• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বাংলাদেশে এসে জীবনের গল্প শুনিয়েছিলেন কথার জাদুকর

  অধিকার ডেস্ক    ১০ মার্চ ২০১৯, ১১:৫৩

সমরেশ মজুমদার
সমরেশ মজুমদার এসেছিলেন রাজধানীর বাতিঘরে (ছবি: নাজমি খান)

সমরেশ মজুমদার। কথার জাদুকর বললে খুব একটা ভুল হয়ত ওনাকে নিয়ে বলা হবে না। শুধু ওপার বাংলা নয়, এপার বাংলাতেও তাঁর অগণিত পাঠক-ভক্ত আছেন। লেখকের লেখার জাদুতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে এক নজর দেখার অপেক্ষায় কতদিন ধরে কত মানুষের অপেক্ষা ছিল তা হয়ত হিসেব করে বলাও কঠিন। অপেক্ষমান এই পাঠকভক্তের সামনে তিনি এসেছিলেন। তিনি কথা বলেছেন, নিজের জীবনের গল্প শুনিয়েছেন। কিছুটা হলেও তাঁকে এক নজর দেখতে চাওয়া তৃষিত পাঠকের তৃষ্ণা কমিয়েছেন।

সমরেশ মজুমদার ঢাকা এসেছিলেন গত বছরের ১ ডিসেম্বর। ২ ডিসেম্বর তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বাতিঘর-এ উপস্থিত হয়েছিলেন। সেদিন সেখানে কী বলেছিলেন কথার এই জাদুকর? সেদিন তাঁর বলা জীবনের গল্পগুলো লিখেছেন মাসুম আহমেদ আদি।

আগের বার ঢাকার বাতিঘর উদ্বোধন করার সময় তিনি এসেছিলেন। আগে থেকে জানতাম না বলে যেতে পারিনি। এবার যখন তিনি আসবেন বললেন তখন বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে উনার আগমন বার্তা পাওয়া গেল।

বুঝতে পারছেন হয়ত আমি কার কথা বলছি। তিনি এলেন, মাতালেন, নিজের লেখক হওয়ার গল্পটা বললেন। তিনি আর কেউ নন, আমাদের সবার পরিচিত সমরেশ মজুমদার।

সমরেশ মজুমদার ঢাকায় আসছেন, তাও আবার বাতিঘরে, আমি যাব না এটা হতেই পারে না। আগেরবার সুযোগ ছিল না বলে যেতে পারিনি। এবার সুযোগ পেয়েও হেলায় হারাবার মত বোকা আমি নই। আগের দিন থেকেই “বইপোকাদের আড্ডাখানা” গ্রুপে এ নিয়ে অনেক পোস্ট হলো। গ্রুপের মেম্বারদের মধ্যে ভালো সাড়া পাওয়া গেল।

ভেবে রেখেছিলাম সকাল দশটার মধ্যেই ওখানে উপস্থিত থাকবো। কিন্তু অপ্রত্যাশিত কিছু কারণে এয়ারপোর্ট রোড অচল ছিল। একপাশে অচল থাকলে অন্যপাশেও এর ইমপ্যাক্ট পড়ে। মোটর সাইকেল থাকা সত্ত্বেও পৌনে এগারোটা বেজে গেল পৌঁছুতে পৌঁছুতে। মনে তখন একটাই আশা, হয়তো আমাদের গ্রুপের অন্যান্যরা ততক্ষণে পৌঁছে গেছে, হয়তো বসার ব্যবস্থাও হবে।

কীসের কী! ভিতরে এত ভীড় ছিল যে গেট দিয়ে আমাদের ঢুকতেই দেয়া হচ্ছিল না। গেট কিপার বললেন কয়েকজন বের না হলে আপনারা ঢুকতে পারবেন না। উনাকে বেশ কয়েকবার রিকুয়েস্ট করাতে এবং ঢুকেই একদম পেছনে চলে যাব এই আশ্বাস দেয়াতে উনি সদয় হলেন। অতঃপর আমরা ঢুকলাম। পেছনে যাওয়ার সময় তাঁকে এক ঝলক দেখতে পেলাম। রোগা হয়ে গেছেন, বয়সের ছাপটা বেশ ভালোভাবেই পড়েছে শরীরে।

একদম পেছনে চলে গিয়ে অবশ্য ভালোই হয়েছে। সামনে থেকে না ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল না ভালোভাবে শোনা যাচ্ছিল। পেছনে সাউন্ড সিস্টেম থাকায় দেখতে না পেলেও প্রাণ ভরে তাঁকে শুনতে পেরেছিলাম।

আমি যখনই পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি তখনই সঞ্চালকের অনুরোধে সমরেশ মজুমদার নিজের গল্পটা বলতে শুরু করলেন। প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিলেন বসে কথা বলার জন্য। অসুস্থতার কারণে পায়ের উপর ভরসা করতে পারছিলেন না। শুরু করলেন শেষ থেকে...

মানুষ মসজিদে, মন্দিরে, চার্চে যায় কিছু পাবার আশায়। কেউ কেউ আবার আবু সায়ীদের আরেক মন্দিরে আরেক মসজিদে আরেক ব্রীজে আসে; এই ভাষার মন্দিরে। আমি ওঁর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হই আমেরিকাতে। ঐ আরেক ভাষার মন্দিরে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা। তারপর মুগ্ধ হই। ক্রমশ আমাদের মাঝে একটা সখ্যতা তৈরি হয়। আর আমি ভাবি, এইভাবে সারা পৃথিবীতে বাংলা ভাষাকে আর কেউ তো কখনো প্রচার করেননি। তাঁর টানে প্রচুর ছেলেমেয়ে ছুটে আসে, এটা বিস্ময়কর ব্যাপার।

আজকের এই সময়ে যখন কম্পিউটার, যখন নানাবিধ আকর্ষণ, জীবিকার আকর্ষণ ছড়িয়ে আছে, তখন ভাষার সাহিত্য পড়ার জন্যে তাঁর কাছে আসে মানুষ। এ বড় আনন্দের দিন, আজকে উনি এখনো আসেননি, তবুও আমি বলি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ওঁর জন্যে থাকলো, চিরকাল থাকবে। আপনারা আজকে সকালবেলায়, অবশ্য এখন প্রায় সকাল পেরিয়ে যাচ্ছে, নিজের যাবতীয় কাজকর্ম ছেড়ে এখানে এসেছেন, আমি কী বলব, আমি আপ্লুত বললেও কম বলা হবে। আমি আরেকটা জীবন খুঁজে পেলাম আপনাদের কাছে। আমি শেষ থেকে শুরু করি...

শেষের গল্প:

দুবছর আগে এক রাতে, লেখালেখির পর আমি যখন শুয়ে ঘুমালাম, তখন ভোরের দিকে আমার মনে হলো কী একটা হয়ে গেল। তারপর আমি আবিষ্কার করলাম, আমি হাসপাতালে। আমি যে হাসপাতালে আছি আমি জানতাম না। প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা পর আমার চৈতন্য এলো। আমি শুয়ে শুয়ে আবিষ্কার করলাম, একটা অন্ধকার আলো-আঁধারির একটা ঘর। দূরে একরকম সাদা পোষাক পরা একটা লোক বসে আছে, আর কেউ নেই। আমার টয়লেটে যাওয়ার খুব দরকার হচ্ছিল। আমি উঠতে গিয়ে দেখলাম আমি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা আছি বিছানায়। তবুও আমি ওঠার চেষ্টা করছি। এই ওঠার চেষ্টা দেখে, ঐযে বসেছিল দূরে, তার নজর পড়ল আমার ওপর। সে চেঁচিয়ে উঠলো। তার কয়েক মিনিটের মধ্যে অনেক ডাক্তার এবং নার্স ছুটে এলেন। আমাকে ইঞ্জেকশন দেয়া হলো, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। এর দশ দিন পরে আমি বাসায় ফিরলাম। কিন্তু আশ্চর্য্য, খবরের কাগজটা যখন আমি সামনে মেলে ধরলাম, আমি কোনো অক্ষর চিনতে পারলাম না। একটা অক্ষরও না। আমি আমার নিজের বইগুলো, কার বই বুঝতে পারছি না। এবং আমি আবিষ্কার করলাম, আমি বাংলা কেন, ইংরেজী কেন, কোনো অক্ষরই আমি চিনি না। আজ থেকে দু বছর আগে। ডাক্তাররা এসে বলেছেন মেমোরি লস হয়ে গেছে, ফিরে আসা খুব ডিফিকাল্ট, তবু কী সব ধ্যান ট্যান করতে হবে, অনেক ঔষধ-পত্র খেতে হবে। যদি, কিছু কিছু আসে। তারপর আমার জন্য একটা বর্ণ পরিচয় কিনে আনা হলো। কিনে এনে একটা স্লেট দেয়া হলো। শেখানো হলো এটা অ, এটা আ, এটা ই। আপনারা ভেবে দেখুন, আজ থেকে দুবছর আগে আমি অ আ ই ঈ লিখতে আরম্ভ করলাম। এবার এ বি সি... এ বি সি’টা আমি খব দ্রুত শিখতে পারলাম। এরপরে একদিন হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই আমার নামটা মনে পড়েছে। এর মধ্যে সবার নাম, আমার দুই কন্যা আছে, তাদের, সবার নাম আমার চট করে মনে পড়লো। ডাক্তার বলল, এটা মিরাকল, এমনটা হয় না, কী করে হলো?

সেটা ছিল এপ্রিল মাস। আমাদের এখানে একটা বড় কাগজ আছে, আপনারা নাম জানেন। আনন্দবাজার পত্রিকা। তার পূজো সংখ্যায় আমাকে একটা উপন্যাস লিখতে বলেছিল। তবে আমার এই অবস্থা দেখে তারা উইথড্র করে দিয়েছিল। আমি আনন্দবাজারকে ফোন করে বললাম আমি উপন্যাস লিখতে পারি। ওরা বিশ্বাস করেনি। আমি যখন লিখতে বসলাম... একটা ফুলস্কেপ পাতায় আমি সাধারণত পঁয়ত্রিশটা লাইন লিখি, প্রতিটা লাইনে আমি বারোটা শব্দ লিখি। এটা আমার মাপা, দীর্ঘদিনের অভ্যেস। কিন্তু আমি লিখতে গিয়ে দেখলাম, এক পাতায় ছটা লাইন লিখতে পারলাম এবং প্রতিটা লাইনে সাতটা থেকে আটটা শব্দের বেশি নয়। বুঝতেই পারছেন কত বড় বড় অক্ষর হচ্ছিল সেগুলো। পাতা জুড়ে অক্ষর প্রায়। কারণ আমার হাত আর মস্তিষ্ক এক সাথে কাজ করছিল না। এবং আস্তে আস্তে লিখতে লিখতে দেখলাম, অক্ষরগুলো ছোট হচ্ছে, ছ লাইনের জায়গায় কুড়ি লাইন হলো, বাইশ লাইন হলো। এবং সেই লেখা উপন্যাসটি আনন্দবাজার পূজো সংখ্যায় ছাপাও হলো। আমাকে সবাই বলল, আপনি ফিরে এসেছেন। আমি ভাবি, কিভাবে ফিরলাম? এবং একটা সময় ডাক্তার বলেছিলেন, আপনার সবকিছুর মধ্যে একটা জিনিষ আপনি হারাবেন। আপনার নাম মনে পড়বে না। অত্যন্ত পরিচিত মানুষ দেখলেও নাম মনে পড়বে না। তখন আপনি এ বি সি বলতে শুরু করবেন মনে মনে। এ বলতে বলতেই দেখবেন, যার নাম হয়তো বাদল, বি বলার পরই আপনার বাদল মনে পড়ে যাবে। এইভাবেই আপনি কিন্তু তাকে গেইন করবেন। তখন চট করে আপনি তাকে বলবেন, হ্যাঁ কেমন আছো ভাই... কিন্তু আপনি মনে মনে আওড়াচ্ছেন তার নামটা। এই করে করে আজকে এই আমি এই জায়গায়। এখন আর লিখতে অসুবিধা হয়না। এবং দীর্ঘদিন পর, প্রায় তিরিশ বছর পর আবার ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছি কলকাতার দেশ পত্রিকাতে। যেটা আমি দুবছর আগে ভাবতেই পারতাম না। এটা ছিল শেষের গল্প, শুরুর গল্পটা বলি...

শুরুর গল্প:

আমি জীবনে কখনো ভাবিনি আমি লেখালেখি করব। স্কুলে তো নয়, কলেজেও নয়, কিন্তু পড়তাম। প্রচুর পড়তাম। রবীন্দ্রনাথ কিছুতেই পড়তাম না। রবীন্দ্রনাথের বই দেখলেই মনে হত ওটা তো পন্ডিতরা পড়ে। ভাবুন, পুরো স্কুলে পাঠ্য পুস্তকে রবীন্দ্রনাথের গল্প কবিতা যা আছে তার বাইরে আমি পড়িনি। কলেজে এসে আমার স্যার, আমার স্যার ছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপ্যাধ্যায়, বিখ্যাত লেখক। তিনি বললেন, তুই এতো মূর্খ? বললেন, আচ্ছা তোকে আমি নষ্ট করি। বলে শেষের কবিতা নামক একটি উপন্যাস আমাকে পড়তে দিলেন। ওখান থেকেই রবীন্দ্রনাথ পড়তে আরম্ভ করলাম।

দুবছরের মধ্যে পুরো রবীন্দ্রনাথ পড়ে ফেললাম। এর বেশি আমি আর কী বলব, কিন্তু গল্প উপন্যাস লেখার কথা আমি ভাবলাম না। আমাদের ধ্যান জ্ঞান ছিল নাটক করা। আমাদের একটা গ্রুপ তৈরি হলো, আমরা বিভিন্ন নাটক করতাম। তাদের অনেকেই পরবর্তীকালে বড় বড় অভিনেতা হয়েছেন। সেই নাটকগুলো আমরা করতাম কলকাতা স্টেজে, কিন্তু সবই প্রিন্টেড ড্রামা। অন্যান্য বড় বড় অভিনেতারা সেই নাটকগুলো করেছে, আমরা পরবর্তীতে সেই নাটকগুলোই করতাম। এতে হয় কী, প্রশংসা পাওয়া যায় না। দলের নাটক বলে কেউ বলে না। তখন আমার এক বন্ধু আমাকে বলল, তুই তো অনেক পড়িস, তুই একটা নাটক লিখ না... যেন খুব ইজি ব্যাপার। তুই তো অনেক খাস, একটু খেয়ে দেখা, এরকম একটা ব্যাপার। বললাম ঠিক আছে। সারারাত জেগে একটা নাটকের প্রথম অংক লিখে পরদিন নাটকের দলে গিয়ে সেটা পড়লাম। দেখলাম, প্রত্যেকের মুখ কেমন যেন বাংলার পাঁচের মত হয়ে গেল। কারুরই ভালো লাগেনি। একজন বলল সব আছে, কিন্তু নাটকে গল্পটাই বুঝতে পারছিনা। গল্প আছে কোনো? তখন ওরা বলল, তুই আগে গল্পটা লিখ, সেই গল্পটা নাট্যরূপ দে, না হলে নাটক হবেনা।

অনেক ভেবে চিনতে আমি একটা গল্পও লিখলাম। লিখে তার নাট্যরূপ দিলাম। ওরা অর্ধেক শোনার পর থামিয়ে দিতে বলল। আমার দলে প্রায় ধরুন পনেরো ষোলো জন ছেলেমেয়ে। তারা বলল, আগে গল্পটা শোনাও তো, এত বাজে লাগছে কেন? গল্পটা শুনে বলল, গল্পটাকে গল্প বলে মনে হচ্ছে কিন্তু নাটক মনে হচ্ছে না। আমাদের কলকাতার সবথেকে জনপ্রিয় পত্রিকা হলো দেশ পত্রিকা। বিখ্যাত বিখ্যাত লেখকরা সেখানে লিখতেন। আমার সেই বন্ধু সেই গল্পটা দেশ পত্রিকার ঠিকানায় পোস্ট করে দিল। এর মধ্যে ছ মাস হয়ে গেল, আমার বন্ধু বলল চল একবার খোঁজ করে আসি। আমরা গেলাম। দেখলাম এক ভদ্রলোক অফিস ঘরে বসে আছেন, আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকালেনও না। বললাম, একটা গল্প পাঠিয়েছিলাম। উনি চোখ না তুলেই জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম? আমি বললাম আমার নাম সমরেশ মজুমদার। এর আগে গল্প লিখেছেন? আমি বললাম, না। বলল, সাত দিন পর আসবেন।

সাত দিন পর আবার গেলাম। চিনতেই পারলেন না। আমি বললাম, আমরা এসেছিলাম সাতদিন আগে, একটা গল্প পাঠিয়েছিলাম, আপনি বলেছিলেন সাত দিন পর আসতে। গল্পের নাম? নামটা বললাম। বললেন, কালকে আসবেন।

পরের দিন গেলাম। বললেন, ও আচ্ছা আপনার গল্প ছাপা হচ্ছে। দু সপ্তাহ পর ছাপা হবে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। দেশ পত্রিকায় আমার গল্প ছাপা হবে! আমি জীবনে গল্প লিখিনি! আমাদের ভার্সিটির পাশেই ছিল কফি হাউজ, কলেজ স্ট্রিটে। আমার পকেটে তখন সামান্য টাকা থাকতো। চার টাকা পাঁচ টাকা। কফির দাম ছিল মনে হয় তখন তিরিশ পয়সা। চার টাকা বন্ধুরা নিয়ে কফি আর পাকোড়া খেলো। কেউ বিশ্বাস করছেনা, সবাই বলছে সমরেশ ব্লাফ দিচ্ছে। দুদিন পরে আমার বাড়িতে একটা খাম এলো। দেশ পত্রিকা থেকে এসেছে। ভিতরে আমার গল্পটা, তার সঙ্গে একটা প্রিন্টেড চিঠি। আমার গল্পটি অমনোনীত হয়েছে, তবে ভবিষ্যতে যদি ভালো গল্প লিখতে পারি তবে যেন পাঠাই।

কী অবস্থা ভেবে দেখুন! চারটে টাকা তো শেষ হয়ে গেছে। আমি ব্লাফ দিচ্ছি বলে কেউ কেউ বলেছিল, সেটাই সত্যি হয়ে যাচ্ছে। আমার বন্ধু বলল, ঠিক আছে চল, ঐ লোকটা মিথ্যে কথা বলেছে, ওকে গালাগাল দিই। তখন এরকম মোবাইল টোবাইল ছিল না। ফোন করতে চাইলেই ফোন করা যেত না। দশ পয়সা নিত ফোন করতে। তখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফোনের বুথ থাকতো। সেখান থেকে ফোন করলাম। ভদ্রলোককে পৃথিবীর যত গালাগালি আছে দিলাম। আপনি মিথ্যুক, আপনার মত এমন লোক দেখিনি ইত্যাদি ইত্যাদি বললাম। ভদ্রলোক চুপচাপ শুনে বলল, আপনি গল্পটা নিয়ে কাল দেখা করুন। এর পর তো যাওয়া যাবে না। এত গালাগালির পর আমি যদি যাই দেশ পত্রিকার মত এত বড় কাগজে, ওরা আমাকে পুলিশে তুলে দিলে, অবধারিত জেলে থাকতে হবে। তখন আমার বন্ধু বলল, এক কাজ কর, আমাদের দলের দশ বারোজনকে এক সাথে জোগাড় কর। যদি পুলিশে দেয় তবে আমরা সবাই মিলে যা একটা করব।

পরদিন গেলাম। আমাকে দেখে বলল, কই দেখি? আমি বাড়িয়ে দিলাম। বললেন, আমি দুঃখিত, আমি পিয়নকে বলেছিলাম প্রেসে দিতে, ও ভুল শুনে পাঠিয়ে দিয়েছে বাড়িতে। সামনের সপ্তায় ছাপা হবে।

পরের সপ্তায় গল্পটি বেরিয়েছিল। গল্পটির নাম ছিল অন্তরাত্মা। আপনারা শুনলে অবাক হবেন যে ভদ্রলোকের সাথে আমার কথা হতো, যাঁকে আমি খুব গালাগাল দিয়েছিলাম, পরবর্তীকালে তিনি আমার প্রায় গুরুর পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম লেখক, বিমল কর।

এইভাবে আমার এতে ঢোকা হল। খবরে ছাপা হওয়ার পরদিন আমার তো গর্বে বুক ফুলে যাচ্ছে। মানে, একটা গল্প লিখেছি সেটাই ছাপা হয়েছে। এটা ভাবতেই পারছেনা কেউ। কিন্তু পনেরোটা টাকা পাওয়া গেল। মানি অর্ডারে এলো পারিশ্রমিক বাবদ। সেটা বন্ধুদের বলতেই কফি হাউজে একটা উৎসব হয়ে গেল। এক বিকেলে পনেরো টাকা শেষ, সবাই কফি খেলো, পাকোড়া খেলো আরো কি কি সব খেলো। খেয়ে শেষ হলো না, সবাই বলল, শোন তোকে আবার লিখতে হবে। আবার টাকা পাব, আমরা আবার খাব। আর রোজই দেখা হলে বলত, লিখেছিস? মানে লিখলে পরে ওরা কফি খেতে পারবে। আমি বললাম, আমি কি টাকার জন্য লিখব? হ্যাঁ টাকার জন্য লিখবি। এরপর আস্তে আস্তে আমি চুরি করতে আরম্ভ করলাম। পরের বার যখন গল্পটা বেরুলো, দু মাস পরে, পচিশ টাকা পাঠালো, আমার প্রমোশন হলো। আমি ওদের বললাম পনেরো টাকা পাঠিয়েছে। ওরা পনেরো টাকা দিয়ে খাওয়া দাওয়া করল, আমি দশ টাকা পকেটে ঢুকালাম। এখন আমি এগুলো নিয়ে আপনাদের সাথে মজা করছি, তখন কিন্তু খুব দুঃখ পেতাম। এরপর ছমাস, একবছর, আঠারো মাস করতে করতে যখন আট বছর কেটে গেল, তখন বছরে চারটে গল্প লিখি, পঞ্চাশ টাকা গল্পপ্রতি বছরে দুশো টাকা পাই। আমি খুব খুশি।

১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে দেশ পত্রিকার সম্পাদক আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁকে আমি চিনতাম না। তাঁর ঘরে ঢুকতেই সাহস পেতাম না, একটা রাশভারী লোক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে গল্প আনতেন, তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। আমার যারা সিনিয়র, তারাশংকর, বিভূতিভূষণ তাঁরা তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর কাছে যাওয়ার কোনো সাহসই ছিল না আমার। কিন্তু আমি যেতেই বিমল’দা আমাকে বললেন, তোমাকে সাগরময় ঘোষ ডাকছেন। সব্বনাশ! আমার ভয় হলো আমার বুঝি আর লেখালেখি হল না! তো, গেলাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম সমরেশ মজুমদার? আমি বললাম, জ্বি। শোনো, তোমায় দুমাস সময় দিচ্ছি, তার মধ্যে একটা উপন্যাস লিখে আনো। এ বছর পূজো সংখ্যায় তোমার উপন্যাস ছাপব। আমার নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! আমি সেই উপন্যাসটা লিখলাম, তারপর জমা দিলাম, প্রুফ হলো, আবার দেখলাম। আমার বাড়িতে একটা চিঠি এল, সমরেশ আপনি দেখা করুন, -সাগরময় ঘোষ। আমি গেলাম, বললেন বসুন। আচ্ছা ধরে নিন আমি সমরেশ মজুমদার, আপনি দেশ পত্রিকার সম্পাদক। আমার বয়স তখন সাতাশ আটাশ, আর উনার বাহাত্তুর।

উনি আবার বললেন, ধরে নিন আপনি আমাকে মানে সমরেশ মজুমদারকে দেশ পত্রিকার পূজো সংখ্যার জন্য একটা উপন্যাস দিতে বললেন, আমি দিলামও। কিন্তু হঠাৎ আপনার হাতে শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি অপ্রকাশিত উপন্যাস এসে পড়েছে। আপনি শরৎ চন্দ্রের অপ্রকাশিত উপন্যাস ছাপবেন নাকি নতুন লেখক সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস ছাপবেন? কোনটা ছাপলে পাঠকরা খুশি হবে? আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ঠিক আছে, উত্তর পেয়ে গেছি, যান।

এর আগে তালাক থেকে টালিগঞ্জ, কলকাতা শহরে যত বন্ধু বান্ধব ছিল সকলে জানতো আমি দেশ পত্রিকার পূজো সংখ্যায় উপন্যাস লিখছি। যেদিন প্রথম বিজ্ঞাপন বেরুলো, তাতে আমার নাম নেই। কী লজ্জার ব্যাপার! আমি কলকাতা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। দুমাস ছিলাম না কলকাতায়। মানে, তখন মনে হচ্ছিল আত্মহত্যা করাই ভালো। মানুষের ভাবখানা এমন, কী, আর কত মিথ্যে কথা বলবে? দুমাস পরে আবার একটা বিজ্ঞাপন বেরুলো। বড়দিনের আগে একটা বিশেষ সংখ্যা বেরুত, তাতে একমাত্র উপন্যাস, সমরেশ মজুমদারের ‘দৌড়’। সেই পচাত্তুর সালে আমার প্রথম উপন্যাস দৌড় বেরিয়েছিল।

আর যেহেতু আর কোনো উপন্যাস ছিল না, যারা পত্রিকাটি কিনেছিলেন, আমার উপন্যাসটি না পড়ে তাদের কোনো উপায় ছিল না। যদি বড় লেখকদের ভালো ভালো উপন্যাস থাকতো সেগুলোই হয়তো পাঠক পড়তেন। আমারটা বাধ্য হয়েই তারা পড়েছেন, আর পড়েছেন বলেই কারো কারো একটু একটু ভালো লেগেছিল। এই গল্প শুরু হলো, ঘাট ছেড়ে সমুদ্রে যাওয়া... এখনো ভেসে চলেছি, ভাসছি আর ভাসছি। আর ভাসছি বলেই আপনাদের মত এতগুলো পাঠকের ভালোবাসা আমি পেয়েছি।

আমি প্রথমে লেখক হতে চাইনি। কি করে কেমন করে জানিনা, আমি লেখক হয়ে গেলাম। আর, এই লেখক হওয়ার পেছনে কিন্তু পাঠকদের একটা হাত আছে। আমি যখন উত্তরাধিকার বলে একটা উপন্যাস দেশ পত্রিকায় লিখছি, আমি জানিনা আপনারা উত্তরাধিকার পড়েছেন কি না। লিখতে লিখতে ভাবছিলাম, আর পারছি না, আমি আর কত লিখব। আমি ছোটগল্প লিখে অভ্যস্ত, একেকটা আট দশ পাতার। আর এটা দুশো আড়াইশো পৃষ্ঠার উপন্যাস হয়ে গেছে, আর পারছি না, মাথায় আসছে না। শেষের দিকে আমি অনিমেষের পায়ে পুলিশের একটা গুলি লাগালাম, অনিমেষ পড়ে গেল, অজ্ঞান হয়ে গেল, আর উপন্যাস শেষ হয়ে গেল। শেষ অংশটুকো বেরুনোর পনেরো দিন পর সাগরময় ঘোষ আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, তুমি কী চাও? উনার সামনে তখন এক ট্রে ভর্তি চিঠি, উনি বললেন, পড়ো তো দু একটা চিঠি। কী গালাগালি দিয়েছে সম্পাদককে! “আপনি তরুন লেখক সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসের কণ্ঠরোধ করেছেন। অনিমেষ কলকাতায় আসছিল, সে কংগ্রেস করে কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকছিল, আপনারা বুর্জ্যোয়া কাগজ যখনই সেটা পড়েছেন, বন্ধ করে দিয়েছেন। এবার থেকে আমরা ঠিক করেছি দেশ পত্রিকা রাখবো না।”

আমাকে সাগরময় ঘোষ বললেন, তুমি অন্যায় করছো, তার ফল আমি কেন ভোগ করব? তুমি দুমাসের মধ্যে দ্বিতীয় খণ্ড শুরু করো। আমি অসহায়ের মত আবার দ্বিতীয় খণ্ড শুরু করলাম; কালবেলা। তারপরে সেটাও শেষ হওয়ার পরে কালপুরুষ। এগুলো কিন্তু পর পর চলেছে কয়েক মাসের ব্যবধানে। হঠাৎ দেখলাম আমি লেখক হয়ে গেছি। এই আমার লেখক হওয়ার গল্প...

এই ছিল সমরেশ মজুমদারের গল্প। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্বেও তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তখনই এক পর্যায়ে মঞ্চে উপস্থিত হন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার। তাঁকে ইঙ্গিত করে সমরেশ মজুমদার বলেন, “রাজা এলেন তার রাজত্বে”।

আবু সায়ীদ স্যার মুচকি হেসে সমরেশ মজুমদারের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “সাহস পাই না, আসল রাজা যে।”

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড