• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৪ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : কুমারী কন্যার মুখ

  রোকেয়া আশা

২৬ মার্চ ২০১৯, ১২:০৭
গল্প
ছবি : প্রতীকী

সাইদুর মোল্লা এলাকার মোটামুটি প্রভাবশালী লোক ছিলেন একসময়। তবে সবচে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন একাত্তর পরবর্তী সময়ে। একাত্তরে পুরো যুদ্ধের সময়টা তার কাছে একটা সুযোগ ছিলো, সম্ভবত। যে কারণে একাত্তর পরবর্তী সময়ে দেখা যায় গ্রামের অর্ধেক জমিজমা তার নামে রেজিস্ট্রি করা। সাইদুর মোল্লার আগে গ্রামের সবচে প্রভাবশালী ছিলেন আব্দুল কাদের ভূঁইয়া। একাত্তরে যুদ্ধকালীন সময়টায় এই লোক নিজের মেজ ছেলের সাথে অনেকটা জায়গাজমি আর অস্থাবর কিছু সম্পত্তিও হারিয়েছেন।

এই দুইজনের পরবর্তী ক্ষমতার পরিবর্তনের কারণ হয়তো তাদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন। কে না জানে, টাকা থাকলে লোকের ভক্তিও মেলে।

‘তুমি রুশির কাছে যাবেনা।’ সাবিনার গলা খুব শক্ত শোনায়। অবাক হয়ে সাবিনার দিকে তাকায় দুজন মানুষ। একজন সাবিনার স্বামী, এনায়েত কবির; আরেকজন সাবিনার মা, সেতারা।

রুশি সাবিনার মেয়ে, একমাত্র মেয়ে। বারো বছর বয়সী মেয়েটা। ছেচল্লিশ বছরের সাবিনার এই একটাই সন্তান। রুশির জন্মের আগে সাবিনার দুটো মিসক্যারিয়েজ হয়। প্রথম জীবিত সন্তান। প্রথম সন্তানের স্নেহমুখ ছুঁয়ে দেখা সাবিনার - সে তো রুশিই। বেসরকারি হাসপাতালের করিডোরে সাবিনা এনায়েত মুখোমুখি দাঁড়ানো। সাবিনার কাঁধে সেতারার হাত। মায়ের স্পর্শ; ভরসার ছোঁয়া। এই প্রথম সাবিনার অনুভূতিতে তার মা। অদ্ভুত! এতগুলো বছর মায়ের এই স্পর্শটা কই ছিলো?

সাবিনার জন্মের পর ওকে দেখে প্রতিটা মানুষ প্রথমেই বলতো, মেয়ে অন্যরকম সুন্দর। সাবিনা যত বড় হতে থাকে, ওর রূপও খুলতে থাকে পাল্লা দিয়ে। যেই দেখতো, সেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো। কি সুন্দর মসৃণ ঘন সোজা চুল, বড় বড় গাঢ় বাদামী চোখ, লম্বা নাক। কেমন মসৃণ ত্বক, লাবণ্য ফুটে ওঠা গোলাপি আভা পুরো মুখ জুড়ে। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছে সাবিনা, সে সুন্দরী। বাঙালি মেয়েরা সুন্দর, কিন্তু ওর মত অপ্সরী কম মেয়েই হয়। সেতারার বাবা আমাদের পূর্বপরিচিত। সাইদুর মোল্লা। তিনি ধনী। টাকা আর ক্ষমতা থাকলে মেয়ের বিয়েও ভালো ঘরে দেওয়া যায়। সাইদুর মোল্লা তার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ভালো ঘরে। সেতারার স্বামী ডাক্তার। একাত্তরে যুদ্ধ চলা একটা দেশে মেয়ের ডাক্তার পাত্রের সাথে বিয়ে দেওয়া মুখের কথা না। এজন্য এলেম লাগে। সাইদুর মোল্লার এলেম ছিলো। তিনি নিজের ষোড়শী মেয়েকে ঠিকঠাক মত পার করে দিতে পেরেছিলেন। বিয়ের নয় মাসের মাথায় জন্ম হয় সাবিনার।

সাবিনার বাবাও ঠিক তার শ্বশুরের মতই এলেমওয়ালা মানুষ। তিন ছেলেমেয়ে সবাইকে তিনি পড়াশুনা করিয়েছেন; সাবিনাও বাদ পড়েনি। এপ্লাইড কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করা সাবিনার বিয়ে হয় দেশের কর্পোরেট জগতের পরিচিত মুখ এনায়েতের সাথে। অল্প বয়সেই পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরে উন্নতি করেছে এনায়েত। সাবিনাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে এনায়েত আর তার পরিবার। অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে, পছন্দ না করে উপায় নেই।

সাবিনাকে বিয়ে করার পর থেকে সাফল্য চারদিক থেকে আরো আসতে থাকে এনায়েতের কাছে। ইন্টারন্যাশনাল ডিল ও পেতে থাকে একের পর এক। বড় এমাউন্টের ডিল সব। আশেপাশের সবাই বলতে থাকে, এনায়েত কবিরের বউ খুব পয়া।

বিয়ের সাত বছরের মাথায় কন্যাসন্তানের জন্ম দেয় সাবিনা। এনায়েত শখ করে মেয়ের নাম রাখে রুশি। মেয়ে দেখতে ঠিক মায়ের মত, শুধু চোখ দুটো বাদে। সাবিনার চোখ বাদামী, আর রুশির চোখ নীল। আকাশের মত।

এই মেয়েও স্বর্গের সব সৌন্দর্য পৃথিবীতে নিয়ে চলে এসেছে। কন্যা জন্মে রূপ না থাকা পাপ, রূপ থাকাও পাপ। দ্বিতীয় পাপটা রুশি করেছে। সে স্বর্গীয় রূপ নিয়ে কুৎসিত একটা পৃথিবীতে চলে এসেছে। ফলাফল, নিজের বাড়িতে বাবার এক ক্লায়েন্টের কাছে ধর্ষিত হয় এই কিশোরী। কিশোরী কি বলা যায়? বারো বছর বয়সী মেয়েটা। দুমাস আগে মাত্র ঋতুবতী হয়েছে। কিশোরী? নাকি বালিকাই?

গুলশানে বিশাল আলিশান বাড়ি টায় রুশি একা ছিলো না, কাজের মেয়েটাও ছিলো। তিনটা মানুষ আর কাজ করার জন্য চারটা অস্বীকৃত নমানুষ থাকে এই বাড়িতে। ড্রাইভার, দারোয়ান, কাজের লোক দুজন। একজন বয়সী মহিলা, আর একটা বাচ্চা মেয়ে। সব এনায়েত কবিরের ঠিক করা লোক। সেদিন বয়সী মহিলা বাড়িতে ছিলো না, বাজারে গিয়েছিলো। এনায়েত ছিলো প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে। এক ক্লায়েন্ট পার্টি এরেঞ্জ করেছিলো। সস্ত্রীক উপস্থিত না হলে মান থাকতো না।

বাড়িতে শুধু দুটো বাচ্চা মেয়ে ছিলো; রুশি আর আফসানা। আফসানার বয়স নয় বছর। হাড় জিরজিরে, গায়ের রং কেমন সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কালো কিংবা শ্যামলা।

কন্যা জন্মে রূপ ছাড়া জন্মের এই পাপটুকু আফসানাকে সেদিন বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। হর্ষদ ভারদ্বাজ এনায়েত কবিরের পুরনো ক্লায়েন্ট। ভারতীয়। বিদেশী বলে খাতির যত্ন বেশী তার। বাংলাদেশে আসেন বছরে পাঁচ থেকে ছয়বার। এবার এসেই তথাকথিত বন্ধু এনায়েতকে সারপ্রাইজ দিতে সরাসরি বাড়িতে চলে আসেন তার। যদিও এসে দেখেন বন্ধু বা বন্ধুপত্নী কেউই বাড়িতে নেই। তবে বন্ধুর সুন্দরী কুমারী কন্যা আছে। রুশির চিৎকার বাড়ির গেট পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ছোট্ট আফসানা চিৎকার করে কাঁদা ছাড়া কিছু করতে পারেনি। রুশিকে বাঁচাতে পারেনি।

এনায়েত এগিয়ে এসে সাবিনার কাঁধে হাত রাখার চেষ্টা করে; সাবিনা ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দেয়। থু করে থুথু ছিটিয়ে দেয় স্বামীর মুখে। হতভম্ব এনায়েত তাকিয়ে থাকে। সাবিনা চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘তুমি কিভাবে জানলে মেয়েটা তোমার? ক্লায়েন্ট বাগাতে, ডিল ফাইনাল করতে তো দিনের পর দিন আমার শরীরটা ব্যবহার করে গেছো। রুশি তো তোমার মেয়ে নাও হতে পারে। পারেনা?’

সেতারা চমকে ওঠে। তার মেয়ের শরীরটাও কেউ খেলনা বানিয়ে খেলেছে? মেয়েটা সেতারার চাইতেও দুঃখী? এত কষ্ট আড়াল করে ছিলো এতদিন?

সাইদুর মোল্লার সাথে মিলিটারিদের সম্পর্ক ভালো ছিলো, বেশ ভালো। একরাতে তার বাড়িতে রাতের খাবার খেতে আসা কর্নেল ফারিক ইহসানের চোখ পড়ে সাইদুর মোল্লার ষোড়শী কন্যা সেতারার ওপর।

পরের সপ্তাহেই সাইদুর মোল্লা তাড়াহুড়ো করে সেতারার বিয়ে দিয়ে দেন। সাবিনার জন্মের পর ওর অদ্ভুত আরবদের মত রূপ দেখেই সেতারা নিশ্চিত হন, এই মেয়ে পাকিস্তানী রক্তের। মেয়েকে কখনোই মন থেকে মানতে পারেননি সেতারা। অথচ কি অদ্ভুত, এই মেয়ে ঠিক মায়ের মতই দুঃখী, কিংবা কে জানে, তার চেয়েও বেশী।

নাহ্, বেশীই। দু দুটো সন্তানকে জন্মের আগেই হারিয়েছে; এটা কি দুর্ঘটনা? বায়োলজিক্যাল কোন সমস্যার জন্য? নাকি ওই সময়টায় ও কারো শয্যাসঙ্গী হতে বাধ্য হয়েছিল মেয়েটা? গর্ভপাত দুটো তার ফল না তো?

সাবিনাকে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে সেতারা। উনিশশো একাত্তর সালে ঠিক যেই মুহূর্তে কিছু বাঙালি নিজভূমির নারীদের স্পর্শ করার সুযোগ করে দিয়েছিলো পাকিস্তানিদের; ঠিক তখনই এটা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো - তারা নিজেদের নারীদের রক্ষা করার যোগ্যতা হারাবে। এক একটা সময় পাকিস্তানি ফারিক ইহসান, বাংলাদেশের এনায়েত কিংবা ভারতীয় হর্ষদ ভারদ্বাজ - সবাই কেমন একই পুরুষ হয়ে যায় সহসাই।

রুশির কুমারী মুখ হঠাৎ হয়ে যায় একাত্তরের মানচিত্রের মতন। সেতারা কাঁদছে, কাঁদছে সাবিনাও। তাদের চোখে একটা পুরো মানচিত্রের দুঃখ।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড