জান্নাতুল ফেরদৌস
১৯৮১ সাল আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বাড়ির পাশের এক কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে গেলাম। তার কয়েকদিন পর আব্বা আমাকে নিয়ে গেলেন তার প্রিয় ব্যবসাখানায়। শহরে আব্বার বিবিধ রকম পণ্যের কয়েকটা দোকান আছে। আমাকে তিনি নিয়ে গেলেন যে দোকানটাতে তার নাম ‘ছবিঘর’। জেলার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের গেটের সামনেই এই দোকান। দিনে যে কোন একটা সময়ে আব্বা অবশ্যই এ দোকানে বসতেন। ফলে শখ করেও কোনোদিন বালিকা বিদ্যালয়ের আশপাশ দিয়ে ঘোরার সাহস হয়নি। আর সেদিন আব্বা কিনা নিয়ে গেলেন এই দোকানে। বুঝলাম বড় হয়েছি, আর এই দোকানের দায়িত্ব আমি পেতে যাচ্ছি। আব্বা সেদিন আমাকে বলেছিলেন, স্কুলের মেয়েগুলিকে বোনের চোখে দেখবি। কোনোদিন যদি শয়তানি চোখে কোনো মেয়ের দিকে তাকাইছোস, তো বুঝবি তোর ব্যবসা সেদিন থ্যাকাই ডুবতে শুরু করছে।
এর কয়েক বছর পরের কথা, রাতে দোকান থেকে বাসায় ফিরে ভাত খেতে বসেছি। পাশে এসে আমার চাচী বসলেন। তারপর বললেন, শোন, তোর আব্বা, চাচা আর আমি এক মেয়ে দেইখে আইসেছি। মেয়ে ইন্টারে পড়ে। আমাগের পছন্দ হয়ছে। সামনের মাসের প্রথম শুক্রবার তোর বিয়ার তারিখ ঠিক করা হয়ছে। মনটা কেমন আনচান করে উঠলো আমার। মেয়ে দেখতে কেমন, খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করলো। লজ্জায় কিছুই বলতে পারলাম না। ভাবলেশহীনভাবে ভাত খেতে লাগলাম। চাচী একটু পর বললেন, মেয়ে সুন্দর আছে। তোর দোকানের পোস্টারের নায়িকার মতো। খুব জানতে ইচ্ছা করলো, তবু মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না, কোন নায়িকার পোস্টারের মতো দেখতে সে। তারপর আমার দোকানের সব নায়িকার পোস্টারগুলো আমার কাছে জীবন্ত হয়ে গেলো। তাদের দেখতাম আর ভাবতাম, কার মতো দেখতে হবে আমার জীবনের নায়িকা। বিয়ের আগের সেই কয়েকটা দিন কি যে রোমান্টিক ছিলো। এর মাঝে একদিন দোকানে আসলো পনের-ষোলো বছরের এক ছেলে। অনেকক্ষণ ধরে ছেলেটি দোকানের সব পোস্টার খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিলো। একপর্যায়ে আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে তাকে বললাম, কি ভাই, তুমি কি কিছু কিনবা? ছেলেটি একগাল হাসি দিয়ে এগিয়ে এসে আমাকে বললো, দুলাভাইর দোকান থেকে হুদায় নিবো, কিনবো কেন?
ও এটা তাহলে আমার হবু শ্যালক। শুনেছিলাম আমার একজন শ্যালক ও দুইজন শ্যালিকা আছে। মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করলাম পেয়ারের শালাকে। যাওয়ার সময় গোটা পাঁচেক পোস্টার আর দশখানা ভিউকার্ড নিয়ে সে বিদায় নিলো। যাওয়ার আগে বললাম, তোমার বোনের পছন্দের একটা পোস্টার নাও। শ্যালক বললো, নিছিতো, সালমান খানেরটা বুবুর জন্য। সেকি তবে সালমান খানের সাথে আমাকে মেলানোর চেষ্টায় আছে। বাসর রাতে আমি ঘরে ঢুকে দেখি, বউ তিনহাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। আমার হাতে একটা পোস্টার। আমি আমার মুখের সামনে পোস্টার ধরে বললাম, দেখতো, তোমার পছন্দের নায়কের চেয়ে আমাকে বেশি সুন্দর লাগতেছে না? বউ আমার ঘোমটা তুলে হিহি করে হেসে উঠলো। আহারে জীবন, কত কত স্মৃতি নিয়ে ভরা। এরপর আমার সংসার সুজলা সুফলা হয়ে বেড়ে উঠলো।
একসময় আমার দোকানটা আকারে আরো বড় ছিলো। তখন ব্যবসা ছিলো রমরমা। আমার দোকানে কার্ড, পোস্টার, ক্যালেন্ডার, ভিউকার্ড পাওয়া যায়। এ শহরে এ রকম দোকান আরো কয়েকটি ছিলো। আজ অবশিষ্ট আছে শুধু এই ছোট দোকানটা। ঈদের শুভেচ্ছা, নববর্ষের শুভেচ্ছা, জন্মদিনের শুভেচ্ছা, ভালবাসার কথা জানাতে কত রকমসকমের কার্ড কিনতো সবাই। আর খেলোয়াড়, গায়ক, গায়িকা, নায়ক, নায়িকার পোস্টার নিয়ে কিশোর কিশোরীদের কত রকম চাহিদা ছিলো।
একদিন এক কিশোরী মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে এসে বললো, ভাই শহিদ আফ্রিদির পোস্টার দেখান। আমি পোস্টার বের করতে করতে বললাম, কাঁদো কেন? মেয়েটি বললো, আমার এক বান্ধবির সাথে ঝগড়া হইছে, পরে ও আমার ব্যাগ থেকে পোস্টার নিয়ে ছিড়ে ফেলছে। বলেন কাজটা ও ঠিক করলো। যাই হোক সেই মেয়েটার কান্না সেদিন থামানো গেল না। কারন শহিদ আফ্রিদির ছিড়ে যাওয়া পোস্টারটি আর ছিলো না। অন্যগুলো আর সেরকম সুন্দর মনে হলো না কিশোরীটির কাছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিলো সেদিন।
আহারে কি দিন ছিলো, ভিউকার্ড, পোস্টার নিয়ে কি আবেগ। দিব্যা ভারতী মরে গেলো। হায়রে হায়, মনে হল সকল কিশোর যেন অধিক শোকে পাথর হয়ে গেলো। তাদের পড়ার টেবিলের সামনের দেয়াল দখল করে নিলো দিব্যা ভারতী। মিথ্যা বলার উপায় নাই, সালমান শাহর মৃত্যুর পর পোস্টার ব্যবসা সেই রমরমা হয়ে উঠেছিলো। তখন শহরে বেশ কিছু ভিসিডি, ভিসিআরের দোকান ছিলো। তিন চার মাস পরপর ভিসিডি এক সপ্তাহের জন্য ভাড়া করে নিতাম। নতুন হিন্দি, ইংরেজি, কলকাতার বাংলা সিনেমার ক্যাসেট ভাড়া করে এনে দেখা হত। পাড়া প্রতিবেশী কেউ বাদ যেত না এই সিনেমা দেখার রেওয়াজ থেকে। বাড়িতে মেহমান আসছে, যাও সিনেমা দেখার আয়োজন কর। এটা যেমন ছিলো বড় বিনোদন তেমনি যেন একটা উৎসব। আজ আর সেসব নেই। এখন মোবাইলেই সব হয়। সে দিনগুলি বুঝি একেবারেই বদলে গেছে।
সে সময় মেয়েরা স্কুল থেকে বের হত, আর কত কিশোর দাড়িয়ে থাকতো কার্ড হাতে। সেই কার্ডে ছাপা অক্ষরে লেখা থাকতো মনের সব কথা। কিন্তু কজনারই বা শেষ পর্যন্ত সাহসে কুলাতো সঠিক মানুষের হাতে কার্ডটি পৌছে দেয়ার। আহারে কি আবেগ, কত ভাবাবেগ। ঈদে প্রিয় বন্ধু বা পরিচিতজনকে ঈদ কার্ড পৌছে দিতে না পারলে কি আফসোস। সেদিনগুলি যেন আজ শুধুই স্মৃতি। বয়স হয়েছে, দোকানে এখন একজন সহকারি রেখেছি। কিন্তু ব্যবসার যে অবস্থা তাতে, ভিক্ষা লাগবে না মা কুকুর সামলাও অবস্থা। আমার দুই মেয়ে, এক ছেলে বড় হয়েছে। ওদের বিয়ে হয়েছে, ছেলেমেয়ে হয়েছে। আল্লাহর রহমতে সবাই ভালোই আছে। আমি আর আমার মাধুরি, বউকে দেয়া আমার নাম, আমরা বুড়ো হয়েছি। আমার ছেলে এখন বড় চাকরি করে। পাশের ঘর থেকে আমাকে শুনিয়ে ওর মাকে প্রায়ই বলে, আব্বাকে বলো না ওই জঞ্জালটা দূর করতে। বয়স হয়েছে, এখন তার দোকানদারির কি দরকার।
এ ঘর থেকে আমি ওর কথা শুনি। কিছুই বলি না। মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে, এই জঞ্জালের ব্যবসা করেই তোদের বড় করেছি। মাধুরি আমাকে কিছুই বলে না। কারণ ও জানে, এই দোকানের প্রতিটা ধূলিকণা আমাকে টানে। পোস্টার, কার্ডের কাগজ আর আঠার ঘ্রাণ না পেলে আমার ঘুম হয় না।
সেদিন একজন মেয়ে আসলো দোকানে। তার সাথে আট-দশ বছরের একটা ছেলে। মেয়েটা সালাম দিয়ে বললো, চাচা চিনতে পারছেন? আমি সামনের স্কুলে পড়তাম। আপনার দোকানে খুব আসতাম। আমি হাসলাম, ঠিক মনে পড়ছেনা। মেয়েটাই বললো, অনেকদিন পর এখানে এসেছি। আমার ছেলে এটা। ওকে আমার স্কুল দেখাতে নিয়ে আসলাম। আমি ছেলেটাকে বললাম, কেমন আছ তুমি বাবা? ছেলেটা বললো, হু ভালো। আপনার এটা ছবির দোকান। মেয়েটি বললো, হুম। কার্ডও পাওয়া যায়। তুই নিবি একটা কার্ড। ছেলেটি বললো, না, লাগবে না। আমি ওটা দিয়ে কি করবো? আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, আজকালকার বাচ্চারা এগুলো পছন্দ করেনা। মেয়েটি বললো, অথচ ওর বয়সে আমরা টাকা জমিয়ে এগুলো কিনতাম। আমি হাসলাম। মেয়েটি বললো, শহরটাই কত বদলে গেছে। শুধু আপনার দোকানটাই পরিচিত মনে হলো। যদিও দোকানটা ছোট হয়ে গেছে। আমি হাসলাম। মেয়েটি বললো, আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো। আমরা যাই, ভালো থাকবেন। আমি বললাম, দাঁড়াও। ছেলেটির হাতে একটা কার্ড দিলাম। মেয়েটি টাকা দিতে চাইলো, নিলাম না। বললাম, এটা ওকে আমি উপহার দিলাম। ছেলেটি আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললো, আমি এটা রেখে দিবো, আমার ভালো লেগেছে। ওরা চলে গেলো, কিছুটা ভালো লাগার সময় আমাকে দিয়ে।
আজ সকালে এক মধ্যবয়স্ক লোক আসলো দোকানে। ঘুরে ঘুরে দেখলো। তারপর থমকে দাড়ালো একটা পোস্টারের সামনে। যার দৃশ্য এরকম, এক মা উম্মুক্ত বুকে শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছে। লোকটি এবার আমার সামনে এসে বেশ উচু গলায় বললেন, আপনিতো যুবকদের নষ্ট করছেন। আমি শান্ত গলায় বললাম, কেন? কি করেছি? লোকটি বললো, ঐ যে দেখেন কি অশ্লীল একটা দৃশ্য। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো আমার। বললাম, আপনার চোখ খারাপ তাই ওটা অশ্লীল। আমারতো ঐ ছবি দেখলে মায়ের কথা মনে পড়ে। নাকি আপনার মা আপনাকে বুকের দুধ খাওয়াইনি? লোকটা এবার একটু দমে গেলো মনে হলো। এবার বললো, আমাকে মক্কার ঐ পোস্টারটা দেন। আমি বললাম, আমি আপনার কাছে কিছু বিক্রি করবো না। আগে নিজের মন পরিস্কার করেন। তারপর ঘরে মক্কার ছবি টানাবেন। লোকটা গজগজ করতে করতে চলে গেলো। আজ আমাদের বিয়ের ৩৫ বছর পূর্ন হলো। রাত আটটা বাজে। লিটনকে বললাম, দোকানে তালা দে। আমি বের হয়ে এলাম দোকান থেকে। আমার হাতে একটা কার্ড। কার্ডটাতে আছে নীল রঙের দুইটি প্রজাপতির ছবি। মাধুরির নিশ্চয়ই পছন্দ হবে এটা।
হাঁটতে শুরু করলাম আমি। হঠাৎ বুকের বা পাশটা এমন মোচড় দিয়ে উঠলো। মাথাটা ফাঁকা হয়ে এলো। বহুদূর থেকে কেউ যেন চিৎকার করে বলছে, চাচাজি, কি হয়ছে?
ওডি/এসএন
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড