• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

প্রবন্ধ

বিদেশি সাহিত্যে বঙ্গবন্ধু

  খোরশেদ মুকুল

১৭ মার্চ ২০১৯, ০৯:২৬
ছবি
ছবি : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

পৃথিবীব্যাপী স্বাধীনতার চেতনা অভিন্ন। অন্যায়-অবিচার, শাসনের নামে শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ অংকুরিত হয় তা জন্ম দেয় এক জাতীয় বীরের। হয়ে ওঠে মহাকাল। জাতীয় প্রতীক। ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু। আশার পথ প্রদর্শক। মুক্তির মশাল। ইতিহাস তাকে স্মরণ করে হৃদয় দিয়ে। কলমের ছোঁয়ায় ফুটে উঠে তার আপাদমস্তক। ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন হয়ে ওঠে সাধারণের জন্য অনুকরণীয়। প্রতিটি বাক্য যেন নির্দেশনা স্বরূপ শোষিত জাতির জন্য।

একাত্তর আমাদের অহংকার। একাত্তর জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই একাত্তরেই আধার কেটে গিয়ে আসে লাল-সবুজের সূর্য এবং আমরা পাই স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার স্থপতিকে। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ই মার্চের মহাকাব্য আমদের জাতীয় জীবনে এনে দিয়েছে আমুল পরিবর্তন। বায়ান্ন কিংবা একাত্তর পূর্বাপর সাহিত্যে রয়েছে বিরাট পার্থক্য।

ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধ হয়ে যায় মূখ্যবিষয়। একাত্তরের পরে তা আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। আর কেন্দবিন্দু হয় স্বাধীনতার মহান নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে গল্প, গান, কবিতা ,উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি। দেশের সীমানাকে ছাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর আবেদন প্রায় সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সারা বিশ্বের লেখকগণও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দেশপ্রেম, অবিস্মরণীয় অবদান নিয়ে লেখেন সাড়াজাগানো গান, কবিতা ইত্যাদি। অনেক লেখাই হারিয়ে গেছে কালের গর্বে এবং যাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতাগুলো কেবল ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে প্রতিফলিত করেনি, ধারণ করেছে তার সময়কে। আবার কিছুকিছু কবিতা পেরিয়ে গেছে সময়ের গণ্ডি। তেমনি একটি অসাধারণ কবিতা যেটি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে গান হিসেবে বাঙালিদের হৃদয়ে অফুরন্ত আশার সঞ্চার করেছিল, দিয়েছিল অনুপ্রেরণা। সেটি হল গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা- ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ্য মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধবনি, প্রতিধবনি/ আকাশে বাতাসে উঠে রণি/ বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।’

তেমনি আরেকটি অসাধারণ কবিতা লেখেন অন্নদা শংকর রায়। যেটি বর্তমানে প্রতিটি মুজিবপ্রেমির মুখেমুখে শুনতে পাওয়া যায়। সেটি হল- ‘যদদিন রবে পদ্মা মেঘনা/ গৌরি যমুনা বহমান/ ততদিন রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান।/ দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা/ রক্তগঙ্গা বহমান/ নাই নাই ভয় হবে হবে জয়/ জয় মুজিবুর রহমান।’

ত্রিপুরার কবি রাম প্রসাদ দত্তের ‘ইয়াহিয়া খাঁন তাণ্ডব নৃত্য’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের উপর ১২৪ পঙক্তির একটি দীর্ঘ পালাগান লিখেছিলেন। তার ছত্রেছত্রে এসেছে শেখ মুজিব। দু’টি লাইন তুলে ধরছি-

‘আছেন শেখ মুজিবর ভাই জয় বাংলাদেশে/ শাসনতন্ত্র গঠন করে মনের উল্লাসে।’ পাকিস্তানের পাঞ্জাবি কবি আহমেদ সালিম পাঞ্জাবি ভাষায় ‘বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী’ হোক এবং ‘সোনার বাংলা’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কবিতা লিখেন – ‘সব আলো গেল নিভে/ অপমানিত হল সূর্য। বিভক্ত হল পাকিস্তান।’ সেই অপরাধে সামরিক জান্তা তাকে গ্রেফতার করে এবং ৯ মাস পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে মুক্তি দেয়।

লাহোর ডিস্ট্রিষ্ট জেলে বসে তিনি আরো একটি কবিতা লেখেন ‘সিরাজউদ্দৌলাহ’ শিরোনামে এবং এই কবিতাটি উৎসর্গ করেন শেখ মুজিবুর রহমানকে। এই কবিতায় তিনি সিরাজউদ্দৌল্লাহ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে একই সমান্তরালে স্থাপন করে বর্ণনা করেন যে, ‘স্বদেশি মীরজাফরদের (অর্থাৎ রাজাকার আল বদরদের) সহযোগিতার কারণে রক্তস্নাত হল বাংলাদেশ।’

ভারতের উর্দু কবি কাইফি আজমী ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামে ১৯৭১ সালে একটি কবিতা লেখেন, যার ভেতর শেখ মুজিবের ছবি ভেসে উঠেছে জীবন্তভাবে। জানা যায়, ইউরোপের এক কবি ‘টাইগার অব বেঙ্গল’ আখ্যায়িত করে শেখ মুজিবকে কবিতায় উপমা হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতার সূর্যকে ডুবিয়ে দেয়ার নিমিত্তে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। শোকে নুয়ে পড়ে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব। শোকাবিভূত হয়ে অমিয় চক্রবর্তী লেখেন-

‘আশ্চর্য নেতার নামে জড়ো হয়, আয়ামির দল মুজিবের মুখে চেয়ে সারা পাকিস্তানে ভোটে জেতে, সংঘশক্তি মুক্তির নিশানী, রোধ করবে সাধ্য কার?’

বঙ্গবন্ধুর সাথে অবোধশিশু রাসেলের মৃত্যুও সবার মনে বিষাদের দাগ কাটে । রাসেলের কথা উল্লেখ করে সুনীল পঙ্গোপাধ্যায় লেখেন-

‘রাসেল অবোধ শিশু তোর জন্য আমিও কেঁদেছি খোকা, তোর মরহুম পিতার নামে যারা একদিন তুলছিলে আকাশ ফাটানো জয়ধ্বনি তারাই দু’দিন বাদে থুতু দেয়, আগুন ছড়ায় আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার কাছে ক্ষমা চাই।’

নয়াদিল্লীর সাহিত্য একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত মনিপুরের প্রথম সারির কবি এলাংবম নীলকান্ত ‘শেখ মুজিব মহাপ্রয়াণে’ শীর্ষক কবিতা রচনা করেন। তা তার ‘তীর্থযাত্রা’ গ্রন্থে স্থান পায়। কবিতাটির খণ্ডাংশ নিম্নরূপ- ‘হে বঙ্গবন্ধু/ নিষ্ঠুর বুলেটের আঘাতে নিহত হয়েছো শুনে/ পেরিয়েছি আমি এক অস্থির সময়/ খোলা জানালা দিয়ে সুদূর আকাশের দিকে/ পলকহীন তাকিয়ে থেকেছি/ উত্তরহীন এক প্রশ্ন নিয়ে/ বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে গড়ে তুলেছিলে স্বদেশ তোমার/ কিন্তু এ কোন প্রতিদান পেলে তুমি?” (অনুবাদকঃ এ.কে. শেরাম)

গান্ধীকে নিয়ে কবি অরুণ মিত্র একটি কবিতা লিখেছেন – ‘আজকের দিন যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আছে কাল, একশো গান্ধী যদি মিথ্যে হয় তবুও থাকে সত্য’। এই পঙক্তিটিই গান্ধীর স্থলে মুজিব বসিয়ে শঙ্খ ঘোষ বলেছেন- ‘আজকের দিন যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আছে কাল, ‘এক’শ মুজিব যদি মিথ্যে হয় তবুও থাকে সত্য।’ এছাড়া মার্কিন লেখক রবার্ট পেইনের ‘দি চর্টার্ড এন্ড দ্য ডেমড’, সালমান রুশদীর ‘মিড নাইট বিলড্রেম’ এবং ‘শেইম’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব পশ্চিম, জাপানি কবি মাৎসুও শুকাইয়া, গবেষক ড. কাজুও আজুমা, প্রফেসর নারা, মার্কিন কবি লোরী এ্যান ওয়ালশ, জার্মান কবি গিয়ার্ড লুইপকে, বসনিয়ার কবি ইভিকা পিচেস্কি, বৃটিশ কবি টেড হিউজের কবিতায় বঙ্গবন্ধু উপস্থাপিত হয়েছেন।

অবশ্য ভারতীয় ও পাকিস্তানি প্রচুর কবিই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। তাদের মধ্যে পশ্চিম বাংলার বনফুল, বুদ্ধদের বসু, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, রাজলক্ষ্মী দেবী, মনীষ ঘটক, অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত, বিমল চন্দ্র ঘোষ, দীনেশ দাস, দক্ষিণা রঞ্জন বসু, করুণা রঞ্জণ ভট্টাচার্য, অমিয় মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র কুমার গুপ্ত, নলিনীকান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, নির্মল আচার্য, বিভূতি বেরা, অমিত বসু, শান্তিময় মুখোপাধ্যায়, শান্তিকুমার ঘোষ, গোলাম রসুল, অমিতাভ দাশগুপ্ত, তরুণ সান্যাল, দেবেশ রায়, গৌরী ঘটক, রাম বসু, তারাপদ রায়, মনীন্দ্র রায়, বিনোদ বেরা, অমিতাভ চৌধুরী, পাকিস্তানি কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজসহ আরো অনেকেই।

একাত্তর-বাহাত্তর এবং পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর সালের কলকাতার কাগজগুলোতে তাঁদের লেখা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর যাঁরা তাঁকে নিয়ে গ্রন্থ লিখেছেন তারা হচ্ছেন-অমরেন্দ্র কুমার ঘোষ, অমিতাভ গুপ্ত, মনোজ দত্ত, কালাহান, কৃত্তিবাস ওঝা, নিরঞ্জন মুজুমদার, পরেশ সাহা, শ্যামল বসু, এ. এল খতিব, আই. এল. তেওয়ারী, অতিন্দ্র ভাটনগর, মৃণাল কর প্রমুখ।

এপর্যন্ত বিদেশি ভাষায় অর্ধশতেরও বেশি বই লিখিত ও অনূদিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিদেশিদের লিখিত বেশ কিছু গ্রন্থের নামঃ ১.Who Killed Mujib , A.L. Khatib ২. Mujib: The Architect of Bangladesh a Political Biography, Yatinra Bhainogor, ৩. War of Independence in Bangladesh Style of Sheikh Mujibur Rahman, I. N. Tewary, ৪. Mujib's Revenge From The Grave, Thomas Merore, ৫. Bhuettu Sheikh Mujib Bangladesh, Row Farman Ali, ৬. মহানায়ক মুজিবুর, অমরেন্দ্র কুমার ঘোষ, ৭. গতিবেগ চঞ্চল বাংলাদেশ: মুক্তি সৈনিক শেখ মুজিবুর, অমিতাভ দাশগুপ্ত, ৮. আমি শেখ মুজিবুর বলছি, কৃত্তিবাস ওঝা, ৯. বঙ্গবন্ধু ও রক্তাক্ত বাংলা, নিরঞ্জন হালদার, ১০. মুজিব হত্যার তদন্ত, পরেশ সাহা, ১১. মুজিবের বাংলা, পঙ্কজ কুমার মুখোপাধ্যায়, ১২. বাংলাদেশের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি: মুজিব পর্ব, পরেশ সাহা, ১৩. আমি মুজিবর বলছি, মনোজ দত্ত, ১৪. আমি মুজিব বলছি , শ্যামল বসু, ১৫. পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দী জীবন, আহমেদ সালিম, ১৬. মুজিবের বাংলা, সুহীন পাবলিশিং হাউস, ১৭. পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু, বরার্ট পেইন ইত্যাদি।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড