রোকেয়া আশা
শাহীন ভাই খুব দ্রুতই সবটা গুছিয়ে নিলো; এতটা আসলে আমরাও আশা করিনি। খুব শৈশব থেকেই শুধু ভয়াবহ দুঃসময়গুলো দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। হঠাৎ করেই ভালো সময়টা আমার কাছে কেমন বেমানান লাগে। অথচ তারপরও আমরা একটা ভোরের জন্য আশা করে বসে থাকি। আব্বুর মৃত্যুর দুসপ্তাহ পরেই ভাইয়ের মাস্টার্সের রেজাল্ট হলো। এখনকার সময়ে আর পাশ করে বের হওয়ার সাথে সাথেই কারো চাকরি হয় না। লবিং করতে হয়, নাহলে বিদেশ থেকে বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে আসতে হয়।
শাহীন ভাইয়ের রেজাল্টের পর একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। ভাইকে তাদের ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান স্যার নিজে ডেকে নিয়ে ডিপার্টমেন্টে জয়েন করতে বললেন। আমরা খবরটা শুনে খুশি হয়েছি, অবাকও হয়েছি; কিন্তু উচ্ছ্বাসটা পাইনি। হয়তো, আব্বু আর দাদী তখনো আমাদের মধ্য থেকে ফিকে হয়ে যায় নি। তবে মানুষ সাধারণত মৃত প্রিয়জনকে দ্রুত হারিয়ে ফেলে। আমরাও দেখতে দেখতে আব্বু আর দাদীকে কাটিয়ে উঠলাম।
একটা মানুষ; যিনি দীর্ঘদিন অথর্ব, জড় হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন; আর আরেকটা মানুষ, যিনি শুকনো, শীর্ণ একটা পাতার মত বয়সের ভারে ন্যুব্জ ছিলেন - এমন দুটো মানুষের মৃত্যুতে পৃথিবীর খুব বেশি ক্ষয়বৃদ্ধি আসলে হয় না। কিন্তু কি জানি, হয়তো তারপরও; দিনশেষে পরিবার বলেই এত কষ্ট হয়।
আমাদের এই কষ্টের মধ্যে শাহীন ভাইয়ের চাকরি হওয়াটা হঠাৎ করেই মরুভূমিতে দীর্ঘদিন পরে বৃষ্টি হওয়ার অনুভূতি নিয়ে এলো। কিছুটা স্বচ্ছলতা, রোজকার চালডালের হিসাব মেলানোর ঝামেলা নেই। এরমধ্যেই একদিন রূপু আপা এসে হাজির।
দুপুর পর্যন্ত খুব কড়া রোদ ছিলো; বৈশাখ মাস। বাংলা অন্য কোন মাসের হিসেব আজকাল রাখা হয় না, শুধু বৈশাখের আগমনটাই আমাদের একটু চোখে পড়ে। সকালে স্কুলে আসার সময় আম্মা ছাতা দিতে দিয়েছিলো সাথে ; আমি নিতে চাইনি। রোদের জন্য ছাতা নেয়াটা কেন যেন বড্ড বেমানান লাগে আমার কাছে। এতদিন তো আর নেয়া হয়নি। এতদিন আম্মার সময় হয় নি তিনবেলা ভাত খাওয়া বাদে আমাদের আর কোন ছোটখাটো যত্ন নেওয়ার। ভাইয়ের চাকরি হওয়ার পর আম্মা চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। এখন আম্মা আমাদের ছোট ছোট যত্নগুলোও নেয়। নিতে পারে।
এখন আম্মা রোদের দিনেও আমার আর মাহিনের ব্যাগে ছাতা দিতে পারে; রোজ আলাদা রকম টিফিন বানাতে পারে। আমার স্কুল ছুটি হয় বিকাল চারটায়, সাড়ে তিনটার দিকে হঠাৎ করেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। স্কুল ছুটির পর যখন আমি বেরোলাম, তখনও বৃষ্টি থামার কোন নাম নেই। ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। আমি যখন বাসায় পৌঁছাই তখন মাত্র সোয়া চারটা বাজে, অথচ এরমধ্যেই আমাদের শহরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মেঘ এসে ভিড় করলে এত আঁধার কেন হয় কে জানে!
বাসায় ঢুকতেই একটা অবয়ব দেখতে পাই। বিবর্ণ একটা সুতি শাড়ি পরা একটা অবয়ব। ভিজে একাকার। খোঁপা থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। রূপু আপা! ঘরের মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। একটু বোধহয় কাঁপছেও। আম্মা একটু দূরে, সেও মেঝেতেই বসে আছে। আম্মা কিছু বলছে না। আপাও না। শাহীন ভাই কখন ফিরবে?
আমি কিছু না বলে ভেতরে চলে যাই। ওয়ারড্রব খুলে সুতি একসেট সালওয়ার কামিজ বের করি। তারপর পাশের ঘরে গিয়ে খুব সহজ গলায় আপাকে ডাকে বলি, ‘ঠাণ্ডা লেগে যাবে তো আপা। জামাকাপড় পাল্টাও।’
আম্মা অবাক হয়ে তাকায় আমার দিকে। শাহীন ভাই বাসায় এলো সত্যিকারের সন্ধ্যায়। আপা তখন ঘুমুচ্ছে। আম্মা তখনই ভাইকে সব জানালো। রূপু আপার বাচ্চা হবে। আটমাস চলছে। - রূপসা পালিয়েছিলো কার সাথে বলেছে? শাহীন ভাইয়ের মুখটা থমথমে লাগে। আম্মা মাথা নাড়ে। - ছেলেটা এখানকার না। ধামরাইয়ের ওইদিকে বাড়ি। মোবাইলে কথা হতো রূপুর ওর সাথে। ভাই ভ্রু কুচকে তাকায় আম্মার দিকে। তখন রূপু আপার আমার মত বয়স ছিলো, আপার ফোন ছিলো না নিজের। মানে হচ্ছে বাসার ফোনেই আপা কথা বলতো; আর ভীষণ ভেঙে পড়া একটা পরিবারে কখনোই আপার দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়ে ওঠেনি। বাইরে তখনো বৃষ্টি, খুব ঝুম বৃষ্টি। অন্ধকার ফুড়ে আসা তীব্র চিৎকারটা শুনে আমার ঘুম ভাঙে, ঘর অন্ধকার। ফ্যানটাও চলছে না। লোডশেডিং আবারও। বৃষ্টি হচ্ছে তখনো, বরং আরও জোরে। তীব্র যন্ত্রণায় গোঙানোর শব্দ আসছে। আমি উঠে পড়ি ঝট করে। আম্মার ঘরে চার্জার লাইট জ্বলছে, ওখানে গিয়ে দেখি রূপু আপা আম্মার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে, চারপাশটা রক্তে ভেসে গেছে। এই চার্জার লাইটটা গাঢ় অন্ধকারটা কাটাতে পারছে না। আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকি। এত রক্ত ছিলো এই রোগা মানুষটার শরীরে?
আম্মা শাহীন ভাই আর মাহিনকে ঢুকতে দেয় না, আমি শুধু থাকি। আমার এই কিশোরী বয়সে প্রথমবার জন্ম দেখি; তিনটা মৃত্যুর পর একটা জন্ম দেখছি আমি। মৃত্যুর চাইতে জন্ম আরও যন্ত্রণার বুঝি। এখানে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে গাঢ় কালো একটা রাত। ঘুমের মধ্যে এই শহরের আর সব মানুষ অজান্তেই একটা মেঘভোরের অপেক্ষা করছে।
এই ছোট্ট ঘরটার বাইরে আমার আর রূপু আপার ভাইয়েরা একটা তীক্ষ্ণ আগমনী কান্নার অপেক্ষা করছে, আমি ভেতরে আমার অপেক্ষা একটা নতুন প্রাণ চোখে দেখার। আলো কমে আসছে কেন? ভোর হতে আর কত দেরী?
ওডি/এসএন
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড