• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : অবশেষে ইলিশটা

  অ্যান্থনী সজীব কুলেন্তুনু

২৬ মার্চ ২০১৯, ১৫:৫৪
ছবি
ছবি : প্রতীকী

সদ্য মনোনয়ন প্রাপ্ত মেয়র প্রার্থীর বক্তৃতা চলছে। মঞ্চের সামনে জড় হওয়া প্রতিটা মানুষের চোখ মঞ্চে বক্তৃতারত মেয়রের আঙ্গুলের তালে তালে নড়ছে। কথার সাথে সামঞ্জস্য রেখে মেয়রের হাত একবার উপড়ে উঠে একবার নিচে নামে, একবার শক্ত হয়, আকাশ দেখায় পদ্মার পার দেখায়। কি অসাধারণ দক্ষতা হাতের। একসময় তিনি মাইকের উপর হাত রেখে জোর গলায় বলে উঠলেন- ‘এই পদ্মার পারের মানুষ কে যোগ্য কে অযোগ্য বিচার করতে জানে। আগে অনেক নেতার বড় বড় বুলি আপনারা শুনেছেন ভাইসব। তারা জোয়ারের জলে ভেসে এসে শুধু কথা বলে আর মিথ্যা আশ্বাস ছড়ায়। আগের বার মেয়র বলছিলেন, এই পদ্মাতীরের প্রতিটা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ আসবে, রাস্তা পাকা হবে, আপনাদের জন্য নতুন বাজার করা হবে। কই গেল সেই মেয়রের কথা? বলেন? আপনারা কি এইসব পাইছেন? চুপ করে কেন? বলেন...’

জনতার মাঝে ভাড়া করে রাখা কয়েকটা চামচা জোরে বলে উঠলো- ‘না না পাইনাই...’ এদের দেখে সাধারণ মানুষ গলা মিলালো। পাইনাই, কিচ্ছু পাইনাই৷ তারপর আবার মাইকে কণ্ঠ শোনা গেল- ‘কিন্তু আমি, আপনাদের সন্তান, আর দশজনের মত নই। আমি শুধু বলবো, মানুষ পারেনা এমন কোন কাজ দুনিয়ায় নাই। আপনারাই বলেন আছে?’

চামচাসহ দুই-একজন যারা শুনছিল তাদের কেউ কেউ উত্তর দিল। কয়েকজন করতালি শুরু করলে ছোঁয়াচে রোগের মত আস্তে আস্তে করতালি সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো। মুহূর্তেই হই হই রব সাথে হাততালির ধ্বনিতে গমগমে হয়ে উঠলো পদ্মার পাড়।

শুধু মঞ্চের সামনে চটের উপর বসে থাকা বিসু নাপিতের কোন নড়াচড়া দেখা গেল না। লাল লাল চোখগুলো স্থির হয়ে রইলো সামনের মঞ্চে কথা বলা লোকটার দিকে।

‘সব শালা মিথ্যাবাদী’-মনে মনে ভাবে বিসু। ‘কোন শালা ভালা মানুষের বাচ্চা না। সবগুলান এল লাইনের ধান্দাবাজ৷ আছে খালি মানুষগুলানরে মারবার তালে।’ কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে মনে মনে শক্ত হয়ে উঠে সে। মুখ থেকে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি বের করে। সামনে ভাষণ চলছে সদ্য মনোনয়ন পাওয়া পৌর মেয়র প্রার্থীর।

হঠাৎ বিসুর অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। নদীর পাড়ে জনসভার প্যান্ডেল করা হয়েছে। মাথার উপরে সূর্য। লাল, কমলা আর গোলাপী রঙের সামিয়ানা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তবুও চারিদিকে যেন ভ্যাপসা গরম উঠেছে। চেপে ধরছে বিসু নাপিতকে। এত এত লোকের মাঝে বসে থাকার জন্যই বোধহয় এই অস্বস্তি। সামনে বয়ে চলছে বক্তৃতার ঝড়। বাজে কথা আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ছড়াছড়ি শুধু। একবার ভাবে বিসু, দোকান বন্ধ করে এই সব জনসভায় আসা বোকামি ছাড়া কিছুই না। তাই পাঁচ-সাত না ভেবে সোজা উঠে দাঁড়ায় সে। পাশে বসে থাকা কমল দর্জি জিজ্ঞেস করে- - কিরে বিসু, উঠলি পরে? - দোকান ফেল্যা আইছি, খোলা লাগবি। এসব করলি সংসার চলবি পরে? তু থাক।

নদীর পার ধরে হাঁটলে মিনিট পাঁচেকের পথের পর বড় বাজার। বাজারের পশ্চিম পাশে, মাছের আড়ৎঘরগুলো যেখানে, এর ঠিক উলটো পাশে বিসু নাপিতের ছোট্ট একটা টিনের সেলুনঘর। ভেতরে একটা কাঠের চেয়ার, একটা টুল, কালো হয়ে আসা গোটা কয়েক ইট, সামনে একটা কোণা ভাঙ্গা আয়না, কয়েকটা সেভিং ফোমের টিউব, দুটো চুল কাটার কালো কাঁচি আর একটা ক্ষুর। বিসু নাপিতের সম্বল বলতে দুটো জিনিস - বাপের ভিটায় একটা চৌচালা টিনের ঘর আর বাজারের এই ছোট্ট টিনের সেলুন। জমিজিরাত নেই বহু আগে থেকেই। বাপের তিনবিঘে জমি ছিল এক কালে। নদীর পাড়ের এই জমিটুকুতেই চাষবাস করে দিন চলতো। কিন্তু এক বর্ষায় নদীর পানি বাড়লো। স্রোত রাক্ষসের মত খুবলে খুবলে খেয়েনিল ফসল ভরা মাঠ। যেটুকু বাকি ছিল আজকে সেটুকু থাকলেও বিসুর চলে যেত। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই গভীর রাতে পুলিশ ঢুকলো বাড়িতে। কোমরে দড়ি পরালো বিসুর বাবা পরাণ মণ্ডলকে। অপরাধ, আগের সপ্তায় নগত পঁচিশ হজার টাকা দিয়ে তিনি যে হালের বলদটা কিনেছিলেন সেটা নাকি তিনি চুরি করে এনেছেন নদীর ওপাড়ের আফজাল সরকারের গোয়াল থেকে। বিসুর অবশ্য তখনো কিছুই বুঝে উঠার বয়স হয়নি। বড় হয়ে মার মুখে শুনেছে- আফজাল সরকার পশ্চিম পাড়ের জমিদারের মত। চোর চুরি করে গরু বিক্রি করেছিল চন্দননগরের গরুর হাটে। পরান মণ্ডল সেই গরুটাই কিনেছিলেন পানির দরে; সস্তা পয়সায়। কিন্তু তিনি কি আর জানতেন ওটা চুরির মাল। যা হবার তাই হলো। আফজাল সরকার লোক লাগালেন দশ-বারো। ওরা সন্ধান করে গরু পেল বিসুদের বাড়ি। আর তারপর পুলিশ। কত মার মারলো.. আহারে! একটা কথাও বিশ্বাস করলো না। এদিকে বিসুর মাকে সাহায্য করার একটা মানুষ নেই গ্রাম জুড়ে। মোটে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো তিনটে হিন্দু ঘর। পড়ালেখা জানা লোক নেই কেউ। টাকা পয়সার ছড়াছড়ি নেই, তাই পুলিশের সামনে বা আফজাল সরকার কারো সামনে দাঁড়াবার শক্তি বা সাহসও নেই কারো।

ঠিক এমন সময়ে সাহস করে এগিয়ে এসেছিল কমল দর্জির বাবা নিবারণ ঘোষ। পুলিশের কাছে গেল কথা বলতে। সাথে নিয়ে গেল বিসু আর বিসুর মাকে। পুলিশের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলো তাড়াতাড়ি পুলিশের পকেট ভড়াতে হবে নাহলে কোর্টে চালান করে দেবে ওর বাবাকে। আর সেটা হলে নির্ঘাত এক বছরের জেল। গরীবের তো আর ব্যাংক ব্যালেন্স থাকেনা। সম্বল ওই জমিটুকুই। মাথায় আকাশ ভাঙলে আর চারিদিকে অন্ধকার বোধ করায় বাধ্য হয়ে বেঁচে দিতে হল জমিটা। সেই টাকা দিয়ে কোনরকম বাঁচিয়ে আনা গেল পরান মণ্ডলকে। তবে পরাণ মণ্ডলের প্রাণ তখন ঘোর আশঙ্কায়।

এর পর থেকেই নিবারণ ঘোষের প্রতি সবার শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেল। লোকটাকে ভগবান পাঠিয়েছিল ঠিক। আজও বেঁচে আছেন তিনি, বিসুর নিবারণ কাকা। কাকা বলে ডাকে বিসু। তবে তেজটা আর আগের মত নেই। বয়সের ভারে চাপা পড়েছে অনেকখানি।

পরান মণ্ডল অবশ্য দুনিয়ায় টেকেননি বেশিদিন। পুলিশের অমানবিক নির্যাতনে শরীরের অনেক কিছুই হয়তো বিকল হয়েছিল অজান্তেই। মাস দুই না যেতেই চলে গেলেন। সব হারালো ওরা। শুধু টিনের চৌচালা ঘরটা ছাড়া। মা সরলা দেবী জাত-বেজাত, লজ্জা সরম ভুলে মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে পেটে ভাত যোগাতো। তাই কোনদিন স্কুলের চৌকাঠা পেরুতে পারেনি বিসু এবং বিসু সারাজীবন বিসুই হয়ে রইলো। শুধু নামের পরে নাপিত শব্দটি যোগ হলো। মা সরলা দেবী মারা যাবার পর যেদিন থেকে সে মানুষের চুল কাটা শুরু করলো।

প্রথমে পদ্মার পাড়ের চন্দননগরে বাজারের মাঝ বরাবর যে ছাতিম গাছ তার তলায় একটা কাঠের চেয়ার পেতে দিয়ে মানুষের চুল কাটা আর দাড়ি কামানোর কাজ করতো বিসু। গাছের সাথে পেরেক ঠুকে আয়না ঝুলিয়ে তার সামনে খদ্দের বসিয়ে চকচকে কাঁচি চালিয়ে চুল কাটতো। তখন কেবল শুরু। আর আজকের এই টিনের দোকানঘর হয়েছে বিয়ের পরে। শশুর অনেকটা পণ হিসেবেই করে দিয়েছে এটা। যত ছোটই হোক। বউ ছেলে নিয়ে পেট তো চলে, এতেই খুশি বিসু।

দুই বেলা এগারোটা বাজে দোকান খুললো বিসু। রাস্তার উল্টোপাশের মাছের আড়তে তেমন ভিড় নেই। ভিড় যা হয় সকাল সকাল। সব খুচরা মাছওয়ালারা ভোর হতে না হতেই হুড়োহুড়ি করে মাছ নিয়ে বসে যায় যে যার মতন। বেলা যত বাড়ে আস্তে আস্তে তাদের তাড়াহুড়োও কমে। আর জমে উঠে খোলা মাছের বাজার। তখন আড়ৎদাররা বসে বসে টাকা গোনে।

বিসু দোকানে আগরবাতি জ্বালিয়ে অর্চনা দেয়। মাথার উপরে তক্তায় একটা গণেশের মূর্তি। গায়ের গোলাপী রঙ অনেকটা যায়গা জুড়ে উঠে গেছে। মূর্তিটার সামনে বার কয়েক ধূপ কাঠি ঘুরিয়ে এনে গুঁজে রাখে টিনের খাজে। তারপর চেয়ার টেনে বসে পড়ে। ইদানিং দোকানে মানুষের আনাগোনা খুব কম।

দোকানটাও পড়েছে বেজায়গায়। চুল কাটার প্রয়োজন হলে কেউ মাছের আড়তের পাশে আসবে কখনো? ভাবে বিসু। বরং একটা সাইনবোর্ড লাগাতে পারলে বেশ হতো। ভাবতে ভাবতে চোখ যায় আড়তে। ফ্যানের নিচে চেয়ার পেতে অনেকটা টান হয়ে বসে আছে আশরাফ আড়ৎদার। লোকটার বিশাল এক পেট। বুকপকেট সবসময় টাকায় ফুলে থাকে। খুচরা টাকা নয়। অসম্ভব রকমের পানখোর আর ফ্যাঁসফ্যাসে গলার স্বর। যখন মাছ ওজন দিতে পাল্লায় তোলা হয় তখন ফ্যাঁসফ্যাসে এই গলার জোরে জোরে আওয়াজ এক হাস্যকর ধ্বণির সৃষ্টি করে। একের পর এক পাল্লা তুলে চিৎকার করে বলতে থাকে.. এ..... পাঁচ পঞ্চাইস, পাঁচ পঞ্চাইস, পাঁচ পঞ্চাইস এ..... ছয় পঞ্চাইস, ছয় পঞ্চাইস, ছয় পঞ্চাইস এ..... সাত পঞ্চাইস, সাত পঞ্চাইস, সাত পঞ্চাইস

সকাল আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ সব ঝামেলা চুকে যায় আড়ৎগুলোতে। তখন লোকটা বসে বসে হাওয়া খায় আর কর্মচারীদের সাথে কথা বলে। মাঝে মাঝে বড় মাছ আসলে বিসু দেখতে যায়। বড় মানে স্বাভাবিকের চাইতে বড় মাছ আসে কালে ভদ্রে। একবার শাওন মাসে মাঝামাঝি সময়ে, সারারাত বৃষ্টিতে ঘড়ে যায়নি বিসু, দোকানেই ছিল। ভোরে ঘুম ভাঙতেই একটু হট্টগোল কানে আসলো। ঝাপ তুলে দেখে আশরাফের আড়তে বেশ কয়েকজনের জটলা। সেই দলে যোগ দেয় বিসু নাপিতও। জটলার মাঝে যা দেখে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় ওর। ইয়া বড় এক কাতল মাছ। তখনো পাল্লায় চাপানো হয়নি বলে সবাই ওজন কত হতে পারে তা নিয়ে বলাবলি করছিল। ভোরবেলা কালু মাঝির জালে আটকেছে মাছটা। নায়ে তুলতে গিয়ে তিন ভাইয়ের যে কি হাল হয়েছে সেই গল্প শুনে রোমাঞ্চিত হয় জড় হওয়া সকলে। দুইএক জন বলে উঠে- - সাইজ দেখি তো মনে কয় আধমন খানেক হবি, বুইল্যা আশরাফ। আরেকজন ডানে বামে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, - কি কও মিয়া, ইয়া দেইখি তোমার আধমন মনে হচ্চে? ওয়া এত ওজন হয় ক্যাবা করি! এই মতামতে অনেকেই সায় দেয়। বিসুও সায় দিয়ে বলে- - হ, ঠিকই কচেন, আমার মনকয় কেজি দশেক হবি, লয় বারো চোদ্দ কেজি। এ কাতল এত ওজন হবি ল্যা। বুঝল্যা কালু?

প্রথমজন বিসুর অনুমানে বিরক্ত হয়। দুই-একজনের হাসি পায়। আশরাফ ততক্ষণে মাপঝোঁকের সব কিছু রেডি করে ফেলেছে। এক পাল্লায় ধরাধরি করে মাছটা তোলা হয়। অন্যদিকে আশরাফ একের পর এক বাটখারা দিতে থাকে। প্রথমে দুইটা পাঁচকেজির বাটখারা উঠালে ভুল ভাঙে সকলের। অপর প্রান্তে মাছের পাল্লা হালকা উঠে আবার নিচে হেলে পরে। দুই পাশ সমান কর‍তে দিতে হয় আরোও একটা পাঁচ কেজির বাটখারা। অদ্ভুতভাবে পনেরো কেজিতে এসে সমান হয় দুই পাল্লা। সবার মাঝে ফিসফিস শুরু হয়ে যায় বিসু নাপিতের অনুমানের ক্ষমতা দেখে। বয়স্কদের একজন আল্লার রহমতের প্রশংসা শুরু করে দেয়। আল্লাহ তুমি কত দয়াবান! কি ক্ষমতা তোমার! পদ্মা কি ফলশালী! সবই তোমার দয়া। আল্লাহ হু আকবর! বেলা বাড়ার সাথে সাথে মাছ শিকারি এই তিন ভাইয়ের নাম ছড়িয়ে পড়ে বাতাসের আগে আগে। আর অনেকদিন পর্যন্ত এর রেশ রয়ে যায় গ্রামের মানুষের মাঝে। মাছটা অবশ্য কে কিনেছিল তার খোঁজ নেয়নি বিসু। কিন্তু সারাদিনে যে পরিমাণ লোক জড় হয়েছিল আশরাফ এর আড়তে, টিকেটের ব্যবস্থা করলে ব্যবসা খুব জমে উঠতো সেদিন।

এরকম বড় বড় মাছ আসলে একফাঁকে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে আসে বিসু। কিন্তু কোনদিন কিনবার সামর্থ্য হয় না। সংসারে এত অভাব, এত নাই নাই এর মাঝে ‘ভালো খাই’ এর চিন্তা গরীবের মস্তিষ্কে অত্যন্ত অল্প আলোড়ন সৃষ্টি করে। দুনিয়ায় গরীব ভগবানের এক অভাবনীয় সৃষ্টি। ওরা পারেনা এমন কোন কঠিন কাজ তো নেই। আবেগ আর অনুভূতিগুলোকে এত সহজে বলি দিতে জানে এমন কোন দ্বিতীয় প্রাণী ভগবান সৃষ্টি করেননি।

একদিন বিসু তার ছেলেটাকে নিয়ে এসে রেখেছিল দোকানে। আশরাফ মাণিককে দেখে আদর করে নিয়ে গিয়েছিল তার আড়তে। বরফ দিয়ে রাখা বড় বড় ইলিশ দেখে খোকার সে কি বিস্ময়! অবোধের সে বিস্ময় যেন আর কিছুতেই কাটেনা। বাড়ি নিয়ে যাবার সময় সে কি বায়না। ওই একটা মাছ তাকে কিনে দিতেই হবে। সে কোনদিন এত বড় ইলিশ মাছ খায়নি। বাবা কোনদিন বাড়িতে ইলিশ নেয় না। মাছের মধ্যে কেবল ছোট ছোট পুঁটি নাহয় গুড়া মাছ। আজ আশরাফ কাকার আড়তে না গেলে সে জানতোই না এত বড় বড় মাছ হয়। কি নাম একেকটার, রুই, কাতল, একটা সোনালী রঙের মাছ ছিল যেটার নাম এখন সে মনে করতে পারছে না। আর বরফ দেওয়া সব চেয়ে সুন্দর যে মাছটা, নাম ইলিশ.. লাল চোখ, কি সুন্দর দেখতে। আচ্ছা, পদ্মা নদীতে এই মাছ পাওয়া যায়? সে যদি বড়শি ফেলে তাহলে ওই ইলিশ মাছ কি ধরতে পারবে না? বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে সাধ হয় কিন্তু আজ বাবার সাথে সে কোন কথা বলবে না মনে মনে ঠিক করেছ। তাই অনেক কষ্টে ঠোঁটের সামনে চলে আসা কথাটাকে আবার গিলে ফেলে সে। মাছ বড়শি খাক আর না খাক, আজ সে বড়শি ফেলবেই নদীতে। বাড়ি ফেরার সারা পথ সে এ চিন্তা করেই কাটিয়ে দেয়, কোন কথা বলেনা বিসুর সাথে।

খোকার মনের খবর পিতার অজানা থাকে না, নিজেকেই সে জন্য সে দোষী করে। কিন্তু কিছু করার থাকেনা তার৷ সারা সপ্তাহর উপার্জন এক করলেও অই একটা ইলিশের দাম হবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু এ বুঝ তো অবোধকে বুঝানো যায় না৷ অবোধকে বুঝানো যায় না গরীবের রাগ অভিমান বলে কিছু থাকতে নেই, গরীবের থাকতে হয় তীব্র সহনশীলতা।

রাতে বাড়ি ফেরার আগেই বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়ে খোকা। অভিমান ভাঙানো ভার। সকালে ঘুম ভাঙলে শিশুমনে হালকা হয়ে যায় ইলিশের স্মৃতি। শুধু বিসুর প্রাপ্তবয়স্ক মস্তিষ্ক থেকে হারায় না কিছুই।

তিন কার্তিক মাসের শুরুর দিকে নদীর পারের জেলেদের কর্মব্যস্ততা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ঝাকে ঝাকে ইলিশ ধরা পড়ে জালে। জেলেদের মুখে আর বৃদ্ধ মাঝিদের চামড়ার ভাজে ভাজে ফুঁটে উঠে উজ্জ্বল স্বপ্ন রেখা; সামান্য সুখের। জেলেদের আসা যাওয়া বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে! বিসু আস্তে করে জিজ্ঞাসা করে- - ইলিশ, সেরে দর উটিচে কত? আশরাফ বিসুর মুখ থেকে ইলিশ মাছের দাম জানতে চাওয়ার প্রশ্নে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ মুখের ভেতর থাকা পান চিবানো থামিয়ে বলে, ‘ওয়ার সের কত, তা তুমার জানি কাম কি মিয়া? হাটের পুঁটি মাছ শ্যাষ আইজকে? কিনতে পাওনি?’

কথাটা শ্রবণইনদ্রীয়তে পৌঁছা মাত্র বিসুর মুখের অতি সাধারণ মৃদু হাসি অনন্তে মিলিয়ে গেল। এক মুহূর্তে মাথাটা উলট পালট হয়ে গেল। দেহের অভ্যন্তরে প্রবাহিতত রক্তের গতি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গিয়ে স্বাভাবিক চিন্তা চেতনাকে ব্যহত করলো এবং চোখ দুটোকে ভয়ানক রূপে লাল করে তুললো। বিসু শৈলকণ্ঠে আবার জিজ্ঞাসা করলো, ‘সের কত কও? তোমার একটা মাছ এক সের হবি পরে?’ আশরাফ বিসুর কণ্ঠের অস্বাভাবিকতা খেয়াল করে না বরং বিরক্তি নিয়ে উত্তর দেয়, ‘এক দর, সারাদিন ৮০০ ট্যাকা। পাইকারি ঘরে আইস্যা মিয়া সের এর হিসাব কর? তাও আবার ইলিশের!’ শেষের লাইনটা তীরের মত বিধে বিসু নাপিতের কানে। সেই কঠিন সত্য তীরে আক্রান্ত হয়ে বিসু বেরিয়ে সোজা চলে আসে তার টিনের সেলুন ঘরে। সরাসরি হাত দেয় কাঠের ড্রয়ারে। অনেক গুলো খুচরো টাকার মধ্যে থেকে বের করে কয়েকটি একশ টাকা পঞ্চাশ টাকার নোট৷ সব গুছিয়ে গুনে দেখার অবস্থা থাকেনা বিসুর। তবে চলতি সপ্তার সব টাকা আশরাফের দিকে ছুড়ে দিয়ে বরফ থেকে বড় একটা মাছ হাতে তুলে নিয়ে সোজা হাঁটা শুরু করে বাড়ির দিকে। আশরাফ কিছু বলেনা। টাকা গুলো গোছাতে নিয়ে গুনতে গিয়ে অবাক হয় সে। টাকা যা ছিল তার যোগফল দাড়ায় হাজারের ও বেশি।

চার পাশাপাশি দুটি হিন্দু ঘরের একটিতে উৎসব লাগে যেন। বিসু নাপিতের বউ স্বামীর হাতে কেজি খানেক ওজনের ইলিশ দেখে প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। নদীর পারের রাস্তা দিক থেকে আস্তে আস্তে বিসু এগিয়ে আসতে থাকলে একসময় বিসুর মুখমণ্ডলের অস্তগামী সূর্যের মত সামান্য একটুকরো হাসি দেখা যায়। খোকা পদ্মায় অর্ধেকটা বিলীন হওয়া একটুকরো জমিতে পাড়ার আর ছেলেমেয়েদের সাথে কি একটা খেলছিল। বাবাকে দূর থেকে আসতে দেখে খোকা ছুটে কাছে চলে আসে।

বিসু বলে, ‘খোকা এদিক আয় দেহি পরে। দেখি যা কি আনিচি।’ ততক্ষণে খোকা এসে বাবাকে ছোঁয়। তারপরেই বাবার হাতে থাকা সোনালী রঙের একটা বড় মাছ আবিষ্কার করে সে। মনে পরে যায় সেই দিন হাটে মাছের আড়তে এই একই মাছ সে দেখেছিল। বায়নাও করেছিল। খোকা যেন এক মুহূর্তে চাঁদ ছোঁয়ার উপলব্ধি লাভ করে। বাবার হাত থেকে মাছটাকে নিজের হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়ে এগিয়ে যায়। খোকার মা বাড়ির উঠানে থেকে প্রত্যক্ষ করছিল সব। খোকার আনন্দে বাড়ি মুখর হয়। বিসু উঠানে আসলে মাথায় কাপড় টেনে স্ত্রী বলে- -এত বড় সাইজের ইলিশও হয় পরে? - হয়না আবার! এত ছোটই। বাঝার-গাট করনি বলি দ্যাকোনি ককোনো! আরোও বড় হয় পরে। ওইগুলান বিদ্যাশে চালান দ্যায়।

বিসুর বউএর চোখে বিস্ময় ফুঁটে উঠে। পাশের ঘরের কমল দর্জির বউ একবার এসে দেখে যায়। মাছ দেখে সে ও একই কথা বলে। এর চাইতেও বড় ইলিশ সে দেখেছে জেলেদের নাওয়ে। ওদের ঘরে ইলিশ মাঝে মাঝে রান্না হয়। বাতাস সে খবর বয়ে আনে। কমল দর্জির অবস্থা একটু হলেও বিসুর চাইতে ভালো!

ভাঙ্গাকূলো আর ছাই নিয়ে মাছ কাটতে লেগে যায় বিসুর বউ। খোকা কিছুক্ষণ মাছ কাটার দৃশ্য উপভোগ করে। মাছ কাটা, আঁশ ছাড়ানো, অন্ত্র তন্ত্র বের করা সবই দেখে এক ভিন্ন বিস্ময় নিয়ে। তারপর মাছ কাটার পালা শেষ হলে মাছ ধুয়ে রান্নার ব্যবস্থা করতে ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় মাছ।

খোকা বাবার ঘাড়ে চরে বেড়াতে বের হবে এমন সময় বিসুর বউ এসে বলে- - ইলিশ মাছ নিয়া আসিছেন, কই মশলাপাতি তো কিছুই আনলেন্না পরে। আদা রসুন ছাড়া রান্না ক্যম্নে হয় কন দেখি! বিসু যথাযথ জবাব খুঁজে পায় না। মশলা ছাড়া তো আর ইলিশ রান্না করা যাবে না। আর মশলা আনার কথাও মাথায় ছিল না একদম। আর এখন এ কালি সাঁঝে ঘরে কাঁচা ইলিশ মাছ রেখে বাজারে গিয়ে মশলা আনাও ঠিক হবেনা। কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা বিসু।

কিন্তু দুনিয়ায় গরীব এক অদ্ভুত শ্রেণী। এরা খুব দক্ষভাবে আবদার করতে এবং চাইতে জানে। আর যে চাইতে জানে তার সমাধানের অভাব হয় কখনো!

বিসু বলে- - মশলা পাতি নাই, আগে তো কওনি। এখন দ্যাকো কমল দর্জির বাড়িত আছে ঠিক। একটু চায়া নিয়া আসলে কাল কিইনে আনে দিয়ে দেবো পরে। - আচ্চা। তালে নিয়ে আসি। বউ এর মুখের অনিশ্চয়তা কেটে যায়। সে ঘুমটা টেনে চলে যেতে লাগলে বিসু বলে উঠে- -কিন্তু কাল যাবার আগে মনে করায় দিও এ কথা। বউ মাথা নাড়ে।

খোকাকে কাঁধে চড়িয়ে একটু এগুতেই দেখা হয় আশরাফ আড়ৎদার এর ছোট ভাই কাসেম মোল্লার সাথে। দুই একটা কথা হচ্ছিল এমন সময় পেছন থেকে হঠাৎ একটা আর্তনাদ শোনা গেল। বিসু বউ এর গলা চিনতে পেরে খোকাকে নিচে নামিয়ে অজানা আশংকায় ঘরের দিকে দৌড় দেয়। সন্ধ্যার অন্ধকারে দুর্বল কুপির আলোয় দৃশ্যমান হওয়া ছবিতে বউকে উঠানে কপালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। বিসু কিছু বুঝে উঠার আগেই খোকা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলে- - চারটি কুত্তা বাবা। বড় বড়। শেয়ালও হতি পারে। মুখে করি মাছ গুলি নিয়া কি দৌড়! আমি কি আর পারি ধরতে কও বাবা। বলে খোকা মাটিতে বসে পরে। বউ এর কোন নড়াচড়া লক্ষ্য করা যায় না। পায়ের কাছে গোটা কয়েক আদা পরে থাকে।

গরীবের ঘরের চারিদিকে অন্ধকার জেঁকে বসলে মৃদু আলোর কুপি কেঁপে কেঁপে সে অন্ধকার প্রতিরোধ করে চলে। আর দূরে কোন স্থানে কয়েকটি কুকুরের উল্লাসধ্বনি ভেসে আসে বাতাসে।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড