সেলিম হোসেন
আজ পহেলা বৈশাখ। প্রতিদিনের মতো আজও বরফ বিক্রি করতে বেরিয়েছে রাহুল। অসুস্থ মায়ের অসুখ যেন দিন দিন বেড়েই চলছে। আজকাল কাঁসির সাথে রক্ত বের হচ্ছে । বাবা তো অনেকদিন হলো বাড়ি আসে না। শুনেছে তিনি নাকি নিকাহ করেছেন,তাইতো রাহুলের মায়ের কাছে আসেন না। একা রাহুল আর কতদিন বসে বসে মায়ের অসুখ দেখবে। বয়স কেবল ৯ হলো তারপরও বসে থাকলে চলবে না, তাই তো শেষমেশ পাশের বস্তির টোকাই এবং প্রিয় বন্ধু শহিদের বুদ্ধিতে সে ৫০ টাকা নিয়ে বরফের ব্যবসা শুরু করে দেয়।
দিন শেষে ৫০-৬০ যা লাভ হয় তাই দিয়ে মায়ের জন্য কিছু ওষুধ আর হোটেল থেকে ডাল,পুড়ি কিনে আনে। আজ সব মানুষই বিশেষ ধরনের পোশাক পরেছে। ছেলেরা ‘এসো হে বৈশাখ’ লেখা গেঞ্জি, মাথায় লাল গামছা। মেয়েরা হলদে শাড়ি আর ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা সেজেছে নানান রঙে।
পাকা রাস্তার বুকে রং দিয়ে সাজানো হয়েছে এবং নানা রঙে রাঙিয়েছে ব্যানার। রাহুলের খুব শখ হয় আর সবার মতো সাজতে কিন্ত বিধাতা হয়তো তাকে এতটুকু ভাগ্য দেন নাই। তাই আজ তাকে বিক্রি করতে হচ্ছে বরফ। এদিকে বেলা বেড়েই চলছে, কিন্ত মাত্র কয়েকটা বরফ বেচতে পেরেছে সে। ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাবার না হোক কিন্তু মায়ের জন্য তো ওষুধ চাই।
নাহ এভাবে এক জায়গায় বসে থাকলে চলবে না, ভাবে রাহুল। কাঁধে তুলে নিলো বরফের বাক্সের দড়ি। মাথার উপরে কড়া রোদ, তাপে যেন গলে যাচ্ছে পৃথিবীর সবকিছু। ঘামে ভিজে গেল ময়লাময় ছেঁড়া শার্ট। দুর্গন্ধে নিজেরই খারাপ লাগছিলো তবুও সে দমেনি। বরং হেটে চলছে তার গন্তব্যে। আজকাল রোদে হেটে হেটে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে তাই নতুন করে আর কিছু মনে হয় না। নতুন নতুন রং বে-রঙের গাড়ি রাস্তার পাশে পার্কিং করা। ভেতরে কেউ কেউ বসে আবার কেউ বাইরে চেয়ারে বসে আছে পরিবারের সাথে। কেউ দু একটা নিচ্ছে আবার কোনো ধনীর ঘরের দুলালী পঁচা বাসি বরফ বলে আখ্যায়িত করছে।
মানুষগুলো বড়ই অদ্ভুত। পাশেই কত ছেলে মেয়ে খালি গায়ে হাঁটছে অথচ বড় লোকের পোশাকের কমতি নাই। হাজার টাকা খরচ করে কাপড় কিনে আর বিনা কাপড়ের অভাবে খালি গায়ে সব পথ শিশু। কবে যে মানুষদের হুশ ফিরে আসবে তা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।
রোডের পাশে যে হাইস্কুল আছে সে স্কুলের মাঠের বাঁপাশে বড় বটগাছ আছে তার নিচে হচ্ছে বৈশাখী গানের অনুষ্ঠান। অন্য এলাকা হতে সব ভালো ভালো গায়ক গায়িকা এসেছে, গাইছে বৈশাখী গান। অনেক মানুষের আগমন ঘটেছে। যাক এখানে তাহলে অনেক বরফ বেচা হবে, মায়ের ওষুধ কেনাও হবে, মনে মনে ভাবে রাহুল। বরফের বাক্সটা খুব ভারী মনে হচ্ছে আজ। হাতে গোনা কয়েকটা বেচা হয়েছে মাত্র তাইতো বাক্স ভারী মনে হচ্ছে।
গলে যাওয়া কিছু বরফের পানি চুইয়ে চুইয়ে রাহুলের কপাল বেয়ে নামছে। বাম হাত দিয়ে হালকা মুছে দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে। স্কুলের ডানপাশে ফাকা জায়গায় বরফের বাক্স নিয়ে বসে পড়ে সে। অসহ্য গরমে একটু শীতল পরশ পাবার জন্য দু একটা বরফ কেনা শুরু করে দেয়। রাহুলের মলিন মুখে একটু ফিকে হাসি ফুটে ওঠে। যাক তাহলে আজ মায়ের ওষুধ কেনা যাবে।
হঠাৎ করেই শত শত জনতার মধ্যে এক জঙ্গি আত্মঘাতী বোমা মেরে দেয়। যে যেভাবে পারে দৌড় শুরু করে। প্রাণের ভয় সবারই আছে তাই সবাই প্রাণ বাঁচানোর জন্য সর্বশক্তি দিয়ে দৌড় দেয়। কে কোন দিতে যাচ্ছে সেটা বিষয় না বিষয় হলো নিরাপদ স্থানে পৌঁছানো।
পায়ের নিচে কি আছে না আছে দেখার সময় নেই। রাহুল ছোট মানুষ এবং বরফই তার একমাত্র সম্বল তাই যতদূর পারে বাক্স নিয়ে দৌড়াতে থাকে। হঠাৎ কারো পায়ের সাথে পা লেগে উপুড় হয়ে পড়ে যায় রাহুল, অনেক চেষ্টা করছিলো উঠার কিন্ত মানুষের দৌড়ানোর মধ্যে সে আর উঠতে পারে নি। ‘আমার বরফ, আমার বরফ, আমার বরফ’।
বলতে বলতে তার প্রাণ পাখিটা উড়াল দিলো আকাশে। মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ক্ষুধার্ত মাটি লাল রঙে ভিজে গেছে তবুও কারো ভ্রুক্ষেপ নেই।
ওদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে আর অসুস্থ মা পথ চেয়ে আছে কখন খোকা ঘরে ফিরবে।
ওডি/এসএন
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড