• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

প্রবন্ধ

বুদ্ধদেবের মুখোমুখি আল মাহমুদ: মোহভঙ্গ

  সৌরভ মাহমুদ্‌

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:১৪
ছবি
ছবি : বুদ্ধদেব বসু এবং কবি আল মাহমুদ

১৯৩৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কত দেহ জন্মাইছিলো তার কি আর হিসাব আছে? তবু একটা শরীর তো জন্মাইছিলো যার আছিলো দুর্দান্ত প্রতিভা। এই যে প্রতিভা নিয়া জন্মাই ছিলো সেইটার সাথে শ্রম দিয়া লোকটা একদিন একটা ভাষার প্রধানতম কবিদের একজন হইয়া ওঠলেন। আহা আল মাহমুদ! যখন বড় হইতাছেন তখন সে ব্রিটিশ শাসনের ভেতরে। যখন ১১ বছর বয়স মানে হাফপ্যান্ট পড়া যায় আরকি এমন টাইমে দেখলেন পাকিস্থান নামে একটা নয়া রাষ্ট্র নির্মাণ হয়া গেলো। পাকিস্থান কি তার রাষ্ট্র ছিলো? উঁহু কোনভাবেই না। কারণ তার কয়েক বছর পর থেকেই সে একটা ঘোড়ার পিঠে উইঠা দৌড়ানো শুরু করলো, সেইটা কবিতার ঘোড়া আর সে দৌড়ায় বাঙালার জমিনে। এই যে দৌড় শুরু করলো সেই দৌড়ে তো হাততালি দেবার জন্য, সাপোর্ট করবার জন্য কাওরে লাগে। আর পাইলেনও বটে, কিছু বন্ধু পাইলেন যারা গোপনে বেড়ে ওঠতাছে ৫০ এর দশকের বাঙলা ভাষার প্রধান কবি হইবে তারা। পাইলেন বান্ধব শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরিরে। একসাথে দৌড়ান তারা বাংলাবাজার, বিউটি বোর্ডিং নানান জায়গায়, দিন কি রাত দৌড়ান। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেই যুবক তখন চাকরি করে একজন প্রুফ রিডারের, পরে সাংবাদিক। তবে এই যে বন্ধুরা দৌড়ান তাদের সবার ঘোড়ারে কিন্তু আলাদা করা যায়, আলাদা করা যায় পথ। এমন পথে প্যারালালিই তারা একসাথেই।

আর অমন সময়ে বুদ্ধদেব বসু নামে এক লোক যে কিনা তখন বাঙলা সাহিত্যের মস্ত মাথা। তার কবিতা ছাপাইয়া দিলেন সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায়। তারে আর পায় কে? বুদ্ধদেব যারে কবি স্বীকৃতি দিয়া দিছেন তার সাহস এমনিতেই বেড়ে যায়, কণ্ঠ দৃঢ় হয়, হয় আরও কনফিডেন্ট। আল মাহমুদ মনে করতাছেন বুদ্ধদেব যেন তারে উড়বার পাঙ্খা দিলেন। আর এই উড়াতেও আল মাহমুদ থাইমা নাই বাতেনে ও প্রকাশ্যে সে হয়ে ওঠতাছে আরও মৌলিক চিন্তায় ও লেখায়। তার কবিতায় আসতেছে আরও এক নতুন বাঙলার ছবি, আরও ইমেজ, আরও বেশী ডাইমেনশন।

তো হইলো কি, একবার একটা যুদ্ধ হইলো শুরু। একটা জনপদ আক্রান্ত। একটা জনপদের ওপর নেমে আসছে ভয়াবহ দুর্যোগ, চারিদিকে বিপদ। তখন আল মাহমুদ শরণার্থীর লগে গেলেন পশ্চিমবঙ্গে, যুদ্ধ করবার দৃঢ় প্রত্যয় তার বুকে। ততদিন চলছে পাকিস্থান রাষ্ট্রের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়া পূর্ববাঙলার কবিরা হয়ে ওঠছে পশ্চিমের কবিদের থেকে আরও আলাদা চিন্তায়, অবস্থানে, ভাষায়। তখন যেই রাজনৈতিক বোধ ও প্রেক্ষাপট পূর্ববাঙলার কবিরা পাইছে কলিকাতার কবিরা পায় নাই। তবে যাই হোক যা কইতাছিলাম অমন টাইমে কলিকাতায় আল মাহমুদ দাওয়াত পাইলেন এক ডিনার পার্টির যেইখানে সুযোগ আছে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে দেখা হইবার। রিতিমতো ছুইটা গেলেন আল মাহমুদ। বেচারা আল মাহমুদ যুদ্ধাক্রান্ত জনপদের প্রতিনিধি সেই পার্টিতে আলোকসজ্জায়, আমোদে বিব্রত, নতমুখে অপেক্ষা করতাছে কখন আইবো সেই বুদ্ধদেব যে তারে উড়বার পাঙ্খা দিছিলো। কখন আসবে সেই ম্যাজিশিয়ান। আর আশপাশে তখন পার্টি, আর যখন একজন মার্কিন তারে জিগায় বাঙাদেশের খবর, বলে তোমাদের ছেলেরা ভালো লড়ছে তখন ব্যক্তিত্বে ঠাসা এই জনপদের কবির গা জ্বলে ওঠে, কিন্তু সে অপেক্ষা করেন। কিন্তু প্রথম দর্শনেই আশাহত হয় আল মাহমুদ পরিচয়সহ যখন বুদ্ধদেবের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেন বুদ্ধদেবের কুঁচকানো ভ্রু, শীতল হাত তারে হতাশ করেন কিন্তু উজ্জ্বল চোখ, প্রতিভাদৃপ্ত চোখ তারে ধরে রাখে আশায়। আল মাহমুদ সেই সাক্ষাৎ নিয়া বলতাছেন-

‘কিন্তু একি, আপনার হাত বুদ্ধদেব, বরফের মতো ঠান্ডা। আপনার মুখ ফসিলের মতো কুঁচকানো। আর আপনার চোখ? না, আপনার চোখ ইন্দ্রের অস্ত্রের মতো উজ্জ্বল! যজ্ঞের ঘৃতদীপ্ত হুতাশন।’

তারপর আলাপ শুরু একজন তখন বাঙলা সাহিত্যের দিকপাল, আরেকজন কবি, শুদ্ধ কবি, যিনি নিজের মাটি ছেড়ে আরেক দেশের মাটিতে এসেছেন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে। তখন বুদ্ধদেব জানতে চায় ঢাকার খবর। আল মাহমুদ আগ্রহ নিয়া বইলা যায় আর দেখে পূর্ববাঙলার জনপদের এই ভীষণ বিভীষিকার খবরে বুদ্ধদেব বিচলিত নয়, তিনি আশ্চর্য নিরব। যেনো কিছুই ঘটেনি সব ঠিক আছে। আরেকটু পর খেয়েদেয়ে বাসায় গিয়ে ঘুমানো যায় এমনতর স্বাভাবিক। আল মাহমুদ টেক্সটে লিখছেন-

‘পুরোহিতের মতো নিষ্কম্প রইল। রেখা ভাঙলো না, ঢেউ উঠলো না। যেন পরাজিত হও, লুটিয়ে পড়ো, সেবা কর- ছাড়া নৈরাজ্যের গহ্বর থেকে আর কিছুই বেরুবে না।’

তখন আসলে দুজন দুই অনেক আলাদা। তেজে আর রঙে এবং গতিতে আর চলার ঢঙে দুজনের ঘোড়া পৃথক। ভেঙে যাচ্ছে আল মাহমুদ স্বপ্নঘেরা হৃদয়। উড়ে যাচ্ছে ম্যাজিশিয়ান। ফাঁকা হচ্ছে মন্দির, দেবতা নেই পূজারির হাতের থালা খসে পড়ছে। বুদ্ধদেব তখন প্রতিষ্ঠান আল মাহমুদ তখন দুর্বার। তবু দূরত্বের মোহ তখন ভাঙ্গছে। বেদনার ঢেউ গ্রাস করছে আল মাহমুদকে। তবু কবি চিরকাল মাথা উঁচু করে দাড়ায়। আল মাহমুদ বেরিয়ে আসছেন সেই পার্টি থেকে আর বলছেন-

‘যে জাদুকর আমাকে একদা উড়াল শিখিয়েছিলেন যেন মন্ত্র বলে আবার তা তুলে নিলেন। কিম্বা যেন আমারি ডানা আমার বাহুর মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়ে পিঠে রয়ে গেলো দগদগে ব্যথা। একটি অন্ধকার গলি পার হচ্ছি, সাম্রাজ্যবাদীদের ভোজসভার বাতি তখন জ্বলে উঠছে। আর বুদ্ধদেব, ধনতন্ত্রের শেষ ভোজসভায় আপনি আমন্ত্রিত।’

তখন আল মাহমুদ ফিরছেন, ফিরে এসেছেন। সময়ের চাকা পাল্টাইছে পথ, পাল্টাইছেন আল মাহমুদও। মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে গণকণ্ঠের সম্পাদক থেকে ৭৫-এ এসে হয়ে বাংলা একাডেমির কর্তা। ৯০-এ এসে আল মাহমুদ পাল্টাইছেন রাজনৈতিক অবস্থান। তবে একদিন হয়তো আল মাহমুদও কাওরে উড়বার পাঙ্খা দিছিলো রাজনীতির মধ্য দিয়া সে পাঙ্খা আল মাহমুদও দৈবক্রমে তুলে নিছেন। এইভাবে পুনরাবৃত্তি না, এইভাবে পাল্টায় পূর্বসাধক থেকে উত্তরসাধক আলাদা হয়ে ওঠে তার চিন্তা ও চেতনা ও প্রেক্ষাপটের মধ্য দিয়া। দূরত্বে বাড়ে কাছে গেলে আরও বাড়ে, ভেঙে পড়ে মুগ্ধতা।

আল মাহমুদ তবু আপনি ততটুকু তো আমাদের আল মাহমুদ যতটুকু কবিতায়। ঐ আল মাহমুদ তো পাল্টে যায় না যেখানে দাঁড়ায় অবিচল দাড়াইয়া থাকে। আল মাহমুদ কার আছে সাহস ঐখান থেইকা আপনারে সরায়। ভাগ্যিস আপনার সাথে দেখা হয় নাই, মোহ ভাঙ্গে নাই, কবিতায় পাইছি আছেন কবিতার মধ্য দিয়া হৃদয়ে ও মগজে। আল মাহমুদ ভালো থাইকেন। ভালো থাইকেন গো কবি।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড