• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

স্বাধীনতা দিবসের ছয়টি বিখ্যাত কবিতা

  অধিকার ডেস্ক    ২৬ মার্চ ২০১৯, ০৮:৩৪

কবিতা
ছবি : প্রতীকী

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা - শামসুর রাহমান

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ? আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?

তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা, সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল, সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর। তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা, শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো দানবের মত চিৎকার করতে করতে তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা, ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড হলো। রিকয়েললেস রাইফেল আর মেশিনগান খই ফোটাল যত্রতত্র। তুমি আসবে বলে ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম। তুমি আসবে বলে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার ভগ্নস্তূপে দাঁডিয়ে একটানা আর্তনাদ করল একটা কুকুর। তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা, অবুঝ শিশু হামাগুডি দিলো পিতা-মাতার লাশের উপর।

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ? আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ? স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুড়ো উদাস দাওয়ায় বসে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে মোল্লাবাডির এক বিধবা দাঁডিয়ে আছে নড়বড়ে খুঁটি ধরে দগ্ধ ঘরের।

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে বসে আছে পথের ধারে। তোমার জন্যে, সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক, কেষ্ট দাস, জেলেপাডার সবচেয়ে সাহসী লোকটা, মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি, গাজী গাজী বলে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে, রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস এখন পোকার দখলে আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো সেই তেজি তরুণ যার পদভারে একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে– সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে, নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।

স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো - নির্মলেন্দু গুণ

একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?’ এই শিশুপার্ক সেদিন ছিল না, এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না, এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না। তা হলে কেমন ছিল সেদিনের বেলাটি? তা হলে কেমন ছিল শিশুপার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি? জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত কালো হাত। তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ কবির বিরুদ্ধে কবি, মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ, বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল, উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান, মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ...। হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি, শিশুপার্কের রঙ্গিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প। সেদিনের এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর। না পার্ক না ফুলের বাগান, -এইসবের কিছুই ছিল না, শুধু একখন্ড অখন্ড আকাশ যেরকম, সেরকম দিগন্ত প্লাবিত ধু ধু মাঠ ছিল দুর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়। আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল এই ধু ধু মাঠের সবুজে। কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক, লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক। হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুন কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে। একটি কবিতা পড়া হবে,তার জন্য কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের: ‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’ শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে, রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। তখন পলকে দারুন ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী? গণসুর্য্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই থেকে 'স্বাধীনতা' শব্দটি আমাদের।

রিপোর্ট ১৯৭১ - আসাদ চৌধুরী

প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো। এ-সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়- বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে শুধু মুখ টিপে হাসে। প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা- সূর্য্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী। অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে- আমি তার সুরকার- তার রক্তে স্বরলিপি লিখি। মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয় মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে-ঝিয়ে খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো, অস্ফুট গোলাপ-কলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে কার কী বা আসে যায়। বিপন্ন বিস্ময়ে কোরানের বাঁকা-বাঁকা পবিত্র হরফ বোবা হ’য়ে চেয়ে দ্যাখে লম্পটেরক্ষুধা, মায়ের স্নেহার্ত দেহ ঢেকে রাখে পশুদের পাপ। পোষা বেড়ালের বাচ্চা চেয়ে-চেয়ে নিবিড় আদর সারারাত কেঁদেছিলো তাহাদের লাশের ওপর। এদেশে যে ঈশ্বর আছেন তিনি নাকি অন্ধ আর বোবা এই ব’লে তিন কোটি মহিলারা বেচারাকে গালাগালি করে। জনাব ফ্রয়েড, এমন কি খোয়াবেও প্রেমিকারা আসে না সহজ পায়ে চপল চরণে। জনাব ফ্রয়েড, মহিলারা কামুকের, প্রেমিকের, শৃঙ্গারের সংজ্ঞা ভুলে গ্যাছে। রকেটের প্রেমে পড়ে ঝ’রে গ্যাছে ভিক্টোরিয়া পার্কের গীর্জার ঘড়ি, মুসল্লীর সেজদায় আনত মাথা নিরপেক্ষ বুলেটের অন্তিম আজানে স্থবির হয়েছে। বুদ্ধের ক্ষমার মূর্তি ভাঁড়ের মতন ভ্যাবাচেকা খেয়ে প’ড়ে আছে, তাঁর মাথার ওপরে এক ডজন শকুন মৈত্রী মৈত্রী ক’রে হয়তো বা উঠেছিলো কেঁদে।

উচ্চারণগুলি শোকের - আবুল হাসান

লক্ষি বউটিকে আমি আজ আর কোথাও দেখিনা, হাটি হাটি শিশুটিকে কোথাও দেখিনা, কতগুলি রাজহাঁস দেখি নরম শরীর ভরা রাজহাঁস দেখি, কতগুলি মুখস্থ মানুষ দেখি, বউটিকে কোথাও দেখিনা শিশুটিকে কোথাও দেখিনা!

তবে কি বউটি রাজহাঁস? তবে কি শিশুটি আজ সবুজ মাঠের সূর্য, সবুজ আকাশ?

অনেক রক্ত যুদ্ধ গেলো, অনেক রক্ত গেলো, শিমুল তুলোর মতো সোনারূপো ছড়ালো বাতাস।

ছোটো ভাইটিকে আমি কোথাও দেখিনা, নরোম নোলক পরা বোনটিকে আজ আর কোথাও দেখিনা!

কেবল পতাকা দেখি, কেল উৎসব দেখি, স্বাধীনতা দেখি,

তবে কি আমার ভাই আজ ঐ স্বাধীন পাতাকা? তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব?

কনসেনট্রেশন ক্যাম্প - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

তাঁর চোখ বাঁধা হলো। বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত করলো তার মুখ। থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লালা-রক্তে একাকার হলো, জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত ঝওে পড়লো কংক্রিটে। মা…মাগো…চেঁচিয়ে উঠলো সে। পাঁচশো পঞ্চান্নো মার্কা আধ খাওয়া একটা সিগারেট প্রথমে স্পর্শ করলো তার বুক। পোড়া মাংসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো ঘরের বাতাসে। জ্বলন্ত সিগারেটের স্পর্শ আমারা কথা বলবো। লাঠিচার্জ আমাদের ফেরাতে পারেনি কাঁদানে গ্যাস আমাদের ফেরাতে পারেনি র্ইাফেল আমাদের ফেরাতে পারেনি মেশিন গান আমাদের ফেরাতে পারেনি - আমারা এসেছি, আমারা আমাদের গৃহহীনতার কথা বলবো। কৃষক তোমাদের পক্ষে যাবে না শ্রমিক তোমাদের পক্ষে যাবে না ছাত্র তোমাদের পক্ষে যাবে না সুন্দর তোমাদের পক্ষে যাবে না স্বপ্ন তোমাদের পক্ষে যাবে না - তারা সকলেই কষ্টে আছে তারা সকলেই অনটনে আছে তারা সকলেই বিক্ষোভের হাত তুলেছে। তোমাদের পক্ষে যাবে কুকুর তোমাদের পক্ষে যাবে সুবিধাভোগী তোমাদের পক্ষে যাবে বিত্তবান নেকড়েরা। বৃক্ষ তোমাদের অভিশাপ দিচ্ছে শস্য তোমাদের অভিশাপ দিচ্ছে রক্ত তোমাদের অভিশাপ দিচ্ছে তোমাদের অভিশাপ দিচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত শিশুরা। লক্ষ মৃত্যু আমাদের ফেরাতে পারেনি আমারা এসেছি। আমারা আমাদের শিক্ষাহীনতার কথা বলবো আমারা আমাদের চিকিৎসাহীনতার কথা বলবো আমারা আমাদের গৃহহীনতার কথা বলবো আমারা আমাদের বস্ত্রহীনতার কথা বলবো আমারা আমাদের ক্ষুধা ও মৃত্যুর কথা বলবো। আমরা তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা থেকে এসেছি আমরা সিপাহী আন্দোলনের দুর্গ থেকে এসেছি আমরা তেভাগার কৃষক, নাচোলের যোদ্ধা আমরা চটকলের শ্রমিক, আমরা সূর্যসেনের ভাই আমরা একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ থেকে এসেছি কাঁধে স্টেন, কোমরে কার্তুজ, হাতে উন্মত্ত গ্রেনেড- আমরা এসেছি।

একটি পতাকা পেলে হেলাল হাফিজ

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন,–’পেয়েছি, পেয়েছি’।

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে, বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসন্মানে সাদা দুতে-ভাতে।

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে, সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড