সানোয়ার রাসেল
কবিতা সম্পর্কে সমসাময়িক একজন কবির মূল্যায়ন ছিল এ রকম—
‘জীবনোৎপলের ফ্রিকোয়েন্সির সাথে কয়েকখান সিমেটিক শব্দ লাগানোটাই বুঝি কবিতা!’
রোবায়েতের কবিতা প্রথম চোখে পড়ে একটা ওয়েবজিনে, খুব সম্ভবত সেটা কোন একটা দীর্ঘ কবিতা ছিলো। দীর্ঘ কবিতা এমনিতেই আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর লাগে। তার উপর সমসাময়িক একজন কবির কবিতা নিয়ে প্রো-লগে অতখানি গুরুত্ব দিয়ে কথা বলা — স্বভাবতই কবিত্বজনিত অহমে সুরসুরি লাগে। অহমের সেই সুরসুরি ও বিরক্তি নিয়ে সেই কবিতায় ঢুকতে গিয়ে প্রচণ্ড হোঁচট খাই। কেন না, শব্দের এমন সব ব্যবহার আমার অভিজ্ঞতার বাইরে ছিলো। শব্দার্থবিদ্যার খোল এভাবে নলচে কেউ পালটে দিয়ে কবিতা করতে পারে এই ধারণাই আমার মাথায় ছিল না। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ফুলের কোন মানে নেই, শুধু ঘ্রাণ আছে। সেই আপ্তবাক্য মাথায় রেখেও রোবায়েতের কবিতাকে গ্রহণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
এরপর বছরখানেক, এরকমই হবে হয়তো, সময় কেটে গেছে। আমি তার কবিতাকে পর্যবেক্ষণ করে গেছি। ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি, রোবায়েত শব্দ নিয়ে, বাক্যগঠনের রীতি নিয়ে আসলে একটা সাধনায় রত। আমি তার এই সাধনার ঘোৎঘাত যে এখনও ঠিকঠাক ধরতে পেরেছি তা বলবো না, কিন্তু আমি তার কাব্যরীতিতে অভ্যস্ত হতে থাকি। আগের মতো ধাক্কা খাই না। বরং এক ধরণের ভালো লাগা কাজ করতে থাকে। আমি তার কবিতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। সে নতুন কী কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে কবিতায় তা দেখার জন্য কৌতুহল জন্মাতে থাকে।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। রোবায়েত যে কেবলই যাপিত জীবনের সাথে সাযুজ্য কতেক শব্দ লাগিয়েই কবির দায় এড়িয়ে যায় না, সমকালীন রাজনীতি, সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা নিয়েও যে তার কাব্যভাবনা রয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে’ কাব্যে (যারা তার কবিতা নিয়ে এ হেন অভিযোগ উত্থাপন করে থাকেন তারা পড়ে দেখতে পারেন)।
যখন একটা অবরূদ্ধ সময়ের আবদ্ধ বাতাসে বাংলাদেশের কবিসমাজের প্রায় সকলেরই দমবন্ধ হয়ে আসে (আমি দুঃখিত যে এই কবিসমাজের ক্ষেত্রেও প্রায় শব্দটি ব্যবহার করতে হচ্ছে), তখন রোবায়েত কতটা সাহসের সাথে উচ্চারণ করেন —
‘দেখার কিছু ছিলই না তো /গুজব ছিল ঘাঁ/ রক্তঘুমে জিভ দেখালো/ মুসোলিনির মা…… যখন আমার /চোখের পাশে/ বাড়ছে ক্ষত/ ফুল তখনো/ ফুটছে মাদার/ চোদের মতো—’
পুলিশের গুলিতে সিদ্দিকুর নামের এক শিক্ষার্থীর অন্ধ হয়ে যাওয়া শিমুল ফুলের মতো রক্তাক্ত চোখ আমাদের মনে পড়ে যায়। আর যা যা মনে পড়ে তা গদ্যভাষায় লেখার শক্তিসাহস আমাদের হয় না, কিন্তু মনে পড়াকে আটকাবে কে?
মাৎস্যন্যায়ের ভরা দিনে আমরা গুটিয়ে যাই। প্রার্থনা ও নালিশ, সবই ওপরওয়ালার কাছেই করতে হয়। আমরা করিও তাই—
‘ক্রমসংকোচে তুমি গুটে যাও/ আসে মাৎস্যন্যায়ের ভরা দিন/ দূরে বুলবুল কাঁপে সন্ধ্যায়/ মার ঠোঁটজুড়ে সুরা ইয়াসিন —’
পদক-পুরস্কার-পৃষ্ঠপোষকতা-জমি-প্লট বুঝে নেওয়ার লোভে একদল কবিমানুষ যখন চোখে উন্নয়নের ঠুলি আর মুখে জিপার টেনে ঘানির গান গেয়ে যাচ্ছে, রোবায়েত তখন উচ্চারণ করেন, ‘ফ্যাসিবাদ’। তার সাহস দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। রোবায়েত বলেন—
‘ফ্যাসিবাদের এসব ক্রুর স্বর্ণযুগে/ তুমি জানতে পাবে /কেউ / কারোর পাশেই/ দেখা বৃষ্টিভিজে পারছে না দাঁড়াতে/ রু / বৃষ্টি তোমাকে ডাকছে/ তুমি পুলিশভ্যানের পাশে এসে দাঁড়িয়ো না-‘
কিংবা
‘আমরা হারিয়েছি মায়ারোদ /ধলেশ্বরী-মেঘ, পারাপার/ এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে/মিনারে শঙ্খের হাহাকার—‘
তো এইসব সাহসী উচ্চারণ যে রোবায়েত একেবারে একাই করছেন বিষয়টা এমনও নয়। আরো অনেকেই করছেন। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে কবিতার নামে কেবলই শ্লোগান কিংবা স্রেফ পত্রিকার প্রতিবেদনের অনুলিপির মতো কিছুই হয়ে যাচ্ছে সিংহভাগ। এ ব্যাপারে রোবায়েত ছাড় দিচ্ছেন না। শব্দ তার অর্থের জোরে রোবায়েতকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নিচ্ছে না, বরং সে-ই শব্দকে কৌশলী সহিসের মতো করে তার ইচ্ছামাফিক কবিতা তৈয়ার করে চলছেন। শব্দ যেন এখানে পোষমানা ঘোড়া। কিংবা গাঁজার নৌকা, যেটা পাহাড় বেয়ে যায় এবং আমরা তা মেনে নিই, অভ্যস্ত হয়ে যাই। এই কারণেই তার কবিতার সাথে পরিচয়ের শুরুর দিকে আমি আরেকজন কবির সাথে মন্তব্য করেছিলাম রোবায়েত কবির চেয়ে বেশি কবিতার কারিগর। নেতিবাচক অর্থেই। তথাপি সে যখন লিখে ফেলে—
‘কোথাও তুমি ধলেশ্বরীর তীর— /বাজ পড়ছে ঢেউয়ের ওপার গ্রামে/ ক্রসফায়ারের শব্দ নড়ে পাতা/ কার মেয়েটা কাঁদছে মধ্যযামে—!’
তখন সেই কারিগরিটা ছাপিয়ে কবিতাটাই আমার কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। একরামের মেয়েদের রোনাজারির শব্দ কানে বেজে ওঠে। ইমেজ তৈরির খেলায় জিতে যায় কবিতা। আর কবিতা জিতে যায় বলেই রোবায়েতের কবিতা ভালো লাগে। ভালো লাগে ‘এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে’।
বই সম্পর্কিত তথ্য- কাব্য: এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে কবি: হাসান রোবায়েত প্রকাশক: ঢাকাপ্রকাশ প্রচ্ছদের ছবি: কবি নামলিপি: কাজী যুবাইর মাহমুদ পাঠকের মূল্য: ১০০ টাকা
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড