শব্দনীল
‘বৃষ্টির দোহাই দিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর, লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোনো কবি করে না কসর।’
কবি আল মাহমুদ। যার কবিতার সাথে পরিচয় ঘটে কৈশোরের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতে ‘নোলক’ কবিতার মাধ্যমে। যদিও তখনো জানতাম না আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তিনি অন্যতম প্রধান কবি ছিলেন। মাধ্যমিক শেষ করে সবে মাত্র কলেজে উঠেছি। তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা ছেড়ে হুমায়ূন আহমেদের কিছু কিছু বই পড়ছি তখন কলেজের লাইব্রেরিতে গিয়ে। বাধা ধরা নিয়মে নয় যখন যেটা ভালো লাগে সেটাই। কাব্যগ্রন্থের প্রতি তখনো টান ছিলো প্রবল। সময় পেলেই রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা পড়তাম। সে সময়ই কোন এক সন্ধ্যায় পড়ে ছিলাম-
‘এ বিষণ্ণ বর্ণনায় আমি কি অন্তত একটি পংক্তিও হবো না হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন? লোকালয় থেকে দূরে, ধোঁয়া অগ্নি মশলার গন্ধ থেকে দূরে এই দলকলসের ঝোপে আমার কাফন পরে আমি কতকাল কাত হয়ে শুয়ে থেকে দেখে যাবো সোনার কলস আর বৃষের বিবাদ?’
তখন হয়তো কবিতার মর্মার্থ অতটা বুঝতে পারিনি কিন্তু কবির নাম চিরতরে মনে গেঁথে গিয়েছিলো। নতুন করে আবারও পরিচয় পেলাম যিনি ‘কবিতার আসন্ন বিজয়’ ঘোষণা করে বাঙলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তিনি কবি আল মাহমুদ। যার নামের আগে বসে যায় ‘সোনালী কাবিন’ এর কবি বা ‘কালের কলস’ এর কবি। তার পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। যিনি ১১ জুলাই ১৯৩৬ সালে ব্রাক্ষনবাড়িয়ায় গ্রহণ করেন। তিনি বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্ভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছিলেন। মাত্র দু’টি কাব্যগ্রন্থ রচনার মাধ্যমে ১৯৬৮ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরষ্কারও।
কবি আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতা দেখতে পান, কিন্তু তিনি সময়ের সাথে গা এলিয়ে না দিয়ে শহরমুখী কবিতার ভিতরে তুলে ধরেছেন অন্য এক জীবন। যাকে বলা হয় ভাটি বাংলা বা গ্রামীণ জীবন। শুধু তাই নয় নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেছেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে দেখা যায়। ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থে যেমন বলেছেন-
‘সোনার দিনার নেই দেন-মোহর চেয়ো না হরিণী যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি ভালোবাসা দাও যদি আমি দেবো আমার চুম্বন ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি।’
অথবা,
‘এর চেয়ে ভালো নয় হয়ে যাওয়া দরিদ্র বাউল আরশী নগরে খোঁজা বাস করে পড়শী যে জন আমার মাথায় আজ চুড়ো করে বেঁধে দাও চুল তুমি হও একতারা, আমি এক তরুণ লালন।’
আবার ভালোবাসা না পেয়ে প্রিয় মানুষের উদ্দেশ্য করে বলেছেন-
‘পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা’
নারী ও প্রেম যে ভাবে কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন ঠিক সে ভাবেই উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা ও ভোগের লালসাকে শিল্প-সাহিত্যের অংশ হিসেবেও দেখিয়েছেন তিনি। মানুষের অধিকারের পক্ষে, সুষম বণ্টনের মাধ্যমে মানবধর্মের কথাও লিখেছেন কবিতায়। তিনি লিখেছেন,
‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণির উচ্ছেদ এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ যেনো না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।’
আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ করেছেন দারুণ দক্ষতায়। তিনি শুধু কবিতাই লেখেননি। লিখেছেন উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, শিশুতোষ গল্প-কবিতা।
বাংলার চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী মৃত্যু নিয়ে একটি কথা বলেছিলে, ‘মৃত্যুর মতো এত স্নিগ্ধ, এত গভীর, সুন্দর আর কিছু নাই’। তাই হয় তো কবি আল মাহমুদ ‘স্মৃতির মেঘলাভোরে’ কবিতায় লিখেছিলে-
‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ; অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।’
কবি ‘ঈদ’কে নিজের করে নিয়ে গতকাল (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাত ১১টা ৫ মিনিটে দেহ ত্যাগ করেছেন। আর বাংলা সাহিত্য হারিয়েছে তার সূর্যসন্তান। প্রিয় কবির মৃত্যুতে ইতোমধ্যেই দেশের রাজনৈতিক, চলচ্চিত্রাঙ্গনসহ ভক্তদের মাঝে শোকের ছায়া নেমেছে। কবিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তার মরদেহ আজ (১৬ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টায় নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে সর্বস্তরের মানুষ প্রিয় কবিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন অনেকদিন ধরে।
এর আগে গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কবিকে ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। ওই দিন ইবনে সিনা হাসপাতালে তাকে প্রথমে সিসিইউতে ও পরে আইসিইউতে নেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) তাকে ‘লাইফ সাপোর্ট’ দেওয়া হয়।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড