রোকেয়া আশা
একটা বোলতা ঢুকে পড়েছে ক্লাসরুমে। অনিতা ম্যাম ভয় পেয়েছেন বোঝা যাচ্ছে, যদিও তিনি হাসছেন থুতনি উঁচু করে। নার্ভাস হাসি। আমি বোলতার দিকে তাকাচ্ছিনা একবারও। একবার ম্যামের দিকে তাকাচ্ছি, একবার পুরো ক্লাসের দিকে। ক্লাসে মৃদু গুঞ্জন, বোলতার শব্দ না। মানুষের শব্দ। ক্লাসে মোট উনচল্লিশ জন ছেলেমেয়ে বসা। সতেরোটা ছেলে, বাইশটা মেয়ে। আমাকে হিসাবে ধরলে চল্লিশ জন হয়। কিন্তু আমি আমাকে হিসাবে ধরছি না। কারণ আছে। কেউই আমাকে তেমন হিসাবে ধরেনা। এই সাতশো একরে আমি অযাচিত।
অনিতা ম্যাম কালো একটা সুতি শাড়ি পরে এসেছেন; পাড় সবুজ। কালো ব্লাউজ। কপালে মাঝারি আকারের একটা সবুজ টিপ। আমার মনে হচ্ছে সবুজ ব্লাউজ পরলে বেশী মানাতো। অবশ্য এমনিতেও খারাপ লাগছে না, ম্যাম ভীষণ সুন্দরী। এই একান্ন বছর বয়সেও তাকে দেখে সাতাশ কি আটাশ বছরের মনে হয়।
ক্লাসভর্তি গুনগুন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না; ম্যাম বুঝলেন। তিনি চট করে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন। বোলতাটা বেরিয়ে যাক। গেলোও, ধীরে। কোন তাড়াহুড়ো নেই বোলতাটার। আমি বোর্ডের দিকে তাকাই। পুরো হোয়াইট বোর্ড জুড়ে অনেক তাত্ত্বিকের নাম, তাদের নামের পাশে এরো দিয়ে একটা করে শব্দ বা শব্দগুচ্ছ। ধর্মের সংজ্ঞা। বিভিন্ন তাত্ত্বিক খুঁজে গেছেন এই সংজ্ঞা। দিয়েছেন, কোনটা কি ধ্রুব? না।
বোলতাটা, হলুদ রঙের। কেমন ধীরে ধীরে উড়ে বেরিয়ে গেলো। জীবন কি এমন?
একটা দেজা ভ্যুঁ মতন হতে থাকে আমার; এখন কিংবা এখন থেকে কয়েক শতাব্দী আগে বা পরে কোথাও - একটা এমন হলদে বোলতা একটা কোন ঘরে ঢুকে পড়েছিলো হয়তো। সেখানে কেউ ওর বেরিয়ে দেয়ার জন্য দরজা খুলে দেয়নি। বেচারা বোলতাটা ফ্যানের ব্লেডে কাটা পড়ে মরে ছিলো কোথাও। কোথাও একটা আমরাও বোলতাটার মত। একটা ঘরে অবাঞ্ছিত হয়ে ঢুকে পড়ি; তারপর আর বের হওয়ার রাস্তা পাই না। যেদিক দিয়ে ঢুকেছি, সেখান দিয়ে বের হতে পারি না। কেউ অনিতা ম্যামের মত দরজা খুলে দিলে বের হতে পারি, নাহলে তীব্র গতিতে ঘুরতে থাকা ফ্যানের ব্লেডে কাটা পড়ি।
ক্লাসের গুঞ্জন থেমে গেছে, ম্যাম তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। মুখ হাসি হাসি। আমাদের রিলিজিওন স্টাডিজ পড়ান তিনি। থার্ড ইয়ারে ওঠার পর এটা ম্যামের দ্বিতীয় ক্লাস। ফার্স্ট ইয়ারেও একবছর তিনি ক্লাস নিয়েছেন, সেকেন্ড ইয়ারে নেন নি। অনিতা ম্যাম হাসিমুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তাহলে বলো তো, ধর্ম কি?’ আমি চুপই থাকি এখন, আগে অবশ্য অত চুপচাপ থাকতাম না। ছটফট করতাম খুব। এখন করি না। অনিতা ম্যামের প্রশ্নটা খুব ভাবাচ্ছে আমাকে। ধর্ম আসলে কি? অয়নের গলা কানে আসছে আমার; বোধহয় ধর্ম নিয়ে ম্যাক্স ওয়েবারের তত্ত্বটা বলছে। ম্যাম অবশ্য ওয়েবার বলেন না। তিনি বলেন ‘ভেবার’। ইংরেজির ডাব্লিউ, ফ্রেঞ্চ উচ্চারণে ভ। অয়ন ক্লাসের সম্ভবত সবচে স্মার্ট ছাত্র। সম্ভবত বলাটা ঠিক হয়নি। নির্দ্বিধায় বলা যায়। ডিবেট করে ছেলেবেলা থেকেই, খুব মাল্টিটাস্কার একটা ছেলে হয়েও বরাবরই রেজাল্ট প্রথম সারিতে। এধরণের পারফেক্ট ছেলেদের সাধারণত সমবয়সী অন্য ছেলেমেয়েরা সহ্য করতে পারে না। অয়নের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি, ও সবজায়গায় যেমন সহজ; ওর ব্যাপারেও অন্যরা সহজ।
আমি ভীষণ রকম রকম অন্যমনস্ক থেকেও ওর কথার ছোট ছোট টুকরো শুনতে পাচ্ছি, ‘প্রোটেস্ট্যান্ট’, ‘ধর্ম’, ‘ব্যবহার’, ‘স্বার্থ’... অদ্ভুত লাগছে। অয়নের কথা শেষ হতেই সুপ্তি হাত তুলে ফেললো। অনিতা ম্যাম হাসলেন ওর দিকে তাকিয়ে, সুপ্তি কথা বলছে। আরেকজন টপার। আমি ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, ‘ভালো, মেয়েটা ভালো।’
সুপ্তির কথাগুলো আর শুনতে পাচ্ছি না আমি। অস্বস্তি হচ্ছে কোথাও একটা। সুপ্তির বলার মধ্যেই সুজিত হাত তুললো। ও বোধহয় কথা বলছে এখন। আমি কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছি না এখন। চারপাশ থেকে কয়েক কোটি ঝিঁঝিঁপোকা ভিড় করেছে আমাকে ঘিরে। আর কয়েকটা চড়ুই, কিচকিচ করছে। তাদের দেখা যায়না। একদমই না। সুজিত কি বলছে না শুনতে পেলেও আমি জানি ও কি বলছে। আবার ধর্ম! সংজ্ঞা! তত্ত্বকথা! বিশ্বাস! আমার হুট করেই মনে হতে থাকে কিছু একটা ঠিক নেই। সামথিং ইজ রং, উঁহু, কিছু একটা ঠিক নেই। কি ঠিক নেই বোঝা হয়ে ওঠে না, একটা ঝাঁকুনিমত লাগলো পুরো শরীরে, চমকে উঠে দেখি পুরো ক্লাসরুম খালি। কেউ নেই। কতক্ষণ ঘোরে ছিলাম জানিনা।
ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়াই। মুখ ঘামছে আমার, বুঝতে পারছি। ওড়নার কোণা দিয়ে মুখটা মুছে নিই। ক্লাসরুম থেকে বের হবো, বিশাল হোয়াইট বোর্ডটার দিকে চোখ পড়লো। অসংখ্য শব্দ গিজগিজ করছে। আমার মাথায় ধর্মের প্রশ্নটা সরে গিয়ে আরেকটা প্রশ্ন চলে এলো; বেঁচে থাকা মানে কি?
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড