• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ছোট গল্প : শেষ সময়

  সাদিয়া আফরিন প্রমা

২৩ মার্চ ২০১৯, ০৯:১৫
গল্প
ছবি : প্রতীকী

শরাফত আলী। বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি। চোখে এখন ঝাপসা ঝাপসা দেখে। বয়স হয়েছে তার, বয়সের জন্য কিছুই মনে থাকেনা এখন। একটা চশমা নিতে হবে শরাফত আলীর। কিন্তু তার জন্য তো টাকা লাগবে। হাত তার এখন একদম ফাঁকা। কোথা থেকে’ই বা থাকবে?

নিজে তো আর এখন উপার্জন করে না। ছেলেরা যা দেয় তা দিয়েই চলতে হয়। সহধর্মীনি পরাপারে চলে গেছেন প্রায় দশ বছর হবে কিন্তু তার এখনো যাওয়ার খবর নেই। দুটো ছেলে আছে তার। বড় ছেলের নাম ইউনুস আলী এবং ছোট ছেলের নাম মনসুর আলী। ছোট ছেলে বউ নিয়ে দেশের বাহিরে থাকে, বছরে দু-এক বার আসে তাও কয়েকদিনের জন্য। আর বড় ছেলে শহরে থাকে। সে বড় ছেলের সাথেই থাকে। কিন্তু বড় ছেলের বউ এশা এখন আর শরাফত আলীকে সহ্য’ই করতে পারে না। বড় ছেলের ঘরে একটা ছেলে আছে। নাম রুদ্র, এবার ক্লাস থ্রিতে পড়ে। নাতীর সাথে শরাফত আলীর অনেক ভাব। স্কুল থেকে বাসায় আসলেই, রুদ্র দাদুর কাছে চলে আসে।

দাদুর সাথে খেলা করে আর দাদুকে গল্প বলতে বলে। শরাফত আলী ও গল্প বলেন, নানান ধরনের গল্প।কিন্তু হঠাৎ দু’দিন হলো রুদ্র তার দাদুর কাছে আসে না। আসে না বললে ভুল হবে! রুদ্রর আম্মু আসতে দেয় না। এদিকে কিছুদিন ধরে শরাফত আলীর শরীর টাও ভালো যাচ্ছে না। শরীর খুব দুর্বল লাগে। সারাক্ষণ ঘুমিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। মনে হয় এই বোধহয় তার যাওয়ার সময় হয়েছে। শোয়া থেকে ওঠার শক্তি পাচ্ছে না সে কিন্তু তার বড্ড পানির পিপাসা ধরেছে। কি করবে ভেবে না পেয়ে, -বউমা, ও বউমা। শুনছো? -কি হয়েছেটা? কি? এত চেচাচ্ছেন কেনো? শরাফত আলী চুপ হয়ে যায়। - এত চেঁচাচ্ছেন কেনো বলবেন? - না মানে, খুব পানি পিপাসা পেয়েছে। আমি ওঠার শক্তি পাচ্ছিনা, যদি তুমি একটু এনে দিতে.. - হুহ যতসব ঢং। একটু শান্তিও পেলাম না।

শরাফত আলীর চোখটা ভিজে আসে কিন্তু তার কিছু করার নেই। আজ মাধবীর কথা খুব মনে পড়ছে তার। মাধবী, তার সহধর্মিণী। আদর করে মাধবীলতা ডাকতো তাকে। সে তো চলে গিয়ে ভালোই করেছে, সুখে আছে কিন্তু তার কি হবে? তুমি অনেক স্বার্থপর ইউনুসের মা, তাই তো আমায় একা করে চলে গেছো। তবুও ভালোই হয়েছে নয়তো এই দিনগুলো কি তুমি সহ্য করতে পারতে? - কানে শুনতে পান না নাকি? এই নিন পানি। খেয়ে আমায় উদ্ধার করুন। ধ্যান ভাঙ্গে শরাফত আলীর। নীরবে পানির গ্লাস হতে নেয়। তাও নিতে কষ্ট হয় তার। গ্লাস হাতে ধরিয়ে দিয়ে, বড় ছেলের বউ বিরবির করতে করতে চলে যায়। পানি খেয়ে গ্লাসটা খাটের পাশে রাখলো সে। ঘুম ঘুম পাচ্ছে শরাফত আলীর। চোখদুটো তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। ঘুমের রাজ্য দিয়েই ফিরে যায় অতীতে।

কত সুখের সংসার ছিলো তার। হাসি, কান্না আর দুই ছেলের দুষ্ট-মিষ্টি ঝগড়া দিয়ে মেতে থাকতো পুরো সংসার। মাধবীর নিজের হাতে গড়া সংসার। তীল তীল করে গড়েছে সুখের সংসার। ছেলেদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে। সবই আছে এখনো নেই শুধু তার মাধবী। নেই সেই শান্তি। ঘুমের মাঝেই তার চোখদুটো ভিজে আসে।ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। চোখ দুটো মুছে ফেলে সে। অনেক দিন ধরে ছোট ছেলেকে দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কীভাবে?

সব ইচ্ছে যে পূরণ হয় না। সবটা পূরণ করতে নেই। বুকের ব্যথাটা ক্ষণিক কমেছে তার, ঠিক সেই মুহূর্তে ভেসে আসে সুমধুর এশার আযানের ধ্বনি। শোয়া থেকে ওঠে, মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

নামাজ শেষে বাড়ির পথে হাঁটা দেয় সে। বাড়ির দরজার পাশে এসে থমকে দাঁড়ায়। ঘড়ের ভেতর থেকে হইচই এর আওয়াজ আসছে। কি নিয়ে হইচই হচ্ছে শরাফত আলী বুঝতে পারছেনা। বড় ছেলের গলা শোনা যাচ্ছে হইচই এর মাঝে। বয়সের সাথে সাথে কানে শুনেতেও সমস্যা হয় এখন তার। তবুও মনোযোগ দেয় সে। - আমার পক্ষে আর সম্ভব না, তুমি কি করবে করো। (বউমা এশা) - কি হয়েছে আবার?(বড় ছেলে ইউনুস) - কি হয়েছে তুমি বুঝোনা? তোমার বাবার বয়স হয়েছে, নিজে তো নড়তে চড়তে পারে না। তার সবকিছুই এখন আমাকে করতে হয়। - বয়স হয়েছে, শরীর তো দুর্বল হবে’ই। তাই না? - তো দুর্বল হয়েছে তাতে আমার কি? তার সব কাজ কি আমি করবো নাকি? তোমার ছোট ভাই তো দেশের বাহিরে খুব সুখে আছে, কোন ঝামেলা নেই। সব তুমি একা করবে নাকি? আমি আর পারবোনা, তুমি কিছু একটা করো? - কিছু কি করার আছে?কি করবো আমি(ইউনুস) - আছেই তো, বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেও তোমার বাবাকে। সারাদিন তো বাসায়ই পড়ে থাকে। তার চেয়ে ওখানেই ভালো থাকবে, কথা বলার কিছু সঙ্গী পাবে। - কি বলো তুমি? বৃদ্ধাশ্রম! আমি এটা বাবাকে কোন দিন বলতে পারবোনা। - না বলতে পারলে তুমি থাকো তোমার বাবাকে নিয়া। আমি চললাম। হয় তোমার বাবা থাকবে নয়তো আমি!

শরাফত আলীর চোখদুটো ভিজে গেছে। সে আর সহ্য করতে পারেনা। চোখদুটো মুছে দরজা ঠেলে ভেতর ঢুকে। দরজার পাশে বাবাকে দেখে মুখ নিচু করে ফেলে ইউনুস। শরাফত আলী ছেলের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। -মন খারাপের কিছু নেইরে বাবা। বউমা ঠিক’ই বলেছে, তুই কালকেই ব্যবস্থা কর। আমি চলে যাবো। - কিন্তু বাবা!(কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে) -আরে কাঁদিস কেন? আমি তো আর মরে যাচ্ছি না। তোরা শুধু মাঝে মাঝে দেখে আসিস আমায়। তাহলেই হবে।

কথাগুলো অনেক কষ্টে বললেন শরাফত আলী। কথা শেষ করে তাড়াতাড়ি নিজের রুমে চলে আসে। রাত গভীর হচ্ছে কিন্তু শরাফত আলীর চোখে ঘুম নেই। খাটে এপাশ ওপাশ করতে থাকে কিন্তু ঘুম আসার কোন নাম নেই। সকাল হলেই চলে যাবে সে! তার মাধবীর নিজ হাতে সাজানো ঘড় ছেড়ে চলে যাবে! ভাবতেই চোখ ভিজে আসে। এটাই তো ওর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। যার জন্য কখনো কোনো বাড়িতে এক রাত থাকেনি সে। ওর হাতের ছোঁয়া আছে সর্বত্র। বুকের বাথটা বাড়ছে তার, প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। রাত প্রায় ২টা বাজে, তাহাজ্জুদ পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে শরাফত আলীর। বুকের ভেতরের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েই ওযু করে আসে। জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। বুকের ব্যথাটা ক্রমশ বাড়ছে। প্রথম সেজদা দিয়ে অনেক কষ্টে ওঠে সে কিন্তু দ্বিতীয় সেজদা দিয়ে আর ওঠার শক্তি পায় না। নিস্তেজ হয়ে আসে তার সমস্ত শরীর, হঠাৎ তার মনে প্রশ্নের উকি দেয়? এটাই কি মৃত্যু! তার সময় কি ফুরিয়ে আসছে? চোখদুটো খুলতে পারেনা! তবুও বহু কষ্টে চোখ মেলে তাকায়, চেয়ে দেখে সামনে কে যেনো দাঁড়িয়ে আছে? ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকে, পরিষ্কার হয়ে আসে চোখ। সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার মাধবী! হ্যাঁ সত্যি তার মাধবী! দু’হাত বাড়িয়ে ডাকছে তাকে! সে কি সাড়া না দিয়ে পারে? তার মাধবীলতার ডাক উপেক্ষা করার শক্তি কি আছে তার!

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড