রবিউল আলম অন্তর
আমি যখন ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি তখন আমার পাশের গ্রামের ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া এক মেয়েকে ভালোবাসতাম। তাকে মনের ভাবটি প্রকাশ করার ক্ষমতাও হয়েছিলো। কিন্তু সে আমাকে ক্লিয়ার বলে দিয়েছিলো, যদি সম্ভব হয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেন বিয়ের প্রস্তাব রাখি তার পরিবারের তরে। তখন সেটা সে ভেবে দেখবে। আমি মেনেও নিয়েছিলাম। অতঃপর আমি ইন্টার পাশ করে মেডিকেলে ভর্তি হলাম।
মাঝে মাঝে যখন ছুটিতে গ্রামে যেতাম তখন গ্রামের বন্ধুদের ও ছোট ভাইদের দিয়ে খোঁজ খবর নিতাম সে কি এখন পর্যন্ত একাই আছে নাকি কারো প্রেমের সাগরে স্নান করে কুমারী জীবনের পূর্ণতা আনছে? নাকি বিয়ে করে স্বামীর সংসার করছে?
তাতে কখনো ওর সম্পর্কে খারাপ কিছু শুনিনি। যখন শুনতাম সে একা আছে তখন নিজের মাঝে ভালোলাগা বোধটা কাজ করতো। ভাবতাম মেয়েটি মনে হয় আমার অপেক্ষায় আছে।
এর মাঝে দু’বছর পর গ্রামে গিয়ে একদিন আমার ফোন নাম্বার’টি কোন এক মাধ্যম দ্বারা তাকে দিয়েছিলাম। দেওয়ার সময় তাকে বলেছিলাম সে যেন আমাকে যে কোন নাম্বার দিয়ে শুধু একটি মিসডকল দ্যায়। সে দিন থেকে আমার ফোনে কোন মিসডকল আসলে আমি চমকে উঠতাম আর ভাবতাম ঐ বুঝি মিসডকল দিছে। একটি মিসডকলের অপেক্ষার প্রহরী হয়ে থাকতাম।
কখনো যদি অপরিচিত নাম্বার থেকে মিসডকল আসতো তখন আমি ভাবনায় বিভোর হয়ে যেতাম; ভাবতাম ঐ বুঝি আমাকে স্মরণ করছে। নিজের ফোনে টাকা না থাকলে বন্ধুদের ফোন দিয়ে কল দিতাম। তা সম্ভব না হলে ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকে ফোন দিতাম। ভালোবাসার মানুষের কন্ঠধ্বণি আমি নিজ কর্ণে শ্রবণ করবো এমন ভাবতেই খুশিতে আত্মহারা হতাম।
মোবাইল পড়ার টেবিলের উপর আয়নার মতো করে রেখে দিতাম পড়ার সময়ে। আর ভাবতাম কখন আসবে তার একটি মিসডকল। মনের ভিতর শত শত জমা কথাগুলো বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকতাম। এতদিন শুনছি অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়! এতটা দীর্ঘ হয় তা এখন মর্মে মর্মে বুঝতে পারছি। অপেক্ষার প্রহর গুনে গুনে ক্লান্তির জলছাপ ক্রোড়ে চেপে একদিন অপেক্ষার প্রহরের যবনিকা টানছি।
তবুও তার প্রতি ভালোবাসা এক পরমাণু মাত্রও ক্ষুণ্ণ হয়নি। দীর্ঘ ছয় বছর শেষ করে সাত বছরও শেষের দিকে প্রায় কিন্তু কোন দিন প্রাণখুলে বলতে পারিনি মনের অদ্রিসম আবেগ মিশ্রিত কষ্টগুলো। কখনো লাল একটি গোলাপ নিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেও পারিনি।
অতঃপর আমার মেডিকেলের শিক্ষা জীবন শেষ করে বিসিএস দিয়েছি,সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে প্রথম বারেই কৃতকার্য হয়েছি। এবং আমি মেডিকেল অফিসার হিসেবে জয়েন্ট করছিলাম প্রথমেই রাঙামাটির একটি দুর্গম পাহাড়ি উপজেলায়। সেখানে ছয়মাস থাকার পরে উপর মহলের সুপারিশ নিয়ে নিজ উপজেলায় পোস্টিং হয়। তখন নিজের মনের মাঝে একটি ভালোলাগা কাজ করতো। বাবা মায়ের স্নেহের ডোরে থাকবো, নিজের এলাকার মানুষের সেবা দিবো। বিষয়টা ভাবতেই সত্যি খুব আনন্দিত হতাম।
এখন আমি, আমার নিজ উপজেলা স্বাস্থকমপ্লেক্সের একজন মেডিকেল অফিসার। এখানে যোগদান করছি একমাস একুশ দিন যাবত। একদিন আউটডোরে রোগী দেখতেছি হঠাৎ ওয়ার্ডবয় এসে আমাকে একটি ফাইল দিয়ে বললো, ‘স্যার যদি একটু বাহিরে আসতেন ‘ ওর দিকে তাকায় বললাম, কেন বলো তো?’ - স্যার, জরুরী বিভাগে একটি রোগী আসছে! আমি একটু হেসে বললাম, ‘রোগী তো সবই জরুরী বিভাগেই আগে আসবে, তারপর বলো?’ - স্যার, জরুরী হলেও এটাতে একটু পার্থক্য আছে। আমি ডিউটিরত আরেক মেডিকেল অফিসারকে বললাম, ‘স্যার আসেন বাহিরে অতি জরুরি একটি রোগী আছে সেটাকে দেখে আসি।’ তখন ওয়ার্ডবয় হাতে থাকা ফাইল আমাকে দিয়ে বললো, স্যার, এই ফাইল, গ্লাপস্ পরে আর টর্চ লাইট নিয়ে সাথে একজন সিনিয়র মহিলা নার্সকে নিয়ে তারপর রোগীর কাছে যান।’ আমার আর বুঝতে বাকী রইলো না যে সে এ রোগী আমার আগেই দেখছে।
আমি গ্লাপস্ পরে, টর্চ লাইট নিয়ে একজন সিনিয়র নার্স সাথে নিয়ে রোগীর কাছে যাবো। ফাইলটা হাতে নিতেই যা দেখলাম পুলিশ কেস দিয়ে ভর্তি করছে। ভিকটিম দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। নিজ অঞ্চলে এমন রোগী দেখবো সেটা স্বপ্নেও ভাবিনাই।
এমন রোগী পেয়েছিলাম রাঙামাটিতে যখন চাকরি করতাম তখন। পাহাড়ি অঞ্চলে এক ১৩ বছর বয়সী মেয়েকে চল্লিশ বছরের এক এক লোক.....! আরো সাথে ছিলো ২০ বছরের দুই যুবক। যাইহোক এরকম রোগী আমার ঐ খানে ছয়মাস চাকরির বয়সে পাঁচটি পেয়েছিলাম।
থাক সেসব পুরনো কথা। আসল কথা বলি। ফাইলটা হাতে নিয়েই দেখলাম নাম মায়াদ্রী, বয়স বাইশ।
অতঃপর ভিতরে ডুকে রোগীর কাছে গেলাম। প্রথমে যখন টর্চ লাইটটি মেয়েটির মুখে ধরলাম! আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ওর অবয়ব টুকু যেন আমার হৃদয়ে প্রলেপ দেওয়া। যদিও দীর্ঘ দিন দেখিনা, তবুও প্রথম দর্শনেই চিনতে পারছি। পৃথিবীতে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হইছে এমন অনুধাবন করলাম শুধু আমি একা। আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তাল ঢেউ ভাবে প্রবাহিত হচ্ছে আমার বুকে। আমার ঠোঁট দু’টি ভাঙতে লাগলো। চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই অশ্রুঝরাতে লাগলো। মনে মনে বলতে লাগলাম যার অপেক্ষায় এতোটি দিন অপেক্ষার প্রহরগুনছি, হৃদয় সিংহাসনের মহারাণী করবো এমন স্বপ্নে ভিবোর থাকতাম অহর্নিশি। বিয়ে করে সুন্দর একটি সোনালী ভবিষ্যৎ গড়বো। এখন আমি ডাক্তার হয়েছি। তার পরিবারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিবো সেটা কাল রাতেও ভেবেছি।
এমন সময়ে হঠাৎ আর এম ও স্যার এসে বললো, ‘দেখছেন তো ঠিত মতো?’ আমি বললাম, ‘জ্বী স্যার।’ - সিমটম গুলো দেখে নোট করে, দ্রুত রেফার্ড করে দেনন। আমার শরীর কাঁপছে, হাত পা অবশ হয়ে আসছে। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে স্যার বললো, ‘আপনি সিমটমগুলো বলেন আমি নোট করি।’ আমি বললাম, ‘ওকে স্যার’।
দেখলাম শরীরে অনেক কাঁদামাটি, চুলগুলো এলোমেলো, গায়ের জামা অর্ধছেড়া, গালে মুখে গলার নিচে রক্তের জখম। নাভির পাশ দিয়ে যেন কুকুরে থাবা পড়ছে। পায়জামাটার উপরের বেশি অংশ ছেঁড়া রক্তে ভিজে রক্তগুলো শুকিয়ে চটচটে হয়ে আছে। স্যার বললো শুনেন, ‘এই পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে হিংস্র প্রাণী কিছুনেই।’ আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি, স্যারের কথায় সায়দিয়ে মাথা নাড়ালাম।
ফাইলটা নার্সের হাতে দিয়ে স্যারকে না বলেই চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে পাশের টং দোকানের দিকে হাঁটাদিলাম একটু নিকোটিনের পিপাসায়।
ওডি/এসএন
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড