রকিব লিখন
ধেয়ে চলা মানুষের নিরন্তর স্বভাব। মানুষ প্রকৃতির সন্তান তাই সে স্থির থেকেও গতিশীল। অপার প্রেমের কৃপায় সে হয়ে উঠে বোদ্ধা ও যোদ্ধা। যুদ্ধ মানুষের অলঙ্কার। এ যুদ্ধ গতির যুদ্ধ। এ যুদ্ধ লালনের যুদ্ধ। কোন কিছু হৃদয়ে লালন করা সম্ভব যখন সেই বস্তু বা জিনিসের প্রতি থাকে অকুণ্ঠ অনুরক্ত। অনুরাগ থেকে আসে ভক্তি, ভক্তি থেকে প্রেম। আর প্রেমকে হৃদয়ে লালন করাই কবির ধর্ম। কবির সত্তা ও মনন। কথাগুলো লিখতাম না, যদি না কবি খয়রুজ্জামান খসরুর ‘দীর্ঘশ্বাস ভেজা আলিঙ্গন’ কাব্যগ্রন্থটি আমার কাছে না আসতো।
লালন করে কোন জিনিসকে পরিপক্ব করে তোলে বিকশিত করার যে নিরন্তর প্রয়াস তা তার কাব্যগ্রন্থের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যাপ্তি। দীর্ঘ পরিক্রমায় কবি ক্লান্ত নন। যেন বিকশিত ফুলের সন্ধানে ব্যাকুল। আমাদের কবির কাব্যগ্রন্থ পড়তে গেলে বৃক্ষের ফুল ফোটার দিকে দৃষ্টি দিলে চলবে না, দৃষ্টি দিতে হবে বৃক্ষের ফুল ফোটানোর প্রক্রিয়ার দিকে। নিরন্তর সাধনার ফল বৃক্ষের ফুল ফোটানো। তেমনি কবির কাব্যগ্রন্থ পড়লে বোঝা যায় কবির নিরন্তর পথচলার মাঝেও ধীমান হৃদয়ে বাজিয়েছেন মূরজবীণায় কবিতার পথ চলা।
বর্ণগুচ্ছ কবিতায় ক-বর্ণে যখন আমরা পাই, ‘পাহাড়ের পাদদেশে পাথরের নদী, মনের আরশিতে তার ছায়া নিরবধি। হতাম যদি পরিব্রাজক এ পৃথিবীর, ঘুরে ঘুরে দেখে নিতাম এসব স্থল-জলধীর।’ -এই পঙ্ক্তিদ্বয় পড়লে ভাবনার নদে আমাদের পা রাখতেই হয়। জীবন যুদ্ধে থেকেও তার মন পরিব্রাজক তিনি তা অত্যন্ত সুন্দর ভাবে তোলে ধরেছেন। পাঠক চিত্তেও আসে এক অন্যরকম রোমাঞ্চ।
কবি প্রবাসী। কিন্তু আমি তাকে বলবো পরবাসী। কারণ, চিত্তে তার সদাই স্বদেশ ভাবনা। বিদেশের মাটির গন্ধে তার চিত্ত আকুল হয়নি বলেই ব্যাকুল তিনি স্বদেশের বুকে নানা অনিয়ম, অবিচার নিয়ে। তাই তার ‘নিরাপত্তাবিষয়ক নামতা’ কবিতায় মূর্ত উঠে, ‘ঘুমিয়ে পড়া জনপদের মানুষ ও জীবজগৎ। সকলেরই নিরাপত্তা প্রয়োজন শৈশবে শিশু, ঘরেবাইরে নারী মাঠের ফসল, স্কুলগামী ছাত্রী বন-বাদাড়, গাছপালা, হাওরবাঁওর নদীনালা, খালবিল, ব্যাংক-বিমা, অফিস খাদ্যগুদাম, সংবিধান, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রকর্তা- তেমন নিরাপত্তা প্রয়োজন ভিখারি ও অসহায়ত্বের। নিরাপত্তা দাবি করছি সকল জীব-ক্লীব, ছায়া-প্রতিচ্ছায়ারও। মাইগ্রান্ট প্রতিরোধে নিরাপত্তা একটি মহৌষধ বোধ ও প্রজ্ঞারা তাই বলে হে রাজন।’
কোন এক বন্ধুকে এই ব্যাকুলতার কথা জানালেও আসলে তার জন্মভূমির সকল মানুষের প্রতিই তিনি এই আহ্বান করেছেন। চিত্ত যে তাঁর স্বদেশের তরে দাবানলে পুড়ে যখন তাঁর ‘নদীতীরের উপাখ্যান’ কবিতায় দ্রোহের আহ্বান পাই, ‘ঠোঁটের কোণে ছিল জননীর আশীর্বাদ নিশ্চয়ই হবে সুপুত্র প্রতিগৃহে, জ্বলবে আলোর মশাল নিরাশ হয়ো না, আশায় বাঁধ বুক; সুখ ও শান্তির জোয়ারে ভেসে যাবে পৃথিবীর জঞ্জাল। নির্বাক নদীও লিখে রাখে বিকৃতির ইতিহাস কাউকে লিখে রাখতে হয় না লিখে রাখতে হয় না অমন অনেক কিছুই ঠিকই সেদিন জেগে উঠবে পদ্মার চর।’ নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানুষের আহার ও শক্তি আসে নদী থেকেই। চরের পলি আর বর্ষাকালে নদীর উচ্ছ্বাস দুই-ই আবহমান গ্রাম বাংলার মানুষের প্রেরণা ও শক্তি। তাই কবি নদীকেই আশ্রয় হিসেবে বেঁধেছেন বিদ্রোহীর আস্তিনে।
বিদেশের প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও সে ভুলে যেতে পারেননি তাঁর স্বদেশকে। স্বদেশকেই স্বর্গ ভেবেছেন তাঁর কাব্য সত্তায়। ঘুরে ফিরে তাই তাঁর কাব্যকাননে প্রস্ফুটিত হয়েছে বহুমাত্রিক প্রয়াসে স্বদেশ। কবিতার অনুভূমে, কবিতার পরতে পরতে নির্ঝর ঝর্ণাধারার মতো ব্যাপ্তিময় প্রকাশ কবিচিত্তের গহীনে লুকিয়ে থাকা স্বদেশের প্রতি প্রেম, স্বদেশের পীড়নে দ্রোহ, স্বদেশ প্রতির তাঁর আজন্ম প্রেম, স্বদেশই যেন তাঁর স্বর্গ।
‘ঠিকানা’ কবিতায় তার সেই মনোভাব ধরা পড়ে স্পষ্টই- ‘ভালোবাসা ঠিকানা পায় ঘৃণারাও ঠিকানা খুঁজে ঠিকানা খুঁজে আকাশ এবং মাটির যুগলাক্সগুরীয় হেমন্তে কৃষক খুঁজে ফসলের মাঠে ঠিকানা খুঁজি একটি মধ্যবর্তী কবিতা পাঠে ঠিকানায় নির্ণীত হয় কাব্যরস ঠিকানায় পথিক খুঁজে ঈভের স্বর্গ।’
ইতিহাসের আশ্রয়েও কবির ভাবনা স্বদেশ। ‘ফিরে দেখা’ কবিতাটি সেই আলোকেই আলোকিত- ‘তুমি ক্ষুদিরাম, ঈশা খান, নূর হোসেনের আয়নায় ঝলসে ওঠা দ্যুতিময় কাব্যের মহড়া। আমার শব্দে সাজানো পঙ্ক্তি কবিতা আজ স্বাধীনতার কথা বলে যেমন বলেছিল বায়ান্ন, উনসত্তর কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কালে।’
অবশেষে কবি আশ্রয় নিয়েছেন ‘রোদের ঘরে রাত্রিযাপন’ কবিতায়- মায়ের আঁচলে বেঁধে রাখা রোদ আমার বন্ধু ও স্বজন রোদ পাঠশালার বইয়ে জমা রোদ রোদের পিঠে যাত্রী হবো যাবো তোমার বাড়ি তুমি ও আমি একই রোদের সন্তান রোদে বৈষম্য নেই হৃদয়টা যেন রোদের আলোয় বৈষম্যহীন হয় মানবাত্মা ও পরমাত্মায়।’
বৈষম্যহীনতা দিয়ে শেষ তার কাব্যগ্রন্থ। এ যেন সুদূর প্রসারি ভাবনার দুর্জয় মিলন।
কবির কবিতায় আছে নানাদিক। আছে বিষয়ের বৈচিত্র্য। কবির সব কবিতাই নানন্দিক। প্রসংশার দাবিদার। শব্দের গভীরতা না খোঁজে খোঁজেছেন পাঠক চিত্তে তাঁর কাব্যময়তা যেন দোলা দেয় সেই ভাবনার উৎকর্ষ। দীর্ঘদিবসের দীঘল রজনীর ক্লান্তিহীন পথ চলার সঙ্গী কবি খয়রুজ্জামান খসরুর “দীর্ঘশ্বাস ভেজা আলিঙ্গন” বাংলা কবিতায় জগতে এক নতুন স্থান বলা যেতে পারে।
বই সম্পর্কিত তথ্য- কাব্যগ্রন্থ : দীর্ঘশ্বাস ভেজা আলিঙ্গন কবি : খয়রুজ্জামান খসরু প্রকাশনা : নাগরী প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি - ২০১৯
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড