• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৩ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ছোট গল্প : একজন বাবার গল্প

  শোভা মনি

১৫ এপ্রিল ২০১৯, ১৫:৪৩
ছবি
ছবি : প্রতীকী

জুন মাস। সময় দুপুর ১টা। সূর্য একদম মাথার ওপর। খাঁ খাঁ করছে চারদিকে। দেশের কোনো এক স্বনামধন্য কলেজের গার্লস হোস্টেলের সামনে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে কোঁচকানো ঢোলা একটা প্যান্ট, প্যান্টের চেয়েও বেশী কোঁচকানো আধাময়লা শার্ট। পায়ে একটা সস্তা স্পঞ্জের স্যান্ডেল। সারামুখে খোঁচা দাঁড়ি। শার্ট ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। একহাতে মিষ্টির প্যাকেট, আরেক হাতে নানা জিনিসে ঠাসা একটা বড় বাজারের ব্যাগ। গত দুই ঘণ্টা যাবত এখানেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।

কয়েকবার একই জায়গায় পায়চারি করে তিনি হোস্টেলের দারোয়ানকে চতুর্থবারের মত জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই, আপনে সিউর তো যে আমার মাইয়ার কলেজ ১টার সময়েই ছুটি হইবো?’ দারোয়ান মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করলেন তাকে। আরো কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোকের মুখে হাসি ফুটলো। উনার মেয়ে এগিয়ে আসছে এদিকেই। দারোয়ানকে বললেন, ‘ভাই, আমার মাইয়া আইতাছে। দেইখেন, আমারে দেইখা কেমুন খুশিডা হয়।’

বলতে বলতেই উনার মেয়ে একদম উনার কাছে চলে এলো। ভদ্রলোক মেয়েকে দেখে যতটা খুশী হয়েছিলেন, উনার মেয়ের মুখ ততটাই বিরক্তিতে ভরে গেলো তার বাবাকে দেখে। ‘তুমি? এইখানে ক্যান আসছো?’ একরাশ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো মেয়েটি।

‘তরে দেখতে মন চাইলো মা। কতদিন দেহিনা। দেখ, তর পছন্দের মিষ্টি আনছি। তর মা আরো কত কিছু রাইন্ধা দিছে দেখ। ইশ রে, সারাদিন ক্লাস কইরা খুব খিদা লাগছে না? হা কর তো দেখি, একটা মিষ্টি খাওয়ায় দেই তোরে’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলা বলে মিষ্টির প্যাকেট খুলতে শুরু করলেন বাবা। চোখেমুখে আনন্দ খেলা করছে উনার।

‘বাবা, থামো’ প্রায় চিৎকার করেই বলে উঠলো মেয়েটি। দারোয়ান ঘুরে তাকালো। ‘তোমারে কতবার বলছি আমি আমারে দেখতে আসবা না, কতবার বলছি বলো? আমার একটু সম্মানও কি রাখবা না? এই বেশভূষা নিয়া কীভাবে পারলা এইখানে আসতে? আমার বন্ধুরা কেউ দেখলে কী ভাবতো? এইভাবে সং সেজে কীভাবে আসতে পারলা? তোমাকে আমি একবারও বলছি যে আমি মিষ্টি খাবো? যতসব বিরক্তিকর! এখন খাম্বার মত দাঁড়াইয়া না থেকে প্লিজ চলে যাও। কেউ দেখার আগেই। আর হ্যাঁ শোনো, আমাকে দেখতে এখানে আসিও না আর। টাকা লাগলে আমি করিম চাচার ফোনে কল করে বলে দিবো। এখন যাও তো প্লিজ।’ রাঁগে ফুঁসতে ফুঁসতে কথা শেষ করলো মেয়েটি।

বাবা মাথা নিচু করে আছে। উনার বেশ কয়েকবছর আগের কথা মনে পড়ছে যখন উনার এই কলেজপড়ুয়া মেয়েটি একদম ছোট্ট ছিলো। যখন মেয়েটি উনার কাঁধে চড়ে গঞ্জে যেতো আর বলত, ‘বাজান, আমার ম্যালা ট্যাকা হইলে তোমারে ওই সাহেবগো লাহান এক খান শাট প্যান কিন্না দিমু।’ যখন উনি বাড়ি ফেরার পর মেয়েটি অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলত, ‘বাজান, আইজ মিষ্টি আনো নাই আমার লাইগা?’ যখন মেয়েটি তার বন্ধুদের বলত ‘আমার বাজান সবার সেরা।’ শহরে পড়তে এসে মেয়েটা কি আজ অনেক বড় হয়ে গেলো? উনি এভাবে এসে সত্যিই কি মেয়েকে অনেক বড় অসম্মানের মধ্যে ফেলে দিলেন? শহুরে আদবকায়দা না জানা বাবার চোখে একই সাথে বিস্ময় ও তীব্র দুঃখবোধ!

‘এখনো দাঁড়ায়া আছো কেন? প্লিজ যাও’ মেয়ের কথায় সম্বিত ফিরলো উনার। ‘যাইতেছি মা। আর আসমু না। আমি আসলে বুঝতেই পারিনাই যে তোর এই বাপ তোর শরমের কারণ হয়া যাইবো। মিষ্টিগুলা আর ব্যাগটা রাইখা গেলাম। এগুলা নিয়া বাড়িতে ফিরলে তোর মা অনেক কষ্ট পাইবো। যাই রে..’ ভারী গলায় কথাগুলো বলেই হাঁটা ধরলেন উনি। পেছন থেকে দেখা গেলো উনি পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। মেয়েটি বাবার দেওয়া জিনিসপত্র না নিয়েই ঢুকে যাচ্ছিলো গেট দিয়ে। দারোয়ান এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো চুপচাপ। হঠাৎ বলে উঠলো, ‘আপা গো, একটু দাঁড়ান। এই জিনিসগুলা নিয়া যান। আপনার বাবা দুইঘন্টার বেশী সময় ধইরা এই ভরা রইদে দাঁড়াইয়া ছিলো এই জিনিসগুলা নিয়া। আপ্নার সাথে এক্টাবার দেখা করার লাইগা। আপনার অনেক গল্প করলো। আপনারে নিয়া গল্প করার সময় আনন্দে উনার চোখ চকচক করতেছিল আপা। ভুল কিছু যদি বইলা থাকি, মাফ কইরা দিয়েন। আমিও বাপ তো, বুঝি। গ্রামে মাইয়াটা আমার কান্দে, আমারে দেখবার লাইগা। ক্যাম্নে যামু, ছুটিই তো নাই। কতদিন আমার যাদুধনরে দেখিনা আপা, পরাণডা খুব কান্দে আপা, খুব...’ বলতে বলতে গলা ধরে এলো দারোয়ানের।

মেয়েটি এক সেকেন্ড ভেবে মিষ্টির প্যাকেট আর ব্যাগটা নিয়ে ঢুকে গেলো হোস্টেলের ভেতর।

আধাঘণ্টা পর। হোস্টেলটার ডাইনিং রুম। লাঞ্চ শেষ সবার। রান্নার খালা এসে সবার পাতে একটা করে মিষ্টি তুলে দিলেন। সবাই একযোগে জিজ্ঞেস করলো, ‘কীসের মিষ্টি গো খালা?’

‘আমার বাবা এসেছিলেন গ্রাম থেকে। উনি এনেছেন। আমাদের এলাকার বিখ্যাত মিষ্টি। খান সবাই। বাবাকে একদিন পরিচয় করিয়ে দেব সবার সাথে। আমার বাবা হলেন পৃথিবীর সেরা বাবা।’ মুখে আস্ত একটা মিষ্টি পুরে ডাইনিং রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল মেয়েটি। অবাক হয়ে ঘুরে তাকালো সবাই। গত এক বছরে অনেকে অনেক বার জিজ্ঞেস করা পরেও এই মেয়েটির মুখ থেকে কেউ কখনোই তার বাবার ব্যাপারে কোনো কথা শোনেনি!

ওডি/এসএন

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড