• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘হতভাগ্য বাতিওয়ালা’-এর ১০ম পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : হতভাগ্য বাতিওয়ালা

  মুহাম্মদ বরকত আলী

২৩ এপ্রিল ২০১৯, ১৭:৩৭
কবিতা
ছবি : প্রতীকী

বিকেলবেলা বের হয়েছি মাঠের দিকে, গায়ে একটু হাওয়া লাগাব বলে। মাঠের খোলা হাওয়া শরীর মন বেশ ফুরফুরে করে তোলে। পাখিদের কোলাহল, বাতাসে ঢেউ খেলানো সোনালী ধানের শীষ, কৃষকের ব্যস্ততা, সব মিলিয়ে এক দারুণ পরিবেশ। ছোটবেলা থেকেই খোলা মাঠ আমাকে ডাকে। কিন্তু বাবা কখনো আমাকে মাঠে আসতে দিতেন না। তবুও বন্ধুদের সাথে লুকিয়ে আসতাম। পাট বোঝায় করা গরুর গাড়ির উপর চড়ে হেলতে দুলতে কতই না মজা পেতাম। কখনো আবার কাদায় আটকে যেতো গরুর গাড়ির কাঠের চাকা। তখন লোকজন ডেকে এনে দিতো জোরসে ধাক্কা। ক্যাঁচুর ক্যাঁচ শব্দে সারা গ্রাম মাতিয়ে রাখতো। রাস্তার কাদা তুলে নিয়ে এসে যত্ন করে তৈরি করতাম খেলনা। এই তো সেদিনের কথা। অথচ আজ কতই না পরিবর্তন। এখন শুধুই সেগুলো স্মৃতির ক্যানভাসে আঁকা ছবি। হারিয়ে গেছে আমার সেই শৈশব সাথে হারিয়ে গেছে বাবা।

আসসালামু আলাইকুম স্যার। হঠাৎ লিটনের সালামে ভেঙ্গে গেলো আমার কল্পনার জগত। ফিরে এলাম অতৃপ্ত এক জগতে। যে জগতে যতই পাচ্ছি ততোই চাহিদা বেড়েই চলেছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জীবনের চাহিদা আর শেষ হবে না। ওয়ালাইকুম আসসালাম। কি খবর লিটন? তোর মা ভালো আছেন তো? গণিত পড়তে যাচ্ছিস তো? জ্বী স্যার, মা ভালো আছে। পড়তেও যায়। একটা কথা বললো স্যার? কি বলবি বল? কিছু মনে করবেন না? না না, বল? একটা সমস্যা হয়েছে। আমাকে বাঁচান স্যার। কথাটা বলেই কেঁদে ফেললো লিটন। ছেলেটা বেশ নরম শরম। অল্পতেই খুব নার্ভাস হয়ে পড়ে। ওর মাথায় হাত রেখে বললাম, কি হয়েছে আমাকে বল? মিনুর ভুতে ধরা টরা কিছুই না। ও আমাকে ব্ল্যাক মেইল করতে চাইছে স্যার। আজ ওর বাড়িতে ওকে দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে একা পেয়ে বললো, কেবল শুরু। এর জন্য সে আমাকে দায়ি করবে। আমি কিছুই বলিনি স্যার। ও আমার সাথে এমন করতে পারে না। ওরা কয়জন মিলে একটা গ্রুপ করেছে। আমি ওদের সাজেসন্স না দিলে আমাকে যেকোন ভাবে ফাসাবে। আমি কি করে সাজেনশন্স দেব? আমারতো কোনো সাজেশন্স নেই। ওরা বিশ্বাস করতে পারছে না। বলছে, নেই তো কিভাবে আমি ভালো রেজাল্ট করছি। আবার বলছে, আমার ভূত তোর কাঁধে গিয়ে বসবে। এমন করলে আমার পড়ার এনার্জি নষ্ট হচ্ছে স্যার। আচ্ছা থাম এবার। চিন্তা করিস না আমি দেখছি কি করা যায়। একদম চিন্তা করিস না। এবার ও আমার হাত ধরে বললো, প্লিজ স্যার ওকে বোঝান। ওরা আমার ভালো বন্ধু। কেনো এভাবে আমাকে টেনশনে ফেলতে চায়চ্ছে? আমি পড়ালেখা করে অনেক বড় হতে চায়। ওর কথার শেষে মাথা দুলিয়ে বললাম বুঝেছি। একদম ভাবিস না। আমি আর বিশেষ কিছু বললাম না। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, বাড়ি যা এখন, কাল ইশকুলে আসিস।

আজ জুম্মাবার। সকাল থেকে বাইরে হইনি। জুম্মার নামাজ আদায় করে খাওয়া দাওয়ার পর একটা ভাত ঘুম দিয়েছি। আছরের নামাজ শেষ করে বের হলাম। হঠাৎ মনে হলো কাদের স্যারের কথা। মেয়েটা পরার পর আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এক সপ্তাহ হয়ে গেলো গাজী স্যার ইশকুলে আসেননি, কেউ কোনো খোজ খবরও নেয়নি। মানুষটাকে দেখে আমার বড্ড কষ্ট হয়। সারা জীবন বিনা বেতনে ইশকুলে শ্রম দিয়ে গেলে। আশায় থাকে এই বুঝি বেতনের ঘোষণা এলো। এভাবে আশায় থেকে থেকে এক সময় আশা গুলো নিরাশার বালুচরে সব স্বপ্ন গুলো ডুবে যায়। কোথায় যেনো মিলিয়ে যায় দুর অজানায়। গাজী স্যারের বন্ধুরা যারা যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হয়েছিল মাষ্টার রুলে, এখন তাদের সবারই বেতন হয়ে গেছে। আবার কোনো বন্ধু সরাসরি নিয়োগ পেয়েছিল ব্যাংকে।

বন্ধুদের সাথে দেখা হলে তারা শোনায় আশার বাণী। গাজী স্যারের চোখ জ্বল জ্বল করে ওঠে। আনন্দের সাথে ইশকুলে এসে সবাইকে বলতে থাকে আজ ঐ ইশকুল এমপিও হয়েছে। আমরা খোজ খবর রাখলে আমাদেরটাও হবে। পরে দেখা যায় সব মিথ্যা আজগুবি খবর। এই মিথ্যা খবরে কিছুক্ষণ তিনি আনন্দে থাকেন। কিছুক্ষণ তর্কবিতর্ক চলে বিষয়টা নিয়ে। স্যার কথার মাঝে বারবার বলতে থাকে, সে আমার ছোটবেলার বাল্য বন্ধু, সুতরাং মিথ্যা বলতেই পারে না। কিছুদিন এই তর্কবিতর্কের পর আগের অবস্থানেই ফিরে আসে। ভুলে যায় বেতনের কথা। পাশের গ্রামে গাজী স্যারের বাড়ি। তেমন একটা আসা হয় না। প্রথম এসেছিলাম স্যারের মেয়ের মৃত্যুর দিন।

এই গ্রামে একটা বড়ো গুন আছে। আর তা হলো মস্ত বড়ো একটা খেলার মাঠ। একটা প্রাইমারি ইশকুলের সাথে এই বিশাল মাঠ। এখানে প্রতি বছর ফুটবল মৌসুমে ফুটবল লীগ অনুষ্ঠিত হয়। কিসমত আলী ফুটবল টুর্নামেন্ট নামে এই লীগ। শুনেছি কিসমত আলী এই মাঠটা স্কুলকে দান করে গেছেন। তাই ইশকুল কমিটি আর কিসমতের বংশধরেরা এই খেলা পরিচালনা করে থাকে। কয়েকটা ছেলে এখন ডাংগুলি খেলছে। ওদের কাছে যাওয়া যাক। আমি ওদের নিকটে গিয়ে বললাম, সোনামনিরা খেলা বন্ধ করে একটু এদিকে এসো। ওরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসলো। তোমরা কে কোন ক্লাসে পড়? একে একে সবাই বলল পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। একজন চুল উসকোখুসকো ছেলে এসে বলল, আমি পড়ি না।

কেন? কি করিস তাহলে? সোজা সাপটা বলল, মাঠে ছাগল ভেড়া চরায়। আব্বা বলেছে বড়ো হলে আমাকে ট্রাকটার কিনে দিবে। আমি জমি চাষ করবো। পড়তে ভালো লাগে না। আচ্ছা তোর যা ভালো লাগে তাই কর। যেটাই করবি সেটা ভালো করে করবি। আমার পকেটে থাকা চকলেট গুলো বের করে ওদের হাতে হাতে দিলাম। তোরা সবাই ফাইভ পাশ করে কদমতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হবি। আমার কথা শেষ হতে না হতেই ওরা সকলেই এক সাথে বলল, বোকা মাস্টারের ইশকুলে? বোকা মাস্টার? কে বোকা মাস্টার? একজন বলল, কাদের স্যার। ওনাকে সবাই বোকা মাস্টার বলে ডাকে। আপনি জানেন না? আর একজন বলল, চকলেট ফিরিয়ে নিন। আমি ওখানে ভর্তি হব না। বেসরকারি ইশকুলে আমাকে ভর্তি করাবে না। তোদের ভর্তি হওয়ার জন্য চকলেট দিই নি। তোরা ইশকুলে যাস তাই দিলাম। সামনের দিকে পা বাড়ালাম। এযুগের ছেলেমেয়েদের সাথে পারাও যায় না। রুহু পেকে গেছে সব। কিন্তু গাজী স্যারকে ওরা বোকা মাষ্টার বলছে কেন? এর আগে তো শুনিনি। এর উত্তর হয়তো সারা জীবন বিনে পারিশ্রমে পড়ানোর প্রতিদান স্বরূপ উপাধি এটা। যে লোকটা সারা জীবন বিনা বেতনে ছেলেমেয়ে পড়িয়ে জীবন পার করলো, সে বোকা ছাড়া আর কি ই বা হতে পারে? আমিও স্যারের মত বোকা মাস্টার হতে চাই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বোকা সাজতে বেশ ভালোই লাগে। কোনো কোনা সময় বোকা সাজা মজার ব্যাপার। বিকেল বেলার নানা জাতের পাখি উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। গাছে গাছে পাখিদের কিচির মিচির শব্দ। রাস্তার দুপাশে কাচা পাকা বাড়ি। স্যারের বাড়ির নিকটে এসে পৌছাতেই মনে পড়ে গেলো সেই পুরনো স্মৃতি। স্যারের মেয়ের লাশ নিয়ে স্যারের সেই বিলাপের দৃশ্য। বাড়িটা নিস্তব্ধ। এক খণ্ড জমি, তার চারিদিকে কলা পাতা দিয়ে ঘেরা বেড়া। মাটির দেওয়াল আর খড়ের দুচালা ছাউনির এক কুঠরি ঘর। এই হলো বোকা মাস্টারের প্রাসাদ। বিকেলের রোদ গাছের ফাঁক গলে পড়ছে চালের উপর আর কলা পাতা ঘেরা বেড়ায়, সেই রোদে চিকচিক করছে পুরো প্রাসাদ। বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই দেখি তথা কথিত গ্রামের বোকা মাস্টার চুলোর পাশে বসে মাথাটা ঝুঁকিয়ে ফুঁ দিচ্ছে চুলোয়। পাট খড়ির সাদা ধূয়ায় চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে। পাট খড়ির একমাথা মুখে ঢুকিয়ে ফুঁ দিচ্ছেন অনবরত। গায়ে শত ছিন্ন ছেড়া একটা সাদা সেণ্ড গেঞ্জি। আমি পাশে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা সালাম দিলাম। আসসালামু আলাইকুম স্যার। আপনি একটু সরে বসেন আমি চুলাটা জ্বালিয়ে দিচ্ছি।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড