওয়া-ঘুমে ছুটি পড়ে গেছে। স্বামী সংসারের দিকে চোখ দেবার সময় কোথায়। সেদিন সন্ধ্যা বেলা কাজ শেষে রাহেলা বাড়ির মালিকের কাছে কান্নাকাটি করে শর্তসাপেক্ষে ৫০০ টাকার জোগাড় হলো। মালিকের শর্ত ছিল মাইনে কম নিতে হবে এখন থেকে, তিন ভাগের এক ভাগ কম। শেষমেশ আসিফ পরীক্ষা দিতে পারলো।
মাস তিনেক পর আসিফ একদিন বাসায় এসে চিৎকার করে- ও মা, মা! বাবা কোথায়?
মা বলে কেন, কি হবে? দেখ মনে হয় ও বাড়ি গেছে লাঠি ভর করতে করতে। সারাদিন শুয়ে বসে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে গেলো। মা বাবাকে ডাক দাও এখনি। খুব দ্রুত ডাক মা। বাড়িতে একটু চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে গফুর মিয়া ছুটে এলো। ছেলের চোখে মুখে অন্যরকম রূপ নিয়েছে। মনে হচ্ছে, হাসতে গেলে কেঁদে ফেলবে কিংবা কাঁদতে গেল হেসে দেবে, গফুর বলে, ‘কিহ, কি হয়েছে? চিলাচ্ছে কেন আসিফ?’
তৎক্ষণাৎ আসিফ জোরালে কন্ঠে বলে ওঠে, ‘বাবা আমি যশোর বোর্ডে ফার্স্ট হয়েছি।’
- ফার্স্ট কি রে বাবা? তুই পাস করেছিস তো?
- হ্যাঁ বাবা, পাস করেছি। সাইন্স থেকে যশোর বোর্ডে আমিই ফার্স্ট। আসিফ আর নিজেকে সামলাতে পারেনা। হাউমাউ করে কেঁদে বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। রাহেলা খুশিতে আত্বহারা হয়ে ওঠে।
তৎক্ষণাৎ মা রাহেলা বলে ওঠে, ‘বাবা তুই কিন্তু ডাক্তার হবি। তোর পড়ার খরচ চালানোর জন্য আমি সকাল সন্ধ্যা চাতালে কাজ ঠিক করেছি। দেখো আসিফের বাবা আসিফ একদিন সত্যি সত্যি ডাক্তার হবে। অনেক নাম করবে।’
ঠিক এই মুহূর্তে রাহেলা কাজ করা ঐ বাড়িটার কথা মনে পড়ছে। ও বাড়ির ছেলে মাধ্যমিকে পাস করলে পুরো পাড়াতে মিষ্টি বিতরণ হয়েছিলো। রাহেলকও যদি সবাইকে অমন করে মিষ্টি খাওয়াতে পারতো!
ঘরের এক পোয়া চাল ফুরিয়ে গেলে কার বাড়ি ধার চাইতে যাবে সি চিন্তাতে মগ্ন গফুর মিয়া। এভাবে চলে গেছে বহুবছর। বেড়েছে আসিফের বয়স, বাবা মাও চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। বেড়েছে একটু একটু করে স্মৃতির ভার।
এখন আসিফ ঢাকাতে থাক । বাবা-মায়ের ইচ্ছে আর অপূরণ নেই, নামের আগে ডাক্তার শব্দ যোগ হয়েছে আসিফের। সংসার আজ সুখের। আছে সহধর্মীনি নীলা এবং তার কোলে চার বছরের ছেলে অর্ণব। আসিফের মনে অনেক কষ্ট আছে, চাপাকষ্ট। দারিদ্রতার শিক্ষায় বাবা-মা’র বড্ড বেশিই অভাববোধ করে আসিফ। তার চেম্বারে গ্রাম থেকে কোনো মানুষ এলে সে যেনো স্বর্গ ফিরে পায়। বিনামূল্যে তাদের চিকিৎসা করে। বাবা মায়ের আত্মার শান্তি কামনা করে। এইতো জীবন।
আসিফের বাচ্চাটা দৌড়ে এসে বাবা বাবা ডেকে ওঠে। ছেলের মুখে বাবা ডাক শুনে মনে পড়ে, তার সেই বাবা ডাকটার কথা। আসিফের নিজের অজান্তেই চোখের কোণ বেয়ে দু‘ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ে। তার মনে হয় প্রতিনিয়ত তার মতো হাজারো আসিফের জন্ম হয়, শুধু জন্ম হওয়া প্রয়োজন রাহেলা-গফুরের মতো বাবা-মায়ের।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড